29/04/2025
আপনার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সত্যিই এক বিস্ময়কর জগৎ। প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অনুভূতি, এমনকি পলকের ফেলার মতো অতি সামান্য কাজও ঘটে অসংখ্য নিউরনের জটিল যোগাযোগের মাধ্যমে, যা বৈদ্যুতিক সংকেতের ভাষায় প্রবাহিত হয়। নিউরালিঙ্ক ঠিক এই রহস্যময় ভাষার পাঠোদ্ধার করতে চায়। এটি এমন একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যা মস্তিষ্কের এই সূক্ষ্ম সংকেতগুলোকে ধারণ করে একটি ক্ষুদ্র চিপের মাধ্যমে বাইরের যন্ত্র বা কম্পিউটারে প্রেরণ করতে সক্ষম। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও, এই প্রযুক্তি এখন আর কেবল স্বপ্ন নয়—বাস্তবতার খুব কাছেই এর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
এই প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি ছোট্ট চিপ, যা দেখতে অনেকটা চালের দানার মতো। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র হলেও, এই চিপটি ধারণ করে অসীম সম্ভাবনা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে, সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এটি মানব মস্তিষ্কে স্থাপন করা হয়, যেখানে এটি নিউরনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। নিউরালিঙ্কের সবচেয়ে উদ্দীপক দিকটি হলো—যারা বাকশক্তি হারিয়েছেন, যাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ, এমনকি যারা সামান্যতম নড়াচড়া করতেও অক্ষম, তাদের জন্য এটি নতুন করে জীবন খুঁজে পাওয়ার আলোকবর্তিকা হতে পারে। তারা কেবল তাদের মনের ভাবনার মাধ্যমেই বিভিন্ন যন্ত্র বা কম্পিউটারকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন।
একবার কল্পনা করুন, আপনাকে আর কি-বোর্ডে আঙুল চালাতে হচ্ছে না—আপনার মনের পর্দায় যা ভেসে উঠছে, তা-ই মুহূর্তে শব্দে রূপান্তরিত হয়ে স্ক্রিনে দৃশ্যমান হচ্ছে। শুধু যোগাযোগ স্থাপনই নয়, এই প্রযুক্তি অন্ধদের জন্য দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে, পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনরায় হাঁটার সক্ষমতা দিতে, এমনকি মানুষের স্মৃতিশক্তি এবং শেখার ক্ষমতাকেও উন্নত করতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে উদ্দীপনা প্রদানের মাধ্যমে আলঝেইমার বা পারকিনসন্সের মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের চিকিৎসাও হয়তো একদিন সম্ভব হবে।
তবে, এই অভাবনীয় সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু গভীর উদ্বেগও রয়েছে। আমাদের মনের গভীরে লুকানো ভাবনা যদি কোনো হ্যাকারের হাতে চলে যায়, তাহলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? যদি এই প্রযুক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হয়, তাহলে এর অপব্যবহারের ঝুঁকি কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারব? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। নীতিশাস্ত্রবিদ এবং বিজ্ঞানীরা এই বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন এবং কঠোর নিরাপত্তা প্রোটোকল তৈরির উপর জোর দিচ্ছেন।
ইলন মাস্কের দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত নিউরালিঙ্ক নামক স্টার্টআপ এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে দৃঢ় পদক্ষেপ ফেলছে। তাদের লক্ষ্য হলো এমন একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা, যেখানে মানুষ এবং যন্ত্র একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে—দুটি ভিন্ন সত্তা নয়, বরং একটি শক্তিশালী দল হিসেবে।
২০২৪ সালের ২৯শে জানুয়ারি, নিউরালিঙ্ক তাদের প্রথম মানব মস্তিষ্কে চিপ বসানোর কথা ঘোষণা করে। "টেলিপ্যাথি" নামক এই ডিভাইসটি একজন প্যারালাইজড ব্যক্তির মস্তিষ্কে স্থাপন করা হয়েছে এবং প্রাথমিক ফলাফল অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। মাস্কের মতে, এই ব্যক্তি কেবল মনের মাধ্যমেই কম্পিউটার কার্সর নাড়াতে সক্ষম হচ্ছেন। এই ঘটনা নিউরালিঙ্কের অগ্রযাত্রায় একটি বিশাল মাইলফলক স্থাপন করেছে এবং মানব-মেশিন মিথস্ক্রিয়ার এক নতুন যুগের সূচনা করেছে।
বর্তমানে, নিউরালিঙ্ক তাদের প্রযুক্তির নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাচ্ছে। তারা এফডিএ (Food and Drug Administration) সহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে, যাতে এই প্রযুক্তি নিরাপদে এবং নৈতিকভাবে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও, অন্যান্য বায়োটেক কোম্পানি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানও মস্তিষ্কের ইন্টারফেস প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যা এই ক্ষেত্রের অগ্রগতিকে আরও দ্রুততর করছে।
এই গল্প কোনো সুদূর ভবিষ্যতের অলীক কল্পনা নয়—এর বীজ ইতিমধ্যেই বোনা হয়ে গেছে। নিউরালিঙ্ক হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষের জীবনের সংজ্ঞা আমূল পরিবর্তন করে দেবে, যেখানে শারীরিক সীমাবদ্ধতা আর অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। মনের শক্তিকে ব্যবহার করে মানুষ এক নতুন, উন্নত জীবনের দিকে এগিয়ে যাবে—এই বিশ্বাস এখন ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে।