24/06/2025
আপনি এক রুম থেকে আরেক রুমে গেলেন একটা কাজের জন্য কিন্তু সেই রুমে গিয়ে আপনি ভুলে গেলেন আপনি কোন কাজে এসেছেন? আপনার চশমাটা এইমাত্র রাখলেন কিন্তু কোথায় রাখলেন সেটাও আপনি ভুলে গেছেন? আপনার চিরুনি টা এইমাত্র রেখেছেন কিন্তু কোথায় রেখেছেন সেটা মনে করতে পারছেন না এমন যদি আপনার সাথে হয় তবে আমার এই লেখাটা আপনার জন্য :----
এমন হলে এটাকে বলে ব্রেইন ফগ। আসুন জানি এটা কি ?
ব্রেইন ফগ (Brain Fog)কোনো নির্দিষ্ট রোগ নয়, বরং একটি উপসর্গসমষ্টি (Collection of Symptoms)যা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটায়। এটাতে সাধারণত যা হয় তা হচ্ছে:--
--মনোযোগ ও একাগ্রতা হ্রাস
--স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়া (খুব সাম্প্রতিক জিনিস ভুলে যাওয়া)
---মাথা ঘোলা লাগা বা অস্পষ্ট ভাবনা
---সিদ্ধান্ত নিতে বা সমস্যা সমাধানে কষ্ট হওয়া
---মানসিক ক্লান্তি ও ঝিমুনি ভাব
--মাথা ভারী বা ধোঁয়াশা লাগা- এরকম অনুভূতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
ব্রেইন ফগ কেন হয়? (কারণসমূহ)
ব্রেইন ফগের পেছনে একটি নির্দিষ্ট কারণ নেই, বরং বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক ও জীবনযাপন সংক্রান্ত বিষয় এর ট্রিগার হতে পারে:
1. ঘুমের সমস্যা: অপর্যাপ্ত ঘুম, খারাপ ঘুমের মান, অনিদ্রা (Insomnia) বা স্লিপ অ্যাপনিয়া সরাসরি ব্রেইন ফগ সৃষ্টি করে।
2. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ (Stress & Anxiety): দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ কর্টিসল হরমোন বৃদ্ধি করে, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, বিশেষ করে স্মৃতি ও মনোযোগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
3. খাদ্যাভ্যাস ও পানিশূন্যতা (Diet & Dehydration):
অপুষ্টি (বিশেষ করে ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি, আয়রন, ম্যাগনেসিয়ামের অভাব)
প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনি ও অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট বেশি খাওয়া।
পর্যাপ্ত পানি না পান করা (হালকা পানিশূন্যতাও ব্রেইন ফগ করতে পারে)।
খাদ্যে অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা (যেমন: গ্লুটেন, ডেইরি)।
4. হরমোনের পরিবর্তন (Hormonal Changes):
গর্ভাবস্থা (Pregnancy Brain)
মেনোপজ (Menopausal Brain Fog)
থাইরয়েড হরমোনের অসামঞ্জস্যতা
(hypothyroidism)
5. চিকিৎসা সংক্রান্ত অবস্থা (Medical Conditions):
দীর্ঘস্থায়ী রোগ:ফাইব্রোমায়ালজিয়া, ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম (CFS), লুপাস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা (Anemia)।
সংক্রমণ:কোভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব (Long COVID), অন্যান্য ভাইরাল ইনফেকশন।
নিউরোলজিক্যাল অবস্থা: মাইগ্রেন, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (MS), আলঝেইমার্স বা ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ (তবে ব্রেইন ফগ একাই ডিমেনশিয়া নির্দেশ করে না)।
6. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Medication Side Effects): কিছু ব্যথানাশক, ঘুমের ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, কেমোথেরাপির ওষুধ ইত্যাদির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ব্রেইন ফগ হতে পারে।
7. মেন্টাল হেলথ ইস্যু: ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।
8. অতিরিক্ত ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল সেবন।
9. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা।
ব্রেইন ফগ হলে করণীয় (কিভাবে মোকাবিলা করবেন)
ব্রেইন ফগের চিকিৎসা নির্ভর করে এর অন্তর্নিহিত কারণ শনাক্ত করে তার সমাধানের উপর। তবে সাধারণভাবে যা করা যেতে পারে:
1. ঘুমের উন্নতি করুন (Prioritize Sleep):
৭-৯ ঘন্টা গুণগত ঘুম নিশ্চিত করুন।
নিয়মিত ঘুমানোর ও জাগার রুটিন করুন।
ঘুমের আগে স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিন, শান্ত পরিবেশ তৈরি করুন।
2. মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা (Manage Stress):
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন, ইয়োগা, প্রাণায়াম চর্চা করুন।
গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন।
ব্যস্ততার মাঝে বিরতি নিন, যা পছন্দ করেন (গান শোনা, বই পড়া, প্রকৃতির কাছে যাওয়া) তা করুন।
"না" বলতে শিখুন।
3. সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস (Balanced & Nutritious Diet):
প্রচুর ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য, লিন প্রোটিন (মাছ, মুরগি, ডাল) ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (আভোকাডো, বাদাম, অলিভ অয়েল) খান।
প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট এড়িয়ে চলুন।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন (হাইড্রেটেড থাকুন)। দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল সীমিত করুন।
সম্ভাব্য খাদ্য সংবেদনশীলতা লক্ষ্য করুন (ডায়েরি, গ্লুটেন ইত্যাদি)।
4. নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম (Regular Exercise):
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করুন (হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা)। ব্যায়াম রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়, চাপ কমায় এবং ঘুমের মান উন্নত করে।
5. মস্তিষ্কের ব্যায়াম (Mental Stimulation):
পড়াশোনা, ধাঁধাঁ সমাধান, নতুন ভাষা বা দক্ষতা শেখা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো ইত্যাদি মস্তিষ্ককে সচল রাখে।
6. সংগঠিত থাকুন (Stay Organized):
টু-ডু লিস্ট, ক্যালেন্ডার, রিমাইন্ডার ব্যবহার করুন।
জিনিসপত্র নির্দিষ্ট জায়গায় রাখুন।
বড় কাজকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে নিন।
7. সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখুন (Social Connection):বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সাথে সময় কাটান।
8. ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন (Consult a Doctor):
ব্রেইন ফগ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় (কয়েক সপ্তাহের বেশি),খুব তীব্র হয় বা দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে তাহলে অবশ্যই ডাক্তার দেখান।
অন্তর্নিহিত কোনো চিকিৎসা অবস্থা (থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, ডিপ্রেশন, স্লিপ অ্যাপনিয়া, লং কোভিড ইত্যাদি) শনাক্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসাই ব্রেইন ফগ দূর করতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে বলা যায় ব্রেইন ফগ নিজে কোনো রোগ নয়, কিন্তু এটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক বা মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন (ঘুম, খাদ্য, ব্যায়াম, চাপ কমানো) প্রায়ই ব্রেইন ফগ উপশমে সাহায্য করে। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি, যাতে এর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা যায়।
ফারজানা রফিক
২৪.০৬.২০২৫