
16/02/2025
"সবচেয়ে সামনে ছিল অমিত ভাই, উনার মাথায় হেলমেট ছিল।পুলিশ, ছাত্রলীগ উনার উদ্দেশ্যেই গুলি করছিল । আমি ভাই কে বারবার ডেকে বলছিলাম, “অমিত ভাই, পিছনে আসেন”। আমার ডাকার সাথে সাথে আর একটা ছেলে ছিল যাকে আমি চিনি না। অমিত ভাই ও তাকে চিনেনা। সেই ছেলেটাও আমার থেকে অমিত ভাইয়ের নাম শুনে অমিত ভাইকে ডাকছিল । ঠিক ওই সময়ই ছেলেটার মাথায় এসে গুলিটা লাগে । সাথে সাথেই সে স্পট ডেড হয়ে গেল। যে গুলিটা অমিত ভাইকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল, সেটা ওর মাথায় লেগে ওর মগজ পড়ে গেল রাস্তায়। "
১৭ তারিখ আমরা প্রথম নারায়নগঞ্জের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে প্রায় দুইশো থেকে আড়াইশো লোক জমায়েত হই । এদের মধ্যে সাধারণ ছাত্রের থেকে সাধারণ মানুষই বেশি ছিল। আমাদের অনেকগুলো গ্রুপ ছিল। একেক গ্রুপের দায়িত্ব এক এক জায়গায় ভাগ করে নিয়েছিলাম । আমার দায়িত্ব ছিলো ঈদগাহ মাঠে।
আমাদের আরেকটি টিম ছিল দুই নাম্বার রেলগেটের ঐ দিকে। আমি আমার এরিয়া থেকে তাদের সবাইকে চাষাড়া নিয়ে আসার জন্য গেলাম। সেখানে যেহেতু তেমন কেউই কারোর পরিচিত ছিলাম না তাই কেউই নিজে থেকে মূল পয়েন্টে আসতে চাচ্ছিল না বরং এড়িয়ে যাচ্ছিল। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুুঝিয়ে তাদেরকে চাষাড়া আনা হল৷ তবে এর মধ্যেই পুলিশ রাবার বুলেট আর গুলি চালিয়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দিল। গুলির জন্য আমাদের কয়েকজনের যে টিমটা ছিল, আমরা কালি বাজারের রোডের ঐদিকে দৌড়ে যাই। তখন আমরা পুলিশের থেকে খুবই কম দূরত্বে ছিলাম। পুলিশ তখনও আমাদের উপর প্রচুর গুলি আর টিয়ারশেল ছুড়ছিল।
ওই সময়ই দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট চাষাড়া থেকে কালিবাজারে যাওয়ার রাস্তায় পপুলার হাসপাতালের এবং পাম্পের সামনে আমার হাতের তালুতে, বুকে, কনুইয়ে রাবার বুলেট ও ছররা গুলি লাগে। রাবার বুলেটের ছিটাগুলিতে তেমন কোনো সমস্যা করেনি। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা বা ঝামেলা হইয়েছিল টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় । একটা টিয়ারশেল আমার মুখের সামনে এসে পড়ে। আমার মুখ একদম ঝলসে যায়। তখন আমি চোখে কোন কিছু না দেখতে পেয়ে অন্যদিকে দৌড়ে যাই। কিছুদূর গিয়ে মুখে পেস্ট লাগিয়ে আমি আবার আগের জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করি ।
দুপুর ১ টার দিকে ছাত্রলীগ, আওয়ামীলীগের একটা টিম চাষাড়া আসে । আসার পরে পুলিশের সাথে একজোট হয়ে আমাদের উপর আক্রমন করে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় , ওরা একবার আমাদের দিকে আসছে আর আমরা আবার ওদের দিকে যাচ্ছি এরকম ভাবেই বিকেল পর্যন্ত চলছিল। যেহেতু টিয়ারশেল এর ধোঁয়ার মারাত্মক প্রভাব পড়ে আমার উপর তাই আমি টিকতে না পেরে বিকেলে আসরের আজানের সময় বাসায় চলে আসি।
