পাহাড়ের খবর-Paharer Khobor

পাহাড়ের খবর-Paharer Khobor চাঞ্চল্য আর রহস্যে ঘেরা গহীণ পাহাড়ের খবর, একমাত্র এখানেই।
(1)

Please LIKE this PAGE if you want to know 24 hours Update News of CHT (Khagrachari/Rangamati/Bandarban).

01/12/2025

দুই যুগ পেরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, শান্তি কতদূর.......?

পার্বত্য চুক্তির পরও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র, খুন-গুম ও অশান্তি।

১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। লক্ষ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট এবং সশস্ত্র উত্তেজনা শেষ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে শান্তি অর্জন সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয়নি।

চুক্তির পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িতদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও ভিন্ন স্বার্থের লড়াই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯৭২ সালে আত্মপ্রকাশ করা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পাহাড়ে সন্ত্রাস ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর ভিত্তি গড়েছিল। যদিও ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে তাদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথ সুগম হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, তথাপি স্বার্থনির্ভর নেতারা চুক্তি বিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়। এর ফলে ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং পুনর্গঠন (জেএসএস মূল ও সংস্কার ২০০৮, ইউপিডিএফ মূল ও গণতান্ত্রিক ২০১৭) সংঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ২০২০ সালের পর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আত্মপ্রকাশ করে, যা পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন প্রধান সশস্ত্র গোষ্ঠী জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের ওপর হামলা চালিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে, জেএসএস মুখে চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করে আর বান্দরবান কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলা নিয়ে কুকি রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। এই ৩ সংগঠনের সংঘাতের কারণে প্রায় ১৮ লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন অস্থিরতায় জীবনযাপন করছে। তাদের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী হামলা বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। চুক্তির পরও পার্বত্য অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ খুন, গুম ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি তাদের অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতের মিজোরাম ও মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সহায়তা গ্রহণ করে। জেএসএস-এর “শান্তিবাহিনী” ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় গঠিত হয়েছিল, যা এখনও বহাল। ইউপিডিএফ ও কেএনএফও ভারী অস্ত্র সংগ্রহ ও গেরিলা প্রশিক্ষণে নিযুক্ত। মায়ানমারের আরাকান আর্মি, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, কুকি ন্যাশনাল আর্মি এবং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (CNF)-এর মাধ্যমে তারা ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্থাপন করা এসব ঘাঁটি নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। উদাহরণস্বরূপ, ইউপিডিএফের প্রধান হেডকোয়ার্টার খাগড়াছড়ি লক্ষ্মীছড়ি, পানছড়ি দীঘিনালা এবং রাঙামাটি বাঘাইছড়ি কাউখালী অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে প্রায় ২৫০০ সশস্ত্র সদস্য অবস্থান করছে। এছাড়া রামগড়, মাটিরাঙা, বাঘাইছড়ি, সাজেক ও থানচি এলাকায় প্রচুর অস্ত্রঘাঁটি রয়েছে। জেএসএস-এর ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিতে প্রায় ৪০০ সদস্য এবং রাঙামাটি ও বান্দরবান এলাকায় ৫,২০০ অস্ত্রধারী সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে যে এই গোষ্ঠীগুলির ক্ষমতা অপরিসীম। কেএনএফ এর প্রায় ১৫০০ অস্ত্রধারী রয়েছে বলে জানা যায়।

জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে। এদের অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে একে-৪৭, একে-৫৬, এম-১৬, স্নাইপার রাইফেল, মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড, আইইডি, রকেট লঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র। জেএসএস সদস্যরা গাঢ় সবুজ বা বন সবুজ সামরিক পোশাক পরিধান করে, ইউপিডিএফ সেনাবাহিনীর মতো পোশাক ব্যবহার করে। কেএনএফ তাদের সদস্যদের বিশেষ সামরিক পোশাক সরবরাহ করে।

ভারত ও মায়ানমারের অবাধ সীমান্ত পারের মাধ্যমে অস্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবাহিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ মিজোরাম পুলিশ এক বড় অস্ত্র চালান আটক করে। ২৭ জুন ২০২৪ খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারী অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের ঘটনা ধরা পড়ে। এসব অস্ত্র মূলত ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর হাতে পৌঁছছে। র‌্যাবের মতে, ধুধুকছড়া এলাকা ভারত থেকে অস্ত্র প্রবেশের একটি মূল পথ। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি শিথিল হওয়ায় এ প্রবাহ অব্যাহত।

নিরাপত্তা বাহিনী সময়কালের বিভিন্ন অভিযানে বিপুল অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩: গুইমারা রিজিয়নে উদ্ধার ১টি একে-৪৭, ১টি এম-১, ১টি একে-২২, ৪টি মর্টার, ১টি পিস্তল, আইইডি সরঞ্জামাদি। ৭ মে ২০২৪: কেওক্রাডং পাহাড়ে কেএনএফ সদস্য নিহত, ৩টি একে-২২, ১টি শটগান, বিস্ফোরক সরঞ্জামাদি, ড্রোন উদ্ধার।
১৪ নভেম্বর ২০২৪: মুনলাই পাড়ায় এসএমজি, ২টি গাঁদা বন্দুক, আইইডি উপকরণ উদ্ধার। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪: রুমা উপজেলার ধোপানী ছড়ায় ২টি অটোমেটিক কারবাইন, ১টি সেমি অটোমেটিক অ্যাসল্ট রাইফেল, ৩টি এসবিবিএল, সোলার সিস্টেম, ড্রোন উদ্ধার। ২১ ডিসেম্বর ২০১৮: রাঙামাটিতে মেশিনগানসহ তিন অস্ত্র ব্যবসায়ী আটক।

এই উদ্ধার অভিযানগুলির পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে যে, পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র ভাণ্ডার বিপুল হলেও উদ্ধারকৃত অস্ত্র সামান্য। ফলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম সীমিত করা সম্ভব হয়নি।

গত ১১ জুন ২০২২ ভারত থেকে ইউপিডিএফ-এর ৩ কোটি টাকার অস্ত্র চালান পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করায় সংঘর্ষ শুরু হয়। জেএসএস-এর কমান্ডার অর্জুন ত্রিপুরার নেতৃত্বে রাঙামাটি বাঘাইছড়ি-ভারত সীমান্তে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। সংঘর্ষে ইউপিডিএফ-এর ২ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। ১২ ও ১৮ জুলাই পুনরায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

সূত্র অনুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলের ১৭৮ কিলোমিটার সীমান্ত অধিকাংশই জেএসএস-এর দখলে। ইউপিডিএফ বাঘাইছড়ি সীমান্তের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত থেকে অস্ত্র আনা প্রধান পথ বাঘাইছড়ি সীমান্ত। ইউপিডিএফ অস্ত্র চালানের পথ আটকাতে জেএসএস দীঘিনালা ও পানছড়ির কিছু এলাকা দখল করে।

সশস্ত্র গোষ্ঠী পাহাড়িদের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাঁদাবাজি করে। আদায়কৃত অর্থ দিয়ে শীর্ষ নেতারা দেশ-বিদেশে বিলাসিতায় জীবনযাপন করে, সন্তানদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। প্রকৃতপক্ষে, পার্বত্য অঞ্চলকে নরকায় পরিণত করা হয়েছে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।

