Choukidar - চৌকিদার

Choukidar - চৌকিদার Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from Choukidar - চৌকিদার, News & Media Website, Dhaka.

সকল শ্রেণি, পেশা, ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ অংশ নিয়েছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের লড়াইয়ে। তারা একই সাথে লড়েছে, প্রার্থনা করেছে ও রক্ত দিয়েছে। আমরা ‘চৌকিদার’ হিসেবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উদ্দীপনা ও মর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

"সবচেয়ে সামনে ছিল অমিত ভাই, উনার মাথায় হেলমেট ছিল।পুলিশ, ছাত্রলীগ উনার উদ্দেশ্যেই গুলি করছিল । আমি ভাই কে বারবার ডেকে ...
16/02/2025

"সবচেয়ে সামনে ছিল অমিত ভাই, উনার মাথায় হেলমেট ছিল।পুলিশ, ছাত্রলীগ উনার উদ্দেশ্যেই গুলি করছিল । আমি ভাই কে বারবার ডেকে বলছিলাম, “অমিত ভাই, পিছনে আসেন”। আমার ডাকার সাথে সাথে আর একটা ছেলে ছিল যাকে আমি চিনি না। অমিত ভাই ও তাকে চিনেনা। সেই ছেলেটাও আমার থেকে অমিত ভাইয়ের নাম শুনে অমিত ভাইকে ডাকছিল । ঠিক ওই সময়ই ছেলেটার মাথায় এসে গুলিটা লাগে । সাথে সাথেই সে স্পট ডেড হয়ে গেল। যে গুলিটা অমিত ভাইকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল, সেটা ওর মাথায় লেগে ওর মগজ পড়ে গেল রাস্তায়। "

১৭ তারিখ আমরা প্রথম নারায়নগঞ্জের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে প্রায় দুইশো থেকে আড়াইশো লোক জমায়েত হই । এদের মধ্যে সাধারণ ছাত্রের থেকে সাধারণ মানুষই বেশি ছিল। আমাদের অনেকগুলো গ্রুপ ছিল। একেক গ্রুপের দায়িত্ব এক এক জায়গায় ভাগ করে নিয়েছিলাম । আমার দায়িত্ব ছিলো ঈদগাহ মাঠে।

আমাদের আরেকটি টিম ছিল দুই নাম্বার রেলগেটের ঐ দিকে। আমি আমার এরিয়া থেকে তাদের সবাইকে চাষাড়া নিয়ে আসার জন্য গেলাম। সেখানে যেহেতু তেমন কেউই কারোর পরিচিত ছিলাম না তাই কেউই নিজে থেকে মূল পয়েন্টে আসতে চাচ্ছিল না বরং এড়িয়ে যাচ্ছিল। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুুঝিয়ে তাদেরকে চাষাড়া আনা হল৷ তবে এর মধ্যেই পুলিশ রাবার বুলেট আর গুলি চালিয়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দিল। গুলির জন্য আমাদের কয়েকজনের যে টিমটা ছিল, আমরা কালি বাজারের রোডের ঐদিকে দৌড়ে যাই। তখন আমরা পুলিশের থেকে খুবই কম দূরত্বে ছিলাম। পুলিশ তখনও আমাদের উপর প্রচুর গুলি আর টিয়ারশেল ছুড়ছিল।

ওই সময়ই দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট চাষাড়া থেকে কালিবাজারে যাওয়ার রাস্তায় পপুলার হাসপাতালের এবং পাম্পের সামনে আমার হাতের তালুতে, বুকে, কনুইয়ে রাবার বুলেট ও ছররা গুলি লাগে। রাবার বুলেটের ছিটাগুলিতে তেমন কোনো সমস্যা করেনি। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা বা ঝামেলা হইয়েছিল টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় । একটা টিয়ারশেল আমার মুখের সামনে এসে পড়ে। আমার মুখ একদম ঝলসে যায়। তখন আমি চোখে কোন কিছু না দেখতে পেয়ে অন্যদিকে দৌড়ে যাই। কিছুদূর গিয়ে মুখে পেস্ট লাগিয়ে আমি আবার আগের জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করি ।
দুপুর ১ টার দিকে ছাত্রলীগ, আওয়ামীলীগের একটা টিম চাষাড়া আসে । আসার পরে পুলিশের সাথে একজোট হয়ে আমাদের উপর আক্রমন করে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় , ওরা একবার আমাদের দিকে আসছে আর আমরা আবার ওদের দিকে যাচ্ছি এরকম ভাবেই বিকেল পর্যন্ত চলছিল। যেহেতু টিয়ারশেল এর ধোঁয়ার মারাত্মক প্রভাব পড়ে আমার উপর তাই আমি টিকতে না পেরে বিকেলে আসরের আজানের সময় বাসায় চলে আসি।

এরমধ্যে আরেকটা ব্যাপার ঘটল। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে দেয়াল লিখন করার সময় সেদিন ২ জনকে আটক করে পুলিশ। একজনের নাম রিয়াদ সাথে আরও একজন, ওনার নাম হাসান। পুলিশ সেখান থেকে আমার নাম যোগাড় করে। আমি যে বাসায় থাকতাম সেই বাসার লোকেশন এবং আমার নাম্বার পুলিশের কাছে চলে যায়। তো পুলিশ আমাকে বারবার কল দিচ্ছিল, হুমকি ধামকি দিচ্ছিল তখন। ফোন বাসা থেকে ধরলে সমস্যা, বাসার লোকেশন দেখাবে তাই আমি দূরে গিয়ে ফোন কাটতাম বা সিমটা বন্ধ করে রাখতাম।
এই ব্যাপারগুলোর জন্য যখন আমার গুলি লাগে তখন কোন হসপিটালে যেতে পারিনি। অনেক দূরে একটা পরিচিত ফার্মেসি ছিল ওখানে যেতাম। ঐ সময়ে সংঘর্ষের কারণে মাথাব্যথা,জ্বর এই সব কিছুর ট্রিটমেন্ট ওই ফার্মেসি থেকেই নিতাম। ওই ফার্মেসির ভাই আমার পরিচিত হওয়ার কারণে আমাকে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিত, টেক কেয়ার করত।

পরের দিন ১৯ তারিখ শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ থমথমে ছিলো ঐ সময়ে নারায়ণগঞ্জে আমাদের কোনো কমিটি বা সমন্বয়ক ছিলনা। ১৮ তারিখে ছাত্রলীগ খুব তৎপর থাকলেও ১৯ তারিখে সবজায়গায় ছিল বেশ থমথমে পরিবেশ। আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখেছি। অবজারভেশন করেছি যে কী করা যায়। শহীদ মিনারের সামনে বসে চা খাচ্ছিলাম ওই সময় ছাত্রলীগ গুণ্ডাদের কথা শুনছি । দেখলাম ওরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসে আছে। যেকোনো কিছুর জন্যই ওরা প্রস্তুত। সেখানে ছাত্রলীগ একাই ছিল কোন পুলিশ ছিল না। আমরা তখন উদ্যোগ নিলাম, যেহেতু শুক্রবার তাই নূর মসজিদের জুম্মার নামাজ পড়ে আমরা মিছিল বের করে চাষাড়ার দিকে যাব। তো যথারীতি নামাজের পরে আমরা বের হলাম মিছিল নিয়ে।
এখানে আন্দোলনের ক্ষেত্রে দুইটা ব্যাপার ছিল। আমাদের আন্দোলনে যারা ছিল তারা অনেকেই রাস্তায় ফাইট হলে ফাইট করছে না। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যারা ফাইট করছে তাদের সংখ্যা কম। আমাদের প্রয়োজন ছিল ফাইটার বা যারা ফাইট করবে। ফাইট করার মত ছিল মাত্র ৩০ থেকে ৪০ জন। এই কয়েকজন নিয়ে আমরা ছাত্রলীগের সাথে পারব না।
তখন সেখানে আমি স্লোগান ধরেছিলাম। আল্লাহর রহমতে আশেপাশে থেকে তখন অনেক মানুষ জমায়েত হয়, প্রায় ৩০০ জনের মত। আমরা তখন দুই নাম্বার গেট থেকে চাষাড়ার দিকে রওনা হলাম। দুপুরে তিনটায় ওখানকার ক্লাবের সামনে থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয় এবং সবাই যে যার মতন দূরে সরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই । সেদিন পুলিশ, ছাত্রলীগ, সাধারণ জনগণ এবং আমাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত।

