27/09/2025
ক্যান্সার নিয়ে কিছু কথা
প্রথমেই একটা জিনিস পরিষ্কার করা জরুরি। ক্যান্সার সরাসরি কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয় না, যেমনটা হয় টাইফয়েড বা ফ্লুতে। বরং, আমাদের দেহের কোষগুলো যখন অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে, তখনই ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। আর এই সুযোগ পায় তখনই, যখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে, অস্বাভাবিক কোষগুলোকে শনাক্ত করে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়।
ক্যান্সার থেকে বাঁচার একটি বড় হাতিয়ার হলো আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করা। আর এই শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম গড়ে তোলার মূল চাবিকাঠি রয়েছে তিনটি জায়গায়:
১. সঠিক খাবার
২. সুস্থ লাইফস্টাইল
৩. ইতিবাচক আবেগ ও মানসিকতা
চলুন, একে একে জেনে নিই প্রতিটির বিস্তারিত
১. ইমিউন সিস্টেমের সুপারফুড: কী খাবেন?
প্রথমেই আসি খাবারের কথায়। মনে রাখবেন, আপনার প্লেটই আপনার প্রথম ওষুধ। এই খাবারগুলো প্রতিদিনের ডায়েটে রাখুন:
· রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল: টমেটো, গাজর, মিষ্টি আলু, ব্রকলি, পালং শাক, ক্যাপসিকাম, বেরি জাতীয় ফল, পেঁপে, কমলা। এগুলোতে আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (ভিটামিন এ, সি, ই) ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যা ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেল দূর করে এবং ইমিউন কোষ তৈরি করে।
· প্রোটিনের উৎস: মাছ (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ), মুরগির বুকের মাংস, ডিম, ডাল, বিনস, টোফু। প্রোটিন হলো অ্যান্টিবডি ও ইমিউন কোষের মূল গাঠনিক উপাদান।
· স্বাস্থ্যকর ফ্যাট: বাদাম (আমন্ড, ওয়ালনাট), বীজ (ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া সিড), অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো। এগুলো প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
· প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক: দই (প্রোবায়োটিক), পেঁয়াজ, রসুন, শিম, ওটস (প্রিবায়োটিক)। এরা গাট হেলথ বা অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে, যা পুরো ইমিউন সিস্টেমের ৭০-৮০% নিয়ন্ত্রণ করে!
· ভিটামিন ডি ও জিংক: সূর্যের আলো (ভিটামিন ডি-এর প্রধান উৎস), সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম; জিংকের জন্য বাদাম, বীজ, ডাল। এই দুটো পুষ্টি উপাদান ইমিউন রেসপন্সের জন্য অপপরিহার্য।
এড়িয়ে চলুন:
প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও মিষ্টি, রিফাইন্ড কার্বস (সাদা আটা, সাদা চিনি), অস্বাস্থ্যকর তেলে ভাজা খাবার, অতিরিক্ত লাল মাংস। এগুলো ইনফ্লামেশন বাড়ায় এবং ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে।
২. লাইফস্টাইল: শক্তিশালী ইমিউনের ভিত্তি
শুধু খেলেই হবে না, জীবনযাপনের পদ্ধতিও হতে হবে ইমিউন ফ্রেন্ডলি:
· নিয়মিত ব্যায়াম: সপ্তাহে ৫ দিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি ধরনের ব্যায়াম (দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার)। ব্যায়াম ইমিউন কোষের সঞ্চালন বাড়ায়, প্রদাহ কমায় এবং স্ট্রেস হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে।
· গুণগত ঘুম: প্রতিরাতে ৭-৮ ঘন্টা গভীর, নিরবচ্ছিন্ন ঘুম। ঘুমের সময় শরীর সাইটোকাইনস নামক প্রোটিন তৈরি করে যা সংক্রমণ ও প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে। মোবাইল ফোন বিছানায় নেবেন না!
· ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ: এগুলো সরাসরি ইমিউন কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্যান্সার সেল তৈরিতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে।
· সূর্যের আলো: প্রতিদিন সকালের হালকা রোদে ১৫-২০ মিনিট থাকুন। ভিটামিন ডি তৈরির জন্য এটি জরুরি।
· ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন ক্রনিক ইনফ্লামেশন বাড়ায় এবং ইমিউন ফাংশনে ব্যাঘাত ঘটায়।
৩. আবেগ নিয়ন্ত্রণ: মন ভালো রাখুন, ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকবে
এটি হয়তো সবচেয়ে অবহেলিত, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক! দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ, উদ্বেগ, কষ্ট, রাগ, হতাশা – এই নেগেটিভ ইমোশনগুলো সরাসরি আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়। কারণ চাপের হরমোন (কর্টিসল) ইমিউন কোষের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
· স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: প্রতিদিন মিনিট ১০-১৫ ধ্যান (মেডিটেশন), গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (Deep Breathing) করুন।
· পছন্দের কাজ: যা আপনাকে আনন্দ দেয় – গান শোনা, বই পড়া, বাগান করা, আঁকা – তা করুন নিয়মিত।
· সামাজিক সংযোগ: পরিবার ও প্রকৃত বন্ধুদের সাথে গুণগত সময় কাটান। একাকিত্ব দূরে রাখুন।
· কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: প্রতিদিন ২-৩টি জিনিসের কথা ভাবুন যার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ। এটি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।
· পেশাদার সাহায্য: অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা বিষণ্নতা মনে করলে কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।
মনে রাখবেন, আপনার মন ও শরীর এক সিস্টেম। মন ভালো না থাকলে শরীরও ভালো থাকতে চায় না।
আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ক্যান্সার প্রতিরোধ শুধু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়ার বিষয় নয়। আমাদের দৈনন্দিন ছোট ছোট সচেতন সিদ্ধান্তই পারে আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে একটি অজেয় দুর্গে পরিণত করতে।
সংক্ষেপে মনে রাখুন:
· প্লেটে রং আনুন (রঙিন শাকসবজি, ফল)।
· নিয়মিত হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন
· গভীর ঘুমকে প্রাধান্য দিন।
· ধূমপান/মদ্যপানকে বলুন 'না'।
· মনকে রাখুন হালকা, ইতিবাচক ও কৃতজ্ঞ।
এই পরামর্শগুলো ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করে এবং যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা ও সুস্থতায় সহায়তা করে। কিন্তু এগুলো কোনো গ্যারান্টি নয় যে ক্যান্সার হবে না। বংশগতি ও অন্যান্য পরিবেশগত কারণও ভূমিকা রাখে। তাই নিয়মিত হেলথ চেকআপ এবং স্ক্রিনিং (বয়স ও ঝুঁকি অনুযায়ী) অবশ্যই করাবেন।
আপনার এবং আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। নিজের যত্ন নিন, ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করুন, ইতিবাচক থাকুন। ধন্যবাদ!
ফারজানা রহমান খান
কনসালটেন্ট টাইটিসিয়ান
ফিট উইথ ব্যালেন্সড ডায়েট
এক্সফুড এন্ড নিউট্রিশন অফিসার
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট
২৭.০৯.২৫