সাত রাজ্যের ভারতীয় রাজ্য, যেমন মিজোরাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচল প্রদেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে। মায়ানমার থেকে মিজোরামের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রবাহিত হচ্ছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না থাকার কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অবাধে চলাচল করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কেবল অস্ত্র উদ্ধার যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন: সুশাসন ও কার্যকর আইন প্রয়োগ, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প বৃদ্ধি, সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও অস্ত্র চোরাচালান ঠেকানো। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা নিয়ে অবৈধ অস্ত্র ও সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করা। রাজনৈতিক সমঝোতা পার্বত্য চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সমাধান। অর্থ ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ-সশস্ত্র গোষ্ঠীর অর্থায়ন বন্ধ করতে স্থানীয় সহায়তা ও নজরদারি বৃদ্ধি।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির স্বাক্ষর সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর দাপট অব্যাহত রয়েছে। জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফের অস্ত্রভাণ্ডার, সীমান্তে অবাধ চলাচল, আন্তর্জাতিক অস্ত্র সরবরাহ এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনকে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করছে। উদ্ধার অভিযান ও আইন প্রয়োগ কিছু প্রভাব ফেললেও, কার্যকর ও সুসংগঠিত পদক্ষেপের অভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র পাচার ও সশস্ত্র সংঘাত নিয়ন্ত্রণে না এলে, শান্তি ও নিরাপত্তা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা দুষ্কর হবে।

© Save CHT

01/12/2025

পার্বত্য চুক্তির পরও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র, খুন-গুম ও অশান্তি।

১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। লক্ষ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট এবং সশস্ত্র উত্তেজনা শেষ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে শান্তি অর্জন সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয়নি।

চুক্তির পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িতদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও ভিন্ন স্বার্থের লড়াই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯৭২ সালে আত্মপ্রকাশ করা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পাহাড়ে সন্ত্রাস ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর ভিত্তি গড়েছিল। যদিও ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে তাদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথ সুগম হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, তথাপি স্বার্থনির্ভর নেতারা চুক্তি বিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়। এর ফলে ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং পুনর্গঠন (জেএসএস মূল ও সংস্কার ২০০৮, ইউপিডিএফ মূল ও গণতান্ত্রিক ২০১৭) সংঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ২০২০ সালের পর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আত্মপ্রকাশ করে, যা পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন প্রধান সশস্ত্র গোষ্ঠী জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের ওপর হামলা চালিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে, জেএসএস মুখে চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করে আর বান্দরবান কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলা নিয়ে কুকি রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। এই ৩ সংগঠনের সংঘাতের কারণে প্রায় ১৮ লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন অস্থিরতায় জীবনযাপন করছে। তাদের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী হামলা বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। চুক্তির পরও পার্বত্য অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ খুন, গুম ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি তাদের অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতের মিজোরাম ও মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সহায়তা গ্রহণ করে। জেএসএস-এর “শান্তিবাহিনী” ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় গঠিত হয়েছিল, যা এখনও বহাল। ইউপিডিএফ ও কেএনএফও ভারী অস্ত্র সংগ্রহ ও গেরিলা প্রশিক্ষণে নিযুক্ত। মায়ানমারের আরাকান আর্মি, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, কুকি ন্যাশনাল আর্মি এবং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (CNF)-এর মাধ্যমে তারা ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্থাপন করা এসব ঘাঁটি নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। উদাহরণস্বরূপ, ইউপিডিএফের প্রধান হেডকোয়ার্টার খাগড়াছড়ি লক্ষ্মীছড়ি, পানছড়ি দীঘিনালা এবং রাঙামাটি বাঘাইছড়ি কাউখালী অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে প্রায় ২৫০০ সশস্ত্র সদস্য অবস্থান করছে। এছাড়া রামগড়, মাটিরাঙা, বাঘাইছড়ি, সাজেক ও থানচি এলাকায় প্রচুর অস্ত্রঘাঁটি রয়েছে। জেএসএস-এর ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিতে প্রায় ৪০০ সদস্য এবং রাঙামাটি ও বান্দরবান এলাকায় ৫,২০০ অস্ত্রধারী সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে যে এই গোষ্ঠীগুলির ক্ষমতা অপরিসীম। কেএনএফ এর প্রায় ১৫০০ অস্ত্রধারী রয়েছে বলে জানা যায়।

জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে। এদের অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে একে-৪৭, একে-৫৬, এম-১৬, স্নাইপার রাইফেল, মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড, আইইডি, রকেট লঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র। জেএসএস সদস্যরা গাঢ় সবুজ বা বন সবুজ সামরিক পোশাক পরিধান করে, ইউপিডিএফ সেনাবাহিনীর মতো পোশাক ব্যবহার করে। কেএনএফ তাদের সদস্যদের বিশেষ সামরিক পোশাক সরবরাহ করে।

ভারত ও মায়ানমারের অবাধ সীমান্ত পারের মাধ্যমে অস্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবাহিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ মিজোরাম পুলিশ এক বড় অস্ত্র চালান আটক করে। ২৭ জুন ২০২৪ খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারী অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের ঘটনা ধরা পড়ে। এসব অস্ত্র মূলত ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর হাতে পৌঁছছে। র‌্যাবের মতে, ধুধুকছড়া এলাকা ভারত থেকে অস্ত্র প্রবেশের একটি মূল পথ। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি শিথিল হওয়ায় এ প্রবাহ অব্যাহত।

নিরাপত্তা বাহিনী সময়কালের বিভিন্ন অভিযানে বিপুল অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩: গুইমারা রিজিয়নে উদ্ধার ১টি একে-৪৭, ১টি এম-১, ১টি একে-২২, ৪টি মর্টার, ১টি পিস্তল, আইইডি সরঞ্জামাদি। ৭ মে ২০২৪: কেওক্রাডং পাহাড়ে কেএনএফ সদস্য নিহত, ৩টি একে-২২, ১টি শটগান, বিস্ফোরক সরঞ্জামাদি, ড্রোন উদ্ধার।
১৪ নভেম্বর ২০২৪: মুনলাই পাড়ায় এসএমজি, ২টি গাঁদা বন্দুক, আইইডি উপকরণ উদ্ধার। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪: রুমা উপজেলার ধোপানী ছড়ায় ২টি অটোমেটিক কারবাইন, ১টি সেমি অটোমেটিক অ্যাসল্ট রাইফেল, ৩টি এসবিবিএল, সোলার সিস্টেম, ড্রোন উদ্ধার। ২১ ডিসেম্বর ২০১৮: রাঙামাটিতে মেশিনগানসহ তিন অস্ত্র ব্যবসায়ী আটক।

এই উদ্ধার অভিযানগুলির পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে যে, পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র ভাণ্ডার বিপুল হলেও উদ্ধারকৃত অস্ত্র সামান্য। ফলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম সীমিত করা সম্ভব হয়নি।

গত ১১ জুন ২০২২ ভারত থেকে ইউপিডিএফ-এর ৩ কোটি টাকার অস্ত্র চালান পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করায় সংঘর্ষ শুরু হয়। জেএসএস-এর কমান্ডার অর্জুন ত্রিপুরার নেতৃত্বে রাঙামাটি বাঘাইছড়ি-ভারত সীমান্তে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। সংঘর্ষে ইউপিডিএফ-এর ২ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। ১২ ও ১৮ জুলাই পুনরায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

সূত্র অনুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলের ১৭৮ কিলোমিটার সীমান্ত অধিকাংশই জেএসএস-এর দখলে। ইউপিডিএফ বাঘাইছড়ি সীমান্তের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত থেকে অস্ত্র আনা প্রধান পথ বাঘাইছড়ি সীমান্ত। ইউপিডিএফ অস্ত্র চালানের পথ আটকাতে জেএসএস দীঘিনালা ও পানছড়ির কিছু এলাকা দখল করে।

সশস্ত্র গোষ্ঠী পাহাড়িদের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাঁদাবাজি করে। আদায়কৃত অর্থ দিয়ে শীর্ষ নেতারা দেশ-বিদেশে বিলাসিতায় জীবনযাপন করে, সন্তানদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। প্রকৃতপক্ষে, পার্বত্য অঞ্চলকে নরকায় পরিণত করা হয়েছে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।

