28/08/2025
🏞️ "মুন্সীগঞ্জ"-তথা প্রাচীন বিক্রমপুরের ইতিহাস 🏞️
বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক গৌরবোজ্জ্বল নাম বিক্রমপুর, যার আধুনিক নাম আজকের মুন্সীগঞ্জ জেলা। হাজার বছরের সভ্যতা, রাজনীতি, সাহিত্য, দর্শন, ধর্মীয় কেন্দ্র ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের কারণে বিক্রমপুর সমগ্র বাংলার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
---
📜 নামকরণের ইতিহাস
“বিক্রমপুর” নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মতে, ১০ম শতকে চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের তাম্রলিপিতে প্রথমবার এই নাম পাওয়া যায়। ‘বিক্রম’ মানে বীরত্ব এবং ‘পুর’ মানে নগর—অর্থাৎ বিক্রমপুর অর্থ “বীরদের নগর”।
👉 প্রাচীনকাল থেকেই এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী।
👉 মুঘল আমলে এটি সোনারগাঁও সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরগনা হিসেবে পরিচিতি পায়।
বর্তমান নাম “মুন্সীগঞ্জ” এসেছে “মুন্সী” উপাধিধারী স্থানীয় রাজস্বকর্মী/প্রভাবশালী পরিবারের নাম থেকে। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ প্রশাসনিকভাবে মুন্সীগঞ্জকে ঢাকা জেলা থেকে আলাদা করে পূর্ণাঙ্গ জেলা ঘোষণা করা হয়।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে বিক্রমপুর নামটির উৎস প্রাচীন ভারতের কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য। তবে এ নিয়ে একাধিক মতামত রয়েছে। আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিচ্ছি—
---
🔶 রাজা বিক্রমাদিত্য ও বিক্রমপুর নামকরণ
বিক্রমাদিত্য ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক কিংবদন্তি সম্রাট। তাঁর শাসনকাল সাধারণত উজ্জয়িনী নগরকে কেন্দ্র করে ধরা হয়। তিনি ছিলেন জ্ঞান, ন্যায়বিচার ও সাহসিকতার প্রতীক।
তাঁর নামে শুরু হয় বিক্রম সংবৎ (৫৭ খ্রিষ্টপূর্ব), যা উত্তর ভারতে দীর্ঘকাল ব্যবহার হয়েছে।
ইতিহাসবিদদের ধারণা, “বিক্রমপুর” নামটি রাজা বিক্রমাদিত্যের স্মরণে রাখা হয়েছে।
বিক্রমাদিত্য উপাধিটি একাধিক শাসকের ছিল, তাই নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন কার নামে এই নামকরণ করা হয়েছিল।
আবার কিছুজন মনে করেন, বিক্রমাদিত্যের সেনাপতি বা তাঁর বংশধরেরা এই অঞ্চলে এসে বসতি গড়েন এবং সেখান থেকেই নামটি প্রচলিত হয়।
---
🔶 বিকল্প ব্যাখ্যা
তবে সব ইতিহাসবিদ একমত নন। অন্য একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়—
“বিক্রম” শব্দের অর্থ সাহস, শক্তি, বীরত্ব।
প্রাচীন এই জনপদে সাহসী শাসক ও যোদ্ধাদের বসবাস ছিল, তাই এর নাম হয় বিক্রমপুর।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, পাল ও সেন যুগে যখন এই অঞ্চল বাংলার রাজধানী ছিল, তখন বিক্রমপুর নামটি স্থায়ী রূপ পায়।
---
🔶 শাসকদের সঙ্গে বিক্রমপুর
পাল রাজবংশ (৮ম–১২শ শতক) দীর্ঘদিন বিক্রমপুরকে রাজনৈতিক কেন্দ্র করে।
সেন রাজবংশের বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন বিক্রমপুরকে তাঁদের রাজধানী করেন।
মুসলিম আমলে বিক্রমপুর ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
---
📌 সারকথা:
বিক্রমপুর নামটি সম্ভবত রাজা বিক্রমাদিত্যের নামের সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে এর সাহসিকতার প্রতীকী অর্থও থাকতে পারে। যা-ই হোক, এই অঞ্চল হাজার বছর ধরে বাংলার ইতিহাস ও সভ্যতার এক সমৃদ্ধ কেন্দ্র।
---
🏯 বিক্রমপুরের শাসকগণ
প্রাচীনকাল থেকে বিক্রমপুর ছিল শাসন ও সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল।
চন্দ্র বংশ (১০ম শতক) – শ্রীচন্দ্র বিক্রমপুরকে রাজধানী করেন।
