Shamogra Prokashan

Shamogra Prokashan Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from Shamogra Prokashan, Media/News Company, 73 Concord Emporium Shopping Complex (Basement), 253-254 Drive Kudrat-e-Khuda Road, Kataban, Dhaka-1205, Dhaka.

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ব্যাপারে যা যা জানার আছে১৯০১ সালে সাহিত্যে প্রথম নোবেলপ্রাপ্ত লেখক সুলি প্রুদোম আর ২০২২ সালের ...
23/10/2024

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ব্যাপারে যা যা জানার আছে

১৯০১ সালে সাহিত্যে প্রথম নোবেলপ্রাপ্ত লেখক সুলি প্রুদোম আর ২০২২ সালের নোবেল বিজয়ী আনি এরনোর মাঝখানে রয়েছে ১২১ বছরের উজ্জ্বল ইতিহাস। এই প্রায় শোয়া শতাব্দীজুড়ে নোবেল পেয়েছেন মোট ১১৯ জন সাহিত্যিক। এর মধ্যে ১০২ জন পুরুষ এবং ১৭ জন নারী সাহিত্যিক পুরস্কৃত হয়েছেন, যার সর্বশেষজন ফরাসি লেখক আনি এরনো। তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির পর এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের জিজ্ঞাসা ছিল: কে এই আনি এরনো, কীভাবে নোবেল পেলেন তিনি?

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার প্রক্রিয়া

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। সুইডিশ একাডেমির নেতৃত্বে প্রতিবছর সাহিত্যে যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, এর সদস্যসংখ্যা ১৮। তবে চার থেকে পাঁচজনের সমন্বয়ে গঠিত নোবেল কমিটিই মূলত লেখকদের সাহিত্যকর্ম পাঠ ও সুইডিশ একাডেমির কাছে সম্ভাব্য প্রাপকদের নাম পেশ করে থাকে। যেমন এ বছর নোবেল কমিটির সভাপতি ছিলেন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক অ্যানডার্স ওলসন। আর সদস্য ছিলেন চারজন—সাহিত্যিক পিয়ার ওয়াস্টবার্গ, লেখক জেসপার স্ভেনব্রো, লেখক অ্যালেন ম্যাটসন ও লেখক অ্যালেন সোয়ার্ড। কমিটির সহসদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ম্যাটস মাম।

এ পুরস্কারের কয়েকটি ধাপ রয়েছে।

প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরে নোবেল কমিটি কর্তৃক বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ও সংস্থার কাছে লেখকদের নাম মনোনীত কারার জন্য চিঠি পাঠানো হয়। পরের বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় এই নাম। বিভিন্ন দেশের যেসব ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠান পুরস্কারের জন্য লেখকদের নাম প্রস্তাব করতে পারেন, তাঁরা হলেন সুইডিশ একাডেমির অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের সদস্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক, কোনো দেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্য সংস্থা এবং আগে নোবেল পেয়েছেন এমন লেখকেরা।

প্রতিবছর প্রায় ২০০টির মতো মনোনয়ন আসে। পরে প্রস্তাবিত নামগুলো নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে অনুমোদনের জন্য সেটি একাডেমির কাছে পেশ করে নোবেল কমিটি। এর পরবর্তী ধাপে এপ্রিল মাসে ১৫ থেকে ২০ জন লেখককে নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করা হয়। মে মাসে ওই তালিকা থেকে পাঁচজনকে বাছাই করা হয়। এটাই হলো নোবেলের সংক্ষিপ্ত তালিকা।

জুনে শুরু করে আগস্ট মাস পর্যন্ত সুইডিশ একাডেমির সদস্যরা সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত পাঁচজন লেখকের লেখাপত্র পড়ে ও বিশ্লেষণ করে কাটান। সেপ্টেম্বরে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন এবং তর্কবিতর্ক করেন। সুইডিশ একাডেমির সভাপতি অ্যানডার্স ওলসন জানান, ‘পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, এত সব অসাধারণ লেখকের মধ্য থেকে কেবল একজনকে বাছাই করা।’ অবশেষে অক্টোবরে নির্বাচিত হয় বিজয়ী, এ মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়। আর ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের স্টকহোমে বিজয়ী লেখকের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার।

নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর

সুইডিশ কমিটি ৫০ বছরের আগে কোনো সালের প্রস্তাবিত লেখক ও প্রস্তাবকারীদের নাম প্রকাশ করে না। সম্প্রতি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রস্তাবিত লেখক ও প্রস্তাবকারীদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সাহিত্যে মোট ৩ হাজার ৭৭৭টি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

চমকপ্রদ তথ্য হলো, ১৯৭১ সালে নোবেল কমিটির কাছে বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। তাঁর নামটি প্রস্তাব করেছিলেন কৃষ্ণ কৃপালিনি। সে বছর তারাশঙ্কর নোবেল পাননি, পেয়েছিলেন চিলির কবি পাবলো নেরুদা। এ লেখার শেষে এই সুযোগে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই রুশ কথাসাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের কথা, যিনি মোট ১৯ বার মনোনয়ন পেলেও নোবেল জেতেননি। এ প্রসঙ্গে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসের কথাও বলা যাবে, নোবেল পুরস্কারের জন্য মোট ২৬ বার প্রস্তাব করা হয়েছিল তাঁর নাম। কিন্তু তিনিও পাননি এ পদক।

 নোবেলের ১২১ বছরের ইতিহাসে পুরস্কার পেয়েছেন ১১৯ জন সাহিত্যিক, পুরুষ ১০২ ও নারী ১৭ জন।

 ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সাহিত্যে মোট ৩ হাজার ৭৭৭টি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

 গ্রন্থনা: মাহীন হক
সূত্র: নোবেলপ্রাইজ ডট ওআরজি

কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
১৫ অক্টোবর ২০২২

সাহিত্যে নোবেল ২০২৪ হান কাংয়ের সাহিত্যের অন্দরমহলেউম্মে ফারহানাভৌগোলিক দূরত্ব খুব বেশি না হলেও সাংস্কৃতিকভাবে দক্ষিণ কোর...
23/10/2024

সাহিত্যে নোবেল ২০২৪

হান কাংয়ের সাহিত্যের অন্দরমহলে
উম্মে ফারহানা

ভৌগোলিক দূরত্ব খুব বেশি না হলেও সাংস্কৃতিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমরা বেশ দূরেই ছিলাম বহুদিন। মাত্র কয়েক দশক হয় কোরিয়ার চলচ্চিত্র আমাদের নজর কেড়েছে। এরপর এই প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে কে–পপ আর কে–ড্রামা। সাম্প্রতিক সময়ে রামেন আর কিমচির মতো কোরিয়ান খাবারের প্রতিও আগ্রহ বেড়েছে বাংলাদেশের মানুষের। বিশ্বায়নের যুগে গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিন সবার হাতের মুঠোয় থাকায় পৃথিবীর কোনো দেশই আর দূরের নয়। অথচ একই মহাদেশে অবস্থানের পরও কেবল ভাষা অপরিচিত হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্য আমাদের অনেকের কাছে এখনো দূরের। অনেক সময় শহরের দেয়ালে ‘কোরিয়ান ভাষা শিখুন’ জাতীয় বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে বটে, তবে সাহিত্য পড়ার জন্য কেউ কোরিয়ার ভাষা শেখেন বলে মনে হয় না।

দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপন্যাসিক হান কাং ২০২৪ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পর কথাগুলো মনে এল।

সাহিত্যের নোবেল এবার যখন হান কাংয়ের ঝুলিতে গেল, সাহিত্যামোদীরা বোধ করি খুব বেশি বিস্মিত হননি। তাঁর উপন্যাস দ্য ভেজিটারিয়ান ২০১৬ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার জেতার পর আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে হান কাং বেশ পরিচিত নামই। বইটি অনেকেই পড়েছেন, আরও আগ্রহীরা একই সঙ্গে পড়েছেন ২০১৭–তে বুকারের দীর্ঘ তালিকায় স্থান পাওয়া তাঁর আরেকটি উপন্যাস হিউম্যান অ্যাক্টসও। কবিতার মাধ্যমে লেখালেখির সূচনা হলেও হান কাং নোবেল পেয়েছেন কাব্যিক গদ্যভাষার জন্য। সাহিত্যিক পরিবারে জন্ম নেওয়া হান কাং এরই মধ্যে জিতেছেন সম্মানসূচক ফরাসি পুরস্কার লে প্রি মেডিসিস, ই স্যাং সাহিত্য পুরস্কার, কোরিয়ান নভেল অ্যাওয়ার্ড, মালাপার্তে, সান ক্লেমেন্তেসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা। কাজেই চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল ঘোষণার আগে অনেকেরই অনুমানের তালিকায় ছিল এই কথাসাহিত্যিকের নাম।