এরপর ২০ তারিখ, শনিবার আবারো থমথমে অবস্থা। ওইদিন আন্দোলন বেশি হয়েছে শানারপাড়ার ঐদিকে। কারফিউ জারি করার পর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে চিটাগং রোডের ওইদিকে বেশ কয়েকজনকে স্পট ডেড করার খবর পাই ।
আমিসহ আমাদের কয়েকজনের টিমের ব্যপারটা এমন ছিল যে, যেখানে আন্দোলন থাকত আমরা ঐখানেই যাওয়ার চেষ্টা করতাম ।ব্যপারটা এমন না যে চাষাড়াতে আজকে কিছু নাই, তাহলে থাক। আমার টিমে ছিল- হুজ্জাতুল্লাহ,অমিত হাসান,সজিব হাসান,আসাদ এরকম কয়েকজন।

২১ তারিখ যোহরের নামাজের পর সেদিন আমরা বের হই সাইনবোর্ডের উদ্দেশ্যে। সাইনবোর্ড অব্দি পুরো রাস্তা ব্লক ছিলো। পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব সরাসরি আসল গুলি ফায়ার করতে করতে সাইনবোর্ডের দিকে আগাচ্ছিল। এভাবে তারা যখন আমাদের সামনাসামনি এসে পড়ে, আমরা মেইন রাস্তায় টিকতে না পেরে মসজিদের গলির মধ্যে ঢুকে যাই। গলিতে যাওয়ার পরে একজন বিজিবি সদস্যকে দেখলাম তখন আমাদের গলির মাথায় চলে আসে। তখন ঐ গলি বা রোডটার মধ্যে আমরা পাঁচজন ছিলাম যার তিনজনকে আমি চিনি না আর আমি ছিলাম, সাথে আমার বন্ধু হুজ্জাতুল্লা। সেখানে যে টিম লিডার ছিল সে বিজিবি সদস্যকে গালি দেয়। বিজিবি সদস্য লোকটা আমাদের থেকে ২৫-৩০ হাত দূরত্বে ছিল। ফলে সে গালিটা শুনতে পায়। তারপর দেখলাম সাথে সাথেই আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে ওখানেই বসে পরল। তখনই আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের দিকে গুলি করবে। আমরা এক সিরিয়ালে সবাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। যে গালি দিয়েছিল তার উদ্দেশ্যে গুলিটা করলেও গুলিটা তার গায়ে না লেগে ডান পাশে একটা ছেলে ছিল তার গায়ে লাগল। সে সেখানেই মারা যায়।

এরপরে ম্যাক্সিমাম দিনগুলোতে আমি ঢাকা যাই। বিশেষ করে ৪ তারিখের ঘটনা যদি বলি, ঐ সময় সবই তো ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। আমরা শাহবাগ থেকে বাংলা মোটরের দিকে হাঁটছিলাম। আমার মেইন উদ্দেশ্য ছিল আমি ফাইট করব। যে পয়েন্টে আমাদের পয়েন্ট শেষ এবং ছাত্রলীগ বা পুলিশের পয়েন্ট শুরু সেরকম একটা জায়গা বা পয়েন্ট খুঁজছিলাম। আমার সাথে ছিল অমিত ভাই, মনিরুজ্জামান ভাই, রায়হান ভাই। আরো দুই থেকে তিন জন ছিল, তাদের সাথে তেমন পরিচিত ছিলাম না।

যেতে যেতে বাংলা মোটরের ওইখানে পৌঁছে দেখি যে চারিদিকে ছাত্রলীগ। বিভিন্ন বাসার ছাদের উপর থেকে তারা গুলি করছে। তখনকার অবস্থাটা এরকম ছিল, আমাদের ছয় জন যাদের নাম বললাম আমাদের টিমটা ছিল আন্দোলনকারীদের থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাত দূরত্বে। আমরা ছিলাম সবচাইতে সামনে আর আমাদের থেকে খুব অল্প দূরত্বে ছিল ছাত্রলীগ এর বিশাল বাহিনী।

ওই সময়ের অনুভব করলাম এখন যদি আমরা দৌড় দিই তাহলে ওদের সাথে আমরা পারবো না। তাই আমরা সবাই এক পা এক পা করে পিছাতে লাগলাম আর তাদের উদ্দেশ্যে ইট পাটকেল ছুড়ছিলাম।

সবচেয়ে সামনে ছিল অমিত ভাই, উনার মাথায় হেলমেট ছিল।পুলিশ, ছাত্রলীগ উনার উদ্দেশ্যেই গুলি করছিল । আমি ভাই কে বারবার ডেকে বলছিলাম, “অমিত ভাই, পিছনে আসেন”। আমার ডাকার সাথে সাথেই আর একটা ছেলে ছিল যাকে আমি চিনি না। অমিত ভাই ও তাকে চিনেনা। সেই ছেলেটাও আমার থেকে অমিত ভাইয়ের নাম শুনে অমিত ভাইকে ডাকছিল । ঠিক ওই সময়ই ছেলেটার মাথায় এসে গুলিটা লাগে । সাথে সাথেই সে স্পট ডেড হয়ে গেল। যে গুলিটা অমিত ভাইকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল, সেটা ওর মাথায় লেগে ওর মগজ পড়ে গেল রাস্তায়।

তাই আমরা ব্যাকে আসলাম এরপর কিছুক্ষন থমথমে পরিবেশ তারপর আবারও সন্ধ্যা পর্যন্ত ফাইট চলল। সন্ধ্যায় সকল আন্দোলনকারীদের বাড়িতে ব্যাক পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও আমরা আর বাড়িতে যেতে পারিনি। ওখানে একটা হসপিটালে আমরা আটকা পড়ে যাই। আমরা হসপিটালের তিন তলায় ছিলাম। তিন তলা পর্যন্ত ছাত্রলীগরা এসে খুঁজে গেছে। আমরা একদম ফ্লোরের সাথে মিশে ছিলাম তাই আমাদের দেখেনি।ঐসময় হসপিটালের দারোয়ান আমাদেরকে পেছনের একটা গেট দিয়ে বের করে দেয়। এই দারোয়ান আমাদেরকে ধরিয়ে দিলে হয়তো ওই দিনই একদম শেষ। ওখান থেকেও আল্লাহর রহমতে বেঁচে ফিরি।

সর্বশেষ ৫ তারিখ ৫ তারিখে আমরা ছিলাম চানখারপুলে। আমরা যেই গলিতে ছিলাম সেখানে প্রচুর গুলি চলছিল।আমি,হুজ্জাতুল্লা ভাই সহ আরও কয়েকজন ছিলাম। ঐদিন আমাদের সাথে সেখানে প্রায় চারজন মারা গেছে। দুপুর একটার দিকে হুজ্জাতুল্লাহ ভাইয়েরও গুলি লাগে। হুজ্জাতুল্লাহ ভাই আমার আপন চাচাতো ভাই তাই তার গুলির খবর শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল আর হবেনা, আর পারবো না, আর কত মৃত্যুর খবর শুনতে হবে, তখন শরীরে আর কুলাচ্ছিল না। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লাম। নামাজের পর আবার বের হলাম। তারপর আবারো মনের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করলাম যে, নাহ এখান থেকে ফেরত যাওয়ার সুযোগ নাই। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবাদ পেলাম যে হাসিনা
মনের মধ্যে।

ঐদিনও বাসায় ফিরে শান্তি পাই নাই। কারণ হচ্ছে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার ব্যাপারটা যখন শুনি তো সেই সূত্রে রাত বারোটার দিকে বের হয়ে যাই এবং মন্দিরে পাহারায় কিছু কাজ করি।