এরমধ্যে আরেকটা ব্যাপার ঘটল। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে দেয়াল লিখন করার সময় সেদিন ২ জনকে আটক করে পুলিশ। একজনের নাম রিয়াদ সাথে আরও একজন, ওনার নাম হাসান। পুলিশ সেখান থেকে আমার নাম যোগাড় করে। আমি যে বাসায় থাকতাম সেই বাসার লোকেশন এবং আমার নাম্বার পুলিশের কাছে চলে যায়। তো পুলিশ আমাকে বারবার কল দিচ্ছিল, হুমকি ধামকি দিচ্ছিল তখন। ফোন বাসা থেকে ধরলে সমস্যা, বাসার লোকেশন দেখাবে তাই আমি দূরে গিয়ে ফোন কাটতাম বা সিমটা বন্ধ করে রাখতাম।
এই ব্যাপারগুলোর জন্য যখন আমার গুলি লাগে তখন কোন হসপিটালে যেতে পারিনি। অনেক দূরে একটা পরিচিত ফার্মেসি ছিল ওখানে যেতাম। ঐ সময়ে সংঘর্ষের কারণে মাথাব্যথা,জ্বর এই সব কিছুর ট্রিটমেন্ট ওই ফার্মেসি থেকেই নিতাম। ওই ফার্মেসির ভাই আমার পরিচিত হওয়ার কারণে আমাকে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিত, টেক কেয়ার করত।
পরের দিন ১৯ তারিখ শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ থমথমে ছিলো ঐ সময়ে নারায়ণগঞ্জে আমাদের কোনো কমিটি বা সমন্বয়ক ছিলনা। ১৮ তারিখে ছাত্রলীগ খুব তৎপর থাকলেও ১৯ তারিখে সবজায়গায় ছিল বেশ থমথমে পরিবেশ। আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখেছি। অবজারভেশন করেছি যে কী করা যায়। শহীদ মিনারের সামনে বসে চা খাচ্ছিলাম ওই সময় ছাত্রলীগ গুণ্ডাদের কথা শুনছি । দেখলাম ওরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসে আছে। যেকোনো কিছুর জন্যই ওরা প্রস্তুত। সেখানে ছাত্রলীগ একাই ছিল কোন পুলিশ ছিল না। আমরা তখন উদ্যোগ নিলাম, যেহেতু শুক্রবার তাই নূর মসজিদের জুম্মার নামাজ পড়ে আমরা মিছিল বের করে চাষাড়ার দিকে যাব। তো যথারীতি নামাজের পরে আমরা বের হলাম মিছিল নিয়ে।
এখানে আন্দোলনের ক্ষেত্রে দুইটা ব্যাপার ছিল। আমাদের আন্দোলনে যারা ছিল তারা অনেকেই রাস্তায় ফাইট হলে ফাইট করছে না। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যারা ফাইট করছে তাদের সংখ্যা কম। আমাদের প্রয়োজন ছিল ফাইটার বা যারা ফাইট করবে। ফাইট করার মত ছিল মাত্র ৩০ থেকে ৪০ জন। এই কয়েকজন নিয়ে আমরা ছাত্রলীগের সাথে পারব না।
তখন সেখানে আমি স্লোগান ধরেছিলাম। আল্লাহর রহমতে আশেপাশে থেকে তখন অনেক মানুষ জমায়েত হয়, প্রায় ৩০০ জনের মত। আমরা তখন দুই নাম্বার গেট থেকে চাষাড়ার দিকে রওনা হলাম। দুপুরে তিনটায় ওখানকার ক্লাবের সামনে থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয় এবং সবাই যে যার মতন দূরে সরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই । সেদিন পুলিশ, ছাত্রলীগ, সাধারণ জনগণ এবং আমাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত।
এরপর ২০ তারিখ, শনিবার আবারো থমথমে অবস্থা। ওইদিন আন্দোলন বেশি হয়েছে শানারপাড়ার ঐদিকে। কারফিউ জারি করার পর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে চিটাগং রোডের ওইদিকে বেশ কয়েকজনকে স্পট ডেড করার খবর পাই ।
