07/04/2025
অনেকদিন পর আবারও নিয়মিত গল্পে ফিরতে চাচ্ছি।
আপনাদের কি অভিমত?
সাইকো ও থ্রিলার গল্পপ্রেমীদের জন্য গল্পের স্বর্গরাজ্য
অনেকদিন পর আবারও নিয়মিত গল্পে ফিরতে চাচ্ছি।
আপনাদের কি অভিমত?
"টোপ"
লেখা: রায়হান মাসুদ
" কি রে? আজ রাতে মাছ ধরতে যাবি না?" মর্জিনা চাচী জিজ্ঞেস করল ফাহাদকে।
আমি আগ্রহ নিয়ে ফাহাদের দিকে তাকালাম। আমি ঢাকা থেকে শুনে আসছি আমার চাচাতো ভাই ফাহাদের মাছের বড্ড নেশা। এলাকার বড় বড় দীঘিতে যখনই মাছ ধরার আয়োজন করা হয়, ফাহাদ টিকেট কেনে। আর দক্ষ হাতে বড় বড় মাছও ধরে। সেই মাছের ছবি চাচী আমার মাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায়। কয়েকদিন আগে তো ত্রিশ কেজি ওজনের একটা কাতল ধরে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল ফাহাদ। স্থানীয় পেপারেও এসেছিল, ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক ছেলে টিকেট কেটে মাছ ধরতে এসে একা ত্রিশ কেজি ওজনের দানবাকৃতির কাতল ধরেছে। সেই পেপারে ফাহাদের ভারী মাছ হাতে ছবিও আছে। চাচী পেপার কাটিংয়ের ছবিও আমার মাকে পাঠিয়েছিল। আমার চাচাতো ভাই ফাহাদ পড়াশোনায় তেমন ভাল না। বুদ্ধিসুদ্ধিতেও কাঁচা। চাচার এই উপজেলা শহরের সবচেয়ে বড় চালের আড়তে স্কুলে থাকা সত্ত্বেও চাচা হিসাব নিকাশ শিখাতে কাজে লাগাতে চেয়েছিল তাকে, কিন্তু ফাহাদের মাথায় তা কুলায় নি। চাচাও স্বীকার করে নিয়েছে ছেলেটা বড্ড সহজ সরল। এবং একারণে চাচা অলরেডি বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, একমাত্র ছেলে ফাহাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। ফাহাদের ব্যাপারে চাচার সাথে আমার বাবার বেশ কথাবার্তা হয়। আমি তা জানি।
তবে চাচী বাংলাদেশের সে সকল গর্বিত মায়েদের মধ্যে অন্যতম, যারা নিজের ছেলের অনেক ব্যর্থতার মাঝে অল্প যেসব গুণ আছে, সেই গুণ নিয়ে গর্ববোধ করে এবং বুক ফুলিয়ে প্রচার করে। আমার ক্লাস নাইনে এই নিয়ে দুইবার থাকা হিসাব নিকাশ না বোঝা সহজ সরল চাচাতো ভাই ফাহাদের গুটিকয়েক যে যোগ্যতা আছে, সে ব্যাপারে চাচী যখন আমার মায়ের সাথে গল্প করে, আমার মায়ের মতে চাচীর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, সে তার ছেলের জন্য সত্যিকারেই গর্বিত। চাচী নিজেও খুব ভাল মানুষ, মা তাই চুপচাপ সব শোনে। কখনোই ফাহাদের পড়াশোনার খবর নেবার চেষ্টা করে চাচীর মন খারাপ করে দেয় না।
এবার ঈদের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হবার পর তাই আমি যখন বাবা মায়ের সাথে গ্রামে বেড়াতে আসলাম, চাচীর তাই শখ হল, নিজের চোখে যাতে আমরা দেখি তার ছেলে মাছ ধরতে কতটা দক্ষ সেই ব্যবস্থা করতে। এমনিতেই কোন একটা দীঘিতে মাছের টিকেট বিক্রি করছিল। চাচীই টাকা দিয়ে ফাহাদের সেই টিকেট কেনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আর পইপই করে বলেছিল, ফাহাদ যাতে এবারের মাছ ধরার সময় অবশ্যই আমাকে সঙ্গে রাখে। আমি যাতে তার মাছ ধরার কৃতিত্বের সাক্ষী থাকি।
ঈদের সিজনে সারাদিন মানুষজন ব্যস্ত থাকে , তাই যারা মাছ ধরার টিকেট বিক্রি করেছিল, তারা দীঘিটা বন্ধ করে রেখেছিল সকালে। বলা হয়েছিল, রাতে একটা পিকনিকের আমেজে সবাই মাছ ধরবে। মাছশিকারীরাও রাজি হয়ে গিয়েছিল। কারণ পুকুর বা দীঘির বড় মাছগুলো রাতেই উপরে উঠে আসে।
যখন রাত হল, মাছ ধরার সময় হল, চাচী তাই ফাহাদকে তাড়া দিল, " সময় হয়ে গেল তো। ছিপ বরশি রেডি কর। অভিকে নিয়ে যা। ও শহুরে ছেলে, মাছ ধরা দেখে আনন্দ পাবে।"
আমিও বলে উঠলাম, " চলো ফাহাদ, বের হই।"
ফাহাদ নাকি সাধারণত মাছ ধরতে একা একাই বের হয়ে যায়। কাউকে বলাও লাগে না। তবে সেদিন ফাহাদ প্রথম বলল, " মা, আমাকে না বলে জনি মোল্লার দীঘির টিকেটটা তোমার করা উচিত হয় নি। তুমি তো জানো, দীঘিটা ভাল না।"
চাচীর মুখ এতটুকু হয়ে গেল। আমার মা কথাটা শুনে আগ্রহে হয়ে উঠল। বলল, " কি বলে ও। মর্জিনা বুবু, দীঘি কি ভূতুড়ে নাকি?"
চাচী বলল, " আরে না। এখন কি আর এটা গ্রাম আছে নাকি। রীতিমত উপজেলা শহর। আর ফাহাদ কত রাতে মাছ ধরে এসেছ বাসায়। কখনোই সমস্যা হয় নি। এই গ্রামে ভূতুড়ে কিছু নেই।"
ফাহাদ বলল, " অন্য কোনো পুকুরে সমস্যা নেই। কিছু জনি মোল্লার পুকুরে তো সমস্যা বহু আগে থেকে। প্রায়ই তো মানুষ নিখোজ হয় এখান থেকে। কতবছর পুকুর বল, দীঘি বল, এই জায়গাটা আটকানো ছিল জানো না তুমি?"
চাচী বলল, " আরে কিছু হবে না, তুই অভিকে নিয়ে যা। অনেক মানুষ থাকবে। এত মানুষের ভিড়ে কোনো ভয় নেই।"
ফাহাদ বলল, " একটাও গ্রামের লোক টিকেট কেনে নি। যারা কিনেছে, সবাই ঈদের ছুটিতে শহর থেকে এসেছে। এরা জানেও না বেশি কিছু।"
চাচী বলল, " এতদিন ওরা আটকে রেখেছিল পুরো দীঘি। এখন টিকেট দিচ্ছে। সমস্যা নেই বলেই দিয়েছে।"
ফাহাদ বলল, " এতদিন জনি মোল্লার বড় ছেলে শফিক মোল্লা ওই দীঘি দেখাশোনা করত। সে জানত, দীঘিটা খারাপ। একা কেউ এই দীঘির পাড়ে এলে নিখোঁজ হয়। দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু শফিক মোল্লা এবছর মারা যাবার পর ওর ছোটভাই রফিক মোল্লা শহর থেকে এসেছে সম্পত্তিগুলো দেখভাল করতে। সে তো সবকিছু জানে না, অথবা পরোয়া করে না, তাই টিকেট ছেড়েছে। তুমি সব জেনেও টিকেট আনলে কেন? আমি গিয়ে যদি আর না ফিরি?"
এই কথাটায় চাচী খুব কষ্ট পেল। তার চোখ ছলছল করে উঠল। মায়ের সামনে গাল লাল হয়ে গেল। মায়েদের একটা প্রতিযোগিতা থাকে প্রচ্ছন্ন। কাদের সন্তান কতটা যোগ্য সেটা দেখানোর। আমার মা আজ সকালে চাচীকে বলছিল আমার এবারের রেজাল্টের কথা, আমি ফার্স্ট হয়েছি, সেটা গর্বের সাথে বলছিল। চাচীও পাল্টা গর্ব করে বলছিল, ফাহাদের মাছ ধরার দক্ষতার কথা। মা দুইটার তুলনা অস্বীকার করে চাচীকে কষ্ট দেয় নি। কিন্তু চাচীর কেন জানি রোখ চেপে গিয়েছিল, তার ছেলের একটা দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার।
গ্রামের মায়েদের দুশ্চিন্তা আর সন্তানের নিরাপত্তাবোধ শহরের মায়েদের মত হয় না। এজন্যই হয়ত ভূতুড়ে দীঘির কাহিনী জেনেও ফাহাদের জন্য টিকেট কিনেছিল সে।
আমাদের সামনে চাচী অপমানিত হচ্ছে বলে আমি ফাহাদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। সঙ্গে ওর ছিপ আর বরশিও নিয়ে নিলাম। বাইরে বেরিয়ে বললাম, "ফাহাদ, এক কাজ করি চল, তোমার ঝুঁকি নিয়ে জনি মোল্লার পুকুরে যেতে হবে না। তুমি তো ভাল মাছ ধরো। চল দুই ভাই মিলে অন্য কোনো পুকুরে যাই, কিছু মাছ নিয়ে ঘরে ফিরি। চাচী আসলে তোমার মাছ ধরার দক্ষতা নিয়ে অনেক গর্বিত। আমাদের সামনে সেটা দেখাতে চাচ্ছে। আর টিকেট কাটা দীঘিতে অনেক লোক থাকবে বলে হয়তো ভেবেছে, খারাপ কিছু হবে না। তুমি ভুল বুঝো না।"
ফাহাদ চুপ করে রইল। আমি আশেপাশে তাকালাম। বেশ অন্ধকার। মাঝে মাঝে দুই একটা টিমটিমে রোডলাইট, চাচী যে শহরের কথা বলেছে, সেই তুলনাটা সঠিক হয় নি। চাচী দীর্ঘদিন আসল শহর দেখেই নি।
আমি বললাম, " ঈদের সিজনে একটু গান বাজনা করো না তোমরা এখানে?"
ফাহাদের মন খারাপ। সেই আস্তে করে বলল, " হ্যা করি, আমিই আমার বন্ধুদের নিয়ে করি। এবার তো তোমরা অনেকদিন পর এলে গ্রামে, তাই তোমাদের সঙ্গ দিতে আর আয়োজন করতে পারি নি। আর আমার সিনিয়র যারা এই কাজ করত, সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত এই বছর।"
ফাহাদ হাটতে হাটতে নির্জন অন্ধকার মেটে পথে নেমে এল। এই গ্রামের কিছুই আমি চিনি না। গ্রামের অন্ধকার নির্জনতায় ভয় হল একটু। ভয় কাটাতে বললাম, " জানো, এবছর আমরা সবাই উমরাহ করতে চেয়েছিলাম। আমি, বাবা আর মা। সব গুছানোও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে চাচা এত করে বলল, এই ঈদে আসতেই হবে গ্রামে, তাই বাবা বাধ্য হয়ে এল। উমরাহ তো করা যাবেই আল্লাহ চাইলে, কিন্তু চাচা তো বড় ভাই,মুরুব্বি, তার কথা অমান্য করে কষ্ট দিলে আল্লাহ পাপ দেবে,এই ভয়ে বাবা ক্যান্সেল করল। বাবা তোমার বাবাকে অনেক ভালবাসে। প্রায়ই গল্প করে কিভাবে দাদা মারা যাবার পর চাচা বাবাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছে।"
ফাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, " হ্যা, বাবাও তোমার বাবাকে অনেক ভালবাসে। বাবা তো অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছে। একসময় ভেবেছিল, বাবার আর সন্তান হবে না। আমার মায়েরও বয়স হয়ে গিয়েছে। মা বাবার যখন বিয়ে হল, তোমার বাবা তখন স্কুলে পড়ে। তাদের দীর্ঘদিনেও বাচ্চা হল না বলে, তোমার বাবাকেই সন্তানের মত করে মানুষ করল, পড়াশুনা করাল, বিয়ে করাল। তারপর আল্লাহর কি নেয়ামত! তুমি আর আমি একসাথে হলাম। বাবার বহু বছরের সন্তান লাভের সাধনার ফল আমি।"
আমি বললাম, " হ্যা, বাবা তো এখন সরকারের উচুপদের অফিসার। সময়ই পায় না চাচার সাথে দেখা করার। এই তো সরাসরি দেখা হল, সাত বছর পর। যদিও ফোনে কথা প্রতিদিনই হয়। চাচার চালের আড়ত করতেও বাবা চেষ্টা করেছিল অনেক।"
ফাহাদ আবার বিষণ্ণ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে আমরা একটা প্রকাণ্ড দীঘির সামনে চলে এলাম।
আমি বললাম, " ফাহাদ, এত নির্জন দীঘিটা। অন্ধকার.... ফাঁকা চারিদিক... ভয় করে তো।"
ফাহাদ বলল, " তুমিই তো বললা, মাকে দেখাতে কিছু মাছ ধরে নিয়ে যেতে। এই দীঘিতে ভাল মাছ আছে। আর সাধারণত এই দীঘিতে লোকজন থাকে রাতেও। আজ মনে হয় সবাই জনি মোল্লার ওদিকে গিয়েছে। তাই এখানটা নির্জন। দাঁড়াও তোমাকে টোপ বানানো দেখাই।"
আমি দেখতে লাগলাম, ফাহাদ একটা বাক্স থেকে আটা গুলিয়ে নরম করে বরশির ছিপে বাঁধছে। বলছে, " আজকে আমার কেঁচো বা কাঁচা চিংড়ি ঘাটতে ইচ্ছা করছে না। আটার টোপ বানাই। এতে রুই কাতল ধরা পড়ে। কেঁচোতে ধরা পড়ে তেলাপিয়া। চিংড়িতে শোল।"
ফাহাদ দক্ষ হাতে বরশি ছুড়ে মারল দীঘির দিকে। নির্জন নিস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ পানিতে টুপ করে শব্দ করে বরশিটা ডুবে গেল। শব্দটা আশেপাশে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম আমি। ফাহাদও কোনো কথা বলছে না। আমি একবার কথা বলতেই নিজের ঠোটে আঙুল দিল সে। বলল, " রাতের কথা পানিতে জোরে শোনা যায়, মাছ ভয় পাবে।"
কতক্ষণ কাটল জানি না। হঠাৎ দীঘির পাড় ধরে একটা পাঞ্জাবী পরা লোককে আমি হেটে আসতে দেখলাম। লোকটার হাতে একটা টর্চ। টর্চের আলোয় দেখলাম, লোকটার কাধে ঝোলানো একটা বাক্স। আর একটা লম্বা বরশির মত কি যেন। লোকটা মধ্যবয়সী।
আমি বলে উঠলাম, " ফাহাদ, মনে হয় মাছ ধরতে আরেকজন আসছে।"
ফাহাদ মুখ গোমড়া করে বলল, " উনি কালিগুণিন।"
আমি বললাম, " অদ্ভুত নাম তো।"
তখনই ফোন এলো আমার মোবাইলে। আমি ফোন ধরলাম। আমার মায়ের আর্তচিৎকার ভেসে উঠল ওপাশ থেকে। মা বলছে, " অভি, বাবা, পালা শিগগিরই... পালা..."
পাশ দিয়ে বাবার কান্না শুনলাম মনে হল। বাবা কাউকে বলছে, " দাদাভাই, তুমি এটা করতে পারো না..."
হঠাৎ আমার ঘাড় চেপে ধরল কে যেন। পাশে ফিরতেই দেখি কালিগুণিন নামের লোকটা। টর্চের আলোয় ওর চোখটা লাল টকটক করতে। কপালে তিনটা আড়াআড়ি তিলক।
ওর হাতে একটা লাঠি, যেটাকে আমি ছিপ বরশি ভেবেছিলাম। ও সেটা দিয়ে আমার মাথায় একটা বাড়ি দিল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে গেল।
জ্ঞান কতক্ষণ পরে ফিরল আমি জানি না। তবে যখন ফিরল, তখন রাত আরো গভীর হয়েছে। আর গম্ভীর গলায় কেউ উদ্ভট কিছু মন্ত্র পড়ছে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, কালিগুণিন মন্ত্র পড়তে পড়তে একটা অগ্নিকুণ্ডে ঘি ঢালছে। আর চড়চড় শব্দে আগুণের তেজ বাড়ছে। আগুণের আলোয় আশেপাশের অন্ধকার আরো কালো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আগুণের পাশেই দেখলাম ফাহাদ বসা। ওর হাতে ছিপ। ও এক নিবিষ্টে তাকিয়ে আছে দীঘির কালো পানির দিকে।
আমি আতংকিত গলায় বললাম, " ফাহাদ..."
ফাহাদ গোমড়া মুখে ফিরে তাকাল আমার দিকে। কালিগুণিন মন্ত্র পড়েই যাচ্ছে।
ফাহাদ যন্ত্রের মত বলল, " এটাই জনি মোল্লার পুকুর। ওর ছেলে শফিক মোল্লা মারা গিয়েছে কয়েকদিন আগে। এখন এই দীঘির মালিক রফিক মোল্লা। এই দীঘি নিয়ে অনেক ভূতুড়ে কাহিনী প্রচলিত এই গ্রামে। এই পুকুরে একটা দেবী থাকে। যে পুরুষ মানুষের রক্ত খেতে পছন্দ করে। দীঘির পাশে ওর নাগালে কেউ এলেই ও তুলে নিয়ে যায় তাকে। তারপর রক্ত খেয়ে লাশ ফেরত দেয়।"
আমি বললাম, " তুমি না বললে, জনি মোল্লার পুকুর অন্যদিকে? টিকেট বিক্রি হয়েছে মাছের..."
আমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে ফাহাদ বলল, " শফিক মোল্লা বেঁচে থাকতে সেই দেবী যাতে কারো ক্ষতি না করতে পারে, তাই দীঘিটা উচু দেয়াল দিয়ে আটকে দিয়েছিল। যাতে এই দীঘির আশেপাশে কেউ না আসে। বহুবছর দেবী তাই অভুক্ত ছিল। মানে, মানুষের রক্তের অভুক্ত। ছোটখাটো পশু, মাছ সে নিয়মিত খেত।
শফিক মারা যাবার পর সম্পত্তি হাতে এল ছোটভাই রফিকের। সে শহরে মানুষ , সে এসব বিশ্বাস করে না, সে সম্পত্তি দখল নিয়ে এত বড় দীঘিতে মাছ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুবিধার জন্য আশেপাশের কিছু দেয়াল সে ভেঙে ফেলে। এরপর সে মাছ ছাড়ে এখানে।
মাছের লোভে সাতদিন আগের এক রাতে আমি আসি এখানে। বহুদিন পুকুরের দেবীর দৌরাত্ম্য কেউ দেখে নি, সবাই তাকে ভুলে গিয়েছে, যদিও আমার মা আমাকে মানা করেছিল বারবার।
আমি শুনি নি। আমি মাছ ধরতে আসি রাতের গভীরে। আর আমাকে একা পেয়ে সেই দেবী পানির নিচে নিয়ে যায়।"
আমি চোখ বড় বড় করে শুনতে থাকি ফাহাদের কাহিনী। কালিগুণিনের মন্ত্রের আওয়াজ বেড়ে চলছে।
ফাহাদ বলে, " আমাকে পানির ভেতরে নিয়ে কোথায় কোন বাতাসের কোটরে রেখেছিল জিনিসটা, আমি জানি না। তবে দেখছই তো আমি বেঁচে আছি। সেরাতেই আমার খারাপ কিছু হয়েছে বুঝে আমার মা সাথে সাথেই কালিগুণিনের সাথে যোগাযোগ করে। কালিগুণিন তন্ত্রসাধনা করে বের করে, আমি বেঁচে আছি, তবে বেশিক্ষণ বাঁচব না। তখন আমার মা বাবার কথায় মোটা টাকার বিনিময়ে কালিগুণিন দেবীর সাথে চুক্তি করে একটা। আমার জীবন বাঁচানোর চুক্তি। চুক্তিটা হল, দেবী আমাকে জীবিত ফেরত দেবে, তবে আমার শরীরে একটা রোগ ঢুকিয়ে দেবে। সাতদিন থাকবে আমার আয়ু। কিন্তু যদি আমার বাবা মা একই রক্তের একই বয়সের আরেকটা ছেলেকে এনে দিয়ে ওকে ভোগ দেয়, তাহলে সে আমার জীবন ফিরিয়ে দেবে। আমার ভেতরে যে রোগটা সে দিয়ে দিয়েছে, তা ফেরত নেবে। আমি বেঁচে থাকব।
বাবার তখনই মনে এল। আমার একই রক্তের একই বয়সের একমাত্র তুমি আছো। তোমাকে যদি এনে দেবীকে ভোগ দেয়, তবে আমার জীবন হয়ত দেবী ফেরত দেবে।
একারণে শুধু শুধু তোমরা উমরাহ করতে যাচ্ছ জেনেও বাবা ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে চাচা আর চাচীকে এই ঈদে বাড়ি আসতে বাধ্য করল। যাতে তুমি আসো। আর কৌশলে মাছ ধরার কথা বলে তোমাকে নিয়ে এই পুকুরে আমি আসি। কালিগুণিন ওৎ পেতে থাকবে। ওর হাত ধরেই, ওর মন্ত্রের মাধ্যমেই তোমার আর আমার জীবন বিনিময় হবে। পুরো ঘটনাই সাতদিনের ভেতরে হয়েছে।"
এই গল্প শুনে এবার আমি আতংকিত হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম আমাকে ফোন দিয়ে বাবা মা কেন আর্তচিৎকার করছিল। এই ষড়যন্ত্র তারাও বুঝে গিয়েছিল কোনোভাবে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আর চেঁচাতে লাগলাম। যাতে বাবা মা আসে আমাকে বাঁচাতে।
আগুণের আলোয় দেখলাম ফাহাদের করুণ মুখ। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " আমি শেষ মুহুর্তে চেয়েছিলাম, যাতে আমার জন্য মিছেমিছি তোমার প্রাণটা না যায়। একারণে মা ষড়যন্ত্র করে অভিনয় করে যখন টিকেটের মিথ্যা কথা তুলে তোমাকে আমার সাথে পাঠাতে চাচ্ছিল, আমি ভৌতিক কাহিনীটা উঠিয়েছিলাম, যাতে চাচী তোমাকে না আসতে দেয়। কিন্তু তোর ভাগ্য সহায় হল না। আর বাইরে আসার পর আমার বুকে ব্যাথা শুরু হল। রোগটা মাথাচাড়া দিচ্ছে। তুমি না মরলে ওই রোগে আমি মরব। বুকে ব্যাথায় মৃত্যুভয় চলে এল। তাই তোমাকে নিয়েই এলাম।"
কালিগুণিনের গমগমে কণ্ঠ তখনই শোনা গেল, " ফাহাদ বাবু, দেবী আসছে। ভোগ দিলাম তোমার চাচাতো ভাইকে। চল, আমরা কেটে পড়ি।"
আমি চেঁচালাম, " না.... না.... না....."
