27/06/2024
উনিশ শতকে বাংলার গ্রামে মানুষ কী ধরনের বাড়িতে থাকতেন, তার ছবির মতো (ছবিসহও বটে) বর্ণনা দিয়ে গেছেন এক বিদেশি। তিনি অবশ্য নিছক বেড়াতে আসেননি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশ অনুযায়ী ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন বিহার-পাটনা -সাহাবাদ- ভাগলপুর-গোরখপুর-দিনাজপুর-পূর্ণিয়া-রংপুর-আসাম অঞ্চলে ১৮০৭-১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিস্তৃত সমীক্ষা চালান। তাঁর সংগৃহীত তথ্য বিন্যস্ত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন মন্টগোমারি মার্টিন, ১৮৩৮-এ। উনিশ শতকের গোড়ার এই সমীক্ষা থেকে দেশমানুষ সম্পর্কে প্রচুর তথ্য উদ্ধার করা যায়। দিনাজপুরের খণ্ডে বাংলার সমকালীন স্থাপত্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সুনির্দিষ্ট বর্ণনা আছে। অনেকটাই প্রত্যক্ষদৃষ্ট হওয়ায় এর মূল্য খুবই বেশি, কারণ সমসময়ের এত নিখুঁত বিবরণ আর দ্বিতীয়টি নেই। হ্যামিলটনের এই বিবরণ যদিও অবিভক্ত দিনাজপুর সংক্রান্ত, তবু বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রেও যে এটি অনেকটাই প্রযোজ্য।
সেকালে সাধারণ মানুষের বাড়ি বলতে ছিল দোচালা কুটির। একেই বলা হত 'বাংলো' (বাংলা ?), যা থেকে এ দেশে একই ধাঁচের, কিন্তু অনেক পরিবর্তিত সব ইউরোপীয় নির্মাণই 'বাংলো' নামে পরিচিত হয়ে যায়। ('হবসন-জবসন'-এ 'বাংলো' প্রসঙ্গ নিয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। সতেরো শতকের 'বাদশাহনামা' থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝির বিশপ হিবারের বর্ণনাতে বাংলো প্রসঙ্গ কীভাবে এসেছে, 'হবসন-জবসন'-এ তা উদ্ধৃত হয়েছে।) কুটিরের দেওয়াল মাটির, আর মেঝে আশপাশের জমি থেকে এক-দুই ফিট উঁচুতে। তবে অনেক সময়ই এতে বর্ষাকালে পানি জমার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না, তাই ঘরের এককোণে থাকে বাঁশের মাচা, বর্ষায় তার উপরেই শোয়া-বসা চলে। যে অঞ্চলে দেওয়াল তোলার মতো ভাল মাটি পাওয়া যায় না, সেখানে কঞ্চির মধ্যে নলখাগড়া বা খড়ের বান্ডিল করে দেওয়াল তৈরি হয়। গৃহস্থ সম্পন্ন হলে এই বান্ডিলে খড়ের বদলে মাদুরকাঠি ব্যবহার হয়, বা খড়ের বান্ডিলে গোবর এবং মাটির সুন্দর প্রলেপ দেওয়া হয়। ঘরের কাঠামো পুরোপুরি বাঁশ দিয়ে তৈরি, বাঁশগুলি পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা থাকে। খুব ধনী গৃহস্থের বাড়িতে কাঠের খুঁটি এবং বরগা দেখা যায়। তবে তাতে পালিশ বা রঙ কোনও কিছুই থাকে না, আর পেরেকের ব্যবহারও নেই বললেই চলে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বরগার উপর মাটির আস্তরণ দেওয়া বাঁশের মাচা থাকে, মূলত আগুন লাগলে পালিয়ে বাঁচার মতো সময় পাওয়ার জন্য। খুব কম ক্ষেত্রেই ওই মাচায় ওঠার মতো সিঁড়ি থাকে। সিঁড়ি থাকলে মাচাটি বসবাসের জন্যও ব্যবহার করা হয়। কুটিরে দরজা ছাড়া আর কোনও ফাঁক নেই। দরজার উপরে আটকানো ‘ঝাঁপ’ ফেলে তা বন্ধ করা হয়। কাঠের পাল্লার দরজা ধনীদের বাড়ি ছাড়া দেখা যায় না। আলো-হাওয়া আসার জন্য জানলা খুব কমই থাকে। দোকান করার প্রয়োজন হলে ঘরের এক দিকের চাল দেওয়ালের বাইরে চার-পাঁচ ফিট বাড়িয়ে দেওয়া হয়, এক সারি বাঁশের খুঁটির উপর তার ভার থাকে।
ধনীদের ক্ষেত্রে চারচালা কুটির দেখা যায়, যার নাম ‘চৌয়ারি'। ইউরোপীয়রা তাদের ‘কটেজের জন্য এই ধাঁচটি গ্রহণ করেছে। বাড়ি বর্গাকার হলে তার খড়ের চালের প্রতিটি পৃষ্ঠ ত্রিকোণ, যা একটি শীর্ষবিন্দুতে মিলিত হচ্ছে ; আর বাড়ি আয়তাকার হলে দু'পাশের দুটি চাল ত্রিকোণাকার, অন্য দুটি চাল একটি সরলরেখায় মিলিত হয়। ইউরোপীয়রা এই কাঠামোর অনেক উন্নতি করেছে। গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়ির চারপাশে বারান্দা জুড়ে নিয়েছে, আর ভিতরে সুবিধামতো ভাগ করে ঘর তৈরি করেছে। ধনীরাই চারচালা কুটির তৈরি করে বলে এতে কাঠের খুঁটির ব্যবহার দেখা যায়, বাসোপযোগী মাচা আর জানলাও থাকে।
হ্যামিলটন দেখেছেন, গরিব মানুষের নিজের আর গরু-ছাগলের জন্য একটিই কুটির থাকে। ধনীরা মূল কাঠামোর আকার-প্রকার অপরিবর্তিত রেখে কুটিরের সংখ্যা বাড়িয়ে নেয়। একটি থেকে অন্য কুটিরে যাওয়ার সময় রোদ বা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো কোনও ব্যবস্থাই থাকে না। অর্থাৎ খোলা উঠোনের চারপাশেই যে একাধিক কুটির নির্মাণ করে সম্পন্ন গৃহস্থের বসবাস ছিল, তা এই বিবরণ থেকে স্পষ্ট।
বর্ণনার সঙ্গে স্থানীয় ভূস্বামী বৈদ্যনাথ চৌধুরীর বাড়িঘর ছাড়াও দোচালা ও চারচালা কুটিরের ছবি জেলার 'মুখ্য স্থপতি'কে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছিলেন হ্যামিলটন। বিভিন্ন সময়ে আঁকা বিদেশি চিত্রকরদের ছবি থেকে উনিশ শতকের কুটির সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া গেলেও স্থাপত্যগত পরিচয় সব সময় বোঝা যায় না। দেশীয় স্থপতির হাতে আঁকা এইসব ছবি তাই বাংলার স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অমূল্য দলিলিত। লেখাঃ সংগ্রহীত