বর্মণ বংশ (১১শ শতক) – বিক্রমপুরে স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
সেন বংশ (১২–১৩শ শতক) – বিজয়সেন, বল্লালসেন ও লক্ষ্মণসেন বিক্রমপুরকে বাংলার রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেন।
মুঘল যুগ (১৬শ–১৭শ শতক) – আকবরের প্রশাসনে বিক্রমপুর ছিল সোনারগাঁও সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরগনা। জমিদার কেদার রায় মুগল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন।
১৮শ শতক – বিক্রমপুরকে ভেঙে রাজনগর ও বৈকুণ্ঠপুর নামে নতুন পরগনা গঠন করা হয় (১৭২৮ খ্রি.)।
---
🏰 প্রাচীন স্থাপনা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন
বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রত্ননিদর্শন ও স্থাপত্য—
নাটেশ্বর–রঘুরামপুর প্রত্ননগরী – ১২০০ বছরের পুরনো বৌদ্ধ নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
ইদ্রাকপুর কেল্লা (১৬৬০ খ্রি.) – মুঘল সুবেদার মীর জুমলা ঢাকাকে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য দুর্গ নির্মাণ করেন।
রামপাল দুর্গ – প্রাচীন প্রতিরক্ষা স্থাপনা।
বজ্রযোগিনী বৌদ্ধ বিহার – অতীশ দীপঙ্করের অধ্যয়নের কেন্দ্র।
রিকাবিবাজার মসজিদ (শ্রীনগর) – মুঘল আমলের ঐতিহ্য।
ব্রহ্মানগাঁও ও হাসাইল জমিদারবাড়ি – জমিদারি ঐতিহ্যের নিদর্শন।
বল্লাল বাড়ি
অতীশ দীপঙ্করের বাড়ি
পলুঘাটা সেতু :- বিক্রমপুরের প্রাচীন মোঘল আমলের সেতুর মধ্যে পানাম পুলঘাটা সেতু অন্যতম, যা মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ী ও রামপাল অঞ্চলে অবস্থিত।
এগুলো ছাড়াও মুন্সীগঞ্জে আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে যা মুন্সীগঞ্জের ইতিহাস বহন করে চলছে ||
---
🌊 আড়িয়াল বিল – মুন্সীগঞ্জের প্রাণ
মুন্সীগঞ্জের বিস্তীর্ণ জলভূমি আড়িয়াল বিল বাংলাদেশের বৃহত্তম বিলগুলোর একটি। এটি শুধু কৃষি ও মাছের আধারই নয়, বরং প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবিকা ও নৌ-সংস্কৃতির মূলভিত্তি। এটিকে স্থানীয়রা “মুন্সীগঞ্জের হৃদয়” বলে অভিহিত করে।
---
🧑🎓 বিক্রমপুরের গুণী ব্যক্তিত্ব
বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন এবং বসবাস করেছেন অসংখ্য বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব—
আতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮২–১০৫৪) – বৌদ্ধ দার্শনিক, জন্ম বজ্রযোগিনী।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮–১৯৩৭) – বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানের জনক, পৈতৃক ভিটে রাড়িখাল।
হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭–২০০৪) – ভাষাবিদ, কবি, লেখক, জন্ম রাড়িখাল।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী – খ্যাতিমান প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ।
এ.কিউ.এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী – রাষ্ট্রপতি, জন্মসূত্রে বিক্রমপুরের সন্তান।
ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ – সাবেক রাষ্ট্রপতি, শিক্ষাবিদ।
ড. ফখরুদ্দীন আহমদ – সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
(এছাড়াও আরও অসংখ্য সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ,অভিনেতা, ব্যবসায়ী বিক্রমপুর থেকে উঠে এসেছেন।)
---
🏘️ বিক্রমপুরের প্রাচীন বিস্তৃতি
প্রাচীন বিক্রমপুর এক বিশাল জনপদ ছিল, যা আজকের—
মুন্সীগঞ্জ জেলা
নারায়ণগঞ্জ জেলার কিছু অংশ
ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ
ফরিদপুরের কিছু অংশ
অন্তর্ভুক্ত করত।