বিভিন্ন ত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে অনেক মানুষের রক্তের বিনিময়েই আমাদের বিজয়। সেই শাশ্বত একটি কথাই বারবার মনে পড়ে - স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন কঠিন। রক্ষা করা যে কেনো কঠিন, এই ব্যাপারটা সবাই আমরা এখন বুঝতে পারছি খুব ভালোভাবেই। যাই হোক এই আন্দোলন কোনো সাধারণ আন্দোলন ছিল না। আর এই আন্দোলন থামবারও নয়। যতদিন অন্যায় নিপীড়ন থাকবে ততদিন এরকম আন্দোলন বারবার হবে ইনশাআল্লাহ।
চৌকিদারকে ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন,
মো: আরিফুল ইসলাম।
বয়স:২৬
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

(জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সংগ্রামের গল্পগুলো জানতে ও জানাতে চৌকিদারের সাথে যুক্ত হোন)
Choukidar

“মাটিতে পড়ে আমি নিজের পা ধরে দেখলাম, হাঁটুর নিচে হাড় বেরিয়ে এসেছে, গাঢ় লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিয়ে রক্ত চেপে ধরার চেষ্...
13/02/2025

“মাটিতে পড়ে আমি নিজের পা ধরে দেখলাম, হাঁটুর নিচে হাড় বেরিয়ে এসেছে, গাঢ় লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিয়ে রক্ত চেপে ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না। মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা—পা নড়াচড়া করলে রগ ছিঁড়ে যেতে পারে। নিজেই পরীক্ষা করলাম, গোড়ালি ঠিকভাবে কাজ করছে কি না। দেখলাম, এখনো কাজ করছে। তখন একটু স্বস্তি পেলাম—আলহামদুলিল্লাহ, হয়তো পা কাটতে হবে না।
এরপর একটা বিশাল বুলেটের মতো কিছু দেখে বুঝলাম, রাবার বুলেট নয়, আসল গুলিই লেগেছে! তখনই মাথায় আসল, এখন যদি দাঁড়াই, তবে হয় মাথায় নয়তো বুকে গুলি করবে। তাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম।
চারপাশে তখনও গুলি চলছে, টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। আমি শুয়ে ছিলাম প্রায় ৪-৫ মিনিট, তখন তিনজন ভাই ছুটে এল। একজন আমাকে ধরল, আরেকজন পাশ থেকে এগিয়ে এলো। হঠাৎ পুলিশ আবার গুলি চালালো, গুলিটা সরাসরি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের বুকে লাগল।
আমি জীবনে কখনো রক্তের গন্ধ চিনতাম না। সেদিন বুঝলাম—রক্তের আসল গন্ধ কেমন হয়। তার বুক থেকে রক্ত ছিটকে আমার ঠোঁটে লাগল। সেই উষ্ণ লবণাক্ত স্বাদ এখনও যেন জিভে লেগে আছে।“

৫ আগস্ট: লং মার্চের দিন সারা দেশ থেকে মানুষ লং মার্চে অংশ নিতে বের হয়। আমি ছিলাম সাভারের জাহাঙ্গীরনগর এলাকায়। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা দেখি, রাস্তায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন এবং একইসঙ্গে ঢাকামুখী মানুষের ভিড়।
জাহাঙ্গীরনগর থেকে এগিয়ে গেলে সাভারের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ওভারব্রিজের নিচে তখন পুলিশ অবস্থান নেয়। জনতার সঙ্গে সঙ্গে আমিও সামনে এগিয়ে যাই। হঠাৎই শুনতে পাই পুলিশের ফাঁকা গুলির আওয়াজ। প্রথমে মনে হল, হয়তো ভয় দেখানোর জন্য গুলি ছোঁড়া হচ্ছে, কিন্তু সামনে গিয়ে বুঝলাম যে, শুধু ফাঁকা গুলিই না, সরাসরি আমাদের দিকে মাঝে মাঝে শর্টগান ও বুলেটও ছোড়া হচ্ছে। তবে বেশি পরিমাণে নয়। হঠাৎ হঠাৎ টুকটাক কয়েকটা। মানুষ খুব একটা ভয় পাচ্ছিল না, নাকি পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিল, বুঝতে পারছিলাম না। এসবের মাঝেই হঠাৎ, একেবারে আকস্মিকভাবে, একজন পথচারী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, পুলিশ তার হাতে একটা গুলি করল প্রথমে, এরপর শুধু একটা না, ঠিক যতগুলো গুলি করলে আশেপাশের সবাই ভয় পেয়ে যাবে, ততগুলি গুলি করল, লোকটাকে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিল। তার চলাফেরা দেখে মনে হয়নি যে, সে লং মার্চে অংশ নিয়েছিল, অথচ তাকেও রেহাই দেওয়া হল না।
এমন দৃশ্য দেখে আশেপাশের সবাই থমকে যায়। পরিস্থিতি তখন থেকেই ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
আমরা বুঝতে পারছিলাম যে পুলিশ আমাদেরকে কোনভাবেই বাস স্টেশনের পরে আর আগাতে দিবে না।

আমাদের পরিকল্পনা ছিল, পুলিশ যখন বাজারের মাঝখানে চলে আসবে, তখন আমরা সামনে ও পেছন থেকে আক্রমণ করব। কিন্তু মনে হলো, পুলিশ আমাদের কৌশল বুঝে গেছে। তারা বাজারের ভেতরে না গিয়ে ব্রিজের দিকেই দাঁড়িয়ে রইল—না সামনে এগোচ্ছে, না পেছনে সরে যাচ্ছে।
আমরা নতুন পরিকল্পনা করলাম—পাঁচ-ছয়জন পুলিশের সামনে যাবে, আর আমি পেছনে থাকব, যাতে কেউ আহত হলে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যায়। কারণ আমি যেহেতু CRP তে পড়াশোনা করছিলাম তাই ফার্স্ট এই বা প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল জ্ঞানই আমার খুব ভালোভাবে রপ্ত করা ছিল। এছাড়া আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে ভাইয়াদের কথায় মানুষকে সাহায্য করব চিন্তা করে প্রাথমিক চিকিৎসার নানা জিনিসপত্র নিয়েই আমি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। তারপর পরিকল্পনামাফিক পাঁচ-ছয়জন সামনে গেল, কিন্তু তখন পুলিশ আর তেমন গুলি চালাচ্ছিল না, শুধু এক-দুইটা টিয়ার শেল ছুঁড়ছিল। আমরা ভাবলাম পুলিশ একটু নরম হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগরের কাছাকাছি এসে রেডিও কলোনির সামনে পড়তেই পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ শুরু করে বৃষ্টির মতন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল তখনই আক্রমণ করার। কারণ, আক্রমণ ছাড়া লং মার্চ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হত না। পাকিজা থেকে আক্রমণ করা সম্ভব হচ্ছিল না, তাই ভাবলাম, থানা স্ট্যান্ড থেকে যারা আসছে, তাদের সঙ্গে মিশে কিছু করা যেতে পারে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের ভাইয়েরা বললেন, আক্রমণ না করতে, কারণ তাদের কয়েকজন শিক্ষক পুলিশের সঙ্গে কথা বলবেন।
স্যাররা পুলিশের সঙ্গে কথা বললেন, কিন্তু সাধারণত পুলিশ তাদের কথা শোনে না। ঠিক তেমনটাই হল এইবারও। স্যাররা চলে যাওয়ার পরই পুলিশ জনশ্রোতের দিকে লক্ষ্য করে টিয়ার শেল এমনভাবে ছুঁড়তে শুরু করল যে, কেউ কোনো দিক খুঁজে পাচ্ছিল না। সবাই দিগ্বিদিক ছুটতে থাকল।