একটা বিশাল কালো অক্টোপাসের শুড়ের মত কিছু একটা উঠে এল দীঘি থেকে। খপ করে পেঁচিয়ে ধরল বেঁধে রাখা আমাকে। তারপর শূন্যে তুলে ফেলল। আস্তে করে নিয়ে গেল আমাকে অন্ধকার দীঘির উপরে। এরপর ঝপাং করে আমাকে দীঘির তলে নিয়ে গেল।
কেবল দুইটা লাল অঙ্গারের মত চোখ দেখলাম। সেই অঙ্গারের আলোয় বীভৎস মহিলার চেহারাটা দেখলাম। আমার শরীরের চেয়েও বড় ওটার চেহারা। পোড়া শ্যাওলাঢাকা পঁচাগলা ওর মুখ। বীভৎস ওর ধারালো দাঁতের হাসি। ওর বিশাল কেশরাজি শ্যাওলার মত। ওর শরীরটা কত বড় তা বুঝলাম না। তবে শরীরের দুপাশ থেকে হাতের মত একগাদা অক্টোপাসের শুড় বেরিয়েছে। এর একটায় বাধা আমি। দম আটকে মরছি, আস্তে আস্তে ওর ধারাল দাঁতের দিকে আমার শরীর এগোচ্ছে।
মৃত্যুর ঠিক আগে পুরো পুকুরের তলদেশে একটা উজ্জ্বল আলো দেখলাম। সেই আলোয় দেবীর বীভৎস চেহারাটা আরো প্রতীয়মান হল। আলোটা ছিল একটা টর্চ। কালগুণিনের হাতের টর্চ।
সেই আলোয় দেখলাম, আরো দুইটা শুড়ে পেঁচানো, আরো দুইটা দেহ। একটা কালিগুণিনের , একটা ফাহাদের। বাঁচার জন্য ওরাও ছটফট করছে।
দেবী কথা রাখে নি। আমার জীবনের বিনিময়ের ফাহাদের জীবন ফেরত দেয় নি। বরং ফাহাদের জীবনকে টোপ হিসেবে বিছিয়ে আমাকে আর কালিগুণিনকেও শিকার করে নিয়েছে।
অরিজিনাল পোস্ট: ০৫/০২/২০২৫
" অক্ষিকোটর "
লেখা: রায়হান মাসুদ
ইদানীং একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি আমি। আমার বিছানার পায়ের কাছের দেয়ালে লাগানো আমার পড়ার টেবিল। টেবিলের লাগোয়া দেয়ালে জানালা। জানালার ওপাড়ে একটা ব্যালকনি। ব্যালকনিতে গ্রিল দেওয়া।
এ বাসায় ওঠার পর থেকেই, সেই ব্যালকনির সিলিংয়ে দুইটা লোহার আংটা দেখে আসছি। আমাদের আসার আগে এই বাসায় কিছু ভার্সিটির মেয়ে মেস করে থাকত। তারা সম্ভবত ওই আংটায় দোলনা ঝুলিয়ে দুলত। তাদের আসার আগে অন্য কোনো পরিবারের মেয়েরাও সম্ভবত আংটাদুটোকে দোলনার মতই ব্যবহার করত।
আমি স্বপ্নে ওই আংটায় দোলনা ঝুলিয়ে কাউকে দুলতে দেখি। ঘুমের আগে যে জানালা আমি বন্ধ করে শুই, সেই জানালাকে আমি খোলা দেখি। যে দোলে, তার চুলও মেয়েদের মত। কিন্তু খড়খড়ে, জটা পরা, তার ছাই রঙের ধারালো নখরওয়ালা পা দুটো উল্টানো। পুরো গায়ে আলখাল্লা পরে সে। চেহারাটা দীর্ঘদিনের পানিতে ডুবে পঁচে যাওয়া লাশের মত। চোখদুটো নেই অক্ষিকোটরে। কোটরদুটো শূন্য। জিভ আর দাঁতগুলো কালো। সে দোলনায় দোলে আর সুর করে কি যেন একটা বলে।
" মনা রে মনা
কোথায় যাস,
ঝিলের পাড়ে
ধরব হাঁস,
হাঁস কি হবে?
চোখ নেব তার
দেখব পানিতে কি
তাও ভাসে...?"
তারপর স্বপ্নের মাঝেই সে আমার দিকে তার শূন্য অক্ষিকোটরদুটো মেলে তাকায়। আর আমি এই ধাড়ি বয়সেও তীব্র এক চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে গভীর রাতে জেগে উঠি।
স্বপ্নের আবেশ বাস্তবেও কিছুক্ষণ থাকে কিনা জানি না। তবে আমি দোলনা দোলার ক্যাচরম্যাচড় শব্দ ঘুম ভাঙতেও শুনি সামনের ব্যালকনিতে। নাহ, জানালা ঘুমানোর আগের মতই বন্ধ। কিন্তু ব্যালকনিতে ও কিসের শব্দ? আমার ব্যালকনি তো ফাঁকা। কোনো দোলনা আমি ঝুলাই নি। তাহলে শব্দ কিসের?
কিসের শব্দ তা উদঘাটন করার সাহস আজ প্রায় তিনমাস হয়ে গেল, তাও হল না। ঘুমের আগে ব্যালকনির দরজা আর টেবিলের জানালা টাইট করে লক করে আটকাই। প্রায়ই এই ভয়ংকর স্বপ্নটা দেখি। আর স্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হল, ঘুম ভাঙার পরে স্বপ্নের মতই কাল্পনিক সেই দোলনা দোলার শব্দ পাই।
একা থাকি বাসায়। কাউকে যে সমস্যাটা শেয়ার করব, তাও পারছি না। সবকিছুর দাম বাড়ার সাথে সাথে বেতন বাড়ে নি। তাই বাধ্য হয়ে কমদামি এই ফ্লাটটা ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে। ফ্লাটটার ভাড়া যা হবার কথা ছিল, তার এক-তৃতীয়াংশ কমে এখানে থাকছি আমি তিনমাস ধরে। সত্য কথা বলতে, এই ভাড়ায় এই শহরে আমার বস্তিবাড়িটাইপের বাসায় উঠতে হত। কিন্তু সেটা স্ট্যাটাসের সাথে যায় না। শিক্ষিত আর মধ্যবিত্ত হবার এই এক জ্বালা, "স্ট্যাটাস"। স্ট্যাটাস রক্ষা করতে কষ্ট করে হলেও সমাজের আড়চোখ সহ্য না করতে সাধ্যের বাইরে অনেক কিছু করতে হয়। সে হিসেবে, আবাসিক এলাকায় এমন একটা ফ্লাট এত কমটাকায় পেয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়েছিলাম। স্ট্যাটাস আর পকেট দুইই রক্ষা হবে ভেবে।
হরর মুভি বা গল্পে ঠিকই দেখায়। দোষের বাড়িগুলো অনেক কমদামে ভাড়া হয় বা বিক্রি হয়। তবে হরর মুভিতে আশেপাশের মানুষ ভূতুড়ে ঘর নিয়ে মুভির প্রধান চরিত্রদের বাধা দেয়। আমাকে এই ফ্লাটের ব্যাপারে কেউই সাবধান করে নি এর আগে। এমনকি এই ফ্লাট নিয়ে কোনো গুজবও কখনো শুনি নি। হতে পারে, আগের ভাড়াটিয়াদের আমি পাই নি বলে। এও হতে পারে, এযুগে কেউ ভূতের প্রসঙ্গ অপরিচিত কারো কাছে তুলতে চায় না, পাছে সে যদি অবজ্ঞা নিয়ে মুচকি হাসে!