আমিসহ আমাদের কয়েকজনের টিমের ব্যপারটা এমন ছিল যে, যেখানে আন্দোলন থাকত আমরা ঐখানেই যাওয়ার চেষ্টা করতাম ।ব্যপারটা এমন না যে চাষাড়াতে আজকে কিছু নাই, তাহলে থাক। আমার টিমে ছিল- হুজ্জাতুল্লাহ,অমিত হাসান,সজিব হাসান,আসাদ এরকম কয়েকজন।
২১ তারিখ যোহরের নামাজের পর সেদিন আমরা বের হই সাইনবোর্ডের উদ্দেশ্যে। সাইনবোর্ড অব্দি পুরো রাস্তা ব্লক ছিলো। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব সরাসরি আসল গুলি ফায়ার করতে করতে সাইনবোর্ডের দিকে আগাচ্ছিল। এভাবে তারা যখন আমাদের সামনাসামনি এসে পড়ে, আমরা মেইন রাস্তায় টিকতে না পেরে মসজিদের গলির মধ্যে ঢুকে যাই। গলিতে যাওয়ার পরে একজন বিজিবি সদস্যকে দেখলাম তখন আমাদের গলির মাথায় চলে আসে। তখন ঐ গলি বা রোডটার মধ্যে আমরা পাঁচজন ছিলাম যার তিনজনকে আমি চিনি না আর আমি ছিলাম, সাথে আমার বন্ধু হুজ্জাতুল্লা। সেখানে যে টিম লিডার ছিল সে বিজিবি সদস্যকে গালি দেয়। বিজিবি সদস্য লোকটা আমাদের থেকে ২৫-৩০ হাত দূরত্বে ছিল। ফলে সে গালিটা শুনতে পায়। তারপর দেখলাম সাথে সাথেই আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে ওখানেই বসে পরল। তখনই আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের দিকে গুলি করবে। আমরা এক সিরিয়ালে সবাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। যে গালি দিয়েছিল তার উদ্দেশ্যে গুলিটা করলেও গুলিটা তার গায়ে না লেগে ডান পাশে একটা ছেলে ছিল তার গায়ে লাগল। সে সেখানেই মারা যায়।
এরপরে ম্যাক্সিমাম দিনগুলোতে আমি ঢাকা যাই। বিশেষ করে ৪ তারিখের ঘটনা যদি বলি, ঐ সময় সবই তো ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। আমরা শাহবাগ থেকে বাংলা মোটরের দিকে হাঁটছিলাম। আমার মেইন উদ্দেশ্য ছিল আমি ফাইট করব। যে পয়েন্টে আমাদের পয়েন্ট শেষ এবং ছাত্রলীগ বা পুলিশের পয়েন্ট শুরু সেরকম একটা জায়গা বা পয়েন্ট খুঁজছিলাম। আমার সাথে ছিল অমিত ভাই, মনিরুজ্জামান ভাই, রায়হান ভাই। আরো দুই থেকে তিন জন ছিল, তাদের সাথে তেমন পরিচিত ছিলাম না।
যেতে যেতে বাংলা মোটরের ওইখানে পৌঁছে দেখি যে চারিদিকে ছাত্রলীগ। বিভিন্ন বাসার ছাদের উপর থেকে তারা গুলি করছে। তখনকার অবস্থাটা এরকম ছিল, আমাদের ছয় জন যাদের নাম বললাম আমাদের টিমটা ছিল আন্দোলনকারীদের থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাত দূরত্বে। আমরা ছিলাম সবচাইতে সামনে আর আমাদের থেকে খুব অল্প দূরত্বে ছিল ছাত্রলীগ এর বিশাল বাহিনী।
ওই সময়ের অনুভব করলাম এখন যদি আমরা দৌড় দিই তাহলে ওদের সাথে আমরা পারবো না। তাই আমরা সবাই এক পা এক পা করে পিছাতে লাগলাম আর তাদের উদ্দেশ্যে ইট পাটকেল ছুড়ছিলাম।