সেদিনের অন্যতম সমস্যা ছিল বৃষ্টি। সকালের দিকে ওই এলাকায় বৃষ্টি হয়েছিল। চারপাশ ভিজে ছিল, মাটি কাদামাখা, রাস্তা স্যাঁতসেঁতে। টিয়ার শেলের ধোঁয়া থেকে বাঁচতে আগুন জ্বালানোর কোনো সুযোগ ছিল না। তখন মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি কি সেদিন আমাদের বিপক্ষে ছিল? মাথা কাজ করছিল না। আশেপাশে এত মানুষের চোখ নাক জ্বালা দেখে শরীরে এত জিদ কাজ করছিল যে সেটা চোখের পানি হয়ে বের হচ্ছিল।সমস্যা সেদিন একটার পর একটা বাড়ছিল। বাতাস আমাদের দিকেই বইছিল, তাই দূর থেকে ছোড়া টিয়ার শেলের ধোঁয়াও সোজা আমাদের দিকেই আসছিল। চোখ জ্বালা করছিল, গলা শুকিয়ে আসছিল, নিঃশ্বাস নেওয়া দায় হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাই হোক ভয় পেলে চলবে না, এটাই মাথায় ঢুকিয়ে নিলাম। সামনে এগোতেই হবে।

পুলিশ একের পর এক টিয়ার শেল ছুড়ছিল, সব আমাদের দিকেই তাক করে। অনেকেই তখন পালিয়েছিল ভয়ে। কিন্তু আমরা যারা থেকে গিয়েছিলাম, শেলগুলো হাতে তুলে নিয়ে পুলিশের দিকেই ফিরিয়ে ছুড়তে লাগলাম। পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলোও ফিরে আসতে লাগল, যেন একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়তে চাইছিল সবাই। তখন দেশের অনেক জায়গা থেকে নানা রকম খাবার আসছিল তাই সকলেই বুঝল এই লং মার্চ যে করেই হোক এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে।

কিন্তু এরপর শুরু হলো রাবার বুলেট। প্রথম গুলিতেই মনে হলো, সবকিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। মানুষজন আবার ছুটোছুটি শুরু করল। চারপাশে চিৎকার, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, দম বন্ধ হয়ে আসা বাতাস। খারাপ লাগছিল, সবাই তো আন্দোলনের জন্য এসেছিল, তবে সবাই এভাবে চলে গেলে কীভাবে আমরা ধানমন্ডি পর্যন্ত পৌঁছাব? ঘড়িতে তখন ১:৩০। চারদিকে গুজব নাকি আসল খবর বোঝা যাচ্ছিল না। কেউ বলছিল সেনাপ্রধান বিবৃতি দেবেন, কেউ বলছিল শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমরা তখন মাঠে। নেটও নাই। মোবাইল বের করার মানসিকতাও ছিল না। মাথায় শুধু ঘুরছিল—এখন কী করা উচিত?
আমি তখন একটা হার্ডবোর্ড খুঁজতে থাকলাম, যাতে সুরক্ষিত থেকে সামনে এগোতে পারি। একজন ভাই দরজার মতো কিছু একটা নিয়ে এসেছিল, কিছুক্ষণ তার আড়ালে দাঁড়ালাম। কিন্তু পুলিশ থামছিল না, একের পর এক রাবার বুলেট ছুড়ছিল।

আমি কার্ডবোর্ড ধরে সামনে এগোতে শুরু করলাম। বিশ্বাস করলাম, পুলিশ হয়তো রাবার বুলেট মারবে, কিন্তু আসল গুলি মারবে না। কিছুদূর এগুতেই হঠাৎ ধপ করে পড়ে গেলাম। প্রথমে কিছু বুঝতেই পারিনি। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার পড়ে গেলাম। তখনও বুঝিনি—গুলিটা আমার পায়ে লেগেছে।

মাটিতে পড়ে আমি নিজের পা ধরে দেখলাম, হাঁটুর নিচে হাড় বেরিয়ে এসেছে, গাঢ় লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। হাত দিয়ে রক্ত চেপে ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না। মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা—পা নড়াচড়া করলে রগ ছিঁড়ে যেতে পারে। নিজেই পরীক্ষা করলাম, গোড়ালি ঠিকভাবে কাজ করছে কি না। দেখলাম, এখনো কাজ করছে। তখন একটু স্বস্তি পেলাম—আলহামদুলিল্লাহ, হয়তো পা কাটতে হবে না।

এরপর একটা বিশাল বুলেটের মতো কিছু দেখে বুঝলাম, রাবার বুলেট নয়, আসল গুলিই লেগেছে! তখনই মাথায় আসল, এখন যদি দাঁড়াই, তবে হয় মাথায় নয়তো বুকে গুলি করবে। তাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। চারপাশে তখনও গুলি চলছে, টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। আমি শুয়ে ছিলাম প্রায় ৪-৫ মিনিট, তখন তিনজন ভাই ছুটে এল। একজন আমাকে ধরল, আরেকজন পাশ থেকে এগিয়ে এলো। হঠাৎ পুলিশ আবার গুলি চালালো, গুলিটা সরাসরি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের বুকে লাগল। আমি জীবনে কখনো রক্তের গন্ধ চিনতাম না। সেদিন বুঝলাম—রক্তের আসল গন্ধ কেমন হয়। তার বুক থেকে রক্ত ছিটকে আমার ঠোঁটে লাগল। সেই উষ্ণ লবণাক্ত স্বাদ এখনও যেন জিভে লেগে আছে।

আমার ভেতরে তখন মৃত্যুভয় দানা বাঁধছিল। আমি তো এত রোগা, এতই দুর্বল, বাঁচার কোনো আশা দেখছিলাম না। আমাকে যারা ধরতে এসেছিল, তারা তো একে একে মরে যাচ্ছে। পিছনের দুজন আমাকে রেখে পালিয়ে গেল। তা নাহলে তাদের কেও আমার সাথে একই জায়গায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকতে হতো। তখন ভাবতে শুরু করলাম, শেষ সময় এসে গেছে। কী কালেমা পড়বো? কীভাবে তওবা করবো? মনের ভেতরে শুধু একটা কথাই ঘুরছিল—আজকের দিনটা কত পাপ করেছি, কত ভুল করেছি। আবার একপাশ থেকে মনে হচ্ছিল, আল্লাহ হয়তো বাঁচাবেন।

৭-৮ মিনিট কেটে গেল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল সব। আমার পা থেকে অনবরত রক্ত ঝরছিল, হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তখনই মনে হলো—আমার ব্যাগেই তো গজ আছে! কিন্তু ব্যাগ খুলতে পারছিলাম না। হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছি, অন্য হাতেও শক্তি নেই। ঠিক তখনই দুইটা মেয়ে ছুটে এলো। একজনের নাম মনে আছে—নাফিসা। পরে শুনেছিলাম, ৫ আগস্ট লং মার্চের দিন সেই মেয়েটাই গুলি খেয়ে মারা যায়।
ওরা আমাকে সরাতে পারছিল না, আমি নিজেই বললাম, "এভাবে হবে না। একজন আমার কোমর ধরেন, দুইজন দুই পা ধরেন।"

আমার রক্ত তখনও ঝরছে। হাত দিয়ে কতক্ষণ আটকে রাখা যায়? এক ভাইয়ের কাছ থেকে একটা গামছা নিয়ে দ্রুত গজগুলো বের করলাম, স্যাভলনের বোতল খুলতে পারছিলাম না, বাড়ি মেরে খুললাম। তারপর পুরো বোতলটা ক্ষতস্থানে ঢেলে দিলাম। তারপরই একটা রিকশায় তুলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রথমে ইবনে সিনা হাসপাতালে গেলাম, কিন্তু সেখানে কোনো ইমার্জেন্সি নেই। সুপার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, তারা সোজা বলে দিল—"আন্দোলনের আহত রোগী আমরা দেখব না।"

একটাই উপায় ছিল—এনাম মেডিকেল কলেজ বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু মেইন রোড দিয়ে গেলে পুলিশ থামিয়ে দেবে। তাই ছোটো গলিপথ ধরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রক্ত তখনো গড়িয়ে পড়ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। এমন সময় শুনলাম, আমার পেছনে থাকা আরেকজন গুলি খেয়েছিল, রিকশার মধ্যেই মারা গেছে। তখন সত্যিই মনে হলো—আমি কি আর বাঁচবো? সবাইকে তো মেরে ফেলছে কেউ কি বেঁচে ফিরতে পারবে? লংমার্চের কি হবে? দেশের কি হবে?

