17/09/2025
প্রশ্ন: মিলাদ ইত্যাদি নিয়ে এতো এতো প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, এটা ছেড়ে দিলে সমস্যা কোথায়?
উত্তর: আসলে এখানে বিষয়টা শুধু মিলাদকে নিয়ে নয়। এটা মূলত: একটা প্রজেক্টের অংশ। এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। অনেকে নজদী - তাইমীদের বাহ্যিক দাবী দেখে মনে করে, বিষয়টা ছেড়ে দিলে সমস্যা কোথায়? তারা একইভাবে কুরআন - সুন্নাহের অনুসরণের সুন্দর দাবীর আড়ালে ইজতিহাদ, মুজতাহিদ ইমামগণের মাজহাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সালাফের অনুসরণের ভালো দাবীর আড়ালে দেহবাদী হিন্দুয়ানী কুফরী আক্বিদার চর্চা করে। এজন্য তাদের শ্লোগানের চেয়ে বাস্তবতা বোঝাটা আমাদের জন্য জ্বরুরি। তাদের কথা ও দাবী বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুন্দর হয়। কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। বাহ্যিকভাবে বলবে, আমাদের সুন্নাহ অনুসরণ করা উচিৎ, বিদয়াত বর্জন করা উচিৎ। নবীজীর ভালোবাসা হবে তাকে অনুসরণের মাধ্যমে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এইসব ভালো কথার পেছনে রয়েছে ভয়ঙ্কর কিছু দূরভিসন্ধি। মূলত: এর সূচনা হয়েছে ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয়ের বিকৃতির মাধ্যমে এবং সেটি শুরু করেছে ইবনে তাইমিয়া।
ইবনে তাইমিয়াকে সর্বশেষ যখন বন্দী করা হয়, সেই বন্দীর ঘটনাটি দেখুন:
১। ইবনে তাইমিয়াকে বন্দী করা হয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা হারাম ফতোয়া দেয়ার কারণে। কেউ যদি সফর করেও, সফরটি হারাম হওয়ার কারণে নামাজ কসর করা যাবে না।
২। ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র আব্দুল্লাহ ইস্কান্দারিকে বন্দী করা হয়। মসজিদের মুয়াজ্জিন বলেছিল, আলা ইয়া রাসূলাল্লাহ আন্তা ওসিলাতি ( হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমার ওসিলা)। এই কথার কারণে আব্দুল্লাহ ইস্কান্দারি তাকে কাফের বলে।
৩। ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিমকে বন্দী করা হয়েছিল। কারণ, তিনি ফিলিস্তিন সফর করে সেখানে ওয়াজ করেন, এই যে দেখুন আমি এখানে সফরে এসেছি কিন্তু ইব্রাহিম আ: এর কবর জিয়ারত করছি না। কারণ, নবীগণের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা হারাম। একই কথা তিনি নাবুলুস শহরে গিয়ে বলেন। এবং নবীজীর কবর জিয়ারতের বিষয়েও বলেন, শুধু মসজিদে নববী জিয়ারতের জন্য সফর করা যাবে, নবীজীর কবর জিয়ারতের জন্য সফর করা হারাম। তখন নাবুলুস শহরের লোকেরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে সেখানকার কাজী তাকে রক্ষা করে। পরে ইবনে তাইমিয়ার সাথে তাকেও শাস্তি দেয়া হয়।
৪। সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাজি: নবীজী যেখানে যেখানে মক্বা - মদিনার সফরে নামাজ আদায় করেছে সেখানে নামাজ আদায় করতেন। ইবনে উমর রাজি: এর এই আমলকে শিরকের মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছে ইবনে তাইমিয়া।
ইবনে তাইমিয়া শুধু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করাকে হারাম বলেনি, বরং নবীজীর ইন্তেকালের পর তার সত্ত্বার ওসিলা দিয়ে দু’য়া করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আল্লামা ত্বকিউদ্দীন হিসনী বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। আল্লামা ত্বকিউদ্দীন হিসনীর মতে, নবীজীর প্রতি এই বিদ্বেষের বিষয়গুলো ইবনে তাইমিয়া মূলত: ইয়াহুদীদের কাছ থেকে নিয়েছে। আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত তার বক্তব্যসহ পূর্বে লিখেছি। ইবনে তাইমিয়ার এই গোস্তাখীপূর্ণ আচরণ আহলে বাইতের প্রতিও প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে হযরত ফাতেমা রা: ও হযরত আলী রা: এর প্রতি তার গোস্তাখীপূর্ণ বক্তব্য বিখ্যাত।
