
01/12/2024
৬
তারেক আইআরইতে কাজ শুরু করার পর দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। অ্যাডমিরাল নুরুল্লাহ তাকে ভারত ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ছোট শাখায় দায়িত্ব দিয়েছেন। শাখাটি শুধু ছোটই নয়; বরং এটি পুরো ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা একটি ভবনে অবস্থিত। তারেক অবাক হলো যখন জানতে পারল এই শাখার ১৫ জন সদস্যের বেশির ভাগই সেনাবাহিনী থেকে এসেছেন। এবং এখানে কোনো নারী নেই। শুধু সেনাবাহিনীর সদস্যরাই নন, দুজন কর্মকর্তা আছেন যারা আইএসআইয়ের ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বী, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর।
তারেকের জন্য একটি ছোট অফিস বরাদ্দ করা হয়েছে। অফিসটিতে দুটো ধূসর রঙের ধাতব ডেস্ক রয়েছে, একটি ডেস্কের ওপর কমপিউটার রাখা। সাদা দেয়ালগুলো পুরানো এবং মলিন, এখানে-সেখানে মশা-মারা দাগ। কিন্তু এসব বিষয় তারেকের জন্য তেমন কোনো ব্যাপার ছিল না। কারণ, অফিসের ভেতরে সে তেমন একটা সময় কাটাবে না।
কাজে আসার পর তারেক প্রকল্পের ব্রিফিংয়ের যে প্যাকেজ চেয়েছিল, সেটা তাকে দেওয়া হলো। প্যাকেজের বেশির ভাগ তথ্যই ছিল আনক্লাসিফায়েড—কিছু ওপেন সোর্স ডকুমেন্ট, বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে। সঙ্গে ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু রিপোর্ট এবং বাংলাদেশস্থ পাকিস্তানি দূতাবাসের জমা দেওয়া সাম্প্রতিক কয়েক মাসের কয়েকটি প্রতিবেদন।
সবচেয়ে বড় ডকুমেন্টটি ছিল গত বছর নিউইয়র্কে পাকিস্তানের জাতিসংঘ মিশনের জন্য তৈরি করা ৫৪ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট। সঙ্গে ছিল পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে একটি রেফারেন্স বই এবং ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার কয়েকটি মানচিত্র, যার মধ্যে একটি ছিল ১:২৫০,০০০ স্কেলের সামরিক মানচিত্র। মানচিত্রটিই তারেকের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ জাগাল।
তারেক মানচিত্রটি খুলে একটি ছোট ডেস্কের ওপর তা বিছিয়ে দিল। সে গভীর মনোযোগে মানচিত্রটি দেখতে লাগল। একপর্যায়ে সে গঙ্গা নদী এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সংযোগস্থল খুঁজে পেল। তারেক তার তর্জনী দিয়ে সেই স্থানে আলতো চাপ দিল এবং নদীটির দিক ভারত বরাবর পশ্চিমে অনুসরণ করতে লাগল। সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে একটি মোটা কালো রেখা গঙ্গা নদীকে ছেদ করেছে। সেটাই ফারাক্কা ব্যারেজ।
তার প্রকল্প ব্রিফিংয়ের সময় তারেক ফারাক্কা ব্যারেজ সম্পর্কে কিছুই জানত না। এ বিষয়টি ব্রিফিং অফিসারের কাছে স্বীকার করতে গিয়ে তার একটু লজ্জা লাগছিল। তবে পাক সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার সেই কর্নেল তারেকের এই অজ্ঞানতায় এতটুকু অবাক হননি।
কর্নেল তাকে একটি স্ট্যান্ডার্ড ব্রিফিং দিলেন। তিনি ফারাক্কা ব্যারেজের পরিচিতি তুলে ধরলেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ব্যাখ্যা করলেন।
ফারাক্কা ব্যারেজ ২,২৫০ মিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত সহায়তায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়। যদিও সোভিয়েতরা অর্থায়ন করেছিল, তবু এ বাঁধটি ভারতের জন্য গর্বের একটি বিষয়। কারণ, এর নকশা করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার রবীন্দ্রনাথ আদভানি। এর সঙ্গে সম্পর্কিত আরও একটি প্রকল্প হলো জঙ্গিপুর ফিডার ক্যানেল। এটি গঙ্গাকে হুগলি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, এর কাজ ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্পন্ন হয়।
ফারাক্কা ব্যারেজ শুকনো মৌসুমে পানি দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যাতে সেদিককার নদ-নদীর নাব্যতা বজায় থাকে এবং কলকাতার দক্ষিণাঞ্চলে পানির লবণাক্ততার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। বর্ষা মৌসুমে বাঁধের গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়, যাতে বন্যার পানি বাধাহীনভাবে পূর্বস্থ বাংলাদেশে প্রবাহিত হতে পারে।
গত কয়েক বছরে ফারাক্কা ব্যারেজ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের জন্য একটি গুরুতর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা সরকারের দাবি, ব্যারেজের কারণে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ বেড়েছে, গাছপালা ধ্বংস হয়েছে এবং সুন্দরবনের লবণাক্ততা বেড়েছে। সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন।