শেষ পর্যন্ত এনাম মেডিকেলে পৌঁছালাম। ইমার্জেন্সিতে আমিই প্রথম ঢুকেছিলাম। অবশেষে চিকিৎসা শুরু হল। পুরোটা সময় জুড়েই আমার জ্ঞান ছিল। একসময় জানতে পারি যে হাসিনা পালায় গেছে। সেনাপ্রধান বিবৃতি দিয়েছে। আমি অনেকক্ষণের জন্য ভুলে গেলাম যে আমি আহত।আশেপাশের সকলের এত আনন্দ এত খুশি দেখে কান্না করছিলাম। নিজের চোখের সামনে একজন মানুষকে তার কোন পরিচিত লোকের লাশ সামনে রেখে হাসতে দেখলাম শুধুমাত্র হাসিনা চলে যাওয়ার খবর শুনে। ওই লোকটাও আন্দোলনের আহত হওয়ার পরেই মারা যায়।

এইটাই আমার গল্প। এখন আমার পায়ের ভেতরে রড ঢুকানো, কোমর থেকে পা পর্যন্ত। হাঁটতে পারছি, আলহামদুলিল্লাহ। পুরোপুরি সুস্থ হতে এক বছর লাগবে, কিন্তু অন্তত বেঁচে আছি। সেদিনের সেই রক্তের গন্ধ, বারবার পড়তে থাকা শরীর, মানুষের আর্তনাদ—এসব আজও কানের মধ্যে বাজে। পুলিশের গুলিতে পড়ে থাকা লাশগুলোর কথা ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে। আমরা কি এই সব কিছু ভুলে যাব ? নাকি এই যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে? যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।

চৌকিদারকে ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন,
তাহসিন ইসলাম
শিক্ষার্থী, সাভার সিপিআর
ঘটনার স্থানঃ সাভার
তারিখঃ ৫ই আগস্ট, ২০২৪
(জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সংগ্রামের গল্পগুলো জানতে ও জানাতে চৌকিদারের সাথে যুক্ত হোন)
Choukidar

"যে আমাকে গুলিটা করে তাকে আমি চিনতে পারি যেহেতু আমি উত্তরার স্থানীয় এবং অনেক বছর ধরে এখানেই থাকি। সে ছিলো কাউন্সিলরের ছে...
12/02/2025

"যে আমাকে গুলিটা করে তাকে আমি চিনতে পারি যেহেতু আমি উত্তরার স্থানীয় এবং অনেক বছর ধরে এখানেই থাকি। সে ছিলো কাউন্সিলরের ছেলে। আমার মুখে-চোখে যখন গুলি লাগে তখন আমি ভাবছিলাম এখানেই হয়তো আমি মারা যাব। যেহেতু এর আগের দিনও আমি দেখেছি ছড়রা গুলি লাগার কারনে আমার পাশে একজন শহীদ হয়ে যায়। একথা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আমি সেখানে বসে পড়লাম এবং আমার পাশের একজন ভাইকে বললাম আমি তো মনে হয় আর বাঁচবো না, এটা বলে আমি কালেমা পড়া শুরু করে দেই। "


তারপর ২রা অগাস্ট ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ সফল করার জন্য আমরা উত্তরাতে জমায়েত হই। সেদিন আমরা ঘোষণা দেই জুমার নামাজের পর মিছিল বের করবো। জুমার নামাজ শেষ হলে খুব শান্তিপূর্নভাবে উত্তরা বি এন এস এর এখান থেকে মিছিল নিয়ে উত্তরা ১১ নাম্বার সেক্টরে যাই। উত্তরা ১১ নাম্বার সেক্টরে যাওয়ার পর আমরা দেখতে পারি সেখানে আগে থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, , যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ও পুলিশ বাহিনী মিলে ভারি অস্ত্র, শর্টগান,পিস্তল নিয়ে অবস্থান করছিল। আমরা সেখানে সংখ্যায় অনেক কম ছিলাম। মাত্র ২০০-২৫০ জনের মত হবে।
সম্ভবত কি কারনে জানিনা হয়তো আমাদের সংখ্যা কম দেখে তারা আমাদেরকে রাস্তা করে দেয় মিছিল নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য। মিছিল নিয়ে তাদেরকে পাস করে আমরা যখন সামনে চলে গিয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করছিলাম তখনই তারা আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা চিন্তাও করিনি এতো অল্প কিছু মানুষ যেখানে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি সেখানে তারা হামলা করবে। তারা অনবরত গুলি বর্ষন করে যাচ্ছিল। যেহেতু সেখানে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি এবং ছেলেরা কম ছিল তাই আমাদের পক্ষে এতো বড় বাহিনীকে মোকাবেলা করা সহজ হচ্ছিল না তারপরও আমরা আমাদের জায়গা থেকে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে তাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা করছিলাম।
এভাবে যখন ঘন্টাখানেক সংঘর্ষ চলছিল তখনি আমরা দেখতে পেলাম ৫-৬ জন অস্ত্রধারি পিস্তল,বন্দুক, শট গান নিয়ে আমাদের একদম সামনে চলে আসে এবং আমাদের লক্ষ্য করে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করতে থাকে।
আমি সহ বেশ কয়েকজন তখন সামনে ছিলাম, আমরা তাদের গুলি উপেক্ষা করে খালি হাতে তাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা করছিলাম।
একসময় তারা আমাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দিলে আমরা সবাই একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়ি। আমরা তখন গলির মুখে দাঁড়িয়েই ছিলাম, তাদের থেকে মাত্র ১০-১২ ফিট দূরে হবে, তখন তারা আমাদের লক্ষ্য করে আরেক দফা গুলি বর্ষন করে। সেবারই আমার মুখে ও শরীরে গুলি ছড়রা গুলি লাগে, সেসময় আমরা সাথে আরও একজন ছেলের গুলি লাগে।

যখন গুলিটা আমার মুখে এসে লাগে তখন খুব কাছ থেকে চোখের সামনে দিয়ে দেখলাম যে গুলি টা এসে লাগল। এখানে মজার বিষয় হলো, যে আমাকে গুলি টা করে তাকে আমি চিনতে পারি যেহেতু আমি উত্তরার স্থানীয় এবং অনেক বছর ধরে এখানেই থাকি। সে ছিলো কাউন্সিলরের ছেলে। আমার মুখে-চোখে যখন গুলি লাগে তখন আমি ভাবছিলাম এখানেই হয়তো আমি মারা যাব। যেহেতু এর আগের দিনও আমি দেখেছি ছড়রা গুলি লাগার কারনে আমার পাশে একজন শহীদ হয়ে যায়। একথা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আমি সেখানে বসে পড়লাম এবং আমার পাশের একজন ভাইকে বললাম আমি তো মনে হয় আর বাঁচবো না, এটা বলে আমি কালেমা পড়া শুরু করে দেই।
সেখানের আমার পূর্ব পরিচিত বেশ কয়েকজন ভাই আমাকে পাশের ছোট একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। যদিও সেখানে তেমন কোনো চিকিৎসা দেয়া যায়না কারণ সেটা খুব ছোট একটি ক্লিনিক ছিল। সেখানেও ছাত্র লীগ এসে হামলা চালানোর চেষ্টা করে কিন্তু ক্লিনিকের দরজা লাগিয়ে দেয়ার কারণে তারা উপরে আসতে পারে নাই।
তখন আমরা সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। ব্লাড মুছে আমাকে সেখানে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়। ক্লিনিক থেকে বলা হয়, "আপনার চোখে যেহেতু গুলি লেগেছে তাই আপনি এখানে থাকতে পারবেন না, আপনি ভালো কোনো হসপিটালে যান।"
সন্ধ্যায় যখন বৃষ্টি নামার কারণে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সেখান থেকে সরে গেলে আমি তখন ক্লিনিক থেকে বের হতে সক্ষম হই। আমাকে নেওয়ার জন্য এম্বুলেন্স আসলে সেই এম্বুলেন্সও ভাংচুর করা হয়।