এ বাড়ির বাড়িওয়ালা তিনতলায় থাকে। আমার ফ্লাটের ঠিক উপরে। কিন্তু তারা খুবই কম এই বাড়িতে থাকে। তাদের ছেলে মেয়েগুলো সব ঢাকায় পড়াশুনা করে। বাড়িওয়ালা তাই সস্ত্রীক মাসের ২০/২৫ দিনই ঢাকায় থাকে। যে কয়দিন বাসায় থাকে, অনেক ব্যস্ত থাকে তারা। ভাড়াটা উঠিয়েই আবার রওনা দেয় ঢাকায়।
আমি নিশ্চিত অন্য ফ্লাটগুলোতে এই সমস্যাটা নেই। কারণ যেই জিনিস আমি প্রতিনিয়ত স্বপ্নে আর বাস্তবে দেখি আর শুনি, তা যদি অন্য কোনো ভাড়াটিয়া শুনত এই বাসায়, এই বিষয়ে কোনো না কোনো গুজব পাড়ায় উঠতই।
একদিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যাব আর কি গভীর ঘুমের প্রত্যাশায়, যাতে স্বপ্ন না দেখি। যদিও বিশেষ একটা উপকার এতে পাই না। যাই হোক, হুট করে বাড়িওয়ালার ফোন এল। বাড়িওয়ালা মাত্রই আজ সন্ধ্যায় ঢাকায় গিয়েছে। হন্তদন্ত হয়ে বাড়িওয়ালা আমাকে ফোনে বলল, " শোভন, তুমি কি একটু আমাদের ফ্লাটের সামনে যাবা? চারতলার লেকচারার রফিক সাহেব ফোন দিলেন, গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে নাকি। সবার বাসায় চেক করা হয়েছে, কারো গ্যাসের সমস্যা নেই। তুমি তো গ্যাস ব্যবহার করো না। এখন বাকি আছে কেবল আমার বাসায়ই। আমার ফ্লাটের একটা এক্সট্রা চাবি বাইরের পাপোশের নিচে থাকে। খুলে একটু চেক করে দেখো তো বাবা। নয়ত, বড় বিপদ হতে পারে।"
আমি গোটা বাসার একমাত্র যুবক ছেলে। বাকি ফ্লাটে বেশিরভাগই বয়স্ক ,অথবা মেয়েদের মেস। আমাকে এজন্যই বাড়িওয়ালা ফোন দিয়েছে। বের হয়ে বাড়িওয়ালার ফ্লাটের সামনে গিয়ে দেখি যদিও বাড়িওয়ালা আমাকেই তার ফ্লাটে ঢুকতে বলেছে, তবুও চারতলার দুই ফ্লাটের দুই আংকেলও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের নাম রফিক, আরেকজনের নাম করিম। আমি শিগগিরই চাবি বের করে ঢুকলাম বাড়িওয়ালার ফ্লাটে। দরজা খুলতেই প্রচণ্ড জোরে গ্যাসের গন্ধ নাকে ধাক্কা দিল। আমি নাক টিপে ঢুকলাম বাড়িওয়ালার রান্নাঘরে। আংকেলরাও পিছু পিছু এলো। আমি দেখলাম, গ্যাসের সিলিন্ডারের চাবি খোলা। শিগগিরই বন্ধ করে দিলাম সেটা। রফিক আংকেল বলল, " এই গ্যাস বের করতে হবে ফ্লাট থেকে। নয়ত এখনো ঝুঁকি আছে। বাইরেও যদি কেউ সিগারেট ধরায় তো বিপদ। "
আংকেলরা ফ্লাটের বন্ধ জানালা খুলতে লাগল। আমি গেলাম ব্যালকনির দিকে।
ব্যালকনির কাছে গিয়েই একটা ধাক্কা খেলাম। বাড়িওয়ালার বাসায় কোনো ব্যালকনি নেই। নিরেট দেয়াল। কিন্তু বাইরে থেকে তো ব্যালকনির গ্রিল ঠিকই দেখা যায়!
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রফিক আংকেল এসে বলল, " বাড়িওয়ালার একটা প্রতিবন্ধী ছেলে ছিল। সে এই ব্যালকনি থেকে বাইরে পেশাব করত রাস্তার মানুষের গায়ে। বড় ছেলে। ২০/২১ বছরের প্রতিবন্ধী ছেলে। অনেক ঝামেলা হত এ নিয়ে এলাকায়। বাড়িওয়ালা তাই এই ব্যালকনি সিল করে রেখেছে সিমেন্ট দিয়ে।"
আমি আর আংকেলরা আরো অপেক্ষা করতে লাগলাম গ্যাসের গন্ধ সম্পূর্ণ দূর হবার আগ পর্যন্ত। আমি এই ফাঁকে বাড়িওয়ালার ড্রয়িংরুমের দেয়াল দেখতে লাগলাম। আমার জানামতে বাড়িওয়ালার এক ছেলে আর দুই মেয়ে। সবাই ঢাকায় পড়ে। প্রতিবন্ধী ছেলের কথা আগে শুনি নি।
কিন্তু দেয়ালের ছবিগুলোতে পারিবারিক ছবিতে ছয়জনকে দেখা যাচ্ছে। বাড়িওয়ালা ,আর তার স্ত্রী, আমার জানামতে তাদের তিন ছেলেমেয়ে আর একটা ছেলে। বাড়িওয়ালার বাকি ছেলে মেয়ের চেয়ে বড় সে। কিন্তু চেহারা দেখে কেউই বলবে না, ও প্রতিবন্ধী।
আমি অবাক হয়ে ছেলেটার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। করিম আংকেল তা দেখে বলল, " বড় ছেলে ও, বাড়িওয়ালার। নাম মনা। জন্ম থেকেই অটিস্টিক। তাও বাড়িওয়ালা স্বাভাবিক বাচ্চার মতই বড় করেছিল ওকে। এখন পাবনায় থাকে। পাগলাগারদে।"
মনা নামটা শুনে আমার কানে শো শো করতে লাগল। একটা অপার্থিব কণ্ঠে সুর করে কাউকে ছড়া আবৃত্তি করতে শুনলাম আমি যেন,
" মনা রে মনা,
কোথায় যাস...."
আমি আশেপাশে তাকালাম দেয়ালে। কিছু কাগজ ফ্রেমে বাঁধানো। খুব সুন্দর ছবি আঁকা সেখানে।
রফিক আংকেল বলে উঠল, " অটিস্টিক হলেও ছেলেটা খুব সুন্দর ছবি আঁকত।"
আমি ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। উপরের পারিবারিক ছবিটা রংতুলিতে আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রথমেই তা বোঝা যায় না। কারণ আঁকা ছবিতে মনা নিজের ,বাড়িওয়ালার আর ওর ভাইয়ের হুবহু চেহারা এঁকেছে। কিন্তু ওর মা আর বোনদের জায়গায় কার্টুনের মত মেয়েদের জামা পরা তিনটা হাঁসের ছবি এঁকেছে।
আমি হা করে তাকিয়ে থাকায় করিম আংকেল বলল, " মনার অটিস্টিক হবার একটা অন্যতম লক্ষণ ছিল। ও মেয়েমানুষদের হাঁস বলত। ওকে জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসত আর বলত, "মেয়েরা নাকি হাঁসের মত হাঁটে আর প্যাকপ্যাক করে।" এসব কথা বাইরের পার্টিতে বলায় বাড়িওয়ালা অনেকবার অপদস্ত হয়েছিল। যুবক হবার পর সমস্যাটা বেড়ে গিয়েছিল। আমরা উপর থেকে শুনতাম, প্রায়ই মনা চিৎকার করছে," আব্বা, হাঁসের মাংস খাব।" বাড়িওয়ালা হাঁস কিনে আনলে ভাংচুর করত বাসায়। ও এই হাঁসের মাংস খাবে না।"
আমি চমকে উঠে করিম আংকেলের দিকে তাকিয়ে বললাম," বলেন কি? এ তো ভয়ংকর কথা।"
করিম আংকেল বলল, " এজন্যই তো পাগলাগারদে পাঠিয়েছে তাড়াতাড়ি। শেষের দিকে নাকি ঘুমন্ত অবস্থায় বাড়িওয়ালার স্ত্রী, মানে ওর নিজের মায়ের চোখ উঠিয়ে ফেলতে গিয়েছিল। বাড়িওয়ালার আরেক ছেলে, খোকন, ও মাথায় বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছিল মনাকে। সেই থেকে পাগলাগারদে থাকে।"
গ্যাসের গন্ধ সেরাতের মত চলে গেল। আমি বাসায় ফিরে এলাম। কানে একটা অপার্থিব কণ্ঠের ছড়া ভাসছে,
"ঝিলের ধারে
ধরব হাঁস
হাঁস কি হবে?
চোখ নেব তার
দেখব পানিতে
তাও কি ভাসে....?"
সেরাতে আমি কোনো স্বপ্ন দেখলাম না। ব্যালকনিতে দোলনার আওয়াজও পেলাম না।
পরের রাতে আবারও গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেল সারা বিল্ডিংয়ে। আমি আর রফিক ও করিম আংকেল আবার গিয়ে দেখলাম, গ্যাসের সিলিন্ডারের চাবি খুলে গেছে। আমরা আবার লাগিয়ে এলাম।
পরের রাতেও গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেতে লাগল। সেদিন বাড়িওয়ালা আর আমাদের না পাঠিয়ে একজন মিস্ত্রীকে পাঠালো। মিস্ত্রী গ্যাসের সিলিন্ডারের নল, চাবি সব পরিবর্তন করে নতুন সিলিন্ডার আনল।
পরের রাতে আবার গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেতে লাগল। এবার সারা বাসায় একটু কানাঘুষা শুনতে পাওয়া গেল। আমার ফ্লাটে আগে যে মেয়েরা থাকত, তাদের নিয়েও একটা কথা শুনলাম। তারা নাকি প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখত।
এমনসময় বাড়িওয়ালা আমাকে ফোন দিল একটা। একটু ইতস্তত করে বলল, " শোভন, বাবা, তোমার আন্টির সেদিন গোছগাছ করার সময় তাড়াহুড়ায় আমাদের ব্যালকনির দেয়ালে, স্যুটকেস দিয়ে একটা ধাক্কা মেরেছিল। আমাদের ব্যালকনির দেয়ালে দরজা নাই, তা তো জানোই। ওই দেয়ালের উপর লেমোনেটিং করা একটা কাগজ পেরেক দিয়ে লাগানো ছিল। তুমি কি একটু দেখবে, বাবা? কাগজটা আছে কিনা?"
আমি বললাম, " কাগজে কি লেখা আংকেল?"
