04/10/2024
জুম্মার দিনের সুন্নাহসমূহ ও ফজিলত হাদিসের আলোকে!
জুম্মার দিন সপ্তাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটি মুসলিমদের জন্য ইবাদত ও আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়ার একটি বিশেষ সুযোগ। জুম্মার দিনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে সুন্নাহগুলো পালন করতেন, সেগুলো আমাদেরও পালন করা উচিত। আসুন, জুম্মার দিনের সুন্নাহ ও ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
১. আগেভাগে মসজিদে প্রবেশ করা
জুম্মার দিনে মসজিদে আগে প্রবেশ করা একটি ফজিলতপূর্ণ আমল। যারা আগে মসজিদে আসে, তাদের জন্য আল্লাহ বিশেষ পুরস্কার রেখেছেন।
হাদিস:
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"যখন জুম্মার দিন হয়, তখন ফেরেশতারা মসজিদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যায় এবং একে একে আগত লোকদের নাম লিখতে থাকে। যারা আগে আসেন, তাদের নাম প্রথমে লিখে। প্রথম আসা ব্যক্তি যেন একটি উট কোরবানি করল, এরপর আসা ব্যক্তি যেন একটি গরু কোরবানি করল, এরপর আসা ব্যক্তি যেন একটি ভেড়া কোরবানি করল, তারপর যেই আসবে, সে যেন একটি ডিম কোরবানি করল। আর যখন ইমাম (মিম্বারে) উঠে খুতবা দিতে শুরু করেন, তখন ফেরেশতারা তাদের বই বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যায়।"
— সহীহ বুখারী ৯২৯, সহীহ মুসলিম ৮৫০
ব্যাখ্যা:
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, যারা আগে মসজিদে আসে, তাদের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ প্রতিদান নির্ধারিত আছে। প্রথম আগতদের জন্য কোরবানির সওয়াবের মতো ফজিলত রয়েছে, যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই, জুমার দিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মসজিদে উপস্থিত হওয়া উচিত।
২. গোসল করা
জুম্মার দিনে গোসল করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দিনে বিশেষভাবে গোসল করতেন এবং সাহাবীদেরও তা করতে উৎসাহিত করতেন।
হাদিস:
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
"যে ব্যক্তি জুম্মার দিনে গোসল করে, যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার হয়, চুলে তেল লাগায় বা ঘরে থাকা সুগন্ধি ব্যবহার করে, এরপর মসজিদে যায় এবং ইমামের খুতবা মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং চুপ থাকে, তার জন্য পূর্ববর্তী জুম্মা থেকে বর্তমান জুম্মা পর্যন্ত সমস্ত ছোট গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।"
— সহীহ বুখারী ৮৮৩
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, জুমার দিনে গোসল করা শুধু সুন্নাহ নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কারের কারণও।
৩. পরিষ্কার পোশাক পরিধান করা
জুম্মার দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি সুন্নাহ। তিনি মসজিদে যাওয়ার আগে পরিষ্কার পোশাক পরতেন।
হাদিস:
ইয়াযীদ ইবনু খালিদ ও মূসা ইবনু ইসমাঈল ..... আবূ সালামা ও আবূ উমামা থেকে আবূ সাঈদ (রাঃ) ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) এর সূত্রে বর্ণিত। তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জুমুআর দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরিধাণ করবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে যদি তার নিকট থাকে। অতঃপর জুমুআর নামাযে আসে এবং অন্য মুসল্লীদের গায়ের উপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়, নির্ধারিত নামায আদায় করে, অতঃপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর হতে নামায সমাপ্তি পর্যন্ত চুপ করে থাকে; তবে তার এই আমল পূর্ববর্তী জুমুআর দিন হতে পরের জুমুআর দিন পর্যন্ত সমস্ত সগীরা গুনাহর জন্য কাফফারা হবে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আরো অতিরিক্ত তিন দিনের সগীরা গুনাহে্র কাফফারা হবে। তিনি আরো বলেন, একটি ভাল কাজের পরিবর্তে কমপক্ষে দশগুণ ছওয়াব দান করা হবে। -সুনান আবূ দাউদ ৩৪৩
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে জুমার দিন আল্লাহর দরবারে পরিষ্কার ও সুন্দরভাবে উপস্থিত হওয়া এক বিশেষ পুরস্কারের মাধ্যম।
৪. মিসওয়াক করা (দাঁত পরিষ্কার করা)
মিসওয়াক করা একটি বিশেষ সুন্নাহ এবং জুম্মার দিনে এটি করতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।
