05/04/2025
"টোপ"
লেখা: রায়হান মাসুদ
" কি রে? আজ রাতে মাছ ধরতে যাবি না?" মর্জিনা চাচী জিজ্ঞেস করল ফাহাদকে।
আমি আগ্রহ নিয়ে ফাহাদের দিকে তাকালাম। আমি ঢাকা থেকে শুনে আসছি আমার চাচাতো ভাই ফাহাদের মাছের বড্ড নেশা। এলাকার বড় বড় দীঘিতে যখনই মাছ ধরার আয়োজন করা হয়, ফাহাদ টিকেট কেনে। আর দক্ষ হাতে বড় বড় মাছও ধরে। সেই মাছের ছবি চাচী আমার মাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায়। কয়েকদিন আগে তো ত্রিশ কেজি ওজনের একটা কাতল ধরে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল ফাহাদ। স্থানীয় পেপারেও এসেছিল, ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক ছেলে টিকেট কেটে মাছ ধরতে এসে একা ত্রিশ কেজি ওজনের দানবাকৃতির কাতল ধরেছে। সেই পেপারে ফাহাদের ভারী মাছ হাতে ছবিও আছে। চাচী পেপার কাটিংয়ের ছবিও আমার মাকে পাঠিয়েছিল। আমার চাচাতো ভাই ফাহাদ পড়াশোনায় তেমন ভাল না। বুদ্ধিসুদ্ধিতেও কাঁচা। চাচার এই উপজেলা শহরের সবচেয়ে বড় চালের আড়তে স্কুলে থাকা সত্ত্বেও চাচা হিসাব নিকাশ শিখাতে কাজে লাগাতে চেয়েছিল তাকে, কিন্তু ফাহাদের মাথায় তা কুলায় নি। চাচাও স্বীকার করে নিয়েছে ছেলেটা বড্ড সহজ সরল। এবং একারণে চাচা অলরেডি বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, একমাত্র ছেলে ফাহাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। ফাহাদের ব্যাপারে চাচার সাথে আমার বাবার বেশ কথাবার্তা হয়। আমি তা জানি।
তবে চাচী বাংলাদেশের সে সকল গর্বিত মায়েদের মধ্যে অন্যতম, যারা নিজের ছেলের অনেক ব্যর্থতার মাঝে অল্প যেসব গুণ আছে, সেই গুণ নিয়ে গর্ববোধ করে এবং বুক ফুলিয়ে প্রচার করে। আমার ক্লাস নাইনে এই নিয়ে দুইবার থাকা হিসাব নিকাশ না বোঝা সহজ সরল চাচাতো ভাই ফাহাদের গুটিকয়েক যে যোগ্যতা আছে, সে ব্যাপারে চাচী যখন আমার মায়ের সাথে গল্প করে, আমার মায়ের মতে চাচীর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, সে তার ছেলের জন্য সত্যিকারেই গর্বিত। চাচী নিজেও খুব ভাল মানুষ, মা তাই চুপচাপ সব শোনে। কখনোই ফাহাদের পড়াশোনার খবর নেবার চেষ্টা করে চাচীর মন খারাপ করে দেয় না।
এবার ঈদের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হবার পর তাই আমি যখন বাবা মায়ের সাথে গ্রামে বেড়াতে আসলাম, চাচীর তাই শখ হল, নিজের চোখে যাতে আমরা দেখি তার ছেলে মাছ ধরতে কতটা দক্ষ সেই ব্যবস্থা করতে। এমনিতেই কোন একটা দীঘিতে মাছের টিকেট বিক্রি করছিল। চাচীই টাকা দিয়ে ফাহাদের সেই টিকেট কেনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আর পইপই করে বলেছিল, ফাহাদ যাতে এবারের মাছ ধরার সময় অবশ্যই আমাকে সঙ্গে রাখে। আমি যাতে তার মাছ ধরার কৃতিত্বের সাক্ষী থাকি।
ঈদের সিজনে সারাদিন মানুষজন ব্যস্ত থাকে , তাই যারা মাছ ধরার টিকেট বিক্রি করেছিল, তারা দীঘিটা বন্ধ করে রেখেছিল সকালে। বলা হয়েছিল, রাতে একটা পিকনিকের আমেজে সবাই মাছ ধরবে। মাছশিকারীরাও রাজি হয়ে গিয়েছিল। কারণ পুকুর বা দীঘির বড় মাছগুলো রাতেই উপরে উঠে আসে।
যখন রাত হল, মাছ ধরার সময় হল, চাচী তাই ফাহাদকে তাড়া দিল, " সময় হয়ে গেল তো। ছিপ বরশি রেডি কর। অভিকে নিয়ে যা। ও শহুরে ছেলে, মাছ ধরা দেখে আনন্দ পাবে।"
আমিও বলে উঠলাম, " চলো ফাহাদ, বের হই।"
ফাহাদ নাকি সাধারণত মাছ ধরতে একা একাই বের হয়ে যায়। কাউকে বলাও লাগে না। তবে সেদিন ফাহাদ প্রথম বলল, " মা, আমাকে না বলে জনি মোল্লার দীঘির টিকেটটা তোমার করা উচিত হয় নি। তুমি তো জানো, দীঘিটা ভাল না।"
চাচীর মুখ এতটুকু হয়ে গেল। আমার মা কথাটা শুনে আগ্রহে হয়ে উঠল। বলল, " কি বলে ও। মর্জিনা বুবু, দীঘি কি ভূতুড়ে নাকি?"
চাচী বলল, " আরে না। এখন কি আর এটা গ্রাম আছে নাকি। রীতিমত উপজেলা শহর। আর ফাহাদ কত রাতে মাছ ধরে এসেছ বাসায়। কখনোই সমস্যা হয় নি। এই গ্রামে ভূতুড়ে কিছু নেই।"
ফাহাদ বলল, " অন্য কোনো পুকুরে সমস্যা নেই। কিছু জনি মোল্লার পুকুরে তো সমস্যা বহু আগে থেকে। প্রায়ই তো মানুষ নিখোজ হয় এখান থেকে। কতবছর পুকুর বল, দীঘি বল, এই জায়গাটা আটকানো ছিল জানো না তুমি?"
চাচী বলল, " আরে কিছু হবে না, তুই অভিকে নিয়ে যা। অনেক মানুষ থাকবে। এত মানুষের ভিড়ে কোনো ভয় নেই।"
ফাহাদ বলল, " একটাও গ্রামের লোক টিকেট কেনে নি। যারা কিনেছে, সবাই ঈদের ছুটিতে শহর থেকে এসেছে। এরা জানেও না বেশি কিছু।"
চাচী বলল, " এতদিন ওরা আটকে রেখেছিল পুরো দীঘি। এখন টিকেট দিচ্ছে। সমস্যা নেই বলেই দিয়েছে।"
ফাহাদ বলল, " এতদিন জনি মোল্লার বড় ছেলে শফিক মোল্লা ওই দীঘি দেখাশোনা করত। সে জানত, দীঘিটা খারাপ। একা কেউ এই দীঘির পাড়ে এলে নিখোঁজ হয়। দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু শফিক মোল্লা এবছর মারা যাবার পর ওর ছোটভাই রফিক মোল্লা শহর থেকে এসেছে সম্পত্তিগুলো দেখভাল করতে। সে তো সবকিছু জানে না, অথবা পরোয়া করে না, তাই টিকেট ছেড়েছে। তুমি সব জেনেও টিকেট আনলে কেন? আমি গিয়ে যদি আর না ফিরি?"
এই কথাটায় চাচী খুব কষ্ট পেল। তার চোখ ছলছল করে উঠল। মায়ের সামনে গাল লাল হয়ে গেল। মায়েদের একটা প্রতিযোগিতা থাকে প্রচ্ছন্ন। কাদের সন্তান কতটা যোগ্য সেটা দেখানোর। আমার মা আজ সকালে চাচীকে বলছিল আমার এবারের রেজাল্টের কথা, আমি ফার্স্ট হয়েছি, সেটা গর্বের সাথে বলছিল। চাচীও পাল্টা গর্ব করে বলছিল, ফাহাদের মাছ ধরার দক্ষতার কথা। মা দুইটার তুলনা অস্বীকার করে চাচীকে কষ্ট দেয় নি। কিন্তু চাচীর কেন জানি রোখ চেপে গিয়েছিল, তার ছেলের একটা দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার।
গ্রামের মায়েদের দুশ্চিন্তা আর সন্তানের নিরাপত্তাবোধ শহরের মায়েদের মত হয় না। এজন্যই হয়ত ভূতুড়ে দীঘির কাহিনী জেনেও ফাহাদের জন্য টিকেট কিনেছিল সে।
আমাদের সামনে চাচী অপমানিত হচ্ছে বলে আমি ফাহাদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। সঙ্গে ওর ছিপ আর বরশিও নিয়ে নিলাম। বাইরে বেরিয়ে বললাম, "ফাহাদ, এক কাজ করি চল, তোমার ঝুঁকি নিয়ে জনি মোল্লার পুকুরে যেতে হবে না। তুমি তো ভাল মাছ ধরো। চল দুই ভাই মিলে অন্য কোনো পুকুরে যাই, কিছু মাছ নিয়ে ঘরে ফিরি। চাচী আসলে তোমার মাছ ধরার দক্ষতা নিয়ে অনেক গর্বিত। আমাদের সামনে সেটা দেখাতে চাচ্ছে। আর টিকেট কাটা দীঘিতে অনেক লোক থাকবে বলে হয়তো ভেবেছে, খারাপ কিছু হবে না। তুমি ভুল বুঝো না।"
ফাহাদ চুপ করে রইল। আমি আশেপাশে তাকালাম। বেশ অন্ধকার। মাঝে মাঝে দুই একটা টিমটিমে রোডলাইট, চাচী যে শহরের কথা বলেছে, সেই তুলনাটা সঠিক হয় নি। চাচী দীর্ঘদিন আসল শহর দেখেই নি।
আমি বললাম, " ঈদের সিজনে একটু গান বাজনা করো না তোমরা এখানে?"
ফাহাদের মন খারাপ। সেই আস্তে করে বলল, " হ্যা করি, আমিই আমার বন্ধুদের নিয়ে করি। এবার তো তোমরা অনেকদিন পর এলে গ্রামে, তাই তোমাদের সঙ্গ দিতে আর আয়োজন করতে পারি নি। আর আমার সিনিয়র যারা এই কাজ করত, সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত এই বছর।"
ফাহাদ হাটতে হাটতে নির্জন অন্ধকার মেটে পথে নেমে এল। এই গ্রামের কিছুই আমি চিনি না। গ্রামের অন্ধকার নির্জনতায় ভয় হল একটু। ভয় কাটাতে বললাম, " জানো, এবছর আমরা সবাই উমরাহ করতে চেয়েছিলাম। আমি, বাবা আর মা। সব গুছানোও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে চাচা এত করে বলল, এই ঈদে আসতেই হবে গ্রামে, তাই বাবা বাধ্য হয়ে এল। উমরাহ তো করা যাবেই আল্লাহ চাইলে, কিন্তু চাচা তো বড় ভাই,মুরুব্বি, তার কথা অমান্য করে কষ্ট দিলে আল্লাহ পাপ দেবে,এই ভয়ে বাবা ক্যান্সেল করল। বাবা তোমার বাবাকে অনেক ভালবাসে। প্রায়ই গল্প করে কিভাবে দাদা মারা যাবার পর চাচা বাবাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে।"
ফাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, " হ্যা, বাবাও তোমার বাবাকে অনেক ভালবাসে। বাবা তো অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছে। একসময় ভেবেছিল, বাবার আর সন্তান হবে না। আমার মায়েরও বয়স হয়ে গিয়েছে। মা বাবার যখন বিয়ে হল, তোমার বাবা তখন স্কুলে পড়ে। তাদের দীর্ঘদিনেও বাচ্চা হল না বলে, তোমার বাবাকেই সন্তানের মত করে মানুষ করল, পড়াশুনা করাল, বিয়ে করাল। তারপর আল্লাহর কি নেয়ামত! তুমি আর আমি একসাথে হলাম। বাবার বহু বছরের সন্তান লাভের সাধনার ফল আমি।"
আমি বললাম, " হ্যা, বাবা তো এখন সরকারের উচুপদের অফিসার। সময়ই পায় না চাচার সাথে দেখা করার। এই তো সরাসরি দেখা হল, সাত বছর পর। যদিও ফোনে কথা প্রতিদিনই হয়। চাচার চালের আড়ত করতেও বাবা চেষ্টা করেছিল অনেক।"
ফাহাদ আবার বিষণ্ণ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে আমরা একটা প্রকাণ্ড দীঘির সামনে চলে এলাম।
আমি বললাম, " ফাহাদ, এত নির্জন দীঘিটা। অন্ধকার.... ফাঁকা চারিদিক... ভয় করে তো।"
ফাহাদ বলল, " তুমিই তো বললা, মাকে দেখাতে কিছু মাছ ধরে নিয়ে যেতে। এই দীঘিতে ভাল মাছ আছে। আর সাধারণত এই দীঘিতে লোকজন থাকে রাতেও। আজ মনে হয় সবাই জনি মোল্লার ওদিকে গিয়েছে। তাই এখানটা নির্জন। দাঁড়াও তোমাকে টোপ বানানো দেখাই।"
আমি দেখতে লাগলাম, ফাহাদ একটা বাক্স থেকে আটা গুলিয়ে নরম করে বরশির ছিপে বাঁধছে। বলছে, " আজকে আমার কেঁচো বা কাঁচা চিংড়ি ঘাটতে ইচ্ছা করছে না। আটার টোপ বানাই। এতে রুই কাতল ধরা পড়ে। কেঁচোতে ধরা পড়ে তেলাপিয়া। চিংড়িতে শোল।"
ফাহাদ দক্ষ হাতে বরশি ছুড়ে মারল দীঘির দিকে। নির্জন নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ পানিতে টুপ করে শব্দ করে বরশিটা ডুবে গেল। শব্দটা আশেপাশে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম আমি। ফাহাদও কোনো কথা বলছে না। আমি একবার কথা বলতেই নিজের ঠোটে আঙুল দিল সে। বলল, " রাতের কথা পানিতে জোরে শোনা যায়, মাছ ভয় পাবে।"
কতক্ষণ কাটল জানি না। হঠাৎ দীঘির পাড় ধরে একটা পাঞ্জাবী পরা লোককে আমি হেটে আসতে দেখলাম। লোকটার হাতে একটা টর্চ। টর্চের আলোয় দেখলাম, লোকটার কাধে ঝোলানো একটা বাক্স। আর একটা লম্বা বরশির মত কি যেন। লোকটা মধ্যবয়সী।
আমি বলে উঠলাম, " ফাহাদ, মনে হয় মাছ ধরতে আরেকজন আসছে।"
ফাহাদ মুখ গোমড়া করে বলল, " উনি কালিগুণিন।"
আমি বললাম, " অদ্ভুত নাম তো।"
তখনই ফোন এলো আমার মোবাইলে। আমি ফোন ধরলাম। আমার মায়ের আর্তচিৎকার ভেসে উঠল ওপাশ থেকে। মা বলছে, " অভি, বাবা, পালা শিগগিরই... পালা..."
পাশ দিয়ে বাবার কান্না শুনলাম মনে হল। বাবা কাউকে বলছে, " দাদাভাই, তুমি এটা করতে পারো না..."
হঠাৎ আমার ঘাড় চেপে ধরল কে যেন। পাশে ফিরতেই দেখি কালিগুণিন নামের লোকটা। টর্চের আলোয় ওর চোখটা লাল টকটক করতে। কপালে তিনটা আড়াআড়ি তিলক।
ওর হাতে একটা লাঠি, যেটাকে আমি ছিপ বরশি ভেবেছিলাম। ও সেটা দিয়ে আমার মাথায় একটা বাড়ি দিল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল।
জ্ঞান কতক্ষণ পরে ফিরল আমি জানি না। তবে যখন ফিরল, তখন রাত আরো গভীর হয়েছে। আর গম্ভীর গলায় কেউ উদ্ভট কিছু মন্ত্র পড়ছে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, কালিগুণিন মন্ত্র পড়তে পড়তে একটা অগ্নিকুণ্ডে ঘি ঢালছে। আর চড়চড় শব্দে আগুণের তেজ বাড়ছে। আগুণের আলোয় আশেপাশের অন্ধকার আরো কালো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আগুণের পাশেই দেখলাম ফাহাদ বসা। ওর হাতে ছিপ। ও এক নিবিষ্টে তাকিয়ে আছে দীঘির কালো পানির দিকে।
আমি আতংকিত গলায় বললাম, " ফাহাদ..."