বাড়িওয়ালা আংকেল ইতস্তত করে বলল, " আরবিতে আয়াতুল কুরসি লেখা।"
আমি উপরে গিয়ে খুজে আসলাম। দেয়ালের নিচে, মেঝেতে, কোথাও আয়াতুল কুরসির কাগজটা দেখা গেল না।
এই ঘটনার পরেই আমি বুঝে গেলাম, এই বাসায় একটা ভৌতিক কিছু আছে। সেটা শুধু আমার স্বপ্নের থাকে না। এই বাড়িতে আসলেই থাকে। এই জিনিসটাই বাড়িওয়ালার ফ্লাটের গ্যাসের সিলিন্ডারের চাবি প্রতিদিন খুলে ফেলে।
আমি বাসা দেখা শুরু করলাম। বস্তিঘর হলেও চলবে, ব্যাপার না। একটা অপার্থিব কিছু আছে এই বাড়িতে। আর এটা বাড়িওয়ালার সাথে জড়িত। আর জড়িত তার বড় ছেলে অটিস্টিক মনার সাথে। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতে চাই না।
এমন একদিন আমি আমার অফিসে অবসর সময়ে বাসা ভাড়ার খবর নিতে স্থানীয় পত্রিকা পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে হঠাৎ একটা খবরে আমার চোখ আটকে গেল।
" ভূইয়ার ঝিলের চার গুম হওয়া কিশোরীর আদ্যোপান্ত আজও উদঘাটন হল না।"
আমি পড়তে লাগলাম। ঘটনাটা তিনবছর আগের। আমি তখনো এই শহরে আসি নি বলে জানি না। ভূইয়ার ঝিল নামে একটা দর্শনীয় স্থান আছে এই শহরে। তিনবছর আগে ঘুরতে গিয়ে সেখান থেকে চারজন কিশোরী মেয়ে গুম হয়ে যায়। একই সাথে না। কয়েকদিন পরপর। এই শহর সেসময় তটস্থ হয়ে পড়ে কয়েকমাসের জন্য। সবাই নিশ্চিত হয়ে যায়, এক সিরিয়াল কিলার ঘুরছে এই শহরে। কিন্তু সেই চার কিশোরীর পর আর এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। পুলিশও অনেক তদন্ত করে হাল ছেলে দেয়। মেয়েগুলোর কপালে কি হয়েছিল, আজও কেউ জানে না।
আমি সেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে যখন ফিরে এলাম, বাসায় তুমুল ঝগড়া চলছে। রফিক আংকেল, করিম আংকেল বাড়িওয়ালার সাথে সমানে ঝগড়া করছে। বাড়িওয়ালা হুট ক্রে এবার আজই এসে পড়েছে। আমাকে দেখে বাড়িওয়ালা চিৎকার করে উঠল, " এই ছেলে, তোমাকে আমার বাসার এক্সট্রা চাবির কথা বলেছি আমি। তুমি কি প্রতিদিন আমার বাসায় ওই চাবি দিয়ে ঢুকে গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে শয়তানি করো? কি উদ্দেশ্য তোমার, অ্যাঁ? আমার বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি প্রমাণ করতে চাও?"
আমি হা করে রইলাম কিছুক্ষণ। বললাম, "কি বলছেন এগুলো?"
বাড়িওয়ালা কোনো কথা না শুনে বলল, " তুমি বের হয়ে যাবা আমার বাসা থেকে এই মাসেই। শয়তানি আমার সাথে খাটবে না।"
রফিক আর করিম আংকেল একসাথে বলে উঠল, " আপনার বাসায় সমস্যা আছে সেটা আমরা জানি আগে থেকেই। শোভন যে ফ্লাটে থাকে ওই ফ্লাটে তিন বছর ধরে কেউ থাকতে পারে না। আপনার মনাকে পাগলাগারদে পাঠানোর পর থেকেই। আপনিও তো কত হুজুর আনলেন, ভুলে গেছেন? ছেলেটার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন কেন?"
বাড়িওয়ালা পাল্টা চেঁচাল, " আমার বাড়িতে কোনো সমস্যা নেই। হুজুর আমি এনেছিলাম মিলাদ পড়াতে। সংসারের সুখের জন্য। মনার জন্য দোয়া চাইতে। ও অসুস্থ। আমার বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি বানানোর চেষ্টা করবেন না, খবরদার...."
আমি চলে আসলাম আমার ফ্লাটে। আমার জিনিসপত্র গুছাতে শুরু করলাম। কাপড় চোপড় নিয়ে এক কলিগের বাসায় উঠব এই মাসটায়। আগামী মাসে নতুন বাসায় উঠার সময় মালপত্র নিয়ে যাব।
গোছগাছের এক পর্যায়ে রাতে হঠাৎ কারেন্টটা চলে গেল।। সাধারণত কারেন্ট যায় না এই বাসায় তেমন। আমার আলাদা চার্জার লাইট নেই। কারেন্ট গেলে মোমবাতি জ্বালাই।
সেই অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে আমি লাইটারটা বের করলাম। আর তখনই ক্যাচ ক্যাচ করে ব্যালকনিতে দোলনার শব্দ হতে লাগল।
আমি জায়গায় জমে গেলাম। চোখের সামনে ব্যালকনির দরজা একা একা খুলে গেল। আর আমার এতকাল ধরে দুঃস্বপ্ন দেখা অবয়বটাকে আমি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমি চিৎকার করতে যেতেই বিদ্যুতের মত ওটা আমার সামনে এসে নখর ওয়ালা থাবা দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল। আশ্চর্যের বিষয়, আমি অজ্ঞান হলাম না।
চোখের সামনে ভয়ংকর অবয়বটা ধোয়া হয়ে চারটা অংশে ভাগ হয়ে গেল। আমি এই অন্ধকারেও কিসের প্রভাবে যেন স্পষ্ট তা দেখতে লাগলাম। চারটা ধোয়া, চারটা পরমা সুন্দরী কিশোরীতে পরিণত হল। ওরা কাঁদছে।
"আমরা দুঃখী অনেক...."
একইসাথে বলে উঠল ওরা।
"আপনি স্বপ্নে আমাদের দুঃখের রূপ দেখেন। অনেক ভয়ংকর না দেখতে? আমাদের মুক্তি হচ্ছে না, বড্ড দুঃখ..."
আমি কাঁপতে লাগলাম। ওরা বলতে লাগল, " আমরা নাকি হাঁস, হাঁস তো পানিতে ভাসে, হাঁসের চোখ কি পানিতে ভাসে? এটা জানতেই ধরে আনল আমাদের।"
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, " কোথায়?"
ওরা আঙুল তুলে উপরে দেখাল। আমি অনেক কিছুই বুঝলাম, কিন্তু আবার বুঝলামও না। ওরা ফুঁপিয়ে উঠে বলল, " আমাদের চারজনের লাশ গুম করার আগে আপনার বাড়িওয়ালা বুঝতে পারে নি, তার ছেলেকে পাগলাগারদে নেওয়া দরকার। চোখ উপড়ে কত কষ্ট দিয়ে আমাদের মেরেছে। ছেলেকে তো ধরিয়ে দেয়ই নি, আমাদের গুম করে দিয়েছে...."
আমি বললাম, " উপরে?"
ওরা বলল, " মুক্তি দেবেন? আমাদের?"
আমি মাথা ঝাকালাম। ওরা বলল, " আপনি যদি আমাদের মুক্তি দেন, আপনার কিছুই হবে না। বুঝেছেন তো কিভাবে মুক্তি দিতে হবে?"
আমি চুপ করে রইলাম। ওরা চারজন আবার এক হয়ে গেল। সামনে আমি আবার সেই বিভীষিকাটাকে দেখতে পেলাম। ওটা ধোয়া হয়ে উপরে উঠে গেল।
তারস্বরে বাড়িওয়ালার আর্তচিৎকার শুনলাম আমি। আর গ্যাসের গন্ধ নাকে আসতে লাগল। অপার্থিব কণ্ঠে কেউ সুর করে পড়তে লাগল,
"মনা রে মনা...."
আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দোলনার আঙটার কাছে লাইটারটা নিলাম। তারপর কিসের প্রভাবে, কিসের প্ররোচনায়, আমি লাইটারটা যেন জ্বেলে দিলাম।
একটা ভয়ংকর শব্দ হল। ছিটকে পড়ার আগে আমি স্পষ্ট দেখলাম, বাড়িওয়ালার সিল করা ব্যালকনি ধ্বসে পড়ল। আর সাথে সিমেন্টে লুকানো চারটা পঁচা পুরোনো কঙ্কাল বের হল। ওগুলোর চোখ কি মরার আগে তোলা হয়েছে না পরে, তা বোঝার উপায় নেই।
অরিজিনাল পোস্ট: ৩০/১২/২০২৩ রাত ১২:৩০ টা।
দানব কথন উপন্যাসের অংশবিশেষ:
"রাত তখন ১ টা। একটা স্বাভাবিক রাতে এসময়ের আকাশটা দেখতে একটা কালো সামিয়ানার মত লাগত। আর সেই কালো সামিয়ানার গায়ে বুটিকের মত ডিজাইন করা থাকত বহুদূরের মিটমিটে তারকারাজি। নিস্তব্ধ শহরের নির্জন পথের এমন কোনো এক রাতের নিঃসঙ্গ কোনো পথিকের সঙ্গী হয়ে হয়ত একটা চাঁদও থাকত সেই সামিয়ানার ডিজাইনে। তবে আজ না... আজ রাতে না.... এই রাতটা স্বাভাবিক না, এই রাতটা হয়তো একটা দোষের রাত....
দোষের রাতের সাথেই কাকতালীয় মিল রেখে আজ রাতের আকাশের রঙটা লালচে সাদা। ছোটবেলায় সাহিল করিম তার বাবার কাছ থেকে শিখেছিল রাতের আকাশ চেনা। সকালের নীল আকাশ, রাতে তারার বুটিকওয়ালা কালো শামিয়ানায় রূপ নেয়। সকালের সাদা মেঘের আকাশ, রাতে একটা নিরাশাজনক কালো রঙ ধারণ করে। সকালের কালো মেঘের আকাশ, রাতে সাদা দেখায়। আর সকালে যে ঘন কালো আকাশ দেখলে মনে বৃষ্টির প্রত্যাশায় ফূর্তি না এসে ঝড়ের ধ্বংসের ভয় আসে, সে আকাশটা রাতে লালচে সাদা দেখায়।
লালচে সাদা আকাশের সাথে গোটা প্রকৃতি ভয়ংকর নিস্তব্ধ। না, রাত একটার স্বাভাবিক নিস্তব্ধতা না এটা। ওই যে, দোষের রাত.... একটা ভয়ংকর কোনো অভিশাপের প্রতিক্ষায় যেন গোটা প্রকৃতি অস্বাভাবিক নিশ্চুপ হয়ে আছে। প্রকৃতি যেন নিজের সন্তানদের মুখ চেপে ধরেছে, যাতে টু শব্দ না করে সন্তানেরা। বাইরে বর্গী এসেছে....