হান কাংয়ের লেখা কেমন? কী তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়? মূল ভাষার সৌন্দর্য বোঝার মুরোদ আমাদের নেই, তাই তাঁর অনুবাদক ডেবরা স্মিথের অনুবাদই ভরসা। দ্য ভেজিটারিয়ান যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা হয়তো বিস্মিত হয়েছেন এটা জেনে যে ভেজিটারিয়ান–এর দ্বিতীয় পর্ব মঙ্গোলিয়ান মার্ক, যেখানে গদ্যভাষার কাব্যিক প্রয়োগ বিদ্যমান, ওই অংশটি আলাদাভাবে পুরস্কার এনে দিয়েছে ৫৩ বছর বয়সী হানকে।

দ্য ভেজিটারিয়ান তিনটি পর্বে বিভক্ত। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে অসুস্থ হওয়ার পর মাছ–মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইয়েয়ং হাই নামের এক বিবাহিত নারী। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তার স্বামী চেইয়ং দেখতে পায় ফ্রিজ থেকে সব প্রাণিজ আমিষ খাদ্য ফেলে দিচ্ছে সে। নিজে নিরামিষভোজী হয়েই ইয়েয়ং ক্ষান্ত নয়, স্বামীর জন্যও মাছ–মাংস রাঁধতেও সে অস্বীকৃতি জানায়। শান্তভাবে বলে যে দিনের মধ্যে দুই বেলাই যেহেতু চেইয়ং বাইরে খাওয়াদাওয়া করে, তাই এক বেলা নিরামিষ খেলে তার এমন কিছু ক্ষতি হবে না।

উপন্যাসের প্রথম পর্বে ইয়েয়ংয়ের ভেজিটারিয়ান হওয়া নিয়ে অস্বস্তি, যা ক্রমে পারিবারিক সংকট, অতঃপর সংঘাতের রূপ নেয়—সেটুকু ইয়েয়ং হাইয়ের স্বামী চেইয়ংয়ের বয়ানে, সোজাসাপটা ভাষায় লেখা। মাঝেমধ্যে কেবল কিছু অংশ লেখা হয়েছে ইটালিকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেগুলো ইয়েয়ং হাইয়ের স্বপ্নের বিবরণ। তাতে যত না কাব্য, তার চেয়ে বেশি আছে ভয়ানক সব নৃশংসতার চিত্র। রক্তাক্ত, বীভৎস সেই সব দুঃস্বপ্ন ইয়েয়ংকে ভয়ানকভাবে তাড়া করে। স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠার পর প্রাণী হত্যা আর মাংস ভক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর বলে মনে হয় তার কাছে। যদিও প্রতি বেলা মুরগি, গরু, শূকর, অক্টোপাসসহ নানা ধরনের মাছ–মাংস সব সময়ই ছিল তাদের খাদ্যতালিকায়। ইয়েয়ং হাই নিজে খুব ভালো রাঁধুনি। ছোটবেলায় মায়ের কাছে প্রায়ই ওয়েস্টার খাবারের জন্য বায়না করত।

দ্বিতীয় পর্বে ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ লেখা হয়েছে সর্বদ্রষ্টা বক্তার (ওমনিশ্যান্ট ন্যারেটর) ভাষায়। এখানে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ইয়েয়ং হাইয়ের ভগ্নিপতির। আর তৃতীয় পর্ব ‘ফ্লেইমিং ট্রিজ’–এর বক্তা ইয়েয়ং হাইয়ের বোন ইন হাই। তিনটি অংশের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান দুই বছর করে। মূল চরিত্রের সরাসরি বক্তব্য খুব অল্প পরিমাণ হলেও তার প্রাণী হত্যা নিয়ে পরিবর্তিত মনোভাব অনেকটাই বোঝা যায়। নিজে খাওয়ার জন্য অন্য প্রাণকে ধ্বংস করার ব্যাপারটি সহ্য করতে না পারা ইয়েয়ং একপর্যায়ে স্বামীর ‘শরীরে মাংসের গন্ধ’ পায় বলে তার সঙ্গে যৌন সংসর্গও ত্যাগ করে। স্বামীর বয়ানে জানা যায়, এই প্রত্যাখ্যানের ফলে ইয়েয়ংকে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়।

ইয়েয়ং হাইয়ের নিজের শরীর ও জীবনের ওপর তার অধিকার না থাকার বিষয়টির উল্লেখ করে এ আখ্যানকে তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে দেখেছেন দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর বিশ্লেষক জুলিয়া পাসকাল। দ্য অস্ট্রেলিয়ান বইটিকে অদ্ভুতুড়ে বা ‘আনক্যানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গ্যাজেট ভ্যান আনটওয়েরপেন বলেছে, এটি হারুকি মুরাকামির ভক্তদের জন্য উপযোগী এক বই। আবার দ্য আইরিশ টাইমস একে দেখছে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার আখ্যানরূপে। আর দ্য গার্ডিয়ান–এর মতে, এই উপন্যাস নানা পীড়াদায়ক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে।

দ্য ভেজিটারিয়ান অবলম্বনে একই নামে ২০০৯ সালে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন লিম উ সিয়ং। বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ছবিতে দেখানো হয়, ইয়েয়ং হাই নামের এক নারী ফুল হয়ে যেতে চায়। লেখক নিজে তাঁর প্রিয় কবি ই স্যাংয়ের চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভেবেছিলেন, মানুষের আদতে গাছ হওয়া উচিত। বুকার পুরস্কার পাওয়ার পর কাং বলেছিলেন, তিনি নিজেও ভাবেননি দ্য ভেজিটারিয়ান এত বেশি পাঠকপ্রিয়তা পাবে; বিশেষত ভিন্ন সংস্কৃতির নারী পাঠকদের কাছে প্রশংসিত হওয়ার ব্যাপারে তাঁর কথা ছিল, ভেজিটারিয়ান–এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বিশেষভাবে কোরিয়ান নয়; বরং এটি যেকোনো দেশের নারীরই গল্প হতে পারে। উপন্যাসটিকে কেউ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি রূপক প্রতিবাদ হিসেবে দেখতে চাইলেও আপত্তি করেননি লেখক।

এক নারীর নিরামিষাশী হওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে পারিবারিক সংকট আর সামাজিক নিষ্ঠুরতার গল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে দ্য ভেজিটারিয়ান। অন্যদিকে হান কাংয়ের আরেক উপন্যাস হিউম্যান অ্যাক্টস লেখা হয়েছে দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনায়। ইতিহাসভিত্তিক এ উপন্যাসের ভাষা আদতে কাব্যিক। ছয়টি অধ্যায় আর শেষে উপসংহার নিয়ে মোট সাত খণ্ডের উপন্যাসটিতে আছে চুন ডু হুয়ান নামের এক সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কিশোরের গল্প। স্কুলপড়ুয়া কিশোর দং হো ১৯৮০ সালের মে মাসে জড়িয়ে পড়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দানা বাধা গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় পাল্টে যায় পরিপ্রেক্ষিত। জেয়ং দে নামের আরেক নিহত কিশোরের বয়ানে এগোতে থাকে কাহিনি। পড়তে পড়তে কারও মনে পড়তে পারে ওরহান পামুকের মাই নেম ইজ রেড–এর কথা। এখানে নামহীন লেখকের চরিত্রটি হতে পারেন হান কাং নিজেই, যিনি গোয়াংজু অভ্যুত্থানের কিশোর শহীদ দং হোর কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে সম্মান জানিয়ে আসেন। তারপর সিউলে ফিরে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে।

অনেকটাই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি ধারণ করেছে কোরিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতাকে। আবার একই সঙ্গে এটি দেখিয়েছে মানুষের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার ছবিও। অন্যতম মূল চরিত্র ডং হো মৃতদের সমাহিত করার কাজে অংশ নেয়, তার মা আট বছর পরও চোখে ভুল দেখে এবং তার মনে হয় ডং হো এখনো রাস্তায় আছে। এ সময় ডং হোর মা মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয়, কেন ছেলেকে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যেতে দিল, কেন ছেলের হাত ধরে রাখল না সে। পড়তে পড়তে পাঠক বুঝতে পারেন, শত শত শবদেহ নিশ্চিহ্ন করার, তাদের পরিচয় লুকিয়ে ফেলার নৃশংস চেষ্টা চলছে। উপন্যাসজুড়ে তাঁরা দেখেন মুক্তিকামী জনতাকে পোকামাকড়ের মতো মেরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার বীভৎস সব ছবি।

