06/05/2025
লিখেছেন Tamzid Rahman.
অপবিবর্তন: পাঠ প্রতিক্রিয়া
লেখক: রাফাত শামস
প্রকাশনী: ঋদ্ধ প্রকাশ
জনরা: টেকনো থ্রিলার, সাইফাই থ্রিলার
সুদীর্ঘ উপন্যাস বহু আছে। কিন্তু একই সাথে সুদীর্ঘ, গতিশীল, আর সুপাঠ্য উপন্যাসের তালিকাটা বোধকরি খুব বড় হবে না। আর এই ছোট তালিকায় একটা সংযোজন হতে পারে রাফাত শামস এর “অপবিবর্তন”। বহুদিন মোটা বই পড়া হয় না। আর যেগুলো পড়া হয় সেগুলো সাধারণত ইংরেজী বইয়ের ইপাব ভার্সন। কাজেই মোটা বই হাতে নিতে একটু ভয় লাগছিল। আগ্রহ-জাগানো ফ্ল্যাপ আর প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে প্রমিসিং লাগায় নিয়ে নিয়েছিলাম বইটা। কিন্তু পড়ার জন্য হাতে নিয়ে মনে হচ্ছিল - এত মোটা বই কীভাবে শেষ করবো? কিন্তু বই পড়তে গিয়ে বুঝলাম এই বিশাল আকারের “গল্পবাহনের” গতি ঘন্টায় ৩৭৯.৮৬২ মাইল! পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে কখন যে শত শত পৃষ্ঠা পার হয়ে গেছি – বুঝতেও পারিনি। ট্রু পেজ টার্নার যাকে বলে। এটা আসলে কোনও রিভিউ না। বইটা পড়ে আমার যেমন অনুভূতি হয়েছে – সেটাই ব্যক্ত করার প্রচেষ্টা।
* যা নিয়ে অপবিবর্তন:
বাংলা ভাষায় সুপার সোলজার নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। মোটামুটি ”আন এক্সপ্লোর্ড টেরিটরি” বলা যায় (এইটার ভালো বাংলা এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না। অচেনা জগত?)। আর সেই টেরিটরিতে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের একটা নতুন জগত দেখিয়েছেন রাফাত শামস। মনে করুন, ল্যাব এ্যাক্সিডেন্টের ফলে সৃষ্টি হওয়া হাল্ক কে পরিকল্পিত ভাবে সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া নিয়ে উপন্যাসটা। যেখানে একদল মানুষ অতি গোপনে মানব শিশুদের ওপর বিভিন্ন ধরনের জিনেটিক ও রাসায়নিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাদের মাঝে ভয়ঙ্কর সব ক্ষমতা সৃষ্টির প্রয়াসে লিপ্ত। সাধারণ মানুষের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী, গতিশীল, বুদ্ধিমান, আর পরাক্রমশালী কিছু সৈনিক – যারা কোনও দেশ বা গোষ্ঠীর হয়ে যুদ্ধে নামলে প্রতিপক্ষের কোনও সুযোগই থাকবে না – এমন কিছু সুপার সোলজার তৈরী করার জন্য কাজ করে চলেছে কিছু অতি ক্ষমতাবান আর প্রভাবশালী মানুষ। গবেষণার এক পর্যায়ে একজন সোলজার হাতছাড়া হয়ে যায় গোপনে কার্যক্রম চালানো সেই প্রভাবশালীদের হাত থেকে। জড়িয়ে পড়ে পুলিশ আর প্রশাসন। সেইসাথে জীবন বদলে যায় কিছু সাধারণ মানুষের। এই সোলজারকে ফিরিয়ে আনতে ও বিষয়টার গোপনীয়তা রক্ষা করতে সেই প্রভাবশালী মানুষগুলো একের পর এক লা/শ ফেলতে দ্বিধা করে না। একটু একটু করে আত্মপ্রকাশ করে কয়েকটি পক্ষ – যাদের সবার লক্ষ্য সেই সুপার সোলজারের দখল নেয়া। এর মাঝে আবার কিছু পক্ষ হাজির হয় যাদের লক্ষ্য প্রতিশোধ অথবা সত্য উম্মোচন। এক ভয়ঙ্কর গতিশীল আর রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা হয়। পাঠককে নিয়ে যায় এক দম বন্ধ করা রোমাঞ্চকর যাত্রায়। দেশি ক্ষমতাধরদের ওপর ছড়ি ঘোরায় বিদেশী শক্তি, তাদের টেক্কা দিতে চায় ইগো ম্যানিয়াক মন্ত্রী। একের পর এক লাশের স্তুপ জমে, বিস্ফোরণের ঝলক আর ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে আসে সবকিছু, বিশ্বাসঘাতকতা আর নিষ্ঠুরতার বাহুল্যে পৃথিবীটাকে মনেহয় নরক। কিন্তু এই নরকে থাকাটা আপনি উপভোগ করবেন, মনে হবে জীবনের চেয়ে এই নরকটা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।