নিস্তব্ধ পথে সাহিল করিমের দ্রুত পায়ে চলার ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। সে অনেক চেষ্টা করেও শব্দটা কমাতে পারছে না। মাঝে মাঝে শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে, এপথে ও একা হাটছে না। পিছনে কেউ আছে। কেউ ওকে অনুসরণ করছে। ওর মনে একটা চরম আতংক ভর করেছে। ওর নিজের পদশব্দই এই আতংকটা চারগুণ করে দিচ্ছে।
সাহিল হাটতে হাটতে একটু পরপরই পিছনে তাকাচ্ছে। তারপর তাকাচ্ছে লালচে সাদা আকাশের নিকে। লালচে সাদা মেঘের উপরের আরেক স্তরে যেন আগুণের মত একটা বিদ্যুৎ চমক সরে গেল হুট করে। তবে চৈত্রমাসের ফেটে যাওয়া মাটির মত বিদ্যুতটা চোখে পড়ল না নিচের মেঘের স্তরের জন্য। আনমনে সাহিলের একবার মনে হল, লালচে আকাশের এই রূপ দেখেই কি গ্রীকরা বজ্রদেবতা জিউসের কল্পনা করেছিল?
সাহিল হাটতে হাটতেই ফোন হাতে নিল। একটা নম্বরে ডায়াল করে কানে নিল ফোনটা। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ধরল কেউ ফোনটা। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে একটা নারীকণ্ঠ ফিসফিস করে বলল, " কোথায় তুমি?"
সাহিলও কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল, " আমি পথে। আর দশ মিনিট লাগবে। তুমি দরজা ভাল করে আটকে রেখেছ তো? জানালাও? কেউ নক করেছিল?"
নারীকণ্ঠটা কাঁপতে কাঁপতে বলল, " না, কেউ নক করে নি। প্লিজ তুমি একটু তাড়াতাড়ি আসো। আমার হাত পা কাঁপছে।"
সাহিল বলল, " আসছি। ভেবো না। আমি কোথাও থামব না। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন দিলেই কেবল দরজা খুলবে। আমি খাবার নিয়ে আসছি। "
নারীকণ্ঠটা বলল, " আড়ালে আড়ালে হাঁটো। একদম রাস্তায় না। আশেপাশে দেখো। কোনো মানুষ দেখলেই সাবধান! দেখতে যেমনই হোক। "
সাহিল বলল, " আজ গোটা রাস্তায় একটাও রোডলাইট নেই। একহাত সামনেও কিছু দেখা যায় না। আমাকে কেউ দেখবে না।"
নারীকণ্ঠটা ফুঁপিয়ে উঠল, " কি বলছ এসব? আশেপাশের বাসাগুলোর জানালায় আলো আছে? শুধু কি রোডলাইট নেই? নাকি কোথাও ইলেক্ট্রিসিটি নেই?"
সাহিল বলল, " দুই একটা জানালায় আলো আছে। শুধু রোডলাইট নেই। কোথাও না। তোমার ওখানে কি অবস্থা?"
নারীকণ্ঠটা একটু জোরেই যেন ফোঁপাল, " আছে এখানে ইলেক্ট্রিসিটি। রোডলাইট নেই কেন? ওরা আবার রোডলাইট বন্ধ করে দেয় নি তো? ওরা জানে না তো, তুমি ওপথে আসছ? সাহিল....."
সাহিল কথাটা শুনে প্রচণ্ড ভয় পেল। আসলেই তো? এতটা পথের কোথাও রোডলাইট কেন নেই? ওরা কি....?
হ্যা, ওরা পারে.... ওরা সব পারে.... ওরা একজন বাবাকে ভোটে দাঁড়ানো ঠেকাতে, তার একমাত্র কিশোর ছেলেকে বাবাকে লাইভ দেখিয়ে জীবন্ত টুকরা করতে পারে। ওদের কথায় হাইকোর্ট সেই সন্তানকে খুনের দায়ে সেই বাবাকেই ফাঁসিতে ঝুলাতে পারে, ওরা একরাতের মধ্যে যে বিচারক ফাঁসির রায় দিয়েছিল, তাকে সহ পুরো বেঞ্চকে বুড়িগঙ্গায় চুবিয়ে মারতে পারে, একরাতের মধ্যে নতুন বিচারককে বসাতে পারে হাইকোর্টে। যাতে ওদের সম্পৃক্ততা কেউ কখনো না পায়.... হ্যা, ওরা পারে... এত গোপন কথা যে বের করে ফেলেছে, তাকে শেষ করে দিতে একটা এলাকা তো দূরে থাক, গোটা রাজধানী অন্ধকার করে দিতে পারে....
সাহিল বলল, " প্রিয়তা... তুমি ভেবো না.... আমার কিছু হবে না... আমি আসছি..."
বই: দানব কথন
লেখা: রায়হান মাসুদ
প্রকাশনা : চলন্তিকা
জনরা: থ্রিলার
পৃষ্ঠা: ১৪৪
পাওয়া যাবে, রকমারি, চলন্তিকা, প্রজ্ঞা বুকশপে। এছাড়া বইমেলায় ২০৩-২০৪ নং স্টলে।
"ছায়াসারথি"
লেখা: Raihan Masud Bipu
১.
আশপাশটা অন্ধকার। এবং জনমানবশূন্য। রাত দুইটার সময় যেমনটা আশাই করা যায়। আমি এসময়ই বের হতাম সবসময় রাস্তায়। আমার এই সময়টা ভাল লাগে। সেই ছোটবেলা থেকেই। আমি একজন অন্ধকার এবং নির্জনপ্রিয় মানুষ বৈ কি।
আমার মানুষের সঙ্গ একেবারেই অপছন্দ। আমি মানুষের কথা বা কোলাহল, মানবসৃষ্ট যানবাহনের হল্লা, একদমই সইতে পারি না। আসলে এটা কোনো ঢঙের কথা না। সস্তা এটেনশন পেতে এস্থেটিক কথা বলছি না আমি। বলছি না, আমি মানুষের চেয়ে প্রকৃতিকে বেশি ভালবাসি। অথবা মানুষ বেইমান হয়, প্রকৃতি না, ইত্যাদিও বলছি না।
এটা একটা মেডিকেল কন্ডিশন। আমি ছোটবেলা থেকেই মানুষের কথাবার্তা বা সাহচর্য সইতে পারতাম না। একেকটা মানুষ পাশ দিয়ে হেটে গেলেও কানে কথা বাজত। মানুষটা চুপ করে থাকলেও। মনে হত, আমি ওদের চিন্তা শুনতে পারছি।
আরো আছে, এসব কথাবার্তা বা আমার মতে অন্যের চিন্তাভাবনা চাইলে আমি বন্ধ করে দিতে পারি বলেও ভাবতাম। সমস্যাটা গুরুতর হল, যখন আমি স্পষ্ট অদেখা কারো কথা শুনতে শুরু করলাম। কেউ আমাকে অজ্ঞাত থেকে কিছু করতে স্পষ্ট নির্দেশ দিত। কিন্তু তাকে আমি দেখতে পারতাম না।
ঘটনাগুলো আমার সাথে ঘটতে শুরু করেছিল, আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি। আম্মু আমাকে আমার স্কুল থেকে নিতে এসেছিল শুনেছিলাম। স্কুল ছুটির আধাঘণ্টা আগে থেকে আম্মু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি গেট থেকে বের হয়ে আমার আম্মুর হাসিমাখা মুখটা শেষবার দেখতে পেয়েছিলাম। এরপরেই মোটরসাইকেলে করে দুইটা মুখোশ পরা লোক নেমে দাঁড়িয়েছিল আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসতে থাকা আম্মুকে ঘিরে। তারপর তাদেরই একজন একটা বড় রামদা দিয়ে আমার হাসিমাখা মুখের আম্মুকে সারাজীবনের জন্য অতগুলো লোকের সামনেই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল।
আমি এরপর থেকেই বদলে গিয়েছিলাম। লোকজন সইতে পারতাম না। পারতাম না গাড়িঘোড়ার শব্দও সইতে। কেউ কথা না বললেও মনে হত তাদের মনের কথা আমি বুঝতে পারছি। এক অযাচিত সুপারপাওয়ার পেয়ে গিয়েছিলাম যেন।
আম্মু মারা যাবার পর ছোট ফুফু আমাকে লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছিল। ছোট ফুফুর স্বামী তাকে তালাক দিয়েছিল। ছোট ফুফু এরপরে পুরুষজাতির উপর জেদ করে আর বিয়েই করে নি। কিন্তু পুরুষজাতির প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ বুকে নিয়ে থাকা আমার ছোট ফুফু কেন জানি আমার মত অস্বাভাবিক ছেলেটাকে বড্ড ভালবাসত। আর আমিও আমার আম্মু মারা যাবার পর থেকে একমাত্র ছোটফুফুর কাছে গেলেই ভয়ে কুকড়ে যেতাম না। মানুষের সঙ্গকে তীব্র অপছন্দ করলেও ছোটফুফুকে করতাম না। আর অন্যদের চিন্তাধারা শুনতে পারছি মনে করলেও, ছোটফুফুর চুপ করে থাকা অবস্থায় তার কাছ থেকে কোনো শব্দই পেতাম না।
একবার ছোটফুফু তার এক বান্ধবীর ছেলের জন্মদিনে সাথে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। সেদিনই সর্বপ্রথম আমি মানুষের কথিত চিন্তা শোনার বদলে একটা অজ্ঞাত অপরিচিত কণ্ঠ শুনেছিলাম।
" বাচ্চা কাচ্চা এত ট্যাও ট্যাও কেন করে? আমি একদমই সহ্য করতে পারি না।"
কোনো মানুষের চিন্তা শুনি বলে যে ভাবি, সাধারণত সেই কথাগুলো সেই মানুষগুলোর কণ্ঠের মতই হত। এই কথাটা আমার পরিচিত কোনো মানুষের কণ্ঠ বলে মনে হল না।
আমি কথাটা সেদিন আর শুনি নি।
ছোটফুফু জানত, আমার একটু সমস্যা আছে। আমি তাকে ছোটবেলায় অবুঝমনে বলতাম, "ফুফু, জানো? আমি না মানুষের মনের কথা শুনতে পারি।"
ছোটফুফু কষ্টের একটা হাসি দিত। চোখের সামনে মাকে খুন হতে দেখা বাচ্চাদের মানসিক সমস্যা থাকে এটা ফুফুকে এক শিশু কিশোর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বলেছিল।
সেদিন রাতে ছোটফুফুর পাশে ঘুমানোর সময় সেই অজ্ঞাত কণ্ঠটা আমাকে বলেছিল, " তোমার আম্মুকে তোমার পাপা খুন করেছে। নিজ হাতে।"
আমি ধড়মড়িয়ে উঠে গিয়েছিলাম। ভ্যা করে কেঁদে দিয়েছিলাম। প্রায়ই স্বপ্নে আম্মুকে দেখে কাঁদতাম। ফুফু তড়াৎ করে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরত। সেদিনও ধরল। আর বলত, " মাকে দেখেছিস স্বপ্নে, সায়ন?"। সেদিনও বলল।
আমি বলেছিলাম, " ওই কণ্ঠটা কথা বলল।"
ফুফু বলল, " কোন কণ্ঠটা, বাবা?"
