30/06/2025
হাইব্রিড মুরগি যেভাবে বদলে দিয়েছে মানুষের খাদ্যাভ্যাসঃ
মুরগির গল্প শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আট হাজার বছর আগে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন জঙ্গলে ‘রেড জঙ্গলফাউল’ নামের একটি বন্য পাখি ঘুরে বেড়াত। সেই পাখিই ধীরে ধীরে মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোয় প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে জানা যায় কীভাবে মানুষ পাখিটিকে গৃহপালিত করেছিল। প্রথমে হয়তো তারা শুধু ডিমের জন্য এগুলোকে রাখত। পরে বুঝতে পারল এর মাংসও খাওয়া যায়। প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় মুরগি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। চীনে এটি সম্রাটদের খাদ্যতালিকায় স্থান পায়, ভারতে এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রাচ্য হয়ে মুরগি যখন ইউরোপে পৌঁছায়, তখন এর ব্যবহার আরো বিচিত্র হয়। গ্রিকরা মুরগির লড়াইকে একটি খেলায় পরিণত করে, রোমানরা এর মাংসকে রাজকীয় ভোজের অংশ বানায়। কিন্তু মধ্যযুগ পর্যন্ত মুরগি ছিল মূলত সম্পদশালী পরিবারের খাদ্য। সাধারণ কৃষকরা খুব বেশি মুরগি পালতে পারত না, কারণ সেগুলো তেমন ডিমও দিত না, মাংসের পরিমাণও ছিল সীমিত।
অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। যখন চার্লস ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব দিলেন। বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করলেন কীভাবে প্রাণীর প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কাঙ্ক্ষিত গুণাবলি বাড়ানো যায়। বিশ শতকের শুরুতে আমেরিকা ও ইউরোপের বিজ্ঞানীরা মুরগি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। তারা লক্ষ করলেন, কিছু মুরগি অন্যগুলোর চেয়ে বেশি ডিম দেয়, কিছু মুরগি দ্রুত বড় হয়। এ পর্যবেক্ষণ থেকেই শুরু হয় সিলেক্টিভ ব্রিডিং বা নির্বাচিত প্রজননের যুগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে খাদ্যঘাটতি ও অপুষ্টি মোকাবেলার জন্য দ্রুত উৎপাদনশীল প্রাণিসম্পদের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯২০-৩০ সালের দিকে আমেরিকায় হেনরি ওয়ালেস নামের একজন কৃষিবিদ লক্ষ করলেন, যদি বিভিন্ন জাতের মুরগিকে সংকরায়ণ করা যায়, তাহলে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে। তিনি লেগহর্ন জাতের মুরগির সঙ্গে রোড আইল্যান্ড রেড জাতের মুরগির সংকরায়ণ করে যে বাচ্চা পেলেন, সেগুলো ছিল আশ্চর্য রকমের উৎপাদনশীল। এ মুরগিগুলো বছরে ৩০০টিরও বেশি ডিম দিতে সক্ষম ছিল। ওয়ালেস তার এ উদ্ভাবন নিয়ে হাই-লাইন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক হাইব্রিড মুরগির সূচনা। হাইব্রিড মুরগি পালনের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হাই-লাইন ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৩৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানি আজ বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পোলট্রি জেনেটিকস কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি, যাদের প্রযুক্তি ১২০টিরও বেশি দেশে ব্যবহৃত হয়।
এরপর বিজ্ঞানীরা একের পর এক নতুন নতুন হাইব্রিড তৈরি করতে লাগলেন। ১৯৫০ সালের দিকে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এমন কিছু মুরগি তৈরি করলেন যেগুলো আরো কম খাদ্য খেয়ে আরো বেশি ডিম দিতে সক্ষম। ১৯৪৪ সালে ডেক্যালব পোলট্রি রিসার্চ কোম্পানির শুরু হয়, যারা ডেক্যালব হোয়াইট নামে জনপ্রিয় জাত তৈরি করে। শেভার পোলট্রি ব্রিডিং ফার্মস ১৯৫০ সালে কানাডায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা শেভার স্টারক্রস জাত দিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। ১৯৬০ সালে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত লোহম্যান টিয়ারজুখট, তারা বাজারে আনে লোহম্যান ব্রাউন। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে শুরু হয় হাইব্রিড লেয়ার শিল্পের বিশ্বজয়। মুরগি পালন একটি ছোটখাটো কৃষিকাজ থেকে বিশাল শিল্পে পরিণত হতে শুরু করে।
কিন্তু শুধু আমেরিকা বা ইউরোপে এ প্রযুক্তি থাকলে তো হতো না। সারা বিশ্বে এ উদ্ভাবন ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগিতার। ১৯৬০-৭০ সালের দিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোয় হাইব্রিড মুরগি নিয়ে যেতে শুরু করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, এ প্রযুক্তি যদি এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় পৌঁছে দেয়া যায়, তাহলে সেসব দেশের মানুষের পুষ্টির অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হতে পারে।
থাইল্যান্ডের সিপি গ্রুপ ছিল এ আন্দোলনের অগ্রদূত। তারা স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে চুক্তি করে হাইব্রিড মুরগি দিতে শুরু করল। কৃষকরা মুরগি পালবেন, কোম্পানি তাদের খাদ্য, ওষুধ ও প্রশিক্ষণ দেবে, আর উৎপাদিত ডিম ও মাংস কোম্পানি কিনে নেবে। এই মডেল এতটাই সফল হয়েছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে থাইল্যান্ড বিশ্বের শীর্ষ মুরগি রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। ভারতেও একই ধরনের বিপ্লব ঘটে। ভেনকি’স নামের একটি কোম্পানি ভারতে হাইব্রিড মুরগির প্রসার ঘটায়। আফ্রিকার কেনিয়া ও নাইজেরিয়ায় মিনি পোলট্রি ফার্মিং প্রকল্প চালু হয়। এ প্রকল্পগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল দরিদ্র পরিবারগুলোকে কিছু মুরগি দিয়ে দেয়া, যাতে তারা অন্তত নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত ডিম বা মাংস বাজারে বিক্রি করতে পারে। এ সহজ ধারণাই লাখ লাখ আফ্রিকান পরিবারের আয়ের উৎস তৈরি করে দেয়। লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল এ খাতে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পায়। আজ ব্রাজিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুরগি রফতানিকারক দেশ। তাদের উৎপাদিত মুরগির মাংস ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়।
এ বিস্তার শুধু কৃষি খাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফাস্ট ফুড শিল্পের বিকাশে হাইব্রিড মুরগির ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৫০ সালে আমেরিকায় কেএফসি যখন প্রথম ফ্রায়েড চিকেন বিক্রি শুরু করে, তখন তারা স্থানীয় মুরগি ব্যবহার করত। কিন্তু যখন তারা বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ শুরু করল, তখন তাদের প্রয়োজন ছিল এমন মুরগি যা সব দেশেই একই রকম স্বাদ ও আকৃতিবিশিষ্ট হবে। হাইব্রিড মুরগিই এ চাহিদা পূরণ করে। আজ কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ড’সের মতো ফাস্ট ফুড চেইনগুলো যে মুরগির মাংস ব্যবহার করে তার পুরোটাই আসে এই হাইব্রিড মুরগি থেকে।
খাদ্যাভ্যাসে এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের পুষ্টির ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ডিম খাওয়ার পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। হাইব্রিড লেয়ার মুরগির সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রভাব পড়েছে মানুষের খাওয়ার প্যাটার্ন ও পুষ্টির মানে। আগে যেখানে প্রোটিন বলতে বোঝাত গরু-ছাগলের মাংস, যেগুলো কিনা ছিল বেশ ব্যয়বহুল। এখন চিকেন ও ডিম হয়ে উঠেছে সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও সহজলভ্য বিকল্প।
ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকসের মতে, ১৯৫০ সালে বিশ্বে বছরে মাথাপিছু ডিমের ব্যবহার ছিল মাত্র ৩০টি, আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০টিতে। এ অসাধারণ পরিবর্তনের পেছনে হাইব্রিড লেয়ার মুরগির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাইব্রিড প্রযুক্তির আগে ডিম ছিল বিলাসদ্রব্য। ১৯৩০ সালে আমেরিকায় এক ডজন ডিমের দাম ছিল একজন শ্রমিকের দেড় ঘণ্টার মজুরির সমান। আজ এটি মাত্র ৬ মিনিটের মজুরি। ১৯৬০-২০২০ সময়ে বিশ্বে মুরগির মাংসের ব্যবহার বেড়েছে পাঁচ গুণ। হাইব্রিড মুরগি নিয়ে রয়েছে কিছু সমালোচনাও। ফ্যাক্টরি ফার্মিংয়ে মুরগিগুলোকে অতি ঘনিষ্ঠ ও অপ্রাকৃতিক পরিবেশে রাখা হয়, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জিনগত বৈচিত্র্যহীনতার কারণে রোগের ঝুঁকি (যেমন অ্যাভিয়ান ফ্লু) বেড়ে যায়। এছাড়া পরিবেশ দূষণ ও ‘খাঁচায় বন্দিত্বের অমানবিকতা’র মতো সমালোচনা রয়েছে। টেকসই, নৈতিক ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত না হলে এ শিল্প ভবিষ্যতে মানবস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
একসময়ের বনে ঘুরে বেড়ানো এক বুনো পাখিকে মানুষ যখন ঘরে তুলে আনল কেউ ভাবেনি যে এটি একদিন বৈশ্বিক খাদ্যনীতির কেন্দ্রে জায়গা করে নেবে। হাজার বছরের অভিযোজনে মুরগি যেমন খাপ খাইয়ে নিয়েছে, তেমনি মানুষও তাকে বদলে নিয়েছে নিজের প্রয়োজনমাফিক।