যেহেতু আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমি বাটন ফোন কিনি তাই ফোনে নতুন সিম লাগানো ছিল। এজন্য বাসার কারও সাথেও কানেক্ট হতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন আমার গুলি লাগে সেটা কেউ একজন ভিডিও করে অনলাইন এ পোস্ট করে এবং ভিডিওটি বেশ ভাইরাল হয়ে যায়। সেই ভিডিও দেখে আমার বাসার লোকজন প্রথমে দেখতে পায় যে আমার গুলি লাগে। তখন আমার ছোট বোন আমার টেবিল থেকে নতুন সিমের নাম্বারটা খুঁজে বের করে কল দেয়। তো এভাবেই বাসা থেকে আমার সাথে রিচ করা হয়।

সন্ধ্যার সময় বাসা থেকে গাড়ি পাঠানো হলে আমাকে ক্লিনিক থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে তাৎক্ষণিক আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় আগারগাঁও চক্ষু বিজ্ঞান হসপিটালে। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে বলা হল, আপনার চোখের এক্স রে করাতে হবে। এক্স রের জন্য বের হয়ে দেখি সেখানেও পুলিশ উপস্থিত। হয়তো কোনোভাবে ইনফরমেশন গিয়েছে। উত্তরাতেও বিভিন্ন হসপিটালে তখন পুলিশ আমাকে খুঁজতে থাকে।
আমি কোনোভাবে তখন এক্স-রে করাই কিন্তু হসপিটালে আর ফেরত যেতে পারিনি।

এর মধ্যে আমার ইউনিভার্সিটি থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং ট্রিটমেন্ট নেওয়ার ব্যাপারে সেখান থেকে আমাকে সাহায্য করা হয়। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে যোগাযোগ করে সেখানে আমার চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ভার্সিটি থেকে বলা হয়, আমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ তারা বহন করবে। এভাবে পরের দিনই আমি ইসলামিয়া হসপিটালে চিকিৎসা পাই, সেখানে আমার অপারেশন হয় এবং আমার চোখ থেকে বুলেট অপসারণ করা হয়।
সে অবস্থায় আমরা আমাদের পরিচয় সেখানে কোনভাবেই বলতে পারিনি। হাসপাতালে আমার ইনজুরির কারণ এক্সিডেন্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। এছাড়া আমার ঠিকানাও চেঞ্জ করে দিয়ে আসতে হয়।

হসপাতালে গিয়ে আমি দেখতে পাই আমারই মতন অনেকে আহত হয়ে মুখোমুখি বসে আছে কিন্তু কেউ কাউকে জিগেশ করার সাহস পাইনি কিভাবে কী হলো।

বুলেটে আমার চোখের বেশ বড় একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় ত্রিশ টার মতন শেলাই দেয়া লাগে। চোখের রেটিনা এবং ব্রেইন এর সাথে যে নার্ভটা চোখের সাথে কানেক্টেড সেটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। যার কারনে এখনও আমার আমার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফিরে আসেনাই। চোখে নরমাল এর মতন দেখিনা যাস্ট আলোটা দেখি আরকি। ডাক্তার বলেছেন যেহেতু রেটিনা একদম ডিসফাংশন হয়ে যায় নাই তাই হয়তো আমি সামনে কিছুটা দেখতে পারি।

২ তারিখে গুলি লাগার কারনে পরবর্তী ৩ ও ৪ তারিখ আমি হসপাতালে ভর্তি থাকি। ৫ তারিখের বিজয় মিছিলেও সামিল হতে পারিনি। ৫ তারিখ খবর পাই যে হাসিনা পালিয়ে গেছে।

গত ডিসেম্বরে আবারও আমার সার্জারী হয়। ডাক্তার বলেছে আরও ৫-৬ মাস চোখ এভাবেই থাকবে। আমার চোখে সেলাই দিয় এক ধরনের সিলিকন জেল দিয়ে দেওয়া হয় যেনো চোখের শেপটা ঠিক থাকে। এখনও আমার চোখে জেল দেয়া আছে। ৫-৬ মাস পর জেলটা রিমুভ করা হলে বোঝা যাবে যে, ডান চোখে আদৌ দেখতে পাব কিনা। আপাতত শুধু ঝাপসাভাবে আলোর উপস্থিত বুঝতে পারি, আর তেমন কিছুই দেখতে পারিনা।


চৌকিদারকে ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন,
তাহমিদ হুজাইফা
শিক্ষার্থী, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি
ঘটনার স্থানঃ উত্তরা
তারিখঃ ২রা আগস্ট, ২০২৪
(জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সংগ্রামের গল্পগুলো জানতে ও জানাতে চৌকিদারের সাথে যুক্ত হোন)
Choukidar

“একসময় ওরা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে, আর আমরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলি। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। তারা ...
11/02/2025

“একসময় ওরা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে, আর আমরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলি। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। তারা সংখ্যায় কম ছিল, কিন্তু যেহেতু তাদের হাতে অস্ত্র ছিল, তাই সহজে তাদের সাথে পারা যাচ্ছিল না। তবে আমাদের সংখ্যা আবার বেশি থাকায় ওরাও পুরোপুরি আমাদের মোকাবিলা করতে পারছিল না।
এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যেই হঠাৎ ১১:৩০টার দিকে আমি গুলিবিদ্ধ হই। ঠিক কীভাবে গুলিটা আমার হাতে এসে লাগল, সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। আমি পেছনে সরে আসতে থাকি, আর আশপাশের কিছু মানুষ দৌড়ে এসে আমাকে ধরে। তারা আমাকে ধরাধরি করে মোড়ের দিকে আড়ালে নিয়ে যায়।“

সেদিন দিন ছিল আগস্টের ২ তারিখ। সেদিন আগে থেকেই সারা দেশে সকাল ১০টায় কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। আমি প্রায় ১০:৩০টার দিকে নিউ মার্কেট মোড়ে পৌঁছাই। স্বাভাবিকভাবেই হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী তখন মোড়ে অবস্থান করছিল। আমরা সকলে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিলাম, তবে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যেকোনো ধরনের হামলার জন্য।
প্রায় ১১টার দিকে হঠাৎ করেই সিটি কলেজের পাশ থেকে ছাত্রলীগ আমাদের উপর হামলা চালায়। শুধু ছাত্রলীগ নয়, যুবলীগের লোকজনও হামলায় অংশ নেয়। তাদের হাতে ছিল বড় বড় রামদা, ক্রীজ, ট্রিপল আর বন্দুক—মোটামুটি সব ধরনের অস্ত্র নিয়েই তারা আমাদের ওপর চড়াও হয়। কিন্তু আমাদের কাছে তেমন কিছুই ছিল না—শুধু রাস্তার ইট-পাথর আর কিছু লাঠি।

একসময় ওরা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে, আর আমরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলি। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। তারা সংখ্যায় কম ছিল, কিন্তু যেহেতু তাদের হাতে অস্ত্র ছিল, তাই সহজে তাদের সাথে পারা যাচ্ছিল না। তবে আমাদের সংখ্যা বেশি থাকায় ওরাও পুরোপুরি আমাদের মোকাবিলা করতে পারছিল না।

এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যেই হঠাৎ ১১:৩০টার দিকে আমি গুলিবিদ্ধ হই। ঠিক কীভাবে গুলিটা আমার হাতে এসে লাগল, সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। আমি পেছনে সরে আসতে থাকি, আর আশপাশের কিছু মানুষ দৌড়ে এসে আমাকে ধরে। তারা আমাকে ধরাধরি করে মোড়ের দিকে আড়ালে নিয়ে যায়।
মোড়ে তখন একটি মেডিক্যাল টিম ছিল। গুলিটা আমার ডান হাতের কবজির ওপর দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেখানেই আমার হাত ব্যান্ডেজ করা হয়। ব্যান্ডেজ শেষ হতেই দেখি, পেছন থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ সন্ত্রাসীদের পাহারা দিয়ে পুলিশ এসে উপস্থিত হয়।