সাত রাজ্যের ভারতীয় রাজ্য, যেমন মিজোরাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচল প্রদেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে। মায়ানমার থেকে মিজোরামের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রবাহিত হচ্ছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না থাকার কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অবাধে চলাচল করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কেবল অস্ত্র উদ্ধার যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন: সুশাসন ও কার্যকর আইন প্রয়োগ, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প বৃদ্ধি, সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও অস্ত্র চোরাচালান ঠেকানো। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা নিয়ে অবৈধ অস্ত্র ও সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করা। রাজনৈতিক সমঝোতা পার্বত্য চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সমাধান। অর্থ ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ-সশস্ত্র গোষ্ঠীর অর্থায়ন বন্ধ করতে স্থানীয় সহায়তা ও নজরদারি বৃদ্ধি।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির স্বাক্ষর সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর দাপট অব্যাহত রয়েছে। জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফের অস্ত্রভাণ্ডার, সীমান্তে অবাধ চলাচল, আন্তর্জাতিক অস্ত্র সরবরাহ এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনকে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করছে। উদ্ধার অভিযান ও আইন প্রয়োগ কিছু প্রভাব ফেললেও, কার্যকর ও সুসংগঠিত পদক্ষেপের অভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র পাচার ও সশস্ত্র সংঘাত নিয়ন্ত্রণে না এলে, শান্তি ও নিরাপত্তা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা দুষ্কর হবে।

© Save CHT

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম X (টুইটার)–এ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশবিরোধী একটি সুসংগঠিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের এ...
01/12/2025

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম X (টুইটার)–এ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশবিরোধী একটি সুসংগঠিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি অংশ, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ব্যবহারকারীরা—যারা সমন্বিতভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের অনলাইন উপস্থিতি ফেসবুক–কেন্দ্রিক হওয়ায় X প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশিদের সক্রিয়তা তুলনামূলক কম। ঠিক এই ফাঁকটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ভারতীয় অপপ্রচারকারীরা। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বানানো খবর, মিথ্যা সাম্প্রদায়িক ঘটনার গল্প, এবং জঙ্গিবাদ–সম্পর্কিত ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করছে।

আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ভারতীয় নেটওয়ার্কগুলো একতরফা প্রচারণা চালাতে পারছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ওপর বিপজ্জনক প্রভাব ফেলতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দেশকে বারবার জঙ্গিবাদী বা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা হলে, ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়—যা পরবর্তীতে খণ্ডন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন—আমাদের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের X-এ সক্রিয় অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছড়ানো মিথ্যা হ্যাশট্যাগ, ভুয়া তথ্য ও অপবাদগুলোর বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য, প্রমাণ এবং বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরে নিয়মিত কাউন্টার ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে প্রতিটি ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আমরা নীরব থাকতে পারি না। দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব—সত্য তথ্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা, বাংলাদেশের সম্মান রক্ষা করা, এবং ভারতের পরিচালিত অপপ্রচারের মুখোশ উন্মোচন করা।

এখন সময়—X প্ল্যাটফর্মে আমাদের সক্রিয় হওয়ার, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পরিচিতি ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখার।

© ছায়া প্রচার

30/11/2025

দেখুন কতোটা বাস্তববাদী নেত্রী ছিলেন তিনি

30/11/2025

গো-মূত্র খোরদের দেশে

চুক্তির পথে বাধা; ভারত–মিয়ানমার সীমান্তের সন্ত্রাসী ক্যাম্পগুলোর প্রভাব।১৯৯৭ সালে ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্...
30/11/2025

চুক্তির পথে বাধা; ভারত–মিয়ানমার সীমান্তের সন্ত্রাসী ক্যাম্পগুলোর প্রভাব।

১৯৯৭ সালে ২-রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠী জেএসএস এর সামরিক শাখা শান্তিবাহিনীর সাথে শান্তিচুক্তি করে তৎকালীন আওয়ামিলীগ সকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চুক্তির ৭২ টি ধারা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা থাকলেও পাহাড়ে বসবাস করা পাহাড়ি ও বাঙালিদের দাবি চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বাধা ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের সন্ত্রাসী ক্যাম্পগুলো। অনেকেই মনে করেন চুক্তি হয়েছিল ভারতের ইশারায়, আবার চুক্তির পথে বাধাও ভারত। যায় হোক এবার আসুন বোঝার চেষ্টা করি ভারত কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির পথে বাধাঁ।

১৯৯৭ সালের চুক্তির আগে জেএসএস এর সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেখান থেকে অভিযান পরিচালনা করত এমন অভিযোগ রয়েছে। শুরু থেকেই শান্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে ভারত এবং এর যথেষ্ট প্রমাণও আছে বাংলাদেশের হাতে। মূলত আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রেখে ভারত এই অঞ্চলটিকে নিজেদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে বহু আগে থেকে। জেএসএস ও ইউপিডিএফ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলোর উপর চোরাগুপ্ত আক্রমণ চালিয়ে পালিয়ে যায় ভারতে। ভারতও তাদের আশ্রয় দিয়েছে শুরু প্রথম থেকে। শান্তিচুক্তির আগে থেকে আজ অব্দি ভারতের শেল্টার চলমান রয়েছে। ভারতের অরুণাচল, মেঘালয়, ত্রিপুরাতে এখনো রয়েছে শান্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষন ক্যাম্প। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার বিএসএফ ও ভারত সরকারকে এই বিষয়ে অবগত করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশে ভারত সীমান্তের ভিতরেও ৬টি এলাকাভিত্তিক জনগোষ্ঠী এন্সার্জেন্সী যুদ্ধে ব্যস্ত। সেগুলো হলো: নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে নাগা
এন্সার্জেন্সী, মূল আসামে উলফা এন্সার্জেন্সী, ইম্ফল উপত্যকায় মেইতি এন্সার্জেন্সী, মেঘালয়ে এইচ এ এল এন্সার্জেন্সী এবং ত্রিপুরায় এনএলএফ এন্সার্জেন্সী। এছাড়াও মনিপুর ও মিজোরামে আরোও আছে কেএনএফ এন্সার্জেন্সী।

এবার আসুন জেনে নিই, ভারত কোন সময় কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইন্সার্জেন্ট'র (জেএসএস, ইউপিডিএফ) এর হাতে অস্ত্র ও প্রশিক্ষন দিয়েছে।

ঘটনা-১ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার দুমাস পরেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র, তাদের বিশেষ দূত গোপাল কৃষ্ণ চাকমার (আসল কিংবা ছদ্মনাম) মারফত, মানবেন্দ্র লারমাকে আগরতলায় ডেকে পাঠান। সেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় নেতার সাথে মানবেন্দ্র লারমার কথাবার্তা হয়। এ সময় লারমা পার্টির মূল আদর্শ কম্যুনিজমকে গোপন রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার জন্য ভারতের কাছে আবেদন জানান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ লারমাকে সহযোগিতার আশ্বাসও দিলেন।

ঘটনা-২: ১৯৭৫ সালে শান্তিবাহিনীর ২১ সদস্যের ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেয়। এই দলটি উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণসহ অস্ত্র পরিচালনা প্রশিক্ষণ, বেতার যন্ত্র পরিচালনা ইত্যাদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