_________________________________
“বিক্রমপুর” আসলে ছিল এক ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক অঞ্চল, যার কেন্দ্র ছিল বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা। মুঘল আমলে এটি “বিক্রমপুর পরগনা” নামে পরিচিত হয়। আজকের প্রশাসনিক দিক থেকে মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রায় পুরো অংশই সেই বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
🔎 বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জেলার যে এলাকাগুলো বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল—
সিরাজদিখান উপজেলা – প্রায় পুরোটা বিক্রমপুরের অন্তর্ভুক্ত।
শ্রীনগর উপজেলা – পুরো অঞ্চল বিক্রমপুরের অন্তর্গত ছিল।
লৌহজং উপজেলা – বিশেষ করে কান্দি, মাওয়া, কুমারভোগ, বেজগাঁও প্রভৃতি এলাকা।
টঙ্গীবাড়ি উপজেলা – টঙ্গীবাড়ির বেশিরভাগ অংশ।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার দক্ষিণাংশ – বিশেষ করে মিরকাদিম, আধারা, মালখানগর ইত্যাদি অঞ্চল।
📌 সংক্ষেপে বললে—
আজকের মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান, শ্রীনগর, লৌহজং, টঙ্গীবাড়ি এবং সদর উপজেলার একটি বড় অংশ বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বিক্রমপুর শুধু রাজনৈতিক রাজধানী নয়, বাংলার সংস্কৃতি, শিক্ষা ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবেও সমৃদ্ধ ছিল।
---
🏢 বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা
আজকের মুন্সীগঞ্জ জেলা গঠিত ৬টি উপজেলা নিয়ে—
1. মুন্সীগঞ্জ সদর
2. শ্রীনগর
3. লৌহজং
4. টংগীবাড়ি
5. গজারিয়া
6. সিরাজদিখান
---
🕰️ প্রাচীন বসতি
প্রায় ১২০০ বছরেরও বেশি আগে বিক্রমপুরে ঘনবসতি গড়ে ওঠে। নাটেশ্বর ও রঘুরামপুরের প্রত্ননগরী সেই ইতিহাসের প্রমাণ বহন করছে।
---
✨ সারসংক্ষেপ
👉 বিক্রমপুর = আজকের মুন্সীগঞ্জ
👉 নামকরণ: চন্দ্র বংশীয় শ্রীচন্দ্রের আমল থেকে (১০ম শতক)
👉 জেলা: ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ থেকে
👉 ইতিহাস: চন্দ্র, বর্মণ, সেন, মুঘল শাসনের সাক্ষী
👉 আড়িয়াল বিল, ইদ্রাকপুর কেল্লা, বৌদ্ধবিহার – ঐতিহ্যের প্রতীক
👉 অসংখ্য বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান
“বিক্রমপুরের প্রতিটি প্রাচীন স্থাপনা আমাদের অতীতের স্মৃতি বহন করে, আর মুন্সীগঞ্জের ইতিহাস যেন বাংলার গৌরবময় অধ্যায়ের জীবন্ত দলিল। ইদ্রাকপুর কেল্লা, প্রাচীন রাজবাড়ী কিংবা আড়িয়াল বিল—সবকিছু মিলিয়ে মুন্সীগঞ্জ আজও আমাদের ঐতিহ্যের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই বলা যায়, মুন্সীগঞ্জ মানেই বিক্রমপুর, আর বিক্রমপুর মানেই বাংলার গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধনভাণ্ডার।”
আপনাদের জন্য প্রশ্ন---
1. “আপনার মতে বিক্রমপুরের কোন স্থাপনাটি সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাস বহন করে?” 🤔
2. “মুন্সীগঞ্জের ইতিহাসের কোন গল্পটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে?” 🏰
3. “আপনি কি কখনও ইদ্রাকপুর কেল্লা বা বিক্রমপুরের প্রাচীন রাজবাড়ী ঘুরে দেখেছেন?” 🌿
4. “যদি সুযোগ পান, বিক্রমপুরের কোন ঐতিহাসিক স্থান প্রথমে ভ্রমণ করবেন?” ✨
5. “আজকের প্রজন্ম কি বিক্রমপুরের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ঠিকমতো জানে?” ❓
_________________________________
_________________________________
---
📌
#মুন্সীগঞ্জ #বিক্রমপুর #বাংলারইতিহাস #আড়িয়ালবিল #ঢাকারগণপরিবহন #বাংলারঐতিহ্য
#মুন্সীগঞ্জ #ঐতিহাসিক_মুন্সীগঞ্জ #আরিয়ানবিল #বাংলার_ঐতিহ্য #ঐতিহাসিক_বাংলা #বাংলার_গৌরব