অপবিবর্তন পড়ার অভিজ্ঞতাটা আসলে ঠিক বই পড়ার মতো ছিল না। বরং মনে হচ্ছিল একটা চরম গতিশীল আর রোমাঞ্চকর সিনেমা দেখছি। একটা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ সিনেমায় যতগুলো ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করা হয় – তার প্রায় সবই ছিল এই উপন্যাসে। আর এই উপন্যাসের সিনেমাটিক হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি যেটা কাজ করেছে, তা হলো লেখকের রাইটিং স্টাইল বা লেখনশৈলী। এটা নিয়ে একটু আলাদা করে বলতেই হয়।
*লেখনশৈলী:
ব্যক্তিগত ভাবে একটা গল্প বা উপন্যাস পড়ার পেছনে আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া থাকে ভালো লেখনশৈলী। সেটা হতে পারে গভীর কাব্যিক মাধুর্যে মন্ডিত, রসাত্মক, আগ্রহোদ্দীপক, গতিময় – ইত্যাদি। অপবিবর্তন যে ধরনের উপন্যাস সেখানে কাব্যিক মাধুর্য বা রসাত্মক হওয়ার দরকার নেই, সেটা বরং উপন্যাসের গতিকে টেনে ধরতো। এই উপন্যাসে যেটা দরকার ছিল তা হলো আগ্রহোদ্দীপকতা আর গতিময়তা – যা ছিল এই উপন্যাসের পরতে পরতে। বাক্য গঠনে কোনও বাহুল্য নেই – ঘটনা বুঝতে, চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখতে, দৃশ্যের গতির সাথে তাল মেলাতে ঠিক যতটা দরকার ততটাই ব্যবহার করেছেন লেখক, যা সুদীর্ঘ উপন্যাসটিকে পরিনত করেছে দ্রুতগতির এক সুপাঠ্য আখ্যানে। এ্যাকশন দৃশ্যগুলো পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে মাসুদ রানা আবার মাঝে মাঝে হলিউডের এ্যাকশন সিনেমার কথা মনে পড়ছিল। শেষের দিকে রেস্টুরেন্টে একটা গোলাগুলির দৃশ্য পড়তে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করেছিলাম, আমি দম আটকে রেখেছি!
লেখনশৈলীর আরেকটা বিষয় যা চোখে পড়েছে, তা হলো গল্পের প্রয়োজনে অনেক বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল শব্দ বা টার্ম ব্যবহার করা হলেও সেগুলো লেখক ব্যাখ্যা করেছেন সুদক্ষ সাবলীলতার সাথে। ব্যাপারটা ইনফো-ডাম্পিং মনে না হয়ে, মনে হয়েছে যে, এটা না থাকলেই বরং গল্পটা অসম্পূর্ণ হতো। অনেক বইয়ে দেখেছি লেখক নিজের জ্ঞান জাহির করার জন্য জটিল জটিল বিষয় সামনে নিয়ে আসেন, কিন্তু তার কোনও ব্যাখ্যা দেন না। পাঠককে নিজ দায়িত্বে তা বুঝে বা খুঁজে নিতে হয়। অপবিবর্তনে সেই কষ্টটা করতে হয়নি। অপ্রলিত বা অপরিচিত টার্ম থাকলেও সাবলীল ভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার কারণে, পড়তে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার বদলে অন্যরকম তৃপ্তি দিয়েছে।
*চরিত্রায়ণ:
অপবিবর্তনের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা আমার মনে হয়েছে এর চরিত্রগুলো। প্রতিটা চরিত্রের একাধিক পরত রয়েছে, যা তাদের ‘মানুষ’ করে তুলেছে। প্রতিটা চরিত্রের আছে নিজস্ব একটা গল্প, নিজস্ব দর্শন আর মোটিভ। একটা জিনিস দেখে অবাক লেগেছে – এতগুলো চরিত্রকে আলাদা আলাদা গল্প আর দর্শন দেয়ার কাজটা করতে গিয়ে লেখক খুব বেশি জায়গা নষ্ট করেননি – কিন্তু অল্প পরিসরেই তারা নিজের মতো করে ফুটে উঠেছে, সেই সাথে মূল প্লটও এগিয়ে গেছে সমান তালে। চরিত্রের ‘ব্যাক স্টোরি’ গল্পের গতিতে বাধ সাধেনি।
