সাহিত্য পদবাচ্যের (কবিতা এবং গদ্য) সামগ্রিক রূপকে কণ্ঠস্বরে যথাযথ প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রমিত উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রেখে বিষয়ে ধারণকৃত অনুভূতি, আবেগ, ভাব, গতি, বিরাম, ছন্দ ইত্যাদির সমন্বিত ও ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি
আবৃত্তি শিল্প অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেকে কম নয়। আবৃত্তির নিজস্ব একটা জগত আছে। এই শিল্পের মাধ্যমে সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলে দেওয়া যায় মুহূর্তেই।
এক সময়ে
বাংলা একাডেমির বই মেলায় প্রচুর আবৃত্তির ক্যাসেট প্রকাশিত হতো। আর তাতে মুলত প্রেম ভিত্তিক কবিতাই থাকতো। নারীকণ্ঠের আবৃত্তি মানেই ‘তুমি আজ বড় বেশী সিগারেট খাচ্ছো শুভংকর’ জাতীয় অতি নাটকীয় মেয়েলী গলায় আবৃত্তি হতো। নারীকণ্ঠের আবৃত্তি সেই বুহ্য থেকে বেরুতে পেরেছে কিনা জানি না তবে বিশাল প্রভাব ফেলেছে বাংলা আবৃত্তির নতুন শ্রোতাদের ওপর। ৮০, ৯০ দশকে মজা করে বলা হোত আবৃত্তিকার তিন ধরনের, টেলিভিশনের আবৃত্তিকার, ক্যাসেট আবৃত্তিকার আর বিপ্লবী আবৃত্তিকার। শেষের দলটি ছিলো ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের টিএসসি কেন্দ্রীক। রাজনৈতিক আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে এই সব আবৃত্তিকার এবং সংগঠনের অবদান যথেষ্ট।
শিল্পী কাজ করেন রং দিয়ে, আর কবি শব্দ দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন সেই কাজ। কবিতাকে কেউ বলেছেন মিউজিকাল থ্রটস; কেউ বলেছেন, কল্পনার অভিব্যক্তিই কবিতা। জীবনের সত্য ও সৌন্দর্যের জীবনোপলদ্ধিই কবিতায় রূপ নেয়। সেই কবিতাকেই আশ্রয় করে অনুশীলনের গভীর স্পর্শে অবয়ব মেলে ধরে আবৃত্তি। কবি যেমন বিশেষ আবেগ, চিত্রকল্প, গল্প প্ররিস্ফুটন ঘটান কবিতার মাধ্যমে আর আবৃত্তিকার কন্ঠের সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনায় যথাযথ আবেগ, প্রমিত উচ্চারনের দ্যেতানায় রঙিয়ে তোলেন প্রতিটি শব্দকে। শ্রোতাকে করে রাখেন শব্দের মায়ার জালে আচ্ছন্ন।
‘আবৃত্তির অভিধানগত অর্থ যা মেলে তা হচ্ছে, বারবার পড়া বা পুনঃ পুনঃ পাঠ। আবৃত্তিকার যদি পুনঃ পুনঃ পাঠ করে যান তবে আভিধানিক অর্থে সেটাই আবৃত্তি। আভিধানিক অর্থ সংযোগে শিল্পসম্মতভাবে নন্দনতাত্ত্বিক বোধসম্পন্ন সৃজনশীল পরিমিতিবোধে পাঠ করাকে আবৃত্তি বলে।’
আবৃত্তি একটি বহমান চর্চা। সতত অনুশীলনই একজন আবৃত্তিকারকে প্রতিদিনই করোটিতে নতুন নতুন উপলদ্ধি সৃষ্টিতে সহায়তা করে, কবিতার গভীরে নিজেকে প্রোথিত করার প্রেরণা দেয়, নতুন বোধ আর সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটায়-কন্ঠস্বরকে শাণিত করে নিজেকে গড়ে তোলে হৃদ্ধ আবৃত্তিকার হিসাবে।
যে কোন শিল্পের চর্চায় প্রাচীনত্ব এবং গুরুত্ব স্বীকৃত। একজন পাঠক নিজস্ব বোধের আলোয় কবিতাকে উপলদ্ধি করতে পারেন। আবৃত্তিকারকে তাই প্রথমেই বুঝে নিতে হয় কবিতাটি। শ্রোতার কাছে কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে শ্রবণযোগ্য শিল্পকলার দ্যোতনায় প্রতিষ্ঠা করেন একজন আবৃত্তিকার। তাই আবৃত্তিকারকে নিতে হয় নানা প্রস্তুতি এবং স্বরপ্রক্ষেপণের নানান কৌশল। অনুশীলনই পারে সেই জায়গায় পৌঁছে দিতে। সে জন্য একজন নতুন আবৃত্তিকারের অনুশীলনে শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ, কবিতার ছন্দ, মাত্রা, পর্ব, লয়, গতি, যতি ও বিরাম চিহ্ন, কবিতার রস, গুন সম্পর্কে জানা, বাক্যের ভাবানুযায়ী স্বক্ষেপণের পরিকল্পনা করা এবং কন্ঠস্বর, বাকযন্ত্র ও দম এর নিয়মিত অনুশীলন অত্যন্ত আবশ্যক।
সামগ্রিকভাবে এই কাজগুলো নির্ভর করছে একজন আবৃত্তিকারের আন্তরিকতার উপর। তিনি যদি তার আবৃত্তিকে শিল্পের সম্মান দিতে চান তাহলে ঐ কাজগুলোর কোন বিকল্প নেই।