সবচেয়ে সামনে ছিল অমিত ভাই, উনার মাথায় হেলমেট ছিল।পুলিশ, ছাত্রলীগ উনার উদ্দেশ্যেই গুলি করছিল । আমি ভাই কে বারবার ডেকে বলছিলাম, “অমিত ভাই, পিছনে আসেন”। আমার ডাকার সাথে সাথেই আর একটা ছেলে ছিল যাকে আমি চিনি না। অমিত ভাই ও তাকে চিনেনা। সেই ছেলেটাও আমার থেকে অমিত ভাইয়ের নাম শুনে অমিত ভাইকে ডাকছিল । ঠিক ওই সময়ই ছেলেটার মাথায় এসে গুলিটা লাগে । সাথে সাথেই সে স্পট ডেড হয়ে গেল। যে গুলিটা অমিত ভাইকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল, সেটা ওর মাথায় লেগে ওর মগজ পড়ে গেল রাস্তায়।
তাই আমরা ব্যাকে আসলাম এরপর কিছুক্ষন থমথমে পরিবেশ তারপর আবারও সন্ধ্যা পর্যন্ত ফাইট চলল। সন্ধ্যায় সকল আন্দোলনকারীদের বাড়িতে ব্যাক পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও আমরা আর বাড়িতে যেতে পারিনি। ওখানে একটা হসপিটালে আমরা আটকা পড়ে যাই। আমরা হসপিটালের তিন তলায় ছিলাম। তিন তলা পর্যন্ত ছাত্রলীগরা এসে খুঁজে গেছে। আমরা একদম ফ্লোরের সাথে মিশে ছিলাম তাই আমাদের দেখেনি।ঐসময় হসপিটালের দারোয়ান আমাদেরকে পেছনের একটা গেট দিয়ে বের করে দেয়। এই দারোয়ান আমাদেরকে ধরিয়ে দিলে হয়তো ওই দিনই একদম শেষ। ওখান থেকেও আল্লাহর রহমতে বেঁচে ফিরি।
সর্বশেষ ৫ তারিখ ৫ তারিখে আমরা ছিলাম চানখারপুলে। আমরা যেই গলিতে ছিলাম সেখানে প্রচুর গুলি চলছিল।আমি,হুজ্জাতুল্লা ভাই সহ আরও কয়েকজন ছিলাম। ঐদিন আমাদের সাথে সেখানে প্রায় চারজন মারা গেছে। দুপুর একটার দিকে হুজ্জাতুল্লাহ ভাইয়েরও গুলি লাগে। হুজ্জাতুল্লাহ ভাই আমার আপন চাচাতো ভাই তাই তার গুলির খবর শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল আর হবেনা, আর পারবো না, আর কত মৃত্যুর খবর শুনতে হবে, তখন শরীরে আর কুলাচ্ছিল না। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লাম। নামাজের পর আবার বের হলাম। তারপর আবারো মনের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করলাম যে, নাহ এখান থেকে ফেরত যাওয়ার সুযোগ নাই। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবাদ পেলাম যে হাসিনা
মনের মধ্যে।
ঐদিনও বাসায় ফিরে শান্তি পাই নাই। কারণ হচ্ছে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার ব্যাপারটা যখন শুনি তো সেই সূত্রে রাত বারোটার দিকে বের হয়ে যাই এবং মন্দিরে পাহারায় কিছু কাজ করি।
বিভিন্ন ত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে অনেক মানুষের রক্তের বিনিময়েই আমাদের বিজয়। সেই শাশ্বত একটি কথাই বারবার মনে পড়ে - স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন কঠিন। রক্ষা করা যে কেনো কঠিন, এই ব্যাপারটা সবাই আমরা এখন বুঝতে পারছি খুব ভালোভাবেই। যাই হোক এই আন্দোলন কোনো সাধারণ আন্দোলন ছিল না। আর এই আন্দোলন থামবারও নয়। যতদিন অন্যায় নিপীড়ন থাকবে ততদিন এরকম আন্দোলন বারবার হবে ইনশাআল্লাহ।
চৌকিদারকে ঘটনা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন,
মো: আরিফুল ইসলাম।
বয়স:২৬
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
(জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক সংগ্রামের গল্পগুলো জানতে ও জানাতে চৌকিদারের সাথে যুক্ত হোন)
Choukidar