ঘটনা- ৩: ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝিতে ভারত থেকে অস্ত্রের প্রথম চালান আসে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চালান রিসিভ করেন শান্তিবাহিনীর প্রশিক্ষক মেজর অফুরন্ত(ছদ্দনাম নলীন রঞ্জন চাকমা)। এসময় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ৬ জন উপস্থিত ছিলেন। উক্ত চালানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ৫০ টি ৩০৩ রাইফেল, ১০ হাজার বল এ্যামুনেশন ও ১৫০টি গ্রেনেড দিয়েছিল।

ঘটনা- ৪: ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেজর অফুরন্ত ১৫০ জন সঙ্গীসহ ভারতের ইজারা নামক স্থানে বৈরাগির দোকানের নিকট অস্ত্রের ২য় চালান গ্রহণ করে। এই চালানে ছিল এলএমজি ১২টি, ৩০৩ রাইফেল ১০০টি এবং ২০ হাজার রাউন্ড গুলি।

ঘটনা- ৫: ১৯৭৭ সালের নভেম্বর/ডিসেম্বর এর দিকে আসে আরো কয়েকটি চালান। তন্মধ্যে ছিল এসএমজি (কার্বাইন), সেমি অটো রাইফেল, এসএসজি ৯মি.মি সহ বেশকিছু ওয়ারলেস। সকল অস্ত্র ভারতের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ফোর্সের ৩টন ট্রাকে করে আনা হতো। অস্ত্রের পাশাপাশি ৩০/৪০ হাজার টন ড্রাই রেশনও দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৬ থেকে ২০২৫ অব্দি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠগুলোকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ভারত।

ঘটনা-৬: ২০২৫ সালের মার্চ/এপ্রিল মাসে ভারতের এমিউনেশন ফ্যাক্টরি খাদকি থেকে ১২.৭×৯৯ ক্যালিবারের বুলেট পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠগুলোকে দেওয়া হয়েছে।

ঘটনা-৭: ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে ভারত থেকে আসা একটি বড় ধরণের অস্ত্রের চালান লুটে নিতে জেএসএস ও ইউপিডিএফ উভয় খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে জেএসএস এর ৬ জন ও ইউপিডিএফ এর ৪ জন নিহত হয়।

ঘটনা-৮: ১। ২০২১ সালে ইউপিডিএফ (মূল) এর নেতাকর্মীদের ভারতে অবৈধভাব যাতায়াত এবং অবস্থান সম্পর্কে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা যায়-
২৬ এপ্রিল ২০২১ তারিখ ১৩:০০ ঘটিকায় আগরতলার বটতলা নামক স্থানে সমীর বনিক এর কাছ থেকে বিপ্লব চাকমা নগদ বিশ লক্ষ বাংলাদেশী টাকা এক্সেস করে। ২৭ এপ্রিল ২০২১ তারিখ বিপ্লব এবং তপন অস্ত্র ক্রয় করার জন্য আগরতলায় অবস্থান করে। গোয়েন্দা বিভাগ, ত্রিপুরা পুলিশ,এএসপি রনজিত দেববর্মন, এসপি দেবাশীষ দাশ, ওসি পরিতাষ জমাটিয়া জেএসএস এর অস্ত্র চোরাচালানের মূল হোতা সমাজ প্রিয় চাকমার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে।

এবার আসুন জেনে নেয়া যাক শান্তিচুক্তির সময় ভারতের মাটিতে শান্তিবাহিনী (জেএসএস)-এর কিছু ক্যাম্পের অবস্থান।

১. শান্তিবাহিনীর মিশন একাডেমী- ভারতের জয়চন্দ্রপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে আনুমানিক দেড় মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
২. শান্তিবাহিনীর সদর দপ্তর(চিম্বুক)- এসকে পাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের আনুমানিক ৩ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত।
৩. মাইনি মিশন জুম ক্যাম্প- এসকে পাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের আনুমানিক ৩ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত।
৪. উলুছড়ি ক্যাম্প- এসকে পাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের আনুমানিক ২ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত।
৫. জিরানি ক্যাম্প- বোয়ালখালী বিএসএফ ক্যাম্পের আনুমানিক ৩ মাইল দক্ষিন-পূর্বে অবস্থিত। এরকম আরো ৫০ এর অধিক শান্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ভারতে রয়েছে।

১৯৭৬ সালে ভারত থেকে প্রথম অস্ত্রের চালান আসার পর থেকেই শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বাঙালিদের উপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। অবশ্য ১৯৭৬ এর আগেও বেশ কয়েকবার আক্রমণের স্বীকার হয়েছে বাঙালি গ্রাম ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলো। শান্তিবাহিনীর কথামত কাজ না করলে পাহাড়িরাও রক্ষা পায় না তাদের হাত থেকে। অস্ত্রের চালান ঘিরে গড়ে ওঠেছে আন্তঃদেশীয় নেটওয়ার্ক। সম্প্রতি (৫ অক্টোবর,২০২৫) তারিখে সময় সংবাদে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে "অন্তত চারটি রুট হয়ে অস্ত্র ঢুকছে রাঙ্গামাটিতে। যার একটি, মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরাম হয়ে সীমান্ত পার হয়ে থানচি, লুলংছড়ি, চাকপতিঘাট, বসন্তপাড়া হয়ে রাঙ্গামাটিতে প্রবেশ। অস্ত্র আসার আরেক পথ- বান্দরবান থেকে বাঙ্গালহালিয়া, রাইখালী বাজার, বড়ইছড়ি হয়ে কাউখালী রুট।" তৃতীয় রুট হচ্ছে- মিয়ানমার থেকে মিজোরাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ, এরপর বরকল, শুকনাচারী, তালুকদারপাড়া, সারোয়াতলী হয়ে বাঘাইছড়ি পৌঁছাচ্ছে অস্ত্র। এছাড়া মিয়ানমার থেকে মিজোরামের পুকজিং, মানপাড়া সীমান্ত পেরিয়ে অস্ত্র যাচ্ছে রাঙ্গামাটির সাজেক লংকর পয়েন্টে।

এসব রুটে বাংলাদেশে অস্ত্র আসার পথে চলতি বছর দেশটিতে ধরা পড়েছে কিছু চালান। জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে জব্দ হয়েছে ৫টি বড় চালান। এসব চালানে ছিল একে-৪৭, এম-১৬, গ্রেনেড, গ্রেনেড লঞ্চারসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ।অস্ত্রের বড় অংশ আসে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে; এরপর এগুলো ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়। মিয়ানমার থেকে ৩ লাখ টাকার অস্ত্র বাংলাদেশে এনে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। এখানে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পুরো ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করছে এবং অস্ত্র আনা-নেয়ার সবকিছু তারা সমন্বয় করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল তৈরি করা জেএসএস এর কথিত জুম্মল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনোগীত জুম্মকে ইতোমধ্যে ভারত আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। সে বর্তমানে ভারতে আছে। এছাড়াও পিসিজেএসএস সন্তু লারমা গ্রুপের অস্ত্র কমান্ডার জ্যোতিষ্মান চাকমা বুলবুল এবং সমাজ প্রিয় চাকমাকে ভারত নাগরিকত্ব প্রদান করে সেই দেশে আশ্রয় দিয়েছে। মূলত তারাই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র সাপ্লাই করছে বর্তমানে। অন্যদিকে মায়ানমার সীমান্তের সন্ত্রাসী ক্যাম্পগুলো থেকেও অস্ত্র কিনছে ইউপিডিএফ, কেএনএফ ও জেএসএস।