মানুষের সভ্যতায় ঘটে যাওয়া অমানবিকতার মর্মস্পর্শী বয়ান হান কাংয়ের এ উপন্যাস। দ্য গার্ডিয়ান–এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লেখক জানান, ১৯৮০ সালের গোয়াংজু অভ্যুত্থানের সময় তাঁর বয়স ছিল ৯ বছর। তত দিনে তাঁর পরিবার জন্মস্থান ছেড়ে সিউলে বসবাস করেছে। ফলে ওই অভ্যুত্থানের তেমন কোনো স্মৃতি তাঁর নেই। পরে ১২ বছর বয়সে পারিবারিক বইয়ের আলমারির পেছনে লুকিয়ে রাখা একটি গোপন স্মরণিকা খুঁজে পান হান। সেখানে ছিল বিদেশি আলোকচিত্রীদের তোলা অনেক ছবি। বেয়োনেটের আঘাতে মুখমণ্ডল ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া এক নারীর ছবি দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে কাংয়ের। তিনি বলেন, ‘২০ বছর বয়সে এই ছবি দেখলে আমার ঘৃণা হয়তো মিলিটারি রেজিমের দিকে যেত; কিন্তু সেই বয়সে ছবিটি দেখে মনে হয়েছিল, মানবজাতি প্রাণী হিসেবেই ভয়ংকর এবং আমিও এ প্রজাতিরই একজন।’

উপন্যাসের ভাষা নিয়ে নানা নিরীক্ষা করেছেন হান কাং। দ্য ভেজিটারিয়ান, হিউম্যান অ্যাক্টসসহ সব উপন্যাসেই এর ছাপ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ হিউম্যান অ্যাক্টস–এর ভূমিকায় লিখেছেন, ‘উপন্যাসটির অনেকটা, বিশেষত “দ্য বয়’জ মাদার” অংশটুকু লেখা হয়েছে গোয়াংজুর আঞ্চলিক ভাষায়, ইংরেজিতে অনুবাদ করা যা ছিল বেশ কঠিন। অনুবাদক হিসেবে কিছুটা স্বাধীনতা নিয়ে হলেও এর আঞ্চলিকতাটুকু আমি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।’

উপন্যাসে হান কাং এমন এক দুনিয়ার চিত্র তুলে ধরেন, যা দৈনন্দিনতায় ভরা; কিন্তু খানিকটা বীভৎস, অদ্ভুত। পারিবারিক পরিস্থিতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি উপস্থাপন করেন সমাজের সেসব রক্তাক্ত অনুভূতি, সচরাচর যেসব জনসমাজের সামনে আসে না। দ্য ভেজিটারিয়ান–এ বিষয়গুলো যেমন পোক্তভাবে উপস্থিত, তেমনি আছে হিউম্যান অ্যাক্টস–এও। মহান সাহিত্য যা করে, খবরের কাগজে পড়ে ভুলে যাওয়া একেকটি তথ্য বা গল্পের পেছনের বিশাল আখ্যানটিকে মহাকাব্যের মতো বিস্তৃতিতে নিয়ে যায়—হিউম্যান অ্যাক্টসও একই কাজ করেছে। ডং হো নামের কিশোরও হানের ছোটবেলায় পাওয়া সেই স্মরণিকা থেকে উঠে আসা। গোয়াংজুর গণহত্যার সময় নিহত আরও নাম না জানা কিশোর-তরুণেরাও উপন্যাসের চরিত্র হয়ে এসেছে। হান কাংয়ের কলমে বিভিন্ন নামের এসব শহীদ আসলে কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা হিউম্যান অ্যাক্টস–এর সঙ্গে আমাদের পাঠকেরা সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটল, তার মিল পেতে পারেন।

খুব বেশি না লিখেও দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেলজয়ী এই কথাশিল্পী আখ্যান রচনায় অনন্য আর নিজস্ব শৈলী সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। দ্য কনভারসেশন–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হান কাং যে কথা বলেন, সেটি হয়তো তাঁর লেখালেখির মূল মন্ত্র। কাংয়ের কথা হলো, মূলত তাঁর উপন্যাস মানবজীবনের যন্ত্রণা আর বেদনা নিয়ে লেখা। মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক বর্বর আচরণ, অসহনীয় নির্মমতা তাঁকে খুবই পীড়া দেয়।

এ কারণেই কি হান কাংয়ের লেখার অন্দরমহলে এত চাপা রক্তের ছাপ দেখা যায়, আর একের পর এক তিনি লিখতে থাকেন রক্তাক্ত মানুষের গল্প?

কোরিয়ান চলচ্চিত্রে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা এ ব্যাপারে একমত হবেন যে হত্যা, মৃত্যু, নৃশংসতাকে অন্য এক দৃষ্টিতে দেখার আর দেখানোর প্রবণতা আছে কোরিয়ানদের মধ্যে। সম্প্রতি অস্কার পাওয়া ছবি প্যারাসাইট–এও আমরা দেখেছি চরম দারিদ্র্যের ফলে মানবিক অধঃপতন এবং এর সমান্তরালে ধনকুবের এক পরিবারের বিলাসী জীবনযাপনের প্রতি বিদ্বেষ; ফলাফল হত্যা আর নিষ্ঠুরতা।

পাঠক, কাংয়ের লেখায় যে টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ, যে নিষ্ঠুরতা, তা বৃহদাকারের নয়, অনেকটা ফুটকির মতো; কাব্যিক ভাষার আচ্ছাদনে অজস্র রূপক দিয়ে ঘেরা। তাঁর উপন্যাসে ডুব দিলে আপনি অনুভব করতে পারবেন সেই ‘আনক্যানি’ ভরা দুনিয়াকে।

একনজরে হান কাং
■ জন্ম ২৭ নভেম্বর ১৯৭০, দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে।

■ লেখাপড়া করেছেন ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরিয়ান ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে।

■ ১৯৯৮ সালে আইয়োয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশ নেন।

■ ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ও এক পুত্রসন্তানের জননী হান কাং ২০১৮ সাল থেকে সিউলে একটি বইয়ের দোকান চালান।

■ ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিউল ইনস্টিটিউট অব দ্য আর্টসে সৃজনশীল সাহিত্য পড়িয়েছেন।

■ ম্যান বুকারসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার জিতেছেন ৫৩ বছর বয়সী এই লেখক।

■এ বছর প্রথম কোরিয়ান সাহিত্যিক হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পদক জিতলেন তিনি। নারী হিসেবে নোবেলজয়ীর তালিকায় তাঁর অবস্থান ১৮তম।

কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
১৮ অক্টোবর ২০২৪

হারুকি মুরাকামির সাম্প্রতিক গল্প: ‘কাহো’বিশ্বখ্যাত জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির সদ্য প্রকাশিত এই গল্প ছাপা হয়েছে...
23/10/2024

হারুকি মুরাকামির সাম্প্রতিক গল্প: ‘কাহো’

বিশ্বখ্যাত জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির সদ্য প্রকাশিত এই গল্প ছাপা হয়েছে ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণের ৮ ও ১৫ জুলাই, ২০২৪ তারিখের সংখ্যায়। গল্পটিতে এই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন কাহো নামের এক মেয়ের বেদনা। মূল জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। আর ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর করেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন-

লোকটি বলে, ‘জীবনে বহু মেয়ের সঙ্গে ডেটিং করেছি আমি, কিন্তু আমাকে বলতে হচ্ছে, আপনার মতো কুৎসিত চেহারার কাউকে দেখিনি কখনো।’

ডেজার্ট খাওয়ার পর তখন কফির জন্য অপেক্ষা করছিল ওরা।

লোকটার কথার রেশ শেষ হতে একমুহূর্ত লাগে, তিন কি চার সেকেন্ড হতে পারে। কথাটা আসে আচমকা, ওর মতলবটা তক্ষুনি বুঝতে পারে না কাহো। লোকটা যখন এই ঠোঁটকাটা কথাগুলো বলছিল, পুরোটা সময় হাসছিল ও। একটা ভদ্র বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। কোনো কৌতুকও ছিল না ওর কথায়। ঠাট্টাও করছিল না, পুরোপুরি সিরিয়াস।

একমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারত কাহো, কোলের ওপরের ন্যাপকিনটা টেবিলের ওর ছুড়ে ফেলে পাশের চেয়ারে রাখা পার্সটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারত, তারপর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে যেতে পারত রেস্তোরাঁ থেকে। খুব সম্ভবত পরিস্থিতিটা মোকাবিলা করার এটাই হতো সবচেয়ে ভালো উপায়।

কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, কাহো পারে না সেটা। পরে তার মনে আসে, এটার একটা কারণ, সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ও; দ্বিতীয় কারণ ছিল কৌতূহল। রেগে গিয়েছিল সে, সত্যিই ভয়ানক রাগ হয়েছিল ওর। রাগ হবে না কেন? তবে তার চেয়ে বেশি যেটা ছিল, ওর জানার ইচ্ছা, কী বলতে চাইছিল লোকটা। সে কি সত্যিই কুৎসিত? লোকটার এই মন্তব্যের পেছনে আরও কিছু ছিল কি?

একটু থেমে লোকটা বলেছিল, ‘আপনি খুবই বিশ্রি, কথাটা একটু বাড়িয়ে বলেছি আমি। তবে আমার দেখা মহিলাদের মধ্যে আপনি একেবারে সাদামাটা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

ঠোঁট দুটি কুঁচকে স্থির দুচোখে নীরবে লোকটার চেহারা নিরীক্ষণ করে ও।

এ রকম একটা কথা বলার কী দরকার ছিল ওর? প্রথমবার দেখা করতে এসে (এ রকমই কিছু ছিল ওটা) যদি অন্যজনকে পছন্দ না হয়, তাহলে পরে আর কোনো যোগাযোগ না রাখলেই হয়। এটাই তো যথেষ্ট। মুখের ওপর অপমান করা কেন?

লোকটা কাহোর বছর দশেক বা তার চেয়ে বড়, সুপুরুষ, কাপড়চোপড় দাগহীন, নিখুঁত। ঠিক কাহোর ধরনের নয়, যদিও মনে হয় ভালো পরিবারের ছেলে। চেহারাটা ফটোজেনিক, এভাবে বললেই ঠিক হয়। আরও কয়েক ইঞ্চি লম্বা হলে নায়ক হতে পারত সে। যে রেস্তোরাঁটা বেছে নিয়েছিল, সেটাও আরামদায়ক এবং কেতাদুরস্ত, খাবার ভালো ও বিশুদ্ধ। যাকে বাচাল বলা যায়, তেমনও নয় লোকটা, আলাপ চালিয়ে যাওয়ার মতো মার্জিত কোনো অস্বস্তিকর নীরবতাও ছিল না কখনো। (বেমক্কা হলেও, পরে যখন ব্যাপারটার দিকে ফিরে দেখে, ওর মনে পড়ে না কী নিয়ে আলাপ করেছিল ওরা)। ডিনারের সময় লোকটার প্রতি নিজেকে আন্তরিক মনে হয়েছিল ওর, এটা ওকে স্বীকার করতেই হবে। আর তারপরই, আচমকা এই ঘটনা। কী ঘটেছিল আসলে?

‘আপনার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতে পারে,’ ওদের সামনে দুটি এসপ্রেসো কফি রেখে যাওয়ার পর শান্ত কণ্ঠে বলেছিল লোকটা। যেন পড়তে পেরেছিল কাহোর মনের কথা। একটা ছোট চিনির দলা নিজের কফির মধ্যে ফেলে চুপচাপ নাড়তে থাকে লোকটা। ‘যাকে কুৎসিত মনে হয় অথবা বলা উচিত, যার চেহারা পছন্দ করিনি, তার সঙ্গে শেষ অবধি ডিনার করলাম কেন? প্রথম গ্লাস ওয়াইন শেষ করার পর সাক্ষাৎটা সংক্ষিপ্ত করে ফেলা উচিত ছিল আমার। দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে তিন পদের ডিনার খেয়ে পুরো সময়টা নষ্ট, তাই না? একেবারে শেষে এসে এ রকম একটা কথা কেন বলতে হলো আমাকে?’

টেবিলের ওপাশের লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে কাহো। কোলের ওপর ন্যাপকিনটা দুহাতে চেপে ধরা।

লোকটা বলে, ‘মনে হয় নিজের কৌতূহলটা চেপে রাখতে পারিনি আমি। বোধ হয় জানতে চেয়েছিলাম, আপনার মতো একজন সত্যিকার সাদাসিধে মহিলা কী ভাবছে, এ রকম সাদামাটা হওয়াটা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আপনার জীবনটাকে।’

কাহো ভাবে, ‘আপনার কৌতূহল মিটেছিল কি?’ তবে সেটা জিজ্ঞেস করে না মুখ ফুটে।

কফিতে চুমুক দিয়ে লোকটা বলে, ‘আমার কৌতূহল কি মিটেছিল?’ কোনো ভুল নেই, ওর মনের কথা বুঝতে পারছিল লোকটা। ঠিক যেভাবে পিঁপড়েভোজী প্রাণী উইঢিবিকে লম্বা সরু জিব দিয়ে চাটে।

মাথাটা সামান্য নেড়ে কাপটা পিরিচের ওপর নামিয়ে রাখে লোকটা। তারপর নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়, ‘না, মেটেনি।’

হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকে লোকটা, তারপর বিল মিটিয়ে দেয়। কাহোর দিকে ফিরে সামান্য বাউ করে সোজা বেরিয়ে যায় একবারও ফিরে না তাকিয়ে।

সত্যি বলতে, বাচ্চা বয়স থেকেই নিজের চেহারা নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না কাহোর। আয়নায় নিজের যে চেহারা দেখত, সেটা সুন্দর কিংবা বিশেষ রকম বিশ্রি বলে মনে হয়নি কখনো। হতাশ বা খুশি কোনোটাই হতো না সে। চেহারা ওর জীবনের কোনো ক্ষতি করছে না, এমন ভাবনা থেকেই চেহারা সম্পর্কে অনাগ্রহ জন্মায় ওর। কিংবা বোধ হয় এভাবে বলা ভালো, এ বিষয়ে জানার কোনো সুযোগ ঘটেনি ওর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ও, তাই সুশ্রী হতে পারত কি পারত না, তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না ওদের স্নেহ।

কৈশোর পার হওয়ার পরের সময়টুকুতেও নিজের চেহারার বিষয়ে উদাসীন ছিল ও। বান্ধবীদের বেশির ভাগেরই ছিল নিজেদের চেহারা নিয়ে উদ্বেগ। বইতে পাওয়া যায়, এমন সব ধরনের মেকআপ নিত ওরা, নিজের ব্যাপারে কখনো এ রকম তাগিদ অনুভব করেনি ও। ওর একমাত্র নজর ছিল নিজের শরীর ও চেহারাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে। আর সেটা কখনোই তেমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না।

একটা কো-এডুকেশন সরকারি কলেজে পড়ত ও, ছেলেবন্ধুও ছিল কয়েকজন। ওর ক্লাসের ছেলেদের যদি ওদের প্রিয় সহপাঠিনীকে ভোট দিতে বলা হতো, কখনোই জিততে পারত না কাহো, সে রকম ছিল না ও। তারপরও কোনো কারণে, সব ক্লাসেই দু-একজন ছাত্র আগ্রহী ছিল ওর ব্যাপারে, ওরা প্রকাশও করেছে সেটা। ওর ঠিক কোন বিষয়টাতে আগ্রহী ছিল ওরা, জানে না কাহো।

এমনকি কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে টোকিওর আর্ট স্কুলে যখন ভর্তি হয়, তখনো কদাচিৎ ছেলেবন্ধুর অভাব হয়েছে ওর। তাই ও আকর্ষণীয় কি না, এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সেই অর্থে ভাগ্যবতী বলা যায় ওকে। ওর কাছে অদ্ভুত লাগত, যেসব বান্ধবী ওর চেয়ে দেখতে অনেক ভালো, তারাও নিজেদের চেহারা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগত, বহু পয়সা খরচ করে প্লাস্টিক সার্জারিও করিয়েছে কেউ কেউ। কখনোই বিষয়টার তল পায়নি কাহো।

তাই ছাব্বিশ বছর পার হওয়ার পর প্রথম দেখাতেই লোকটি যখন বেমক্কা বলে দিল যে সে কুশ্রী, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায় কাহোর। লোকটার কথায় আঘাত না পেয়ে পুরোপুরি হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে পড়ে সে।

