
19/05/2025
স্বাধীনতা মানে শুধু বিজয় নয়, একটি জাতিসত্তার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা
I.
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই যুদ্ধ ছিল শুধু ভূখণ্ডের নয়, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার জন্য অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
এই মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহায়তা ছিল বাস্তব ও কৌশলগত। বিশেষত, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো এবং প্রায় ১ কোটিরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে ভারত মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েও পূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়নি? —কারণ বিভাজন ছিল অন্তর্নিহিত
স্বাধীনতার পর, যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, তা ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং জাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই রাষ্ট্র কাঠামোতে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের প্রয়োজন ছিল, তা গড়ে ওঠেনি। বরং সেই সময় থেকেই দুটি বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক ধারা বিকাশ পেতে থাকে:
১. মুক্তিযুদ্ধ-সমর্থিত গোষ্ঠী
যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিল, তারা ভারতকে একজন মুক্তিদাতা ও বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে। এ গোষ্ঠী ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীল চিন্তার পক্ষে অবস্থান নেয়।
২. মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী গোষ্ঠী
এই গোষ্ঠী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী ছিল। তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। মসজিদ-মাদ্রাসা ধ্বংস করেও মিথ্যাচার করে তারা ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়। তারা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে চলেছে এবং ভারতবিরোধিতা ও 'ধর্মপ্রাণ মুসলমান' বিরোধিতার নামে রাজনৈতিক চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
৫৪ বছর পরও বিভাজন??
ভারত বনাম পাকিস্তান প্রসঙ্গ আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যকর
আজকের বাংলাদেশে দেখা যায়:
একদল ভারতকে আজও কৃতজ্ঞতার চোখে দেখে, আরেকদল ভারতকে চিরশত্রু হিসেবে গালি দেয়।
একদল ইসলামের নামে পাকিস্তানি ভাবধারাকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়, আরেকদল ধর্মকে অরাজনৈতিক রাখতে চায়।
একদিকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে বিভাজন তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ভারতবিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, তাহলে বাংলাদেশ কি সত্যিই স্বাধীন?
স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ তখনই বাস্তবায়িত হয় যখন:
রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন দূর করতে পারে,
ধর্ম, ভাষা বা গোষ্ঠীগত পরিচয়কে ব্যবহার করে কেউ রাজনীতি করতে না পারে,
একটি পূর্ণাঙ্গ “স্বাধীন চেতা জাতীয় চরিত্র” গড়ে ওঠে।
বাংলাদেশ সেই জায়গায় এখনো পৌঁছাতে পারেনি। এখনো পাকিস্তানি ভাবধারা ও ভারতবিরোধিতার নামে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে ধর্মব্যবসা ও রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে। আর এর মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রকৃত ইসলামের মানসিকতা কোণঠাসা।
II. স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব বাতিল একমাত্র সমাথান স্কাধীনতার ফলভোগ করাঃ
১. সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলে:
“এই সংবিধানই হবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, এবং বাংলাদেশের মালিক হবে জনগণ।”
এবং ৮(২) ধারায় বলা হয়েছে:
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।
অর্থাৎ, স্বাধীনতার বিরোধিতা করা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা সংবিধান বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করা।
২. মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার অতীতে পদক্ষেপ নিয়েছে
(ক) রাজাকার/আলবদর চিহ্নিতকরণ ও বিচার
২০০৯ সালে “আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩” এর আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়।
অনেকেই ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন; কারও কারও নাগরিক মর্যাদা কার্যত বাতিল হয়েছে (যেমন: একাধিক রাজনীতিবিদের রাষ্ট্রীয় পদবি বাতিল)।
(খ) স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা
২০২০ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০,৭৮৯ জন রাজাকারের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে।
যদিও এটি চূড়ান্ত নয়, তবে এটি একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত প্রক্রিয়া—যা আইন ও প্রশাসনের দিক থেকে বড় পদক্ষেপ।
৩. আন্তর্জাতিক নজির: রাষ্ট্রবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নাগরিকত্ব বাতিল
বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে স্বাধীনতা বা সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ক) ভারত:
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন “মুসলিম লীগ” নিষিদ্ধ হয়।
পাকিস্তানপন্থী বা কাশ্মীর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত নাগরিক অধিকার সীমিত করা হয়।
(খ) জার্মানি:
নাৎসি আদর্শকে সমর্থনকারী সংগঠন বা ব্যক্তি চিহ্নিত হলে নাগরিকত্ব ও রাজনৈতিক অধিকার বাতিল হয়।
(গ) রুয়ান্ডা:
গণহত্যা বিরোধী আইন অনুযায়ী যারা তুৎসি জনগণের বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালের হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়, তারা আজীবন রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে গণ্য হয়।
৪. বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী সমাধান কী হতে পারে?
The Bangladesh Citizenship Act, 1951 (with amendments) অনুসারে—
ধারা ১৬(২):
“যে ব্যক্তি রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করে, তার নাগরিকত্ব সরকার বাতিল করতে পারে।”
প্রস্তাবযোগ্য আইনি ব্যবস্থা:
১. "স্বাধীনতাবিরোধী নাগরিকত্ব বাতিল আইন" (প্রস্তাবিত)
যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত বা রাষ্ট্র স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধীদের নাগরিকত্ব বাতিল।
কেউ বসবাস করলে তাঁকে "রাষ্ট্রবিহীন ব্যক্তি (Stateless Resident)" হিসেবে অস্থায়ী ভিসা বা নিয়ন্ত্রিত অধিকার দিয়ে রাখার বিধান।
২. "গণপরিচয় যাচাই আইন"
জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা ও সরকারি চাকরিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের অন্তর্ভুক্তি নিষিদ্ধ করা।
৫. মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ক ভারসাম্য
কিছু আন্তর্জাতিক কনভেনশন (যেমন: UN Convention on Statelessness) রাষ্ট্রকে নাগরিকত্বহীন করে ফেলা থেকে বিরত থাকতে বলে। তবে ব্যতিক্রম রয়েছে—
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকিতে থাকলে রাষ্ট্র এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে।
দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল আন্তর্জাতিক আইনেও বৈধ বলে গণ্য।
সুতরাং, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে রাষ্ট্রীয় অবস্থান সুদৃঢ় করতে হলে—
১. স্বাধীনতাবিরোধীদের নাগরিকত্ব ও অধিকার হরণ একটি ন্যায্য ও আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা
২. এর মাধ্যমে জাতিকে বিভাজন ও সংঘাত থেকে বাঁচানো সম্ভব
৩. রাষ্ট্র, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের সম্মান রক্ষার জন্য এটিই সময়োপযোগী নীতিগত পদক্ষেপ
স্লোগান হিসেবে বলা যায়:
“যে এই দেশের জন্মের বিরোধিতা করেছে, সে এই দেশের মালিক হতে পারে না।”
“বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাষ্ট্র, বিভাজনের নয়।”
আরও পড়ুন: https://www.news24bd.tv/details/222011