১৯৯৭ সালে কিছু নামমাত্র কিছু অস্ত্র জমা নাটক এবং সেনা ক্যাম্প তুলে নেয়ার ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আসেনি পাহাড়ে। ৫ আগষ্টের পর পাহাড়ে বেশ কিছু ইস্যু সৃষ্টি ও পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা সৃষ্টি করে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন গুলোর মাধ্যমে উক্তেজনা সৃষ্টি করেছে ভারত। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ শুরু থেকেই ছিল। পরবর্তীতে ভারতের ইন্ধনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন গুলো পুনরায় অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এদিকে মায়ানমারের আরসা, আরএসও, কেএনএ, আরাকান আর্মির সাথে জান্তা সরকারের সাথে যুদ্ধের ফলে অস্ত্র কেনাবেচা সহজলোভ্য হয়ে উঠেছে পাহাড়ের সীমান্তে।
উপরে উল্লেখিত বিষয় ও ১৯৭০ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য যাছাইয়ে প্রমাণিত হয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখতে এবং শান্তিচুক্তির পথে বাধাঁ সৃষ্টি করছে ভারত ও মায়ানমার সীমান্তের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো কাজ করছে।

© @পাবর্ত্য মঞ্চ

পার্বত্য চুক্তির পরও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র, খুন-গুম ও অশান্তি।১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্ত...
30/11/2025

পার্বত্য চুক্তির পরও পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র, খুন-গুম ও অশান্তি।

১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। লক্ষ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট এবং সশস্ত্র উত্তেজনা শেষ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে শান্তি অর্জন সম্পূর্ণভাবে সম্ভব হয়নি।

চুক্তির পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িতদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও ভিন্ন স্বার্থের লড়াই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯৭২ সালে আত্মপ্রকাশ করা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) পাহাড়ে সন্ত্রাস ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর ভিত্তি গড়েছিল। যদিও ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে তাদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথ সুগম হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, তথাপি স্বার্থনির্ভর নেতারা চুক্তি বিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়। এর ফলে ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং পুনর্গঠন (জেএসএস মূল ও সংস্কার ২০০৮, ইউপিডিএফ মূল ও গণতান্ত্রিক ২০১৭) সংঘাতের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ২০২০ সালের পর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আত্মপ্রকাশ করে, যা পার্বত্য অঞ্চলের সশস্ত্র সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন প্রধান সশস্ত্র গোষ্ঠী জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের ওপর হামলা চালিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে, জেএসএস মুখে চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করে আর বান্দরবান কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলা নিয়ে কুকি রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। এই ৩ সংগঠনের সংঘাতের কারণে প্রায় ১৮ লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন অস্থিরতায় জীবনযাপন করছে। তাদের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী হামলা বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। চুক্তির পরও পার্বত্য অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ খুন, গুম ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি তাদের অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতের মিজোরাম ও মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সহায়তা গ্রহণ করে। জেএসএস-এর “শান্তিবাহিনী” ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় গঠিত হয়েছিল, যা এখনও বহাল। ইউপিডিএফ ও কেএনএফও ভারী অস্ত্র সংগ্রহ ও গেরিলা প্রশিক্ষণে নিযুক্ত। মায়ানমারের আরাকান আর্মি, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, কুকি ন্যাশনাল আর্মি এবং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (CNF)-এর মাধ্যমে তারা ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্থাপন করা এসব ঘাঁটি নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। উদাহরণস্বরূপ, ইউপিডিএফের প্রধান হেডকোয়ার্টার খাগড়াছড়ি লক্ষ্মীছড়ি, পানছড়ি দীঘিনালা এবং রাঙামাটি বাঘাইছড়ি কাউখালী অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে প্রায় ২৫০০ সশস্ত্র সদস্য অবস্থান করছে। এছাড়া রামগড়, মাটিরাঙা, বাঘাইছড়ি, সাজেক ও থানচি এলাকায় প্রচুর অস্ত্রঘাঁটি রয়েছে। জেএসএস-এর ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিতে প্রায় ৪০০ সদস্য এবং রাঙামাটি ও বান্দরবান এলাকায় ৫,২০০ অস্ত্রধারী সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে যে এই গোষ্ঠীগুলির ক্ষমতা অপরিসীম। কেএনএফ এর প্রায় ১৫০০ অস্ত্রধারী রয়েছে বলে জানা যায়।

জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফ অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে। এদের অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে একে-৪৭, একে-৫৬, এম-১৬, স্নাইপার রাইফেল, মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড, আইইডি, রকেট লঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র। জেএসএস সদস্যরা গাঢ় সবুজ বা বন সবুজ সামরিক পোশাক পরিধান করে, ইউপিডিএফ সেনাবাহিনীর মতো পোশাক ব্যবহার করে। কেএনএফ তাদের সদস্যদের বিশেষ সামরিক পোশাক সরবরাহ করে।

ভারত ও মায়ানমারের অবাধ সীমান্ত পারের মাধ্যমে অস্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবাহিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ মিজোরাম পুলিশ এক বড় অস্ত্র চালান আটক করে। ২৭ জুন ২০২৪ খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারী অস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশের ঘটনা ধরা পড়ে। এসব অস্ত্র মূলত ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর হাতে পৌঁছছে। র‌্যাবের মতে, ধুধুকছড়া এলাকা ভারত থেকে অস্ত্র প্রবেশের একটি মূল পথ। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি শিথিল হওয়ায় এ প্রবাহ অব্যাহত।

নিরাপত্তা বাহিনী সময়কালের বিভিন্ন অভিযানে বিপুল অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩: গুইমারা রিজিয়নে উদ্ধার ১টি একে-৪৭, ১টি এম-১, ১টি একে-২২, ৪টি মর্টার, ১টি পিস্তল, আইইডি সরঞ্জামাদি। ৭ মে ২০২৪: কেওক্রাডং পাহাড়ে কেএনএফ সদস্য নিহত, ৩টি একে-২২, ১টি শটগান, বিস্ফোরক সরঞ্জামাদি, ড্রোন উদ্ধার।
১৪ নভেম্বর ২০২৪: মুনলাই পাড়ায় এসএমজি, ২টি গাঁদা বন্দুক, আইইডি উপকরণ উদ্ধার। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪: রুমা উপজেলার ধোপানী ছড়ায় ২টি অটোমেটিক কারবাইন, ১টি সেমি অটোমেটিক অ্যাসল্ট রাইফেল, ৩টি এসবিবিএল, সোলার সিস্টেম, ড্রোন উদ্ধার। ২১ ডিসেম্বর ২০১৮: রাঙামাটিতে মেশিনগানসহ তিন অস্ত্র ব্যবসায়ী আটক।

এই উদ্ধার অভিযানগুলির পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে যে, পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র ভাণ্ডার বিপুল হলেও উদ্ধারকৃত অস্ত্র সামান্য। ফলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম সীমিত করা সম্ভব হয়নি।

গত ১১ জুন ২০২২ ভারত থেকে ইউপিডিএফ-এর ৩ কোটি টাকার অস্ত্র চালান পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করায় সংঘর্ষ শুরু হয়। জেএসএস-এর কমান্ডার অর্জুন ত্রিপুরার নেতৃত্বে রাঙামাটি বাঘাইছড়ি-ভারত সীমান্তে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। সংঘর্ষে ইউপিডিএফ-এর ২ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। ১২ ও ১৮ জুলাই পুনরায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

সূত্র অনুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলের ১৭৮ কিলোমিটার সীমান্ত অধিকাংশই জেএসএস-এর দখলে। ইউপিডিএফ বাঘাইছড়ি সীমান্তের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত থেকে অস্ত্র আনা প্রধান পথ বাঘাইছড়ি সীমান্ত। ইউপিডিএফ অস্ত্র চালানের পথ আটকাতে জেএসএস দীঘিনালা ও পানছড়ির কিছু এলাকা দখল করে।

সশস্ত্র গোষ্ঠী পাহাড়িদের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাঁদাবাজি করে। আদায়কৃত অর্থ দিয়ে শীর্ষ নেতারা দেশ-বিদেশে বিলাসিতায় জীবনযাপন করে, সন্তানদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। প্রকৃতপক্ষে, পার্বত্য অঞ্চলকে নরকায় পরিণত করা হয়েছে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।