অপবিবর্তন আপনাকে মানব চরিত্রের সব অন্ধকার দিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। বিশেষ করে সমাজের এমন কিছু মানুষ যারা ভদ্রলোকের মুখো শপরে থাকে কিন্তু আড়ালে সাক্ষাৎ শয়তান – তাদের বেশ কয়েকজনের দেখা পাবেন এখানে। বিশেষ করে, হাই প্রোফাইল রাজনীতিবিদদের একদম উ’ল’ঙ্গ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অপবিবর্তন পড়তে গেলে এদের প্রতি আপনার সহজাত ঘৃ/ণা কয়েক পরত উপরে উঠতে বাধ্য। ”ওপরমহল” নামে একটা চরিত্র আছে – যার সাথে সময় কাটানো পর আপনার ইচ্ছা করবে, ‘যাই, রান্নাঘরের মরিচ কাটা ছুরিটায়ে একটু লবণ দিয়ে ব্যাটার বিশেষ অঙ্গটা কেটে নিয়ে আসি’। আরেকটা চরিত্র আমার মনে ভালো দাগ কেটেছে, সেটা হলো রাত্রি। একজন মার্সিনারি। রাত্রিকে নিয়েই একটা আলাদা উপন্যাস হতে পারে। অপবিবর্তনের যদি পরবর্তী কোনও খন্ড আসে, আমি চাইব রাত্রিকে নিয়ে যেন আরও কাজ হয়। এছাড়া স্মার্ট ও কৌতুহলী ওসি প্রদীপ কুমার সাহা একটা দারুন চরিত্র। ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞায় নরক নামিয়ে আনা সাবেক সেনাকর্মকর্তা আহনাফ, বাবার খোঁজে মরিয়া হয়ে থাকা আমেরিকা ফেরত নাজিয়া, অথবা সেই লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যান থেকে পালিয়ে যাওয়া সুপার সোলজার ছেলেটা – প্রতিটা চরিত্র নিয়েই আলাদা করে কথা বলা যায়। তবে বেশি কথা বলতে গেলে স্পয়লার হয়ে যাবে। শুধু এটুকুই বলি, প্রতিটা চরিত্রকেই অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী করা হয়েছে, যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব গল্পটা আপনাকে তাদের প্রতি আলাদা অনুভূতির জন্ম দেবে। আর সবচেয়ে মজার বিষয়টা হলো, কে-যে নায়ক আর কে-যে খলনায়ক – এটা বের করতে করতেই আমার ”খবর” হয়ে গিয়েছিল।
*প্লট ও গল্পের গাঁথুনি:
অপবিবর্তন পড়তে গিয়ে একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছিল, এটা কোনও বই না, এটা একটা সিনেমা। ধুন্ধুমার এ্যাকশন, প্রতিটা চরিত্র অল টাইম দৌড়ের উপর, কখন কার কী হয়ে যায় কিছুই বলা যায় না। একদম পয়সা উসুল ইন্টারটেইনমেন্ট যাকে বলে। একটা পিওর সাইফাই টেকনো থ্রিলার যেখানে পদে পদে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিপদ আর মৃত্যু। মাথায় হাত তোলার মতো বিরাট কোনও টুইস্ট আমার চোখে না পড়লেও গল্পের গাঁথুনি আপনাকে আটকে রাখবে ঘন্টার পর ঘন্টা। এরপর কী হবে? কোথায় যাচ্ছে ওরা? পরের অধ্যায়ে কী আছে? – এইসব প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগিয়ে আপনাকে ধরে রেখে আপনার সব হিসাব উল্টে যাবে পরিনতিতে গিয়ে।
*আরো যা থাকতে পারতো:
এতো ভালোর ভিড়ে তিনটা জিনিস আমার মনে হয়েছে আরেকটু থাকতে পারতো। এক. দৃশ্যগুলোর স্থানের বর্ণনা যদি আর একটু বেশি থাকতো, তাহলে কল্পনা করাটা আরো সুবিধা হতো । দুই. চরিত্রগুলোর অনুভূতির বর্ণনা যদি আরেকটু দীর্ঘ হতো, আর তিন. কিছু কিছু অধ্যায়ে দু’টো চরিত্র ও স্থানের আলাদা আলাদা ঘটনার প্রেজেন্টেশন একটু অগোছালো লেগেছে – একটু ডিটেইল বাড়ালে আমার মনেহয় পড়তে আরও মজা লাগতো। তবে, এগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত চাওয়া। এগুলা থাকলে হয়তো গল্পের এই গতিতে ভাটা পড়তো, যা এই উপন্যাসের অন্যতম শক্তির জায়গা।
শেষ কথা:
ওরা চলে যাচ্ছে কেন? আরেকটু থাকুক। আহ, শেষ হয়ে গেল! – শেষ পৃষ্ঠা পড়ার পর এগুলো আমার অনুভূতি। গল্প শেষ হলেও ইচ্ছা করছিল ঘটনাগুলোর সাথে থাকি। দেখি এরপর কী হয়, কী করে ওরা। ৪০০ পৃষ্ঠার একটা বই শেষ করার পর এমন অনুভূতি দিতে পারা একটা সার্থক গল্পের চিহ্ন বহন করে। দিন শেষে তাই পড়াটা সার্থক বলতে হবে। লেখকের জন্য শুভকামণা। পরের খন্ড যদি আসে, আশা করি রাত্রির চরিত্রটাকে আরও খানিকটা জায়গা দেবেন।