25/09/2025
এর আগে আমি তুরস্ক এবং পাকিস্তান কীভাবে প্রযুক্তি খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে তার পিছনের কাহিনী বলেছি। আজকের রাষ্ট্র: ইরান। সবশেষে আমাদের করণীয়।
ইরান এখন বিশ্বের মাত্র সাতটি দেশের মধ্যে একটি, যারা উন্নত এফ-ক্লাস গ্যাস টারবাইন নিজেদের দেশে তৈরি করতে পারে। এই অসাধারণ প্রযুক্তিগত সাফল্য অর্জন করেছে ইরানের একটি বড় কোম্পানি ম্যাপনা (MAPNA), যারা বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস এবং রেলপথ প্রকল্পে কাজ করে।
এই এমজিটি-৭৫ এফ-ক্লাস গ্যাস টারবাইন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। এই টারবাইন ২২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে এবং এতে একটি বিশেষ ক্যান-অ্যানুলার কম্বাসশন সিস্টেম রয়েছে, যা দূষণ কমায় এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের পাশাপাশি হাইড্রোজেনও ব্যবহার করতে পারে।
ইরানের এই অর্জন একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, স্বনির্ভরতার লক্ষ্য এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফল। যেমন:
১) আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং স্বনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তা: ইরান বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি রয়েছে, যা তাদের উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করার সুযোগ সীমিত করেছে। এই পরিস্থিতি ইরানকে নিজেদের প্রযুক্তি উন্নয়নের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে, যেখানে গ্যাস টারবাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ইরান বুঝতে পেরেছিল যে বিদেশী প্রযুক্তির উপর নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তারা নিজেদের গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ বাড়ায়।
২) ম্যাপনা (MAPNA) গ্রুপের ভূমিকা: ম্যাপনা হলো ইরানের একটি শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ, যারা ১৯৯২ সাল থেকে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস এবং রেলপথ খাতে কাজ করছে। তারা ইতিমধ্যে বিদেশী কোম্পানির সাথে কাজ করে ই-ক্লাস টারবাইন তৈরির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ম্যাপনা উচ্চ-দক্ষতাসম্পন্ন এফ-ক্লাস টারবাইন তৈরির জন্য গবেষণা শুরু করে। তাদের প্রকৌশলীরা উন্নত প্রযুক্তি, যেমন একক-ক্রিস্টাল ব্লেড এবং আধুনিক কুলিং সিস্টেম, নিয়ে গবেষণা করে এবং স্থানীয়ভাবে এই টারবাইন তৈরি করতে সক্ষম হয়।
৩) প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং উদ্ভাবন: এমজিটি-৭৫ টারবাইন তৈরিতে বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে: ৩ডি অ্যাক্সিয়াল কম্প্রেসর - এটি বাতাসকে আরও দক্ষতার সাথে সংকুচিত করে, যা টারবাইনের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। একক-ক্রিস্টাল এবং দিকনির্দেশক ব্লেড - এই ব্লেডগুলো অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, যা টারবাইনের দীর্ঘায়ু এবং দক্ষতা বাড়ায়। ক্যান-অ্যানুলার কম্বাসশন সিস্টেম - এটি দূষণ কমায় এবং হাইড্রোজেনের মতো পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ দেয়। আধুনিক তাপ-প্রতিরোধী আবরণ - এটি টারবাইনকে উচ্চ তাপমাত্রায় কাজ করতে সাহায্য করে।
এই প্রযুক্তিগুলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টারবাইন নির্মাতাদের সমতুল্য, যেমন জার্মানির সিমেন্স বা আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিক।
৪) ইরানের বিদ্যুৎ খাতের চাহিদা: ইরানের জনসংখ্যা প্রায় ৯ কোটি এবং শিল্পায়ন দ্রুত বাড়ছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২৪ সালে ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৯২,০০০ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে, যার মধ্যে গ্যাস টারবাইন প্রায় ৪৫,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করে। তবে পুরনো ই-ক্লাস টারবাইনগুলো কম দক্ষতার কারণে বেশি জ্বালানি খরচ করে এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই পরিস্থিতিতে এফ-ক্লাস টারবাইনের উন্নয়ন ইরানের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার। এটি জ্বালানি দক্ষতা বাড়াবে এবং পরিবেশ দূষণ কমাবে।