ফাহাদ গোমড়া মুখে ফিরে তাকাল আমার দিকে। কালিগুণিন মন্ত্র পড়েই যাচ্ছে।
ফাহাদ যন্ত্রের মত বলল, " এটাই জনি মোল্লার পুকুর। ওর ছেলে শফিক মোল্লা মারা গিয়েছে কয়েকদিন আগে। এখন এই দীঘির মালিক রফিক মোল্লা। এই দীঘি নিয়ে অনেক ভূতুড়ে কাহিনী প্রচলিত এই গ্রামে। এই পুকুরে একটা দেবী থাকে। যে পুরুষ মানুষের রক্ত খেতে পছন্দ করে। দীঘির পাশে ওর নাগালে কেউ এলেই ও তুলে নিয়ে যায় তাকে। তারপর রক্ত খেয়ে লাশ ফেরত দেয়।"
আমি বললাম, " তুমি না বললে, জনি মোল্লার পুকুর অন্যদিকে? টিকেট বিক্রি হয়েছে মাছের..."
আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে ফাহাদ বলল, " শফিক মোল্লা বেঁচে থাকতে সেই দেবী যাতে কারো ক্ষতি না করতে পারে, তাই দীঘিটা উচু দেয়াল দিয়ে আটকে দিয়েছিল। যাতে এই দীঘির আশেপাশে কেউ না আসে। বহুবছর দেবী তাই অভুক্ত ছিল। মানে, মানুষের রক্তের অভুক্ত। ছোটখাটো পশু, মাছ সে নিয়মিত খেত।
শফিক মারা যাবার পর সম্পত্তি হাতে এল ছোটভাই রফিকের। সে শহরে মানুষ , সে এসব বিশ্বাস করে না, সে সম্পত্তি দখল নিয়ে এত বড় দীঘিতে মাছ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুবিধার জন্য আশেপাশের কিছু দেয়াল সে ভেঙে ফেলে। এরপর সে মাছ ছাড়ে এখানে।
মাছের লোভে সাতদিন আগের এক রাতে আমি আসি এখানে। বহুদিন পুকুরের দেবীর দৌরাত্ম্য কেউ দেখে নি, সবাই তাকে ভুলে গিয়েছে, যদিও আমার মা আমাকে মানা করেছিল বারবার।
আমি শুনি নি। আমি মাছ ধরতে আসি রাতের গভীরে। আর আমাকে একা পেয়ে সেই দেবী পানির নিচে নিয়ে যায়।"
আমি চোখ বড় বড় করে শুনতে থাকি ফাহাদের কাহিনী। কালিগুণিনের মন্ত্রের আওয়াজ বেড়ে চলছে।
ফাহাদ বলে, " আমাকে পানির ভেতরে নিয়ে কোথায় কোন বাতাসের কোটরে রেখেছিল জিনিসটা, আমি জানি না। তবে দেখছই তো আমি বেঁচে আছি। সেরাতেই আমার খারাপ কিছু হয়েছে বুঝে আমার মা সাথে সাথেই কালিগুণিনের সাথে যোগাযোগ করে। কালিগুণিন তন্ত্রসাধনা করে বের করে, আমি বেঁচে আছি, তবে বেশিক্ষণ বাঁচব না। তখন আমার মা বাবার কথায় মোটা টাকার বিনিময়ে কালিগুণিন দেবীর সাথে চুক্তি করে একটা। আমার জীবন বাঁচানোর চুক্তি। চুক্তিটা হল, দেবী আমাকে জীবিত ফেরত দেবে, তবে আমার শরীরে একটা রোগ ঢুকিয়ে দেবে। সাতদিন থাকবে আমার আয়ু। কিন্তু যদি আমার বাবা মা একই রক্তের একই বয়সের আরেকটা ছেলেকে এনে দিয়ে ওকে ভোগ দেয়, তাহলে সে আমার জীবন ফিরিয়ে দেবে। আমার ভেতরে যে রোগটা সে দিয়ে দিয়েছে, তা ফেরত নেবে। আমি বেঁচে থাকব।
বাবার তখনই মনে এল। আমার একই রক্তের একই বয়সের একমাত্র তুমি আছো। তোমাকে যদি এনে দেবীকে ভোগ দেয়, তবে আমার জীবন হয়ত দেবী ফেরত দেবে।