এই যে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিষয়ে এধরণের গোস্তাখীপূর্ণ আচরণ শুধু একটি দু’টি মাসআলাতে নয়। বরং ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এটি সম্পূর্ণ একটি প্রজেক্ট। যেই প্রজেক্টের অধীনে ধীরে ধীরে নবীজীর তা’জীম ও মোহাব্বত থেকে উম্মতকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যা যা প্রয়োজন সেগুলো করা হয়েছে।
যেমন,
১। ইবনে তাইমিয়ার ভাবধারায় গড়ে ওঠা ইবনে আবিল ইজ্জ তার সময়কার বিখ্যাত এক কবি নবীজীর প্রশংসায় কিছু কবিতা লিখলে এর বিভিন্ন অংশ ইবনে আবিল ইজ্জ কেটে দেয়। ফলে ইবনে আবিল ইজ্জের বিরুদ্ধেও সেসময়ের বিখ্যাত আলিমরা বিচার কার্য পরিচালনা করেন।
২। ইবনে তাইমিয়ার চিন্তা - চেতনা প্রতিষ্ঠায় ওহাবীদের উত্থান হলে, তাদের দাওয়াতেরও মূল চেতনা হয় নবীজীর আজমত, মোহব্বত সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ের বিরোধিতা করা।
যেমন,
১। দালাইলুল খাইরাত নামক দুরুদ ও সালামের কিতাবকে দালাইলুশ শিরক বলা।
২। নবীজীর ওসিলাকে সরাসরি শিরক বলা। এবং তাদের দশটি ঈমান ভঙ্গের কারণের মাঝে দ্বিতীয় কারণ হিসেবে এটিকে রাখা।
৩। ক্বাসীদাতুল বুরদার বিভিন্ন প্রশংসাবাণী ও কবিতাকে শিরক বলে দেয়া।
৪। নবীজীর কাছে শাফায়াতের আবেদনকে শিরক বলা।
৫। নবীজীর স্মৃতি - সংক্রান্ত অধিকাংশ বিষয়কে মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা, সেগুলোর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ বা সীমিত করে দেয়া। নবীজীর সাথে সম্পর্কিত বিষয় থেকে তাবাররুক হাসিলকে শিরক বলা।
৬। নবীজীর জীবনের প্রথম অংশে নাউজুবিল্লাহ তিনি তার বাপ - দাদার ধর্মের উপর ছিলেন কিংবা মুশরিক ইত্যাদি জঘন্য কথা বলা।
নবীজীর তা’জীম ও মহব্বতের জন্য মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত যত আমল ছিলো সেগুলোর বিরুদ্ধে এক প্রকার যুদ্ধ ষোষণা করা। কোনটাকে শিরক, কোনটাকে বিদয়াত ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। যেমন, মিলাদ - ক্বিয়াম, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মসজিদের মিনার থেকে নবীজীর উপর দুরুদ ও সালাম পাঠ, এভাবে নবীজীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। এগুলোর সবই করা হয়েছে, শিরক - বিদয়াত দূর করে তাওহীদ ও সুন্নত প্রতিষ্ঠার নামে। মদীনা মুনাওয়ারা বলা যাবে না, নবীজীকে সাইয়্যেদুনা বলা যাবে না, এরকম শত শত বিষয় রয়েছে যেখানে তারা নবীজীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তা’জীম ও মোহাব্বতের বিরোধিতা করে থাকে শিরক - বিদয়াতের শ্লোগান তুলে। সবগুলো বিষয় একত্র করলে এটা যে শুধু বিচ্ছিন্ন একটি দু’টি মাসআলা নয়, বরং এটি সম্পূর্ণ সুচিন্তিত একটি প্রকল্প সেটি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়।
আর এই প্রকল্পের পেছনে রয়েছে দ্বীন ও শরিয়াতের ভেতরে বড় ধরণের বিকৃতি ও ইয়াহুদিয়াতের নানা চিন্তা - চেতনার প্রভাব। তাওহীদ - শিরক সহ দ্বীনের বড় বড় আক্বিদার কিছু বিষয় ইবনে তাইমিয়া ইয়াহুদী দার্শনিক মুসা ইবনে মাইমুনের কাছ থেকে নিয়েছে। ইবনে তাইমিয়ার দ্বীনের মাঝে বড় বড় বিকৃতির একটি বড় বিকৃতি হলো, তাওহীদের ধারণায় বিকৃতি। শরীয়াতে তাওহীদ ও শিরকের মাঝে পার্থক্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কারও মাঝে রব হওয়ার গুণ আছে কি না সেটা বিশ্বাস করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও মাঝে রব হওয়ার গুণ বিশ্বাস করলে শিরক হয়, বিশ্বাস না করলে শিরক হয় না। এক্ষেত্রে নজদী - তাইমীরা রব হওয়ার গুণ থাকার বিশ্বাসকে তাওহীদের ধারণা থেকে বাতিল করে দিয়েছে। শুধু বাহ্যিক আমল নির্ভর কিছু বিষয়কে সরাসরি তাওহীদ ও শিরকের মূল বানিয়েছে। যেমন, কোন ব্যক্তি বা বস্তুর তা’জীম বা সম্মান করা। এখন