৫) সরকারি সমর্থন এবং বিনিয়োগ: ইরান সরকার প্রযুক্তি উন্নয়নে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। ম্যাপনার মতো প্রতিষ্ঠানকে গবেষণা ও উৎপাদনের জন্য আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ইরানের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ এবং উদ্ভাবনী গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ইরানের এই অর্জন তাদের শুধু স্বনির্ভরই করেনি, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। এফ-ক্লাস টারবাইন তৈরির ক্ষমতা ইরানকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখানে তারা ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি রপ্তানি করতে পারবে। এছাড়া, হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহারের সক্ষমতা ইরানকে পরিবেশবান্ধব শক্তি খাতে এগিয়ে রাখবে।
বিশ্বের অন্য ছয়টি দেশ এফ-ক্লাস টারবাইন তৈরির ক্ষমতা রাখা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (জেনারেল ইলেকট্রিক), জার্মানি (সিমেন্স), জাপান (মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ), ফ্রান্স, ইতালি এবং দক্ষিণ কোরিয়া।
ইরানের এফ-ক্লাস গ্যাস টারবাইন তৈরির সক্ষমতা তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সরকারি সমর্থন এবং স্বনির্ভরতার প্রতি অঙ্গীকারের ফল। এই অর্জন ইরানের বিদ্যুৎ খাতকে আরও দক্ষ ও পরিবেশবান্ধব করবে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতার প্রমাণ দেবে। এছাড়াও ইরান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করছে, রাশিয়া ইরানে মোট ৭টির মতো নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করবে।
ওদিকে আমেরিকা আর ইসরায়েল বলছে ইরানে কোনও ধরনের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামই থাকতে পারবে না, শান্তিপূর্ণও নয়। তারা ইরানকে বলছে ইরানের মিসাইল প্রোগ্রামে ৫০০ কিমি রেঞ্জের বাইরে মিসাইল থাকতে পারবে না। খামেনি আমেরিকার সাথে আর কোনও নেগোসিয়েশনে ইরান যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছে।
এবার আমাদের জন্য কিছু কথা।
হে প্রাণপ্রিয় বুয়েট, ব্যাটারি রিকশার মতো নগণ্য প্রজেক্ট নয়, অথবা কেবল প্রজেক্টেস ফর সস্টেইনবিলিটি, হেলথকেয়ার, এন্ড ইনফ্রস্ট্রাকচর। সময় হয়েছে আউটলুক অনেক বড় করার , নিজেদের সক্ষমতা অর্জনে আরও বোল্ড অ্যান্ড অ্যাম্বিশাস হওয়ার। ইঞ্জিন বানাও, মিসাইল বানাও। আক্রমণাত্মক ড্রোন বানাও, সার্ভেইল্যান্সের ড্রোন বানাও। বিদেশ থেকে ফ্যাকাল্টি হায়ার করো। তুরস্ক, চীন আর পাকিস্তানের সাথে যৌথ রিসার্চ প্রোগ্রাম হাতে নাও যা আমাদের স্বনির্ভরতায় আর প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষমতা লাভে সাহায্য করবে। বিশ্ববিদ্যালয় টু বিশ্ববিদ্যালয় কো-অপারেশন করো। দেশকে প্রযুক্তি খাতে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস এগিয়ে নিয়ে যাও। তোমাদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু তোমরা তা পারবে না, কারণ তোমাদের ফান্ড নাই।
হে বাংলাদেশের সরকার, ডিফেন্স টেকনোলজি আর কমপ্লেক্স টেকনিক্যাল খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনে আপনি বিশ্ববিদ্যালগুলোকে, বিশেষ করে বুয়েটকে ফান্ড একেবারেই দেন না।তাদের মূলত শিক্ষা খাত আর বয়োমেডিক্যালখাতে রিসার্চ ফান্ড মিলে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু করে রেখেছে বাংলাদেশের সরকার, যেখানে ইরান, তুরস্ক চীনের সরকার তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেধাকে এসব খাতে খুব ভালোভাবে ব্যবহার করে।
আর আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের রাজনৈতিক কর্মীর ব্রিডিং গ্রাউন্ড হিসাবে ব্যবহার করে, রাজনীতি করতে যেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করে। দলগুলোর এই নীতি পরিবর্তন করা এখন ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
Sabina Ahmed