একারণে শুধু শুধু তোমরা উমরাহ করতে যাচ্ছ জেনেও বাবা ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে চাচা আর চাচীকে এই ঈদে বাড়ি আসতে বাধ্য করল। যাতে তুমি আসো। আর কৌশলে মাছ ধরার কথা বলে তোমাকে নিয়ে এই পুকুরে আমি আসি। কালিগুণিন ওৎ পেতে থাকবে। ওর হাত ধরেই, ওর মন্ত্রের মাধ্যমেই তোমার আর আমার জীবন বিনিময় হবে। পুরো ঘটনাই সাতদিনের ভেতরে হয়েছে।"
এই গল্প শুনে এবার আমি আতংকিত হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম আমাকে ফোন দিয়ে বাবা মা কেন আর্তচিৎকার করছিল। এই ষড়যন্ত্র তারাও বুঝে গিয়েছিল কোনোভাবে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আর চেঁচাতে লাগলাম। যাতে বাবা মা আসে আমাকে বাঁচাতে।
আগুণের আলোয় দেখলাম ফাহাদের করুণ মুখ। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " আমি শেষ মুহুর্তে চেয়েছিলাম, যাতে আমার জন্য মিছেমিছি তোমার প্রাণটা না যায়। একারণে মা ষড়যন্ত্র করে অভিনয় করে যখন টিকেটের মিথ্যা কথা তুলে তোমাকে আমার সাথে পাঠাতে চাচ্ছিল, আমি ভৌতিক কাহিনীটা উঠিয়েছিলাম, যাতে চাচী তোমাকে না আসতে দেয়। কিন্তু তোর ভাগ্য সহায় হল না। আর বাইরে আসার পর আমার বুকে ব্যাথা শুরু হল। রোগটা মাথাচাড়া দিচ্ছে। তুমি না মরলে ওই রোগে আমি মরব। বুকে ব্যাথায় মৃত্যুভয় চলে এল। তাই তোমাকে নিয়েই এলাম।"
কালিগুণিনের গমগমে কণ্ঠ তখনই শোনা গেল, " ফাহাদ বাবু, দেবী আসছে। ভোগ দিলাম তোমার চাচাতো ভাইকে। চল, আমরা কেটে পড়ি।"
আমি চেঁচালাম, " না.... না.... না....."
একটা বিশাল কালো অক্টোপাসের শুড়ের মত কিছু একটা উঠে এল দীঘি থেকে। খপ করে পেঁচিয়ে ধরল বেঁধে রাখা আমাকে। তারপর শূন্যে তুলে ফেলল। আস্তে করে নিয়ে গেল আমাকে অন্ধকার দীঘির উপরে। এরপর ঝপাং করে আমাকে দীঘির তলে নিয়ে গেল।
কেবল দুইটা লাল অঙ্গারের মত চোখ দেখলাম। সেই অঙ্গারের আলোয় বীভৎস মহিলার চেহারাটা দেখলাম। আমার শরীরের চেয়েও বড় ওটার চেহারা। পোড়া শ্যাওলাঢাকা পঁচাগলা ওর মুখ। বীভৎস ওর ধারালো দাঁতের হাসি। ওর বিশাল কেশরাজি শ্যাওলার মত। ওর শরীরটা কত বড় তা বুঝলাম না। তবে শরীরের দুপাশ থেকে হাতের মত একগাদা অক্টোপাসের শুড় বেরিয়েছে। এর একটায় বাধা আমি। দম আটকে মরছি, আস্তে আস্তে ওর ধারাল দাঁতের দিকে আমার শরীর এগোচ্ছে।
মৃত্যুর ঠিক আগে পুরো পুকুরের তলদেশে একটা উজ্জ্বল আলো দেখলাম। সেই আলোয় দেবীর বীভৎস চেহারাটা আরো প্রতীয়মান হল। আলোটা ছিল একটা টর্চ। কালগুণিনের হাতের টর্চ।
সেই আলোয় দেখলাম, আরো দুইটা শুড়ে পেঁচানো, আরো দুইটা দেহ। একটা কালিগুণিনের , একটা ফাহাদের। বাঁচার জন্য ওরাও ছটফট করছে।
দেবী কথা রাখে নি। আমার জীবনের বিনিময়ের ফাহাদের জীবন ফেরত দেয় নি। বরং ফাহাদের জীবনকে টোপ হিসেবে বিছিয়ে আমাকে আর কালিগুণিনকেও শিকার করে নিয়েছে।
অরিজিনাল পোস্ট: ০৫/০২/২০২৫