সাত রাজ্যের ভারতীয় রাজ্য, যেমন মিজোরাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচল প্রদেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহ হচ্ছে। মায়ানমার থেকে মিজোরামের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র প্রবাহিত হচ্ছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না থাকার কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অবাধে চলাচল করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কেবল অস্ত্র উদ্ধার যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন: সুশাসন ও কার্যকর আইন প্রয়োগ, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প বৃদ্ধি, সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও অস্ত্র চোরাচালান ঠেকানো। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা নিয়ে অবৈধ অস্ত্র ও সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করা। রাজনৈতিক সমঝোতা পার্বত্য চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সমাধান। অর্থ ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ-সশস্ত্র গোষ্ঠীর অর্থায়ন বন্ধ করতে স্থানীয় সহায়তা ও নজরদারি বৃদ্ধি।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির স্বাক্ষর সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর দাপট অব্যাহত রয়েছে। জেএসএস, ইউপিডিএফ ও কেএনএফের অস্ত্রভাণ্ডার, সীমান্তে অবাধ চলাচল, আন্তর্জাতিক অস্ত্র সরবরাহ এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনকে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করছে। উদ্ধার অভিযান ও আইন প্রয়োগ কিছু প্রভাব ফেললেও, কার্যকর ও সুসংগঠিত পদক্ষেপের অভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র পাচার ও সশস্ত্র সংঘাত নিয়ন্ত্রণে না এলে, শান্তি ও নিরাপত্তা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা দুষ্কর হবে।

© CHT Insiders

নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের শর্ত পার্বত্য চুক্তিকে অসাংবিধানিক আর শান্তির পথে অন্তরায় করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি...
30/11/2025

নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের শর্ত পার্বত্য চুক্তিকে অসাংবিধানিক আর শান্তির পথে অন্তরায় করেছে।


পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অসংখ্য অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক ধারা যুক্ত হয়েছে। এই চুক্তিতে সরকার পক্ষে স্বাক্ষর করেন, তৎকালীন জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত মুহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য জন সংহতি সমিতির পক্ষে সংগঠনের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। এ চুক্তির অসাংবিধানিক ধারা যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় এক কালো অধ্যায় সূচিত হয়। এই নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কারণ রাষ্ট্রের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙ্গালী এই চুক্তিতে সাংবিধানিক অধিকার হারিয়েছে।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র তখনই অর্থবহ হয় যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার পর দেশের অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা জটিল হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রায় তিন দশক ধরে আত্মঘাতী তৎপরতায় লিপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি (জেএসএস) কথিত শান্তিবাহিনীর সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামক এক ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অনেক ধারা-উপধারা সাংঘর্ষিক। তাই এই চুক্তির সংবিধান বিরোধী ধারা-উপধারা গুলো সংশোধনের দাবি তীব্র হয়েছে। এই দাবিতে রাষ্ট্রের স্বপক্ষের শক্তি বরাবরই আন্দোলন করে আসছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তির অন্যতম বিতর্কিত অংশ হলো নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের শর্ত, যা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার মৌলিক দায়িত্বের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একটি রাষ্ট্র তার স্বীকৃত ভূখণ্ডের কোনো অংশে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করবে কিনা এ সিদ্ধান্ত সে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার অন্তর্গত এবং সংবিধান তাকে সেই ক্ষমতা অর্পণ করেছে। সুতরাং, পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের যে প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা মূলত রাষ্ট্রের কাঠামো, নিরাপত্তা নীতি ও সংবিধানসম্মত অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ শর্ত শুধু প্রশাসনিক দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে না; বরং চুক্তির নৈতিক ভিত্তিকেও অস্থির করে তুলেছে।

নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের মাধ্যমে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা অপরাধী গোষ্ঠী, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি এবং অস্ত্রধারী সাম্প্রদায়িক উপাদানগুলোর জন্য সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিল জাতিগত কাঠামো, সীমান্তবর্তী দুর্বলতা এবং বহুস্তরীয় সশস্ত্র রাজনীতির বাস্তবতায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বৈরী নয়; বরং স্থায়ীত্ব, আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক সুরক্ষার পূর্বশর্ত। কিন্তু চুক্তির শর্তানুযায়ী বাহিনী প্রত্যাহারের মাধ্যমে সেখানে আইনশৃঙ্খলার স্থানান্তর ঘটে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তহীনতা ও ক্ষমতার দ্বৈততায়, যা শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অস্থিতিশীলতাকে আরও গভীর করেছে। যে স্থানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামো দুর্বল হয়, সেখানেই সংঘাত, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয় এটি পার্বত্য অঞ্চলে বারবার প্রমাণিত বাস্তবতা।

চুক্তিতে এই শর্ত সংযোজনের ফলে একদিকে সংবিধান যে বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়, তা কাঠামোগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; অন্যদিকে প্রশাসনিক বিচ্ছিন্নতা ও বিশেষাধিকার নির্ভর শাসনব্যবস্থার সুযোগ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী অথবা আঞ্চলিক শক্তিকে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হলে, তা সংবিধানের আলোকে এক ধরনের অসম মর্যাদার বৃত্ত তৈরি করে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের একক ক্ষমতার বিপরীতে দ্বৈত কর্তৃত্বের উদ্ভব ঘটায়, যা জাতীয় ঐক্য, শাসনব্যবস্থা ও আইনের শাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলস্বরূপ চুক্তির কাঠামো শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অসাংবিধানিক বিশেষাধিকার-নির্ভর অরাজকতার জন্ম দেয়।

এতদসত্ত্বেও কিছু পক্ষ নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি তুলে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নকে শান্তির একমাত্র পথ বলে প্রচার করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো নিরাপত্তাহীন একটি অঞ্চলে শান্তি শুধু কাগজে লেখা শব্দ; তার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকে না। যেখানে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সঠিকভাবে কার্যকর নয়, সেখানে অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্যই বৃদ্ধি পায়। পার্বত্য অঞ্চলে গত দুই দশক ধরে যে হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, অপহরণ, গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘর্ষ ও সশস্ত্র অবস্থান অব্যাহত রয়েছে, তার অন্যতম কারণ হলো নিরাপত্তা কাঠামোকে দুর্বল করার এই চুক্তিগত শর্ত। রাষ্ট্র যখন তার সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে সরে আসে, তখন তার শূন্যস্থান পূরণ করে অবৈধ শক্তি।

সুতরাং বলা যায় নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহারের শর্ত শুধু চুক্তিকে অসাংবিধানিক করেনি; বরং শান্তির পথকে আরও কঠিন, জটিল এবং বিপদসঙ্কুল করেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তবসম্মত, সংবিধানসম্মত এবং নিরাপত্তানির্ভর কাঠামো প্রয়োজন কাগুজে প্রতিশ্রুতির নয়। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী কোনো অঞ্চলে অপরিহার্য হলে সেটিকে প্রত্যাহারের শর্ত আরোপ করা যুক্তিহীন, দায়িত্বহীন ও জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে এক গভীর ত্রুটি। তাই এই শর্ত সংশোধন ছাড়া পার্বত্য চুক্তি কখনোই প্রকৃত শান্তির ভিত্তি তৈরি করতে পারবে না।