হারুকি মুরাকামি
হারুকি মুরাকামি
লোকটার সঙ্গে কাহোর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মাচিদা। কাহোর চেয়ে চার বছরের বড় মাচিদার ছেলেমেয়ে দুজন। ছোটদের বই বের করে এমন একটা ছোট প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করত সে। সেই সুবাদে কাহোর লেখা ছোটদের বই সম্পাদনা করত ও। ছবির বইগুলো তেমন ভালো চলত না, তবে এসব কাজের ফাঁকে বিভিন্ন ম্যগাজিনের অলংকরণ করে চলার মতো যথেষ্ট আয় করত কাহো। এই সাক্ষাতের মাত্র কিছুদিন আগে প্রায় দুই বছর ধরে চলা সমবয়সী এক লোকের সঙ্গে সম্পর্কটা ছাড়ান-কাটান হয়ে গিয়েছিল ওর, অস্বাভাবিক বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল সে। ভাঙনটা একটা তেতো স্বাদ রেখে গিয়েছিল ওর ভেতর। কিছুটা এই কারণেই কাজকর্মে ভাটা পড়েছিল ওর। ব্যাপারটা জানত বলে প্রথম সাক্ষাতের আয়োজনটা করেছিল মাচিদা। বলেছিল, ‘তোমার চলার ছন্দটা ঠিক হয়ে যেতে পারে।’

লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়ার তিন দিন পর মাচিদা ফোন করে ওকে।

প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘বলো, কেমন ছিল তোমাদের সাক্ষাৎ?’

সরাসরি জবাব এড়িয়ে কাহো কেবল অস্পষ্ট জবাব দেয়, ‘হুঁ।’ তারপর পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘ মানুষটা কী ধরনের?’

মাচিদা বলে, ‘সত্যি বলতে, ওর সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমি। বন্ধুর বন্ধু বলতে পারো। মনে হয় বয়স চল্লিশের মতো, এখনো বিয়ে করেনি, কোনো এক ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করে। ভালো ঘরের ছেলে, কাজকর্মে ভালো। যত দূর জানি, কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। একবারই দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে, কয়েক মিনিট কথা হয়েছিল, মনে হয়েছে লোকটা দেখতে ভালো এবং যথেষ্ট হাসিখুশি। স্বীকার করছি একটু খাটো সে, তবে টম ক্রুজও তো তেমন লম্বা নয়। এমন নয় যে টম ক্রুজকে নিজ চোখে দেখেছি আমি।’

কাহো জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু একটা হ্যান্ডসাম, আকর্ষণীয়, ভালো চাকুরে আগে থেকে জানাশোনা নেই, এমন কারও সঙ্গে ডেটিং করার ঝামেলায় যাবে কেন? ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্য তো বহু মেয়ে ছিল।’

মাচিদা বলে, ‘আমারও তা-ই মনে হয়। এমনিতে খুব শার্প ও, নিজের কাজে ভালো, তবে শুনেছি ওর স্বভাবটা একটু আজব। দেখা হওয়ার আগেই ওর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দিতে চাইনি বলে কথাটা জানাইনি তোমাকে।’

কথাটার পুনরাবৃত্তি করে কাহো বলে, ‘একটু আজব?’ মাথা ঝাঁকায় ও। এটাকে একটু আজব বলা যায়?

মাচিদা জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা কেউ কারও ফোন নম্বর রাখোনি?’

জবাব দেওয়ার আগে একটু থামে কাহো। ফোন নম্বর বিনিময়? তারপর বলে, ‘না রাখিনি কেউ।’

তিন দিন পর মাচিদা আবার ফোন করে ওকে।

বলে, ‘হ্যান্ডসাম সাহারার ব্যাপারে ফোন করলাম তোমাকে। কথা বলা যাবে?’ সাহারা হচ্ছে ওর সঙ্গে প্রথম ডেটিং করা লোকটার নাম। নামের উচ্চারণটা সাহারা মরুভূমির মতো। হাতের ড্রয়িং পেনসিলটা নামিয়ে রেখে ফোনটা বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নেয় কাহো। বলে, ‘নিশ্চয়ই, বলো।’

মাচিদা বলে, ‘কাল রাতে ফোন করেছিলে লোকটা। বলছে, তোমার সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে চায়, তোমরা দুজন আরেকবার কথা বলতে পারো কি না। বেশ সিরিয়াস মনে হলো ওকে।’

একটা লম্বা শ্বাস ঠেকাতে পারে না কাহো, একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। লোকটা আরেকবার দেখা করতে চায়, যাতে দুজন কথা বলতে পারে। কথাটা বিশ্বাস করতে পারে না যেন।

মাচিদার উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়, ‘কাহো সান, শুনছ তুমি?’

কাহো বলে, ‘হ্যাঁ, শুনছি।’

‘তোমাকে ও পছন্দ করেছে বলে মনে হয়। ওকে কী বলব?’

সাধারণ বুদ্ধিতে ‘না’ করে দেওয়াই উচিত। মুখের ওপর এমন জঘন্য কথা বলতে পারে যে লোক, তার সঙ্গে আবার দেখা করার কী দরকার? তবু সেই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না ও। ওর মাথার মধ্যে কিছু সন্দেহ একসঙ্গে ঢুকে পড়ে জট পাকিয়ে যায়।

মাচিদাকে বলে, ‘একটু ভেবে নিই? তোমাকে ফোন করব আমি।’

সেই শনিবারে শেষ পর্যন্ত সাহারার সঙ্গে দেখা করে কাহো। দিনের বেলায় অল্প সময়ের জন্য এমন একটা জায়গা ঠিক করে ওরা, যেখানে নিরিবিলি কথা বলা যাবে, আশপাশে অন্য লোকজন থাকলেও থাকতে পারে, তবে কোনো খাওয়াদাওয়া বা পান নয়। এসব শর্ত মাচিদা জানিয়ে দিয়েছিল সাহারাকে। আর কাহোকে বলেছিল, ‘দ্বিতীয় সাক্ষাতের জন্য অদ্ভুত শর্ত। তুমি খুব বেশি সাবধানী হয়ে পড়েছ দেখছি।’

কাহো বলে, ‘আমারও তা-ই মনে হয়।’

‘হাতব্যাগে স্ক্রু ড্রাইভার বা অন্য কিছু লুকিয়ে নিচ্ছ না তুমি, ঠিক?’ বলে খুশিমনে হেসেছিল মাচিদা।

কাহো মনে মনে ভাবে, সে রকম হলে খারাপ হতো না।

আগেরবার যখন তাদের দেখা হয়, সাহারাকে দেখে মনে হচ্ছিল কাজ শেষে ঘরে ফিরছে, পরনে ছিল চমৎকার গাঢ় স্যুট আর টাই। তবে এবার ছুটির দিনের ক্যাজুয়াল পোশাক, একটা পুরু চামড়ার জ্যাকেট, সরু জিনসের ট্রাউজার আর দৈনন্দিন পরা হয় এমন বুট জুতা। সানগ্লাসটা বুকপকেটে রাখা। বেশ কেতাদুরস্ত চেহারা।

নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পর এসে পৌঁছায় কাহো, ততক্ষণে হোটেল লবিতে এসে গেছে সাহারা, কাউকে ফোনে টেক্সট মেসেজ পাঠাচ্ছিল। কাহোকে দেখার পর একটা মৃদু হাসি দেখা যায় ওর ঠোঁটে, সেলফোনের চামড়ার কাভারটা বন্ধ করে ও। ওর পাশের চেয়ারে একটা মোটরসাইকেলের হেলমেট।

সাহারা বলে, ‘একটা ১৮০০ সিসি বিএমডব্লিউ চালাই আমি। এই ব্র্যান্ডের সব কটির মধ্যে এটার সিলিন্ডার সবচেয়ে বড়, ইঞ্জিনের শব্দও দুর্দান্ত।’

কিছু বলে না কাহো। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে, ‘তুমি কিসে চড়ো, তাতে আমার কি আসে যায়—বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেল, তিন চাকার রিকশা, গরুর গাড়ি—যেটাই হোক।’

সাহারা বলে, ‘বাজি ধরে বলতে পারি, মোটরসাইকেল নিয়ে আপনার কোনো আগ্রহ নেই। তবে ভাবলাম, আপনাকে জানানো উচিত, কেবল আপনার অবগতির জন্য।’

কাহো ভাবে, ‘এই লোক জানে, কীভাবে মনের কথা বোঝা যায়।’

ওয়েট্রেস এলে নিজের জন্য একটা কফির ফরমাশ দেয় কাহো। সাহারা বলে ক্যামোমাইল চায়ের কথা।

সাহারা জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, কখনো অস্ট্রেলিয়া গিয়েছেন আপনি?’