নজদী - তাইমীদের কাছে কোন সম্মান শিরক আর কোন সম্মান শিরক নয়, সেটা পার্থক্যের কোন মানদন্ড নেই। স্বাভাবিক কোন সম্মানের চেয়ে একটু বেশি সম্মান দেখালেই সেটা তাদের কাছে শিরক হয়ে যায়। আর আহলে সুন্নতের কাছে, তা’জীম বা সম্মান শিরক হওয়া বা না হওয়ার মূল মানদন্ড হলো, যেই বস্তু বা ব্যক্তিকে সম্মান করা হচ্ছে তার মাঝে খোদা বা রব হওয়ার কোন গুণ বিশ্বাস করা হচ্ছে কি না। বিশ্বাস করা হলে শিরক, না হলে শিরক নয়। এজন্য নজদীদের কাছে তাহাজ্জুদ না পড়ে ঘুমিয়ে থাকা শিরক, স্ত্রীকে অধিক মহব্বত করা শিরক, নবীজীকে বেশি তা’জীম ও সম্মান করা শিরক। আহলে সুন্নত বলে, রব বা খোদা হওয়ার বিশ্বাস ছাড়া যতই সম্মান করা হোক, সেটা শিরক হবে না। রব বা খোদা হওয়ার কোন গুণ থাকার বিশ্বাস না করলে স্ত্রীকে যতই মহব্বত করা হোক শিরক হবে না।
দ্বীনের একেবারে মৌলিক একটি বিষয় থেকে যেই বিকৃতির সূচনা সেটি এখন খোদ নবীজী থেকে উম্মতকে বিচ্ছিন্ন করার প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। যা দ্বীনকে তার মূল থেকে উপড়ে ফেলার নামান্তর। যদিও বাহ্যিকভাবে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও শিরক - বিদয়াত দূর করার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দ্বীনের ভেতরে এতো বড় ভয়ঙ্কর বিকৃতি করা হচ্ছে যা নবীজী থেকে উম্মতকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এজন্যই হয়ত নবীজী সাল্লাল্লাহু আালাইহি খারেজীদের সম্পর্কে বলেছেন, তারা দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো কথা বলবে। তাওহীদ প্রতিষ্ঠা আর শিরক দূর করার কথার চেয়ে ভালো কথা আর কী হতে পারে? কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এই ভালো কথার মূল্যায়ন করেননি। বরং বলেছেন, তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়।
দ্বীনের মাঝে এতো বড় বিকৃতির এই প্রজেক্টের ছোট মাসআলা হোক কিংবা বড় মাসআলা, আমরা সেগুলোর সমর্থন করব না। অনেক সময় মাসআলা ছোট হতে পারে কিংবা একটা দু'টো বিষয়ে তাদের থেকেও ভালো কথা, মহব্বতের কথা থাকতে পারে, তবে এখানে পুরো একটা মানহাজের সমস্যা। যেমন, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদয়াত বলে এটা থেকে বিরত থাকতে বললেও আবার সওয়াব পাওয়ার কথা ইবনে তাইমিয়া বলেছেন। এরকম কিছু কিছু ভালো বিষয়ও আছে। তবে সামগ্রিকভাবে সম্পূর্ণ মানহাজটিতে দেহবাদ, নাসেবিয়াত, খারেজিয়াত, নবীজীর শান-মান নিয়ে বেয়াদবি, আইম্মা কেরামকে তাকফির - তাবদিসহ বড় বড় সমস্যায় জর্জরিত। এজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, নবীজীর আজমত - মহব্বত জিন্দা রাখার। তবে এই গভীর ষড়যন্ত্রে অনেকে না বুঝে অংশীদার হয়, আমরা সবর ও তাহাম্মুলের সাথে সঠিক বিষয় উম্মতের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাওহীদ প্রতিষ্ঠার নামে দায়েশীপণা, কুরআন - সুন্নাহ অনুসরণের নামে মাজহাবের ইমামগণের বিরুদ্ধে বিষোদগার, আসমা ও সিফাতের নামে পুরো উম্মতের উলামায়ে কেরামকে তাকফির - তাবদী, শিরক - বিদয়াতের নামে নবীজীর আজমত - মহব্বতের বিরুদ্ধে অবস্থানসহ সকল বিষয়ে আমাদেরকে ধৈর্য্য ও সবরের সাথে কাজ করে যেতে হবে। ফেতনা যত বড়ই হোক, মুমিনদের ত্যাগ ও সবরের মাধ্যমে ইনশা আল্লাহ দ্বীন টিকে থাকবে। এজন্য এগুলোকে আমরা বিচ্ছিন্ন একটি দু'টি মাসআলা হিসেবে দেখি না, বরং এটি দ্বীনকে ভেতর থেকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখি। শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ সেদিন সুন্দর একটি কথা বলেছেন, দ্বীনকে কেবল দ্বীনের নামেই ধ্বংস করা সম্ভব।
لا ينقض الدين الا باسم الدين
এটা মাথায় রেখেই আমাদেরকে কাজ করতে হবে। দ্বীনকে যারা ভেতর থেকে ধ্বংস করতে চায়, তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
Copy post