17/09/2025
খেটে খাওয়া মানুষ যেন মনে না করেন, 'আমরা কি প্রতারিত হয়েছি?'
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের কার্যক্রম ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এতো দিন যেই সংস্কার সংস্কার করে গোটা জাতিকে উত্তেজনায় ভাসিয়ে রাখা হয়েছে, সেই ঢেউ ঐক্যমত্য কমিশনে আছড়ে পড়েছে। এরপর যা চলছে তাতে সাধারণ মানুষ মনে করতে শুরু করেছে, এতো দিন কী বলা হয়েছে, কী বোঝানো হয়েছে, আর এখন কী দেখছি?
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন প্রকাশ্যে যেই আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক চলছে, তা একেবারেই দলীয় স্বার্থে। অর্থাৎ সংস্কার বা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের যেই আশার বাণী গণ অভ্যুত্থানের পর থেকে শুনে আসছিল নাগরিকরা, তা এখন রাজনৈতিক দলের ফায়দা হাসিল করার কৌশল ছিল কিনা, এমন সন্দেহ জাগলেও হয়তো দোষের কিছু না।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ছিল ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল। এরপর শুরু হলো, আন্দোলনের কে কী করেছে, এমন ক্যাচাল। কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে, নাগরিকদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান বা জুলাই গণ অভ্যুত্থানে কারা অংশীদার আর কারা দাবিদার।
এরপর সংস্কার নিয়ে শুরু হয় হৈচৈ। মাঠে ময়দানে, টকশোতে, স্যোশাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে কতো কতো পরামর্শ, কতো যে বয়ান আর চিল্লাচিল্লি। আবার সরল মনের মানুষের একটি অংশ তো আরো বেশি আগ্রহী। সংস্কার হতে হবে, সংস্কার না হলে দেশে আর কিছু হতে পারবে না। এমনি কেউ কেউ তো রীতিমত সপরিবারে রাজপথে শুয়ে পড়ার হুমকি ধমকি দেয়া শুরু করল। তারা যে এখন কী করছেন, তা কে জানে।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোও জানে, তারা যা গিলাবে হুজুগে বাঙ্গালী খ্যাত আমরা তাই চোখ বন্ধ করে হজম করতে পারবো। এজন্য বাঁশির সুর যাই হোক, তাল দিতে হবে।
কিন্তু এই তাল মিলিয়ে চলা মানুষের মধ্যে কেউ কেউ তো বেতালে চলা থাকতে পারে, সে কথা কি রাজনৈতিক দলগুলো জানে না? আপনারা যেই শহীদের রক্তের মালিকানা দাবিদার বা অংশীদার যাই হোন না কেন, এখন কোন রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন? এখন সবাই সম্ভবত রক্ত ধুয়ে মুছে সাফ করে আবার পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছেন। কিন্তু যাদের চোখের সামনে এখনো সেই শহীদের রক্ত জীবন্ত তাদের কী দিয়ে বোঝাবেন? সন্তান হারা মায়ের চোখের পানি, আহতদের হাত পা ছাড়া শরীর বয়ে বেড়ানো আর্তনাদ কোন রাজনীতি দিয়ে পূরণ করবেন?
দেশে লাখ লাখ তরুণ যুবক বেকার, কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোন কার্যক্রম নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য পদক্ষেপ দৃশ্যমান নেই। সাধারণ মানুষের মনে 'মবসন্ত্রাস' আতঙ্ক। ব্যবসা বাণিজ্য নেই, জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ঢেলে সাজানোর চেষ্টা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসেনি। রাস্তা ঘাট, অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির। বৈদেশিক কর্মসংস্থান মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণ নেই কোন বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ।
দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে আছে শুধু হাততালি পাওয়ার জন্য কথামালার রাজনীতি। তালি পাওয়ার মতো কথা বলা সহজ, কিন্তু কাজে পরিণত করা সহজ নয়। আর তালি বারবার যাবে না। পেটে ভাত না থাকলে, কথামালার রাজনীতি বেশি দিন গিলানো যায় না।
এখন না হলেও, নিকত ভবিষ্যতে প্রশ্ন কেউ কেউ করবে, সংস্কার কী দিলো? আপনারা গেল ১৩ মাসে কয়বার, কোন কোন বিষয় সামনে এনে সাধারণ নাগরিকের উত্তেজিত করেছেন? রাজনৈতিক হীন স্বার্থ উদ্ধারে সরল মনের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন? কখনো এই নির্বাচন না, ঐ নির্বাচন আগে। আবার এটা না হলে, ওটা হবে না। এইটা লাগবেই। এতো বছর চাই, না হলে সব ছারখার করে ফেলবো। এইভাবে না, ঐভাবে নির্বাচন চাই। কতো কি আওয়াজ সৃষ্টি করে, সমাজে পরিস্কার একটি বিভেদ তৈরি করে দিলেন, এর দায় কে নেবে?
গণ অভ্যুত্থানের মিত্রশক্তির মধ্যে যারা সাধারণ মানুষ আছে , তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো যে বিভেদ ও দূরত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছে, তা ৫ দশকের বাংলাদেশে বড় সংকট বলা যেতে পারে। একসাথে চলা, এক প্লেটে খাবার খাওয়া মানুষের মধ্যে এখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ। পারলে একজন অন্যজনকে যেন না দেখলেই ভালো সময় যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিনা কারণে অযৌক্তিক আপত্তিকর মন্তব্য, অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ গালিগালাজ। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখে নোংরা স্লোগান। এই সবকিছু, এই বাস্তবতা কি সংস্কার? এটাই কি জাতীয় ঐক্যমত্য?
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে কৌশল অবলম্বন করবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু গণ অভ্যুত্থান পরবর্তীতে ভাবতে হবে, এখানে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ আছে। শুধু দলের না, নাগরিকদের রক্ত আছে। তাই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রত্যাশা আছে। সেই খেটে খাওয়া মানুষ যেন মনে না করেন, 'আমরা কি প্রতারিত হয়েছি?'