মাথা নাড়ায় কাহো। কখনো যায়নি।

এবার দুহাত বাতাসে পাখার মতো ঘুরিয়ে সাহারা জিজ্ঞেস করে, ‘মাকড়সা পছন্দ করেন? আট পা-ওয়ালাগুলো?’

জবাব দেয় না কাহো। মাকড়সাকে সবচেয়ে বেশি ঘেন্না করে ও, তবে জানতে দিতে চায় না সেটা।

সাহারা বলে, ‘অস্ট্রেলিয়া গিয়ে একটা মাকড়সা দেখেছিলাম বেসবল গ্লাভসের সাইজের। দেখেই ঘেন্নায় শিউরে উঠেছিলাম আমি। গায়ে কাঁপুনি এসে গিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় ব্যক্তিরা এগুলোকে ঘরে আমন্ত্রণ জানায়। কেন, জানেন?’

চুপ করে থাকে কাহো।

‘কারণ, এগুলো নিশাচর, তেলাপোকা খেয়ে ফেলে। উপকারী পতঙ্গ বলতে পারেন। তবু ভাবুন, তেলাপোকা খাওয়ার জন্য মাকড়সা রাখা। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এই ফুড চেইনটা কত দক্ষ আর নিখুঁত।’

কফি আর ভেষজ চা আসে, কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে সামনে কাপ নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে দুজন।

কয়েক মিনিট পর সাহারা বলে, ‘মনে হয় ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে আপনার। মানে, এই যে আপনার সঙ্গে আবার দেখা করতে চাইলাম।’ ওর গলার স্বর কিছুটা আনুষ্ঠানিক।

এবারও কাহো কোনো জবাব দেয় না। আসলে সাহস পাচ্ছিল না।

সাহারা বলে, ‘বলতেই হবে যে সত্যিই অবাক হয়েছি আমার সঙ্গে আবার দেখা করতে রাজি হয়েছেন বলে। আমি কৃতজ্ঞ, তবে অবাক হয়েছিলাম আপনাকে সেই কড়া কথাটা বলার পরও আপনি রাজি হয়েছেন দেখে। না, আমি যা বলেছিলাম, সেটা কড়া কথার চেয়ে বেশি কিছু। ব্যাপারটা ক্ষমার অযোগ্য অপমান, যেকোনো মহিলার মর্যাদাকে পায়ে মাড়িয়ে দেওয়া। এ রকম কথা যেসব মহিলাকে বলেছি, তাদের বেশির ভাগই দ্বিতীয়বার দেখা করতে রাজি হয়নি। এটাই তো স্বাভাবিক।’

‘তাদের বেশির ভাগই’, মনে মনে কথাটার পুনরাবৃত্তি করে কাহো। একটা ধাক্কা খায় ও।

এই প্রথম কথা বলে ও, ‘তাদের বেশির ভাগই? আপনি বলতে চাইছেন, যেসব মহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের সবাইকে একই কথা বলেছেন? আপনি বলছেন...।’

সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে সাহারা, ‘ঠিক তা-ই। যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সব মহিলাকে ঠিক সেটাই বলেছি, যা বলেছিলাম আপনাকে, “আপনার মতো কুৎসিত চেহারার কাউকে দেখিনি কখনো।” ডিনার উপভোগ করছি, যখন ডেজার্ট দেওয়া হয়েছে টেবিলে, ঠিক এমন সময়। এ-জাতীয় বিষয়ে সময়টাই সব।’

শুকনো গলায় কাহো জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু কেন? এমন একটা কাজ কেন করতে হবে আপনাকে? বুঝতে পারছি না আমি। কোনো কারণ ছাড়াই মানুষকে আহত করেন আপনি? কেবল ওদের অপমান করার জন্য নিজের সময় ও টাকা খরচ করেন?’

মাথাটা সামান্য ঝোঁকায় সাহারা, তারপর বলে, ‘কেন, সেটাই আসল প্রশ্ন। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা খুব জটিল। তার চেয়ে আমরা বরং এ রকম একটা মন্তব্যের ফলাফল নিয়ে কথা বলি না কেন? আমাকে যেটা সবচেয়ে বেশি অবাক করে, যে মহিলাকে কথাটা বলি, তার প্রতিক্রিয়া। আপনি ভাবতে পারেন, ঠিক মুখের ওপর এ রকম জঘন্য কথা বললে বেশির ভাগই আচমকা ক্ষেপে উঠবে, কিংবা হেসে উড়িয়ে দেবে। এ রকমও রয়েছে কিন্তু। তবে সত্যিই খুব বেশি নয়। বেশির ভাগ মহিলাই...খুবই আহত হয়। খুব গভীরভাবে, দীর্ঘ সময়ের জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বোকার মতো অদ্ভুত কিছু বলে ফেলে। সহজে বোঝা যায় না, এমন কিছু।’

কিছুক্ষণের জন্য চেপে বসে নীরবতা। তারপর কাহোই সেটা ভাঙে। ‘আপনি বলছেন সেসব প্রতিক্রিয়া উপভোগ করেন আপনি?’

‘না, উপভোগ করি না। তবে আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। সত্যিই সুন্দরী, কিংবা কমপক্ষে গড়পড়তার চেয়ে অনেক ওপরে, এমন কোনো মহিলাকে যদি তাদের মুখের ওপর বলা হয় যে সে কুশ্রী, কেমন অবাক করার মতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে কিংবা কীভাবে যে আহত হয়।’

কাহোর সামনে ধোঁয়া ওঠা কফি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছিল, কাপটা স্পর্শও করেনি সে। এবারে কঠিন গলায় বলে, ‘আমার মনে হয়, আপনি অসুস্থ।’

মাথা ঝোঁকায় সাহারা। ‘আমারও তা-ই মনে হয়। সম্ভবত ঠিক বলেছেন আপনি। আমি অসুস্থ হতে পারি। আমার নিজের পক্ষে কোনো অজুহাত বা অন্য কিছু নয়, তবে একজন অসুস্থ মানুষের চোখে যে পৃথিবী দেখা যায়, সেটা আরও অসুস্থ। ঠিক না? শোনেন, আজকাল মানুষ চেহারা দেখানো তত্ত্বকে ভয়ানক অপছন্দ করে। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার প্রকাশ্য নিন্দা করে বেশির ভাগ মানুষ। জনসমক্ষে ‘কুশ্রী মহিলা’ কথাটা বলে দেখুন, মার খাবেন আপনি। কিন্তু টেলিভিশন আর ম্যাগাজিনগুলো দেখুন। কসমেটিকস, প্লাস্টিক সার্জারি আর স্পা ট্রিটমেন্টের বিজ্ঞাপনে ভর্তি। ব্যাপারটা আপনি কীভাবে দেখেন, তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু এসব হচ্ছে হাস্যকর অর্থহীন দ্বিমুখী নীতি। একটা সত্যিকার তামাশা।’

কাহো বলে, ‘কিন্তু সেটা তো অন্য কাউকে আঘাত দেওয়ার বৈধতা দেয় না, দেয় কি?’

সাহারা বলে, ‘ঠিক বলেছেন আপনি। আমি অসুস্থ। এই সত্য অস্বীকার মতো নয়। তবে সেটা নির্ভর করে কীভাবে ব্যাপারটা দেখছেন আপনি। অসুস্থ হওয়াটাও উপভোগ্য হতে পারে। অসুস্থ মানুষের নিজস্ব বিশেষ একটা জায়গা আছে, যা কেবল অসুস্থ লোকেরাই উপভোগ করে। মানসিকভাবে অস্থির মানুষের জন্য একটা ডিজনিল্যান্ডের মতো। এবং সৌভাগ্যবশত, সেই জায়গা উপভোগ করার মতো সময় আর টাকা আছে আমার।’

একটি কথাও না বলে উঠে দাঁড়ায় কাহো। এটার শেষ টানা উচিত। এই লোকের সঙ্গে আর কথা বলা যায় না।

ও দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সাহারা বলে, ‘এক সেকেন্ড। আমাকে আরেকটু সময় দিতে পারেন? খুব বেশি সময় নেব না। পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। আমি চাই, আপনি একটু থেকে আমার কথাটা শুনে যান।’

কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করে কাহো, তারপর বসে পড়ে আবার। বসতে চায়নি সে, তবে লোকটার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে ঠেকাতে পারে না।

সাহারা বলে, ‘আমি যেটা বলতে চেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে আপনার যে প্রতিক্রিয়া ছিল, সেটা আর সবার চেয়ে আলাদা। আমার জঘন্য কথাগুলো যখন আপনাকে আক্রমণ করে, আতঙ্কিত হননি আপনি, রেগে গিয়ে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখাননি, হেসে উড়িয়ে দেননি, তেমন আহত হয়েছেন বলেও মনে হয়নি। এসব বস্তাপচা আবেগে ভেসে না গিয়ে কেবল তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। যেন মাইক্রোস্কোপের নিচে কোনো ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করে দেখছেন। আপনিই একমাত্র এবং প্রথম যে এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালেন। মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। আর ভাবছিলাম, এই মহিলা আহত বোধ করছে না কেন? এমন কিছু কি আছে, যা গভীরভাবে আঘাত করবে ওকে, থাকলে কি সেটা?’