আমি ফুপিয়েছিলাম, " যেই কণ্ঠটা বাচ্চাদের ট্যাও ট্যাও সইতে পারে না। আমাকে বুবাইয়ের জন্মদিনের পার্টিতে বলল।"
ফুফু হা করে তাকিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, " ও বলল,আম্মুকে নাকি পাপা খুন করেছে। নিজ হাতে। ওই মুখোশ পরে।"
ফুফু আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল, " কিসব বলছিস এগুলো? এই ছেলে!"
আমি নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
ছোটফুফু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। অবভিয়াসলি মানসিক রোগের ডাক্তার। ডাক্তার সব শুনল মন দিয়ে। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, " তোমার আম্মুর সাথে কি তোমার পাপার ঝগড়া হত?"
আমি মাথা ঝাঁকিয়েছিলাম।
ডাক্তার বলল, "মারামারি হত? তুমি দেখেছ?"
ছোটফুফু যেন গোপনে কিছু বলছে এমন ফিসফিস করে ডাক্তারকে বলেছিল, " এসব কি বলছেন আপনি? আমার ভাই ফেরেশতার মত লোক। এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?"
ডাক্তার পাত্তা দেয় নি। আমি আবারও মাথা ঝাঁকিয়েছিলাম।
ডাক্তার বলল, " ইশ! কি সুন্দর বাচ্চাটা।"
ফুফু বলেছিল, " কি বলছেন?"
ডাক্তার বলল, " এটা সিজোফ্রেনিয়া। বুঝেছেন? সব লক্ষণ মেলে। মাকে নিজ চোখে খুন হতে দেখে বেচারার সিজোফ্রেনিয়া হয়ে গিয়েছে। এখন মা বেঁচে থাকতে বাবার সাথে ঝগড়া হত, মারামারি হত। যেটা অনেক পরিবারেই স্বাভাবিক৷ ও সেসব ধরে কল্পনা করে নিচ্ছে ওর বাবাই বুঝি ওর মাকে খুন করেছে।"
ফুফু ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমাকে নিয়ে বাসায় এসেছিল। ফুফু জানত সিজোফ্রেনিয়া কি। আর্টিকেলে পড়েছে।ডাক্তারের মতে আমি স্থায়ীভাবে পাগল হয়ে যাব এই দুনিয়ায় যতদিন বাঁচি। এটা আমার ভবিতব্য। এখন ওষুধে যতটা পারে যদি সাহায্য করে!
সে রাতে প্রথম ডোজ ওষুধ খেয়ে হজমও হয় নি,এমন সময় সেই কণ্ঠটা আমার শুনেছিলাম।
" আমি সিজোফ্রেনিয়া রোগীর কল্পনা, না? ভোদাই ডাক্তার, যত্তসব! আচ্ছা, সায়ন, আমি যদি কল্পনা হই, তাহলে কিভাবে জানি? তোমার মাকে তোমার বাবা যেই রামদা দিয়ে খুন করেছে,সেটা তোমাদের দাদাবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে মাটি খুড়ে লুকিয়ে রেখেছে? হ্যা? হ্যা? বলো বলো!"
আমি গুমড়ে উঠে ফুফুকে বলেছিলাম," ফুফু, ও আবার কিসব বলছে।"
ফুফুকে এবার সবটা বললাম। এবার ফুফুর মুখমণ্ডলেএ কেন জানি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। সে নিজের মনেই যেন বলল, " নাইমা মারা যাবার পর তোর বাবা হুট করে গ্রামের বাড়ি গেল না? বলল, নাইমার কুলখানি দুইটা করবে? এখানে আর গ্রামে? কবরস্থানটা তো দেখা লাগে।"
ছোটফুফু আমাকে নিয়ে দাদাবাড়ি গিয়েছিল। আমাকে বাড়িতে রেখে নিজে কবরস্থানে গিয়েছিল উঠানে। আমি জানালা দিয়ে সব দেখছিলাম। ফুফু একটু খুড়ে ইয়া বড় একটা রামদা বের করেছিল। ওতে রক্ত তখনো মাখা।
আমার কানে একটা হাসির শব্দ এসেছিল, "ইইইইইইইইহিহিহিহিহিহিহুহুহুহুহুহাহাহহাহা....."
আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আম্মুর রক্তমাখা শেষ হাসিমুখটা মনে পড়ে গিয়েছিল।
স্বপ্নের মধ্যেই যেন ছোটফুফুর চিৎকার শুনেছিলাম, " মেরে ফেললি কেন? ডিভোর্স দিয়ে দিতি। তোর মত কুলাঙ্গার আমার ভাই...."
পাপার মত কারো কণ্ঠ বলেছিল, " সায়নের মামাদের কিসব নেতা ফেতার সাথে ওঠাবসা ছিল। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করব শুনেই আমাকে জেল খাটানোর হুমকি দিয়েছিল।ছোট শ্যালক তো অফিসে গিয়ে গালে থাপ্পড়ও দিয়েছিল। আর নাইমাও হুমকি দিচ্ছিল, বিয়ে করলে নারী নির্যাতন মামলা দেবে। এদিকে মেয়েটা ডানাকাটা পরী। বাপেরও অনেক টাকা। বিয়ে করলেই বিদেশে পাঠিয়ে দেবে...."
ফুফুর কণ্ঠ শুনলাম, " কুত্তার বাচ্চা,তোরে আমি নিজে পুলিশে দেবো। নিজের সুখের জন্য নিজের বাচ্চাকে এতিম করে দিলি। তা তুই বিদেশে যাবি, তোর মা-মরা বাচ্চার কি হবে?"
পাপা বলছিল," তুই নিজের ছেলের মত করে পালবি।"
ফুফু এরপর কি যেন বলছিল। পাপা চেঁচিয়েছিল, " খবরদার আপা! খবরদার!"
আমার জ্ঞান ফিরলে আমি আর ফুফুকে দেখি নি। আজ অবধি না। পাপা আমাকে দাদাবাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল শহরে। আমি বলেছিলাম, "পাপা,ছোটফুফু কই?"
পাপা বলেছিল," চুপ কর, হারামজাদা।"
কানের ভেতর সেই কণ্ঠটা বলেছিল, " ছোটফুফু পুকুরে ভাসে....."
২.
তো যা বলছিলাম। আমি অন্ধকার আর নির্জনতা ভীষণ ভালবাসি। মানুষের সাথে কথা বলি না তেমন। ওই যে, ওদের যেন চিন্তা শুনতে পাই?
ছোটফুফু পুকুরে আসলেই ভেসেছিল কিনা জানি না। তাকে কেউ কখনো খুজে পায় নি। পাপাও ডানকাটা পরীকে বিয়ে করতে পারে নি। আমাদের ঘরে আগুণ লেগে গিয়েছিল। আমি সম্ভবত স্কুলে ছিলাম। সব মনে নেই। আমার যে রোগ,তাতে সব মনে থাকার কথাও না। তবে বিয়ের আগেই ডানাকাটা পরী নাকি পাপার কাছে আমাদের বাসায় এসেছিল। পাপা আর আম্মুর রুমেই আগুণটা লেগেছিল। পাপা আর ডানাকাটা পরী ছাই হয়ে গিয়েছিল। সাথে আমার আম্মুর সব স্মৃতিও ছাই হয়েছিল।কেবল,সেই রক্তমাখা হাসিভরা মুখটা বাদে, সেটা আমার সিজোফ্রেনিক মস্তিষ্কের স্মৃতির হার্ডডিস্কে সারাজীবনের জন্য সেঁটে গিয়েছিল।
তবে ডাক্তারের ওষুধগুলো খেতে খেতে আস্তে আস্তে মানুষের সঙ্গের অপছন্দনীয় ভাবটা কেটে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে মানুষের চিন্তাগুলো জোরে শুনতাম না। আর অপরিচিত সেই কণ্ঠটাও আর শুনতাম না। তবে হ্যা, ওষুধ মাঝে মাঝে বাদ গেলে সমস্যা হত বেশ।
আমার অস্বাভাবিকতাটা তাই আর প্রকাশ পায় নি কখনো। আমিও আলোচনা করি নি আর। পাপা মারা যাবার আগে বড়ফুফু আর চাচাদের বলেছিল, ছোটফুফুর নাকি একটা প্রেমিক ছিল। সেটা জানতে পেরেই তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। দাদাবাড়ি বেড়ানোর ছলে আমাকে নিয়ে গিয়ে সেই প্রেমিকের সাথেই নাকি ছোটফুফু ভেগেছে। আর আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না সে।
ছোটফুফু নেই বলে আমার অস্বাভাবিকতাও কেউ জানত না। সেই পাগলের ডাক্তারটার আমার প্রতি একটা মায়া জন্মেছিল। সে নিজেই গোপনে যোগাযোগ করে আমাকে ওষুধ সেট করে দিত। বড় হয়ে বোঝার পর তো তাকেও আর প্রয়োজন পড়ে নি। নিজের ওষুধ নিজেই চিনতে পারতাম।
তাই বড়ফুফু যখন বাবা মা হারা এই আমাকে পালতে শুরু করল, আমি তখন একটা স্বাভাবিক ছেলে। আমি স্কুল থেকে কলেজে উঠি,ভার্সিটিতে উঠি। একা থাকি,কারণ মানুষ বেশি একটা পছন্দ না আমার। বন্ধু বান্ধব নেই।
একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে ভাল চাকরি হল। মানুষের সাথে যোগাযোগ কম।ভাল বেতন। আরামেই ছিলাম। বড়ফুফু আমাকে তখন একটা বিয়ে দিয়ে দিল।
আমি যেহেতু সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। এবং আমি মানুষ অপছন্দ করি,আমার মোটেও বিয়েতে রাজি হওয়া উচিত হয় নি। তবে সিজোফ্রেনিয়া বলেই কিনা, অথবা আমার শরীরে পাপার রক্ত বইছে বলেই কিনা, আমার নারীদেহের প্রতি আকর্ষণ ছিল অনেক। আমি বিয়েতে মোটেও বাধা দিলাম না।
সব ভালই যাচ্ছিল। একবছরের মধ্যে আমার একটা বাচ্চাও এসে গেল। আমার ছেলে, নাম অরণ্য। ও পৃথিবীতে আসার পর, আমার চরিত্রে আমূল একটা পরিবর্তন হল। আমার আম্মু খুন হবার আগে আমি যেমন ছিলাম, ঠিক তেমনই হয়ে যেতে লেগেছিলাম।
যেন মাঝের পুরোটাই একটা কল্পনা। অখ্যাত, বাজে কোনো লেখকের খেয়াল।
স্বাভাবিক জীবনে এমনভাবেই মজেছিলাম যে, ওষুধ বাদ পড়লেও কারো চিন্তা শুনতাম না। শুনতাম না কোনো কণ্ঠ।
এরপরেই সেই রাতটা এল। বহুদিন পর সেই কণ্ঠটা আবার শুনলাম।
" বউকে কালকে শপিংয়ে যেতে দিও না। ও শপিংয়ে যাবে না। ফেসবুকের এক পরিচিত ছেলের বাসায় যাবে। কালকের পর থেকে সব চলে যাবে। সুখ, শান্তি, স্বাভাবিক জীবন..."