এদিকে দিল্লি দাবি করেছে যে, এই মরুকরণের জন্য প্রাকৃতিক আবহাওয়ার পরিবর্তনই দায়ী এবং নদীর গতিপথের কারণেই এই পরিস্থিতি হয়েছে। ঢাকা সরকার তা মানতে নারাজ এবং তারা জাতিসংঘে বিষয়টি নিয়ে গেছে। জাতিসংঘের কাছে দেওয়া তাদের আবেদনে বাংলাদেশ দাবি করে, শুকনো মৌসুমে ব্যারেজের গেটগুলো খোলা রেখে পানি প্রবাহ অব্যাহত রাখা হোক, যাতে পানি বাংলাদেশে এবং সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু ভারত তা মানেনি।
এখন তারেক তার অফিসে দাঁড়িয়ে মানচিত্রে ফারাক্কা ব্যারেজের অবস্থান দেখছে আর ভাবছে এই মিশনে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। তাকে এ ব্যারেজের পূর্ণ নকশা জোগাড় করতে হবে। অ্যাডমিরাল নুরুল্লাহর মতে, এই নকশার তথ্য থেকে ব্যারেজ দিয়ে কত পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তা হিসাব করা সম্ভব হবে। এভাবে শুকনো মৌসুমে কতটুকু পানি বাংলাদেশ এবং সুন্দরবনে ঢুকতে পারছে না, তা পরিমাপ করা যাবে।
আইআরইয়ের পরিকল্পনা হলো, এই হিসাব ব্যবহার করে বাংলাদেশের মামলাটি শক্তিশালী করা, যাতে ভারতকে বিশ্বমঞ্চে বিব্রত করা যায়। তারেকের কাজটা খুবই সাধারণ। তথ্য সংগ্রহ করাই মূল উদ্দেশ্য; আর এই ধরনের মিশন তার সবসময়ই পছন্দের, যদিও এর লক্ষ্য সামরিক কিছু নয়। তবে এটি ভারতের মধ্যে হওয়ায় কাজটি বেশ কঠিন। ভারতের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো দক্ষ। যদি তারা এই মিশন ব্যর্থ করে দিতে পারে, তাহলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা আরও বেড়ে যাবে।
তারেক ভাবছে পরিবেশগত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার এ মিশনটি আদৌ ঝুঁকিপূর্ণ কি না। আদতে এই স্থাপনা সামরিক দিক থেকে তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না; আর এটি পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে, ভারতের একেবারে অন্য প্রান্তে। আরও কিছু প্রশ্ন তারেককে ভাবিয়ে তুলল। আইএসআইয়ের পরিবর্তে আইআরই কেন এই কাজটি পেয়েছে? আইএসআই হয়তো ইতিমধ্যে সেখানে তার এজেন্টদের দিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পারত।
তারেক বুঝতে পারল যে, গোটা ব্যাপারটা প্রশাসনিক জটিলতার ফল। আইআরই নতুন একটি সংস্থা, আর তারা নিজেদের দক্ষতা ও স্বনির্ভরতা প্রমাণ করতে চাইছে, যদিও কাজটি তাদের জন্য কঠিন। আইএসআই থেকে সাময়িকভাবে একজন অফিসার পাঠানো একধরনের সমঝোতা। কারণ, সরাসরি আইএসআইকে ফারাক্কা ব্যারেজ মিশন বা এর মতো অন্য কোনো কাজের দায়িত্ব দেওয়া বেশি সুবিধাজনক হতো না।
তারেক ডেস্কের ওপর রাখা সব জিনিসপত্র আবার বাক্সে গুছিয়ে রাখল। তারপর কমপিউটারের সামনে বসে দেশের বাইরের পাকিস্তানি দূতাবাসগুলো থেকে আসা প্রতিদিনের কূটনৈতিক তারবার্তা পড়তে শুরু করল। এই অফিসে বসে সে আইএসআইয়ের সরাসরি কার্যক্রমের কোনো তথ্য পায় না। তবে সপ্তাহে এক-দুদিন আইএসআইয়ের সদর-দপ্তরে গিয়ে ভারতের বিষয়ে নতুন আপডেট জানার সুযোগ পায়। এ নিয়ে তার কোনো সমস্যা ছিল না, কারণ তার আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আছেই, বিশেষ করে জেনারেল আলির সঙ্গে।
আইআরইয়ের কাজ নিয়ে কাউকে কিছু বলা যাবে না—অ্যাম্বাসেডর সালিমের এ সতর্কবার্তা তারেক গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি। জেনারেল আলি তারেকের সেই হাতেগোনা মানুষদের একজন, যাকে সে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করত। তারেক জানত, ভারতের মতো একটি শত্রুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেকোনো বিদেশি গোয়েন্দা কার্যক্রমের খবর জেনারেল আলির জানা প্রয়োজন। কারণ, ভারতের পারমাণবিক মিসাইল সোজা পাকিস্তানের দিকে তাক করা।
তবে আলির পরামর্শে তারেক অত্যন্ত সতর্কতা বজায় রেখে তার সঙ্গে যোগাযোগ করছিল। আলি তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, সম্ভবত তার চলাফেরা এবং কার্যক্রম নজরদারিতে আছে। সাবধানতার কারণে তারা দুজন একমত হলেন যে, ফোনে কোনো যোগাযোগ করা যাবে না।
তারেক ভাবল, আলিকে ফারাক্কা ব্যারেজ মিশনটি কীভাবে সম্পন্ন করতে হবে, তার একটি রিপোর্ট দেওয়ার এখনই সময়।
বই : অপারেশন ফারাক্কা
পরিবেশক Kalantor Prokashoni