পুলিশ এসেই তখন সরাসরি মোড়ের দিকে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। মুহূর্তের মধ্যে সবাই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। কেউ কোতোয়ালীর দিকে, কেউ কাজির দেউরির দিকে, কেউ আবার আমতলীর দিকে দৌড় দেয়। আমি প্রচণ্ড ব্যথার মধ্যে ছিলাম, তার ওপর কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় নিশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে উঠছিল। তবুও আমি আমতলীর দিকে দৌড়াই।

আমার হাতের যন্ত্রণা তখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, আন্দোলনকারীদের কেউ সহজে আশ্রয় দিচ্ছিল না। তখন আমি রিয়াজউদ্দিনের এক গলিতে ঢুকে যাই। আমার সঙ্গে তখন আরও দুজন ছিল। মোট তিনজন আমরা একটি ভবনের সিঁড়ির কোণে গিয়ে বসি।

সেখানে কিছু ব্যাচেলর মানুষ ছিলেন, যারা আমাদের দেখেই বলল, ‘তোমরা উপরে চলে আসো, এখানে নিরাপদ থাকবে।’ আমরা তাদের কথামতো এক ফ্ল্যাটের ভেতরে আশ্রয় নিই। পরবর্তী প্রায় পাঁচ ঘণ্টা—বিকেল ৫:৩০ পর্যন্ত আমরা সেই বাসায় অবস্থান করি। বাসার মানুষগুলো খুবই মানবিক ছিল, আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল।
তখন সেই বাসার গলিতে যতক্ষণ ছিলাম, ততক্ষণ সারাক্ষণই গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে মনে হচ্ছিল, শহরজুড়ে একটা যুদ্ধ চলছে। সেসময় আমরা কোনোভাবেই বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না।

প্রায় ৫:৩০টার দিকে খবর আসে যে সেনাবাহিনী নিউ মার্কেট মোড়ে এসেছে, আর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। ততক্ষণে আমার হাতের ব্যথা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ারও কোনো উপায় ছিল না। আতঙ্ক নিয়েই আমি বাসা থেকে বের হই এবং একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হই।

সরাসরি বাসায় গিয়ে আমি রক্তমাখা কাপড় বদলাই, একটু ফ্রেশ হই। তারপর কোনোভাবে প্রাইভেট ন্যাশনাল হাসপাতালে যাই। সেখানকার কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিল। আন্দোলনে আহত যত ছাত্রই সেখানে গিয়েছিল, সবাইকে তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ, আমার হাতে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। গুলি চামড়ার মধ্যে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নার্ভে লাগেনি, তাই স্থায়ী কোনো ক্ষতি হয়নি। হাতে দুটো ছিদ্র হওয়ায় ডাক্তাররা সেটা সেলাই করে দেয়। পুরোপুরি সুস্থ হতে ১৫ দিন সময় লেগেছিল এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
চৌকিদারকে ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন,
তাফহিমুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ১৯-২০ সেশন ।
ঘটনার স্থানঃ চট্টগ্রাম, নিউ মার্কেট মোড়
তারিখঃ ২রা আগস্ট, ২০২৪
(জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সংগ্রামের গল্পগুলো জানতে ও জানাতে চৌকিদারের সাথে যুক্ত হোন)

Choukidar

"আশেপাশে অনেক মানুষ তখন রাস্তায় আহত হয়ে পড়ে ছিল, গোলাগুলি সম্পূর্ণরূপে থামলে তাদেরকে সাহায্যর করার জন্য যেতে হবে এগুলো...
27/01/2025

"আশেপাশে অনেক মানুষ তখন রাস্তায় আহত হয়ে পড়ে ছিল, গোলাগুলি সম্পূর্ণরূপে থামলে তাদেরকে সাহায্যর করার জন্য যেতে হবে এগুলোই চলছিল সেসময় মাথায়। আমি পরিস্থিতি চেক কারার জন্য যখন মাথা উঁচু করলাম, ঠিক তখনই, আনুমানিক ১৫ ফুট দূরত্ব থেকে এসে আমার মাথায় একসাথে অনেকগুলো গুলি লাগে। আমি চিৎকার করে রাস্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু তখন আমাকে ধরার কেউ নাই। পাশেই টায়ারে আগুন জ্বলছিল। আমি চিৎকার করে ওটার পাশেই পড়ি। টের পাই যে আমার পা সেই আগুনেই গিয়ে পড়ছে । কিন্তু আমি তখনও বুঝতে পারিনাই যে আমার মোটামুটি পুরো অঙ্গটাই আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল।"