আমি দুঃস্বপ্ন দেখার মতই জেগে উঠেছিলাম চিৎকার করে। আমার বউ আমার চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, " কি হয়েছে? বাজে স্বপ্ন দেখেছ?"
আমি আমার বউয়ের দিকে তাকিয়েছিলাম।আমার প্রতি কি যত্ন তার। কেমন মায়া মায়া চোখে তাকায়। একটা রোগের লক্ষণ ফিরে আসায় আমি এই মায়াকে পায়ে পিষতে পারি না।
আমি বলেছিলাম," কিছু না, আসমা। ঘুমাও।"
আমিও ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
সেদিন আসমা শপিংয়ে যাবার পর থেকেই সব বদলে গেল।
আমার আর অরণ্যের প্রতি আসমা আস্তে আস্তে উদাসীন হয়ে যেতে লাগল। আগের মত মায়া,বা যত্ন কিছুই দেখতাম না। আমার সাথে তো পরের ব্যাপার, অরণ্যের ছোট ছোট আবদারেও হুট করে ক্ষেপে যেত সে।
আমি তখনো ভেবে বসেছিলাম, এ আমার রোগেরই লক্ষণ। মাথায় একটা কথা ঢুকেছে। এখন আমার নিষ্পাপ বউয়ের প্রতি সন্দেহ জোরদার হয়েছে। আর্টিকেলে পড়েছিলাম, সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের সন্দেহবাতিকতা বেশি থাকে।
এরপরে একদিন আমি নিজে আসমাকে আরেকটা লোকের সাথে আমার বিছানায় দেখে ফেললাম। অরণ্য দরজার বাইরে ছিল। অরণ্য ঘরে থাকতেও ওদের মধ্যে কোনো জড়তা ছিল না।
আসমা বলেছিল," কাবিনে সই করেছি মানে এটা না যে, তোমার জন্য বাঁচব, তোমার জন্য মরব। "
আমিও চেঁচিয়ে বলেছিলাম, " তোকে ডিভোর্স দেবো আমি।"
আসমা বলতে নিয়েছিল, " দাও দাও..."
পাশ থেকে ওর প্রেমিক ওকে চিমটি কেটে মাথা নাড়িয়েছিল। তারপর আমাকে দেখে হাসিমুখে সিক্স প্যাক দেখাতে দেখাতে বের হয়ে গিয়েছিল।
ওরা প্রণয় থামায় নি। তবে আমাকে সরানোর একটা প্লান ছিল। আমার ব্যাংকে ভাল পরিমাণের টাকা ছিল। চাকরি আর উত্তরাধিকার সূত্রে। ডিভোর্স হলে মামলার হ্যাপা, সাথে টাকাও বেশি পাবে না। আসমার প্রেমিক চেয়েছিল সবকিছু। আমি মরে গেলে, বা সরে গেলে আমার স্ত্রী সব টাকা পাবে।
তবে ওরা আমাকে মারল না। একদিন বিকেলে বাসায় ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ বাইরের মানুষের হট্টগোলে ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, আমার বিল্ডিংয়ের নিচে লোকজনের জটলা দেখলাম। তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে জটলা ঠেলে গিয়ে দেখি, আমার অরণ্যের থেতলানো লাশ পড়ে আছে সেখানে।
আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরেছিল হাতকড়া হাতে। আমার স্ত্রী কেঁদে কেটে বলেছে, আমি নাকি অরণ্যকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে খুন করেছি।
আমাকে পুলিশ নিয়ে গেল। মিডিয়ায় জানোয়ার বাপ হিসেবে অসাধারণ কিছু আবেগঘন রিপোর্ট হল। আর এদিকে আমি আবার মানুষের চিন্তাগুলো যেন শুনতে শুরু করলাম। অনেক জোরে জোরে।
আসমার প্রেমিকটা সম্ভবত নামীদামী কেউ। সেদিন আমার স্ত্রীর সাথে ধরা পড়েও নির্ভয়ে আমাকে সিক্স প্যাক দেখিয়ে হেসে হেসে চলে যেতে দেখেই বুঝেছিলাম। ও পুলিশদের টাকাপয়সা দিয়ে আমাকে রিমান্ডে প্রচণ্ড অত্যাচার করিয়ে স্বীকার করাল, আমিই আমার অরণ্যকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলেছি।
আমার শুনানির তারিখ চলে এসেছিল। হঠাৎ একদিন আমার স্ত্রী আর ওর প্রেমিক দেখা করতে এল আমার সাথে। আমি তাকিয়ে রইলাম।
ভণিতা না করে আমার স্ত্রী সখেদে বলল, " ব্যাংক একাউন্ট খালি কেন? টাকা কোথায়?"
আমি মুচকি হেসেছিলাম।
আমার স্ত্রী গালাগাল শুরু করল। ওর সিক্স প্যাকওয়ালা প্রেমিক মিষ্টি হেসে বলল, " দাঁড়াও, পুলিশ দিয়েই বের করব।"
সেরাতে রিমান্ড ছাড়াই পুলিশ বেধড়ক পেটালো। আমি তখন সত্যটা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম। বললাম, " সব টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে একটা বাক্সে রেখেছি। তারপর বাক্সটা একজায়গায় পুঁতে রেখেছি। অরণ্য মারা যাবার বহু আগেই।"
পুলিশ কোথায় বাক্সটা রেখেছি সেই ঠিকানাটা আদায় করল। আমাকে অত্যাচার করে বের হবার সময় নাকি আমি অট্টহাসি দিয়েছিলাম। যদিও আমার তা মনে নেই। হাসতে হাসতে বলেছিলাম,
"ও বলেছে, গল্পের শেষ অংশে এসে গিয়েছি। তোদের সবার হাল পাপার মত হবে"
এরপর অনেককিছুই মনে নেই। এই যে, রাত দুইটায় এই নির্জন অন্ধকারে যে দাঁড়িয়ে আছি তা তো বললামই শুরুতে। শুনেছি,জেলখানায় আগুণ লেগেছে। সাধারণত যে পুলিশরা রিমান্ড নেয়। তার সবাই ছাই হয়ে গিয়েছে। পাপা আর সেই ডানাকাটা পরীটার মত।
একজন নারী আর পুরুষের হাঁফানির শব্দ পেলাম। ওরা কিছু একটা খুড়ছে পরিশ্রম করে। আমি আস্তে আস্তে সেখানে গেলাম। গর্তটা বেশ বড় হয়েছে।
সিক্স প্যাকওয়ালা বয়ফ্রেন্ড বলল, "কই? তোমার স্বামীর টাকার বাক্স কই? মিথ্যা বললে এবার পুলিশ দিয়ে লিঙ্গটা কেটে খাইয়ে দেব।"
আমি হাসতে লাগলাম হঠাৎ। এই প্রথম আমি আমার সেই অজ্ঞাত অপরিচিত কণ্ঠের মালিকের পরিচয় পেয়ে গেলাম। চিনতে পারলাম, সেই ছোটবেলা থেকে আমার যেই ছায়াসারথি আমার সাথে আছে, তাকে। সে আমিই। আমিও এভাবে কথা বলি।তবে এ আমার আরেক কণ্ঠ।
আমার গলা দিয়েই কণ্ঠটা বলল, " অরণ্যকে কে ছুড়ে মেরেছে ছাদ থেকে?"
সিক্স প্যাকওয়ালা প্রেমিক থোড়াই কেয়ার করে গর্ত থেকে উঠে আমার দিকে আসতে লাগল। হঠাৎ আমার চেহারার দিকে তাকাল সে, তারপর প্রচণ্ড এক আর্তচিৎকার দিয়ে গর্তেই পড়ে গেল। আমার স্ত্রীও আমাকে দেখল। সেও আর্তচিৎকার দিয়ে গর্তে পড়ে গেল।
আমি বললাম, " তুই। আসমা। তুই ফেলেছিস অরণ্যকে। ও তো আমার একার বাচ্চা ছিল না। তোরও ছিল। কিসের মোহে নিজের সন্তানকে এভাবে খুন করতে পারলি?"
ওদের আর্তচিৎকার থামছেই না। আমি হঠাৎ নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলাম, " কেন? ডানাকাটা পরীর লোভে তোর পাপা তোর আম্মুকে মেরেছিল না? সব জেনে পুলিশে খবর দেবে বলায় তোর ছোটফুফু, নিজের বোনকে কেটে পুকুরে ভাসিয়েছিল না? আপন বা রক্তের সম্পর্ক বলে কিছু হয় না। দিন শেষে লোভ, লোভই সব.... তাই নারে আসমা...."
আসমা আর ওর প্রেমিক চেঁচাচ্ছে। আমি বললাম, " হ্যা। লোভই সব। তবে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। পাপা আর ডানাকাটা পরীকে আমি পুড়িয়ে মারি নি? একটু আগে জেলখানার সবাইকে পুড়িয়ে মারি নি?"
আমার দুই হাত আসমা আর ওর প্রেমিকের কোদালে ঠেকল। আসমা আর্তচিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল মাত্র। আসমার প্রেমিক প্যান্ট নষ্ট করে ফেলল। আমি বললাম, " এদের লোভের বদলাও আমি নেব।"
কোদালে আমার দুহাতের জায়গায় চারহাত ধরল সেই হাতল। আমার দুই পায়ের জায়গায় চার পা। বুঝতে পারলাম। আমার ঘাড়ে আমার সাথে আরো একজনের মাথাও আছে সেখানে।
আমি আর আমার ছায়াসারথি আমাদের স্ত্রী আর ওর প্রেমিককে জ্যান্ত গর্তে মাটিচাপা দিতে দিতে বললাম, " আমরা...."
অরিজিনাল পোস্ট: ০৪/১০/২০২২ রাত ১২:৪৫
Dhaka
Be the first to know and let us send you an email when সাইকো ও থ্রিলার গল্পের সমাহার posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.