হাদিস:
আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"জুম্মার দিনে মিসওয়াক করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি ইবাদতের আগ্রহ বৃদ্ধি করে।"
— সহীহ মুসলিম ৮৫৪
জুমার দিন ইবাদতের জন্য বিশেষ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মিসওয়াক করার গুরুত্ব হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
৫. সুগন্ধি ব্যবহার করা
জুম্মার দিন সুগন্ধি ব্যবহার করা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় আমলগুলোর একটি ছিল।
হাদিস:
আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"যে ব্যক্তি জুম্মার দিনে সুগন্ধি ব্যবহার করে মসজিদে যায়, সে যেন সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে।"
— সহীহ বুখারী ৮৮১
সুগন্ধি ব্যবহার ইবাদতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং এটি মুসলিমদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্মান বৃদ্ধি করে।
৬. খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং চুপ থাকা
খুতবার সময় মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং চুপ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিস:
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “জুমার দিন ইমাম খোতবাদানকালে আপনি যদি পাশের কাউকে বলেন:‘চুপ থাকুন’ তাহলে আপনি জুমার সওয়াব নষ্ট করে দিলেন।” -সহিহ বুখারি (৮৯২) ও সহিহ মুসলিম (৮৫১)
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, খুতবার সময় কোনও ধরনের কথাবার্তা বা মনোযোগের বিঘ্ন ঘটানো উচিত নয়। খুতবার প্রতি মনোযোগ দেওয়া আমাদের ইবাদতের অংশ।
৭. সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা
জুমার দিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা। এই সূরার বিশেষ ফজিলত রয়েছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি আখিরাতের জন্যও উপকারী। বিশেষ করে, দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষার জন্য সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত আয়াতের তিলাওয়াত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিস:
আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফ তিলাওয়াত করে, তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ে নূর (আলো) থাকবে।"
— সহীহ মুসলিম ৮৭৪
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা জুমার দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ, যা দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ে পথপ্রদর্শক নূর বা আলো সরবরাহ করে।
দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষার ক্ষেত্রেও সূরা কাহফের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষভাবে এ সূরার প্রথম দশ আয়াত তিলাওয়াত করতে উৎসাহিত করেছেন, যা দাজ্জালের ফিতনা থেকে আমাদের রক্ষা করবে।
হাদিস:
আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে।"
— সহীহ মুসলিম ৮০৯
এই হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাই, শুধু জুমার দিনে নয়, দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষার জন্যও সূরা কাহফ নিয়মিত তিলাওয়াত করা উচিত।
৮. দোয়া করা
জুম্মার দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যখন আল্লাহ বান্দার কোন দোয়া প্রত্যাখ্যান করেন না।
হাদিস:
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"জুম্মার দিনে এমন একটি সময় রয়েছে, যখন কোন মুসলিম বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ তাকে তা দিয়ে দেন।"
— সহীহ বুখারী ৯৩৫, সহীহ মুসলিম ৮৫২
কিছু বর্ণনায় এই বিশেষ মুহূর্ত আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বলা হয়েছে:
হাদিস:
"জুম্মার দিন আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিবের আগে যে সময়ে দোয়া করা হয়, তা আল্লাহর নিকট বিশেষভাবে কবুল হয়।"
— তিরমিজি ৪৮৯
এই ছিল জুম্মার দিনের সুন্নাহ ও এর ফজিলত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের এই সুন্নাহগুলো পালন করার তাওফিক দিন এবং জুম্মার দিনকে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন আমিন।
পোস্টটি শেয়ার করে সকলকে জুম্মার দিনের ফজিলতের ব্যাপারে জানিয়ে দিন!