কাহো বলে, ‘তার মানে, এসব আপনি করছেন, এ-জাতীয় লম্বা সাক্ষাতের আয়োজন করছেন বারবার, সবই কেবল মহিলাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য? কেবল এটুকুই?’

মাথা ঝোঁকায় লোকটা। ‘না না, অত বেশি নয়। কেবল যখন নিজ থেকেই সুযোগটা এসে যায়। আমি কখনোই ডেটিং অ্যাপ বা অন্য কিছু ব্যবহার করি না। ওসব খুব সোজা-সরল আর বোরিং। যাদের চিনি, তাদের কাছে নিজের পরিচিতি দিই, আর সেসব মহিলার সঙ্গেই দেখা করি, যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড জানা আছে আমার। আদ্যিকালের ঘটকালির মতো আয়োজন করা দেখা হওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। মানে, প্রাচীন মতবাদের ধারা। আমার কাছে এটাকেই উত্তেজনাপূর্ণ মনে হয়।’

কাহো বলে, ‘আর তখন আপনি মহিলাটিকে অপমান করেন?’

সাহারা জবাব দেয় না। কেবল একটা হাসি দেয় ও, তবে দ্রুত মিলিয়ে যায় সেটা। বুকের সামনে হাত দুটি তুলে ধরে ও, কিছুক্ষণ তাকিয়ে পরীক্ষা করে, যেন দেখছে হাতের রেখায় কোনো পরিবর্তন এল কি না।

তারপর হাতের ওপর থেকে চোখ তুলে বলে, ‘ভাবছিলাম, আমার সঙ্গে মোটরসাইকেলে একটা রাইডে যাবেন কি না। আপনার জন্য একটা বাড়তি হেলমেটও নিয়ে এসেছি। আজকের আবহাওয়াটাও ভালো, এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে পারি দুজন। বাইকের মিটারে দেখছি, পাঁচ হাজার কিলোমিটার পার করে ফেলেছি। বিএমডব্লিউর ইঞ্জিন যে কারণে বুক ফুলিয়ে চলতে পারে, সেটা হচ্ছে তার নিখুঁত কাজ।’

একটা অদম্য ক্রোধ টগবগিয়ে ওঠে কাহোর ভেতর। বহুদিন এমন রাগ হয়নি ওর। কিংবা এবারই প্রথম এমন হলো ওর। ‘এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে পারি দুজন? এসব কি ভাবছে এই লোক?’

নিজের মনোভাব চেপে রেখে কাহো বলে, ‘না, ধন্যবাদ।’ যত দূর সম্ভব, নিজের গলার স্বর শান্ত রাখে ও। ‘আপনি জানেন এই মুহূর্তে আমার এক নম্বর কাজ কী?’

মাথা নাড়ায় সাহারা, ‘কী হতে পারে সেটা?’

‘আপনার আর আমার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রাখা, অল্প দূরত্ব হলও চলবে। তারপর আমার ওপর যে নোংরা এসে পড়েছে, সেটাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলা।’

সাহারা বলে, ‘আচ্ছা। বটে। বেশ। আমার মনে হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার আপনার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোটা বাদ দিতে হবে। কিন্তু আপনি কি ভাবছেন? আমার থেকে সামান্য দূরত্ব পেলে তাতে কি কাজ হবে?’

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
‘তার মানে কী?’

কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে ওঠে। লোকটা একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখে, পরমুহূর্তে সরাসরি কাহোর দিকে তাকায়।

তারপর বলে, ‘আমার মনে হয় আপনি বুঝতে পারবেন, শিগগিরই। যদি একবার কারও ব্যাপারে আগ্রহী হই আমি, তাদের অত সহজে চলে যেতে দিই না। আপনার কাছে ব্যাপারটা অবাক করা মনে হতে পারে, কিন্তু দূরত্বের হিসেবে আপনি আর আমি খুব বিচ্ছিন্ন নই। দেখুন, মানুষ শিকলের ছাঁচটা থেকে পালাতে পারে না। তারা ওটা দেখতে চায় বা না চায়, তাতে কিছু আসে যায় না, এমনকি এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার না থাকলেও। কোনো কিছু গিলে ফেলা আর নিজেই অন্যের গেলার শিকার হওয়া একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সামনে আর পেছনে, জমা আর খরচ। দুনিয়াটাই এ রকম। আমার মনে হয়, সম্ভবত আবার কোথাও দেখা হবে আমাদের।’

কাহো ভাবে, ‘লোকটার সঙ্গে দেখা করাই উচিত হয়নি আমার।’ লম্বা পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নিশ্চিত বুঝতে পারে ও। মাচিদা সেদিন যখন ফোন করে, পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল, “না, ধন্যবাদ। লোকটার সঙ্গে আর কখনোই দেখা করতে চাই না আমি।”

‘কৌতূহল। কৌতূহলই আমাকে টেনে এনেছে এখানে। আমি বোধ হয় দেখতে চেয়েছিলাম, কী এমন উদ্দেশ্য লোকটার, আসলে কি চাইছিল সে। মনে হয় এটাই জানতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু ভুল ছিল কাজটা। কৌতূহলটাকে টোপের মতো ব্যবহার করে কৌশলে আমাকে লোভ দেখাতে চেয়েছিল সে, মাকড়সা যে রকম করে। একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় ওর মেরুদণ্ড বেয়ে। সে ভাবে, আরামের কোনো জায়গায় যেতে চাই আমি। দক্ষিণে সাদা বালুর কোনো দ্বীপ। সব চিন্তা থেকে মনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব সেখানে, সূর্যের আলো বয়ে যাক আমার ওপর দিয়ে।’

কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। মন থেকে যত দ্রুত সম্ভব সাহারা নামের লোকটা সম্পর্কে সব চিন্তা দূর করতে চায় কাহো। ওর জীবনের সঙ্গে কোনো সম্পর্কহীন অর্থহীন এই পর্ব ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়, এমন কিছু আর কখনো কোথাও দেখতে চায় না ও। তারপরও রাতে টেবিলে বসে কাজ করার সময় না চাইলেও লোকটার চেহারা আচমকা জেগে ওঠে মনের মধ্যে। ম্লান হেসে কোনো কারণ ছাড়া নিজের সুন্দর আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে লোকটা।

আগে কখনো যা করেনি, তার চেয়ে আরও বেশি সময় আয়নার সামনে কাটাতে শুরু করে কাহো। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের প্রতিটি খুঁটিনাটি দেখে সে, যেন আবার নিশ্চিত হতে চাইছে, সে আসলে কে। আর তখন মনে হয়, কোনোটার জন্যই আগ্রহ নেই ওর। এটা নিশ্চিত তারই মুখ, কিন্তু তারপরও এমন কিছু পায় না, যা দিয়ে বোঝা যায় এটা তারই মুখ। এমনকি ওর যে বান্ধবীরা প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে, তাদের ঈর্ষা করতে শুরু করে সে। ওরা জানে, কিংবা অন্ততপক্ষে ওরা বিশ্বাস করে যে ওরা জানে, সার্জারিতে পাল্টে ফেলা ওদের মুখের কোন অংশটা আরও সুন্দর করে তুলবে ওদের কিংবা নিজেদের চেহারা নিয়ে সন্তুষ্ট করবে।