কিন্তু দুই যুগেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। চুক্তির সময় যে পরিমাণ অস্ত্র পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলো জমা দিয়েছিল তার তুলনায় বর্তমানে পাহাড়ি সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠীর কাছে কমপক্ষে সাত গুণ বেশি অস্ত্র মজুদ রয়েছে বলে বিভিন্ন নিরাপত্তা সূত্র ও মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হয়েছে। যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে পরিকল্পিতভাবে পুনরায় সশস্ত্র শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে, এবং অস্ত্রশস্ত্র মজুদের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পুরো পাহাড় অঞ্চলে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী সকল অবৈধ অস্ত্র সমর্পণ ও পাহাড়কে অস্ত্রমুক্ত করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি; বরং চুক্তির আড়ালে শক্তি পুনর্গঠন, চাঁদাবাজি, অপহরণ, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিপক্ষ দমনের মতো কর্মকাণ্ডে অস্ত্র এখন প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

চুক্তির পর যে সামান্য পরিমাণ অস্ত্র প্রতীকীভাবে জমা দেওয়া হয়েছিল তা ছিল মূলত পুরনো, অকার্যকর অথবা অস্ত্রশস্ত্রের খুব ছোট একটি অংশ। অথচ একই সময়ে তাদের প্রকৃত অস্ত্রভাণ্ডার অক্ষত ছিল এবং পরবর্তী সময়ে সেই ভাণ্ডার আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার শান্তির স্বার্থে এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনার মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধান চেয়েছিল, কিন্তু পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সেই সদিচ্ছাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখেছে। তারা আন্তর্জাতিক সংযোগ, সীমান্ত পারাপার সুবিধা, ভারি অর্থনৈতিক চাঁদাবাজি এবং অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবহার করে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, যা শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই নয় বরং জাতীয় নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। পাহাড়ি এলাকায় সক্রিয় সংগঠনগুলো নিজেদের রাজনৈতিক দলের আড়ালে সামরিক উইং পরিচালনা করছে এবং শান্তির নামে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করছে। বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে তারা প্রভাব বিস্তার করে সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

বাঙালি ও পাহাড়ি উভয় জনগোষ্ঠীই তাদের অস্ত্রসন্ত্রাসের কারণে আতঙ্কে বসবাস করছে। অস্ত্রের আধিক্য বাড়ার কারণে এলাকায় খুন, গুম, অপহরণসহ সহিংস ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু ভুক্তভোগীরা অনেক সময় অভিযোগ করতেও সাহস পাচ্ছে না। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল সন্ত্রাসীদের দমন, অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা এবং উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি করা; কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহারের ভুল সিদ্ধান্তে সন্ত্রাসীরা আরও সংগঠিত হয়েছে। পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলগুলো এখন তাদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে গেছে। সেখানে তারা স্বাধীনভাবে ট্রেনিং ক্যাম্প, অস্ত্রাগার ও অপারেশন সেল পরিচালনা করছে। এর ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা, টহল দলকে লক্ষ্য করে গুলি, উন্নয়ন প্রকল্পে নাশকতা এবং সাধারণ মানুষের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে।

সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো এ সব আধুনিক অস্ত্র শুধু আত্মরক্ষা বা রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য নয়; বরং অস্ত্র ব্যবসা, মাদক পরিবহন, মানবপাচার এবং সীমান্তবর্তী আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পাহাড়কে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ জোনে রূপান্তরের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। চুক্তির সময় যে কথিত অস্ত্র সমর্পণ হয়েছিল তা মূলত একটি রাজনৈতিক প্রদর্শনী ছাড়া কিছুই ছিল না এবং আজকের অস্ত্রের পরিমাণ তার স্পষ্ট প্রমাণ। জমাকৃত অস্ত্রের তুলনায় সাত গুণ বেশি অস্ত্র এখন পাহাড়ি সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠীর হাতে থাকা শুধু চুক্তি লঙ্ঘন নয়; বরং রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডের শামিল। এতে চুক্তির বৈধতা, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

শান্তিচুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল অস্ত্রহীন, নিরাপদ ও উন্নয়নমুখী পাহাড় নির্মাণ করা। অথচ বাস্তবে পাহাড় পরিণত হয়েছে অস্ত্রের গুদামে এবং সন্ত্রাসীদের শক্ত ঘাঁটিতে। যে কারণে এখন প্রয়োজন চুক্তির ধারাগুলোর পুনর্গঠন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান, সশস্ত্র সংগঠনের পুনর্মূল্যায়ন এবং পাহাড়ে স্থায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে এই অস্ত্রসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সময় এসেছে চুক্তির আড়ালে চলে আসা প্রতারণা, অস্ত্রবৃদ্ধি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার; কারণ অবৈধ অস্ত্রের পাহাড় এখন শান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

তৎকালীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু করে। তারা এ সমস্যা সমাধানের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সময় সল্পতার কারণে শেষ পর্যন্ত জনগণের মতামত এবং বাংলাদেশ সংবিধানকে পাশকাটিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সংবিধান পরিপন্থী ধারা চুক্তিতে যুক্ত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করেন নি। এমন কথাও কথিত আছে। কিন্তু তিনি চুক্তির সংবিধান বিরোধী ও বিতর্কিত ধারা যে স্থান পেয়েছে তার দায় এড়ানো সম্ভব নয়। চুক্তিতে অসংখ্য অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক ধারা যুক্ত হয়েছে। এই নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কারণ রাষ্ট্রের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙ্গালী এই চুক্তিতে সাংবিধানিক অধিকার হারিয়েছে। চুক্তির অসাংবিধানিক ধারার কারণে প্রথাগত ভূমি আইন পার্বত্য বাঙ্গালীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নিয়েছে৷ এই নিয়ে বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে৷ সরকারের কাছে পার্বত্যবাসীদের প্রাণের দাবি সংবিধান পরিপন্থী চুক্তির ধারাগুলো সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশে বাঙ্গালীদের ভূমি অধিকার ফিরে দেওয়া হোক।

১৯০০ সালের পহেলা মে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাহাড়ের ক্ষুদ্র- নৃগোষ্ঠী জাতিসত্তাগুলোর সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এবং প্রশাসনিক অন্য পুনর্গঠনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘শাসন বহির্ভূত এলাকা’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। এরপর ১৯২০ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি’ গঠিত হয় যারা ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিস্তানি শাসন কায়েমের বিপক্ষে ছিল। অতঃপর র‌্যাডক্লিফ মিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৬০ সালে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পর কাপ্তাই কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি হলে বিপুল সংখ্যক উপজাতীয় পরিবারকে পাহাড়ের অন্যান্য স্থানে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় কিছু সংখ্যক পাহাড়ী জনগোষ্ঠী দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার উপজাতীয়দের মধ্য থেকে রাজাকার, ওসি, এ.এফ, হওয়ার জন্য লোক রিক্রুট করে এবং চাকমা রাজা ত্রিদির রায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। যার ফলে পাহাড়ীরা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সরকারকে মেনে নিতে পারেনি। এরপর ১৯৭২ সালে উপজাতীয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার ফলে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে এম.এন লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি’ বা জেএসএস নামে উপজাতি জনগণের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন গড়ে ওঠে। কথিত আছে তৎকালীন রাষ্ট্র প্রধান তাদের বাঙালি হয়ে যাবার পরামর্শ দেন। উপজাতিরা এ পরামর্শ গ্রহণ না করে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি তাদের আর্মড ক্যাডার ফোর্স ‘শান্তিবাহিনী’ গঠন করে। পরবর্তীতে এ বাহিনী প্রথমে স্বাধিকার, পরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম চালাতে শুরু করলে উপজাতি-বাঙ্গালী মিলিয়ে প্রায় ৩৫ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়।