১৮ জুলাই, প্রথম দিন, যেদিন আমার গুলি লাগে, সেদিন আমি জোহরের নামাজ পড়ে বাসা থেকে বের হব চিন্তা করি। নামাজ পরে বের হয়ে আমি আমাদের জেলার বাবুরহাট শেখর চরে চলে যাই। সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় ছাত্র জনতার সেদিন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, সেখান থেকে ছাত্র ভাইদের সঙ্গে নরসিংদীর প্রধান সড়কে, মানে জেলখানা মোড়ে যাব। গেলামও । গিয়ে দেখি, সেখানেও অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, পায়চারা করছে। কিছুক্ষণ পর আমার মত অনেক ছাত্র জনতাকে দফায় দফায় আসতে দেখে পুলিশ আমাদের দিকে তেড়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত রাস্তার চারপাশে অনেক লোকজনের সমাগম হয়ে গিয়েছিল। পুলিশরা চিৎকার করতে করতে উপরে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে যাতে মানুষের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়। অনেক মানুষই ফাঁকা গুলির শব্দে ভয় পেয়ে একজন দুজন করে সরে যাচ্ছিল। এটা দেখার পরে পুলিশ যখন বুঝতে শুরু করল তাদের ফাঁকাগুলির শব্দ মানুষ ছত্রভঙ্গ হচ্ছে, তৎক্ষণাৎ তারা আমাদের দিকে তাক করে একেবারে গুলি ছোঁড়া শুরু করে। একটা কথা বলে রাখা ভাল, তখন এত মানুষের জন সমাগমেও সকলেই নিরস্ত্র ছিল। কারো কারো হাতে কিছু ছোট লাঠির মতোন ছিল, এছাড়া অন্য কিছুই ছিল না।
সবার ছোটাছুটির মধ্যে আমি পুলিশের দিকে একবার তাকালাম, তাদের দৌড়ে আসতে দেখে আমিও ভয় পেলাম। জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে যাব ঠিক ঐ সময়ই আমার এক ক্লাসমেটের নাকের পাশে এসে দুটো গুলি লাগে। আমি ও আমার সাথে আসা আমার ক্লাসের আরো দুজন তাকে ধরতে যাই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার অবস্থা গরুতর হতে লাগলো। প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি পাশেই, তখন সেই অবস্থাতেই আরেকজনকে গুলি করে একদম ঝাঁঝরা করে ফেলে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। আরও অনেকেই আহত হয়। গুলি করতে করতে অনেক পুলিশ সামনের দিকে চলে যায়। পরে দেখি, আরেকটি গাড়ি আসে পুলিশের, পাশের গলিতে ঢোকে। ওই গলির মুখের এক দোকানে তিনজন ছিল , তাদের তিনজনকেই গুলি করে। মানে সামনে কেউ গেলেই গুলি চালাচ্ছে। এক সেকেন্ডও তাদের গুলি করা থামে নাই।
আরেকটা ছেলে, ১৫ থেকে ১৬ বা সর্বোচ্চ ১৭ বছরের, ৫০-৬০ গজ দূরত্বে ছিল রাস্তার পূর্ব পাশে। আমি ছিলাম পশ্চিম পাশে, আর পুলিশও পূর্ব পাশে ছিল। পুলিশ ওই ছেলেটাকে বুকের নিচে কমপক্ষে ১০/১২ রাউন্ড গুলি করে। পুরো পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠেছিল কয়েক মিনিটের মধ্যেই । ভিতরের রাস্তা দিয়ে অন্য আরেক ক্লাসমেটের সাথে আহত বন্ধুকে পাঠিয়ে দেই। আমি সামনে এগোই মুল রাস্তা ধরে। আমার সামনে একটা স্টিলের আলমারি ছিল, কোনো এক ওয়ার্কশপের। আমি সেটার কাভারে নিয়ে ছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, গুলি করছে কিনা আর। আশেপাশে অনেক মানুষ তখন রাস্তায় আহত হয়ে পড়ে ছিল, গোলাগুলি সম্পূর্ণরূপে থামলে তাদেরকে সাহায্যর করার জন্য যেতে হবে এগুলোই চলছিল মাথায় সেসময়। আশেপাশে অনেক মানুষ তখন রাস্তায় আহত হয়ে পড়ে ছিল, গোলাগুলি সম্পূর্ণরূপে থামলে তাদেরকে সাহায্যর করার জন্য যেতে হবে এগুলোই চলছিল সেসময় মাথায়। আমি পরিস্থিতি চেক কারার জন্য যখন মাথা উঁচু করলাম, ঠিক তখনই, আনুমানিক ১৫ ফুট দূরত্ব থেকে এসে আমার মাথায় একসাথে অনেকগুলো গুলি লাগে। আমি চিৎকার করে রাস্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু তখন আমাকে ধরার কেউ নাই। পাশেই টায়ারে আগুন জ্বলছিল। আমি চিৎকার করে ওটার পাশেই পড়ি। টের পাই যে আমার পা সেই আগুনেই গিয়ে পড়ছে । কিন্তু আমি তখনও বুঝতে পারিনাই যে আমার মোটামুটি পুরো অঙ্গটাই আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল।
৮-১০ মিনিট সেখানে ওই অবস্থাতেই পড়েছিলাম। পুলিশ যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনো রাস্তায় আমি সহ অন্যান্য যারা আহত বা নিহত অবস্থায় পড়েছিল ঠিক তাদেরকে তাক করে তারা আরো কয়েক রাউন্ড গুলি করে। হয়তো তাদের উদ্দেশ্য ছিল সকলের মৃত্যু নিশ্চিত করা। টায়ারের আগুনে যখন আমার পা পুড়ছিল সেই অবস্থাতেই তাদের করা গুলিতে আমার চোখে দুটোতে আর মাথায় আবার গুলি লাগে। পরে, পরিস্থিতি মানুষের একটু কন্ট্রোলে আসলে, রাস্তা থেকে আহত নিহত সাহায্যের জন্য ছাত্র জনতা এক হয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় সদর হাসপাতালে। ভ্যানগাড়িতে করে। সেখানে স্যালাইন দিয়ে আমাকে পাঠানো হয় আরেক মেডিক্যালে। রাত ৮টায় সেখানে পৌঁছাই । আমার ধারণা রাত ১১টা বাজে তখনো পর্যন্ত কোন চিকিৎসা আমি পাইনি। তারপর আমার ফুফাতো ভাই আসে, তখন আমাকে ঢাকায় কাকরাইলে ইসলামী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার সিটি স্ক্যান করা এবং নার্সসহ অন্যান্য যেইসব ডাক্তাররা ছিল তারা আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। তবে সেখানেও সেদিন বড় কোনো ডাক্তার আসতে পারেনি গোলাগুলির কারণে। সেদিন হেলিকপ্টার দিয়েও তো গুলি চালাচ্ছিল । ড
সেখান থেকে ঐদিন ডাক্তার আমাকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে যেতে বলেন। বলা হয়, চোখের অবস্থা বেশ একটা ভালো না সেটার চিকিৎসা আগে করা দরকার। চক্ষুবিজ্ঞানে গেলে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।,তবে নিশ্চিতভাবে বলে না, ঠিক হবে কি হবে না হবে। এরপর জরুরি ভিত্তিতে চোখের ছিদ্রগুলো সেলাই করে ব্লক করা হয় এবং বলে এক সপ্তাহ পর আবার আসতে। আমি এক সপ্তাহ পরে আবার যাই তখন তারা আমাকে বলে আমার অপারেশন করা লাগবে তাই আমাকে ভর্তি রাখে। তারপর ঐ হাসপাতালে একদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী যায়, তিনি গিয়ে সব বেড চেক করেন, রোগীদের দেখেন। বলেন –“সবাই তো ঠিকই আছে”, “রাস্তায় নামার আগে ভাবে নাই কেন”, “বাড়িতে পাঠায় দাও, দ্রুত সব বেড খালি করে দাও।“- ইত্যাদি। কিন্তু পরে দেখি মিডিয়ার সামনে আমাদের জন্য কাঁদতেছে।
যাই হোক এক সপ্তাহ পরেও আমার কোন অপারেশন করা হয়নি। আমাকে একবার এক ওষুধ দিয়ে “দুইদিন পরে আসেন”, “পাঁচ দিন ভর্তি থাকেন”,” সেদিন অপারেশন করব, ওইদিন অপারেশন করব”, “এই ওষুধ লাগান, ওই মলম লাগান”- এসব বলে বলে অনেক ঘুরাইসে ।
এমন করে করে আগস্ট মাস শেষ হয়ে গেছে কিন্তু চোখের অপারেশন আর হয়নি। এই নিয়ে অনেক সাহায্যের জন্য দৌড়াইছি অনেক হাসপাতালে গেছি ঢাকা ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালেও গেছি। কোথাও কোনো সাহায্য পাই নাই। শেষে চক্ষু বিজ্ঞান থেকেই জানানো হয় যে আমি কোনো চোখে আর কোনোদিন দেখব না। আমার কথা হচ্ছে যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তারা কেন আমাকে এতদিন এত কথা বলল। তারা ঠিক টাইমে আমার অপারেশন করলে আজকে আমার চোখটা ঠিক থাকতো। আর যদি প্রথম থেকেই আমার চোখের অবস্থা এমন হয় যে আমি আর কখনোই দেখবো না তাহলে কেন আমাকে এত ভর্তি থাকতে হলো। আমার তো সেই আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। তবুও জীবনটা ঠিক করার আশায় নিজের সকল সম্বল আমি ঢেলে দিছি। এখন আমি একটা জড় বস্তুর মত ঘরে পড়ে আছি। কেউ কোনদিন কোন সাহায্যের জন্য আগায় আসে নাই। কেউ জিজ্ঞেস করে নাই কেমন আছি। কি অবস্থা আমাদের।
আমার মাথার ভেতর এখনো সাত থেকে আটটার মতো বুলেট আছে একদম ব্রেইনের পাশে। চল্লিশটার মত শুধু চামড়ার নিচেই আছে, এগুলাও এখনো বের করা হয়নি। এসবের খবর কেউ রাখে না, কেউ জিজ্ঞেস করে না।
এখন নিজেকে হতভাগ্য মনে হয়। আমি সেই হতভাগ্য গুলোর মধ্যে একজন যে না পাইলো শহীদের মর্যাদা না পাইলো একটা ন্যূনতম জীবন। কেন সেদিন বেঁচে গেছিলাম আমি, এইটাই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। এমন অনেক মানুষের সাহায্য পাইতে দেখলাম সাবাশী পাইতে দেখলাম যারা কোনদিন রাস্তায় নামে নাই, শুধু বিজয় মিছিলে উল্লাস করছে। আর আমরা না খেয়ে মরে যাচ্ছি। এটা তো কোনো জীবন না। এটা কোনো জীবন হইতে পারে না। আমাদের গল্প কেউ শুনতে চায় না আমাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। আমাদের এই ত্যাগের কোন দাম নাই, আমাদের কষ্টের আর আমাদের পরিবারের না খেয়ে থাকা বেলাগুলার কোনো দাম নাই।


চৌকিদারকে ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন,
মোঃ আজিজুল হক
শিক্ষার্থী, কল্যানপুর ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা
ঘটনার স্থানঃ নরসিংদী
তারিখঃ ১৮ জুলাই, ২০২৪


(জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সংগ্রামের গল্পগুলো জানতে ও জানাতে চৌকিদারের সাথে যুক্ত হোন)

©️Choukidar

Address

Dhaka

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Choukidar - চৌকিদার posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share