‘জীবনটা হয়তো একটা নিপুণ প্রতিশোধ নিচ্ছে আমার ওপর’, এই ভাবনা মন থেকে তাড়াতে পারে না ও। ‘আসল সময় যখন আসবে, আমার যা ঋণ, হয়তো সেটাই নেবে জীবন। জমা আর খরচ।’ বুঝতে পারে কাহো, সাহারা নামের সেই লোকের সঙ্গে যদি কখনো দেখা না হতো, কখনোই এ রকম করে ভাবত না সে। ওর মনে হয়, ‘লোকটা হয়তো ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে দীর্ঘ সময় ধরে, আমি যাতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যেমন বিশাল একটা মাকড়সা অন্ধকারে অপেক্ষা করে শিকারের জন্য।’

গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমে, মাঝেমধ্যে বড় কোনো মোটরসাইকেল ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তা দিয়ে দ্রুত চলে যায়। যখনই ড্রাম পেটানোর মতো ইঞ্জিনের সেই নিচু ধক ধক শুনতে পায় সে, ওর শরীরেও খুব হালকা কাঁপুনি ধরে। উল্টোপাল্টা হয়ে যায় ওর নিশ্বাস, ঠান্ডা ঘাম বেরিয়ে আসে বগলের নিচে।

লোকটা বলেছিল, ‘আপনার জন্য একটা বাড়তি হেলমেটও নিয়ে এসেছি।’

নিজেকে সেই বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেলের পেছনে দেখতে পায় ও। কল্পনা করে শক্তিশালী সেই ইঞ্জিন কোথায় নিয়ে যাবে ওকে। কী রকম জায়গায় আমাকে নিয়ে যাবে ওটা?

লোকটা বলেছিল, ‘দূরত্বের হিসাবে আপনি আর আমি খুব বিচ্ছিন্ন নই।’

সেই অদ্ভুত প্রথম দেখার ছয় মাস পর ছোটদের জন্য নতুন একটা বই লেখে কাহো। এক রাতে স্বপ্ন দেখে, একটা গভীর সাগরের তলায় পড়ে আছে সে। ঘুম ভাঙার পর ওর মনে হয়, যেন হঠাৎ করে সমুদ্রের তলা থেকে কেউ ওকে ছুড়ে দিয়েছে ওপরের দিকে। সোজা নিজের টেবিলে চলে যায় ও, তারপর লিখে ফেলে গল্পটা। শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগে না।

নিজের মুখের খোঁজ করছে, এমন এক মেয়ের গল্প ওটা। কোনো এক সময় নিজের মুখটা হারিয়ে ফেলেছিল সে, ও যখন ঘুমে ছিল, তখন কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তাই সেটা ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হয় তাকে।

তবে মনে নেই চেহারাটা কেমন ছিল ওর। এটাও মনে নেই, সুন্দর কি বিশ্রি ছিল, গোলগাল নাকি লম্বাপনা। মা-বাবা, ভাই-বোন—সবাইকে জিজ্ঞেস করে ও, তবে কোনো কারণে কেউ মনে করতে পারে না কেমন চেহারা ছিল ওর। নাকি বলতে চাইছিল না ওরা।

তাই চেহারার খোঁজ করতে একাই বেরিয়ে পড়বে বলে ঠিক করে মেয়েটি। আপাতত ওর মুখে এঁটে যায়, এমন একটা চেহারা খুঁজে নেয় সে, যেখানে নিজের মুখ থাকার কথা, সেখানে লাগিয়ে নেয় ওটা। কোনো মুখ ছাড়া চলার পথে লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ওদের কাছে অদ্ভুত ঠেকবে ব্যাপারটা।

সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় মেয়েটি। উঁচু পাহাড়ে চড়ে, পার হয় গভীর নদী, বিস্তীর্ণ মরুভূমি পেরিয়ে যায়, পথ কেটে চলে বিপৎসংকুল অরণ্যের ভেতর দিয়ে। নিজের চেহারা দেখলেই চিনতে পারবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল ও। ‘যেহেতু আমার অস্তিত্বের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওটা’, আপন মনে বলে ও। অভিযাত্রায় বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হয় ওর, সব ধরনের বিদঘুটে অভিজ্ঞতা ঘটে। একপাল হাতির পায়ের নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়, একবার আক্রমণ করে বসেছিল বিশাল কালো এক মাকড়সা, প্রায় খেয়ে ফেলেছিল বুনো ঘোড়ার লাথি।

সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে অগুনতি মুখ পরীক্ষা করতে পেরিয়ে যায় দীর্ঘ সময়, নিজের মুখটা খুঁজে পায় না ও। যতগুলো দেখেছে, সবই অন্যের মুখ। বুঝতে পারে না কী করবে ও। টের পায় না যে আর বালিকাটি নেই ও, পূর্ণবয়স্ক মহিলা হয়ে গেছে। নিজের মুখটা কি আর খুঁজে পাবে না সে? হতাশায় ভেঙে পড়ে ও।

উত্তরের এক অন্তরীপের মাথায় বসে চরম হতাশায় যখন কাঁদছিল সে, ফারের কোট পরা দীর্ঘদেহী এক যুবক এসে বসে ওর পাশে। যুবকটির লম্বা চুলে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল সমুদ্রের বাতাস। ওর মুখের দিকে তাকায় লোকটা, তারপর চওড়া হাসি হেসে বলে, ‘আপনার মতো সুন্দর চেহারার কোনো মহিলা আগে কখনো দেখিনি আমি।’

এস এম রাকিবুর রহমান
এস এম রাকিবুর রহমান
তত দিনে যে মুখটা লাগিয়ে নিয়েছিল, সেটা আসল মুখ হয়ে গেছে ওর। সব ধরনের অভিজ্ঞতা, সব রকম আবেগ ও চিন্তা একত্র হয়ে মুখটা তৈরি করেছে ওর। এটা ওর চেহারা, ওর একার মুখ। একসময় যুবকটির সঙ্গে বিয়ে হয় ওর, তারপর উত্তর দ্বীপে সুখী জীবন কাটাতে থাকে দুজনে।

কোনো বিশেষ কারণে বইটা ছেলেমেয়েদের মনে কিছু একটা ঝলক ছড়ায় বলে মনে হয়, বিশেষ করে টিনএজার মেয়েদের ক্ষেত্রে, কাহো নিজেও জানে না কেন। এই বয়সী পাঠক-পাঠিকারা নিজের চেহারার খোঁজে বিস্তীর্ণ বিশ্বে বালিকাটির অভিযান এবং সংগ্রামের ঘটনাগুলো অনুসরণ করে প্রবল উত্তেজনায়। শেষ পর্যন্ত যখন মেয়েটি ওর চেহারা খুঁজে পায় এবং আবিষ্কার করতে পারে মনের শান্তি, পাঠককুল একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কাহোর একরঙের রেখাচিত্রে আঁকা প্রতীকী ইলাস্ট্রেশনসহ বইটা সহজ।

গল্পটি লেখা ও তার ইলাস্ট্রেশনের কাজ একধরনের মানসিক সুস্থতা এনে দেয় কাহোর ভেতর। ও বুঝতে পারে, ‘এই পৃথিবীতে আমি যে রকম, সেভাবেই বেঁচে থাকতে পারি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ সমুদ্রের নিচে পড়ে থাকার সেই স্বপ্ন এটাই শিখিয়েছে ওকে। মাঝরাতে যে উদ্বেগ ভর করত ওর ওপর, সেটা কমে আসে। যদিও সেটা যে একেবারেই চলে গেছে, সে কথা বলতে পারে না ও।

মুখে মুখে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভালোই কাটছিল বইটা, কাগজে আসছিল ভালো আলোচনা। দারুণ রোমাঞ্চিত মাচিদা।

ও বলে, ‘আমার মনে হয়, ছোটদের এই বই বহুদিন ধরে বেস্ট সেলার থাকবে। সে রকমই মনে হচ্ছে আমার। তোমার অন্য সব কটির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এই বইটা, এটাই অবাক করেছে আমাকে। কিন্তু ভাবছি, আইডিয়াটা কোথায় পেলে তুমি?’

একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে কাহো জবাব দেয়। বলে, ‘একটা ভীষণ অন্ধকার গভীর জায়গায়।’

অনুবাদ: ফারুক মঈনউদ্দীন

কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো
২৮ আগস্ট ২০২৪

Address

73 Concord Emporium Shopping Complex (Basement), 253-254 Drive Kudrat-e-Khuda Road, Kataban, Dhaka-1205
Dhaka

Telephone

01819504916

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Shamogra Prokashan posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Shamogra Prokashan:

Share