শান্তিবাহিনীর গেরিলা কার্যক্রম ও সরকারি পদক্ষেপ:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান-এর হত্যাকান্ডের ফলে জন সংহতি সমিতির সংকটময় অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং সন্তু লারমা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান। ১৯৭৫-১৯৭৭ সালের মধ্যে শান্তিবাহিনী সামরিক দিক দিয়ে অধিকতর সংগঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে সংগঠিত শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন সরকার সামরিক পথেই উপজাতিদের এ দেশদ্রোহী চক্রান্তকে দমন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে দরিদ্র ভূমিহীন কিছু মানুষকে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করেন। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ঘটনা উপজাতিরা মেনে নিতে পারেনি। ৬০, ৭০ ও ৮০-এর দশকে মানবেন্দ্র লারমা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মু উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশে যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন বিহারী খাসা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা প্রমুখ।

পার্বত্য সশস্ত্র সংঘাত অবসানের জন্য প্রথম জনসংহতি সমিতির সাথে আলোচনা করা হয় ১৯৮৫ সালে জেনারেল এইচএম এরশাদের শাসনামলে। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এই শান্তি আলোচনা চলে। এই সময় ১৯৮৯ সালের ২- জুলাই তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনের অধীনে স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয় উপজাতীয়দের মধ্য থেকে। নিয়ম করা হয় প্রতি জেলায় ৩০ জন সদস্য রাখা হবে। যার এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি এবং দুই তৃতীয়াংশ বিভিন্ন উপজাতি জনগোষ্ঠী। কিন্তু দেশদ্রোহী চক্রান্তে লিপ্ত সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। ফলে এই পরিষদের হাতে যে ২২ ধরণের ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার কথা ছিল তা ব্যর্থ হয়।

পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত শান্তি বাহিনীর সঙ্গে ১৩ দফা বৈঠক হয়। তারপর ১৯৯৬ সালের ২২ জুন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শান্তিবাহিনীর সাথে আবার নতুন করে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপন এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা ১৯৯৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন। কমিটির প্রধান হিসেবে মনোনীত হন তৎকালীন চীফ হুইফ আবুল হাসনাত মুহাম্মদ আবদুল্লাহ।

পাঁচ দফা পেশ:
কমিটির প্রধান শান্তি আলোচনার পাশাপাশি ১৯৯৭ সালের ১ আগস্ট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র বিরতি শুরু করেন। তখন জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে আলোচনা করে ৫ দফা দাবি পেশ করে। দাবিগুলো নিম্নরূপ-

১. বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি নির্বাচিত আঞ্চলিক পরিষদের কর্তৃত্বাধীন পৃথক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা প্রদান, যার নাম হবে জুম্মুল্যান্ড।

২. পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের জাতিগত সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান।

৩. ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশকারী বহিরাগতদের প্রত্যাহার। পার্বত্য ভূমির ওপর পাহাড়ি স্বত্ত্বের স্বীকৃতি।

৪. বিডিআর ক্যাম্প ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সকল ক্যাম্প ও সেনানিবাস তুলে নেয়া।

৫. ১৯৬০ সালের পর থেকে যে সব পাহাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা। জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল আইনি অভিযোগ প্রত্যাহার এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিষয়বস্তু:
পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রধান বিষয়বস্তু হলো দ্বিস্তর বিশিষ্ট পরিষদ। যার প্রথমটি আঞ্চলিক পরিষদ, পৃথক তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। স্থানীয় সরকার পরিষদের পরিবর্তে জেলা পরিষদ গঠিত হবে। আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয় করবে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে এ তিনটি জেলা পরিষদ। যা দুই যুগের বেশি সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির দিকসমূহ:
মোট ২৬টি বৈঠক শেষে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অর্থাৎ দীর্ঘদিনের অশান্ত পার্বত্য অঞ্চলকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ নীতিমালার প্রধান প্রধান দিকগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
স্বাক্ষরের পর থেকেই চুক্তি বলবৎ হবে।
বিডিআর ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলী কদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল সরকারি, আধা সরকারি, পরিষদীয় ও সায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে সকল স্তরে নিয়োগে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হবে। একজন উপজাতীয় সম্প্রদায় সুযোগ ভোগী হবেন।
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনসমূহ পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন ও অবলোকন করা হবে।
পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে এই পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। যার পদমর্যাদা হবে একজন প্রতিমন্ত্রীর সমান এবং তিনি অবশ্যই উপজাতীয় হবেন।
পরিষদে মহিলাদের জন্য ৩টি আসন সংরক্ষিত রাখা হবে। দুই-তৃতীয়াংশ উপজাতীয় হবে।
পরিষদের মেয়াদ ৫ বছর হবে।
পরিষদের সাথে আলোচনা ছাড়া কোনো জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করা যাবে।

কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসা জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমির মূল মালিকদের বন্দোবস্ত দেয়া হবে।
মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু হবে।
তিন জেলা সমন্বয়ে ২২ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। এর মেয়াদ হবে ৫ বছর।
সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বহাল থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে চাইলে সরকার পরিষদের সাথে আলাপ করবে।
উপরিউক্ত নীতিমালার ভিত্তিতেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলাফল :

পার্বত্য চুক্তির ফলে পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যমান যে হানাহানি তা মোটেও বন্ধ হয়নি বরং চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে সশস্ত্র সংগঠন ছিল একটি এখন চুক্তির ফলে তা বৃদ্ধি পেয়ে চার-পাঁচ টিতে রুপান্তরিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে সন্তু লারমা দলের ৭৩৯ জন অকেজো কিছু অস্ত্রসহ কথিত আত্মসমর্পণ করে। প্রায় ৬৪,০০০ জন শরণার্থী দেশে ফিরে আসে। অবশ্য এই পার্বত্য চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ পুরুস্কার পেয়েছে। যেমন,‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের একটি বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়েছে।’ ইউনেস্কো বাংলাদেশের এই পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেছে। কিন্তু চুক্তির মৌলিক প্রধান শর্ত ছিল, অবৈধ অস্ত্র পরিহার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। দুঃখজনক যে, চুক্তির ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সন্তু লারমার জেএসএস সম্পূর্ণ অবৈধ অস্ত্র সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করেনি। বরং পূর্বের ন্যায় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, হানাহানি ও খুন-গুম এবং অরাজকতা করে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে নরকের পরিণত করেছে। এটা একপ্রকার রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। তাদের প্রতি রাষ্ট্রের সহনশীল নীতিকে তারা যদি রাষ্ট্রের দূর্বলতা মনে করে তাহলে এটা তাদের ভুল চিন্তাধারা।

করণীয়:
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে যেহেতু বাংলাদেশ সংবিধানের সাংঘর্ষিক অবস্থান রয়েছে এবং চুক্তির পরেও উপজাতি সন্ত্রাসীরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। সুতরাং এই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ধারা সংবলিত চুক্তি সংশোধন পূর্বক পাহাড় এবং সমতলের জন্য একই নিয়ম চালু করতে হবে।

এক কেন্দ্রীক রাষ্ট্রব্যবস্থার বাংলাদেশে পাহাড়ের জন্য ভিন্ন আইন অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে।

কোন প্রকার সহানুভূতি না দেখিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের নির্মূলের জন্য সামরিক অভিযান চালু করতে হবে। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির নামে শন্তু লারমার সাথে যে চুক্তি হাসিনা করেছিল, আদতে সেটি ছিল দেশ বিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের শক্ত পেরেক। যে চুক্তির শর্তানুসারে দুই যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অসংখ্য সেনা ক্যাাম্প প্রত্যাহার করে নিল। মানে চোরের হাতে ঘর পাহারা।

© পার্বত্য চট্টগ্রাম

Address

Dhaka

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when পাহাড়ের খবর-Paharer Khobor posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share