15/04/2025
এত শক্তি কোথায় পেলেন আপা ⁉️ আপনার কি ভয় লাগে না ⁉️
লেখক: ফয়সাল খলিলুর রহমান
কর্মকর্তা, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ: ২৪/১১/২০১৮ ইং
শেখের বেটি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হবে, সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ পাব—এই খবর পাওয়ার পর সবকিছু যেন অন্যরকম হয়ে গেল। নাওয়া-খাওয়া ভুলে, অসুস্থ শরীর নিয়েই ছুটে এলাম সিলেট থেকে ঢাকা। ঢাকা শহরটা সবসময়ই আমার কাছে এক অগোছালো জাদুঘরের মতো মনে হয়—অপ্রয়োজনীয়ভাবে হর্ন বাজানো গাড়ি, এলোমেলো ভবন, ছটফটে কোলাহল। তবে এই শহরের কয়েকটি জায়গা—বঙ্গভবন, সংসদ ভবন আর গণভবন—কল্পনায় সবসময়ই আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। আর আজ, আমি যাচ্ছি সেই গণভবনে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে!
সকালে ঘুম ভাঙতেই গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার ছোট ভাই রাহিম গণভবনের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)’-এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘লেটস টক উইথ শেখ হাসিনা’ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে ১৫০ জন তরুণ। আমি গর্বিত যে তাদের একজন হতে পেরেছি।
বেলা ১২টায় চার স্তরের কড়া নিরাপত্তা পার হয়ে গণভবনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাবা নতুন কিনে দেওয়া সবুজ শার্ট ও লাল টাই পরে এসেছিলাম, কিন্তু এসএসএফ-এর ঘষাঘষিতে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। গেটের বাইরে তখন যশোরের কোনো এক এমপি মনোনয়ন না পেয়ে তার সমর্থকরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে চারদিক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। কবিতার মতো স্লোগান। থিয়েটার মুরারীচাঁদের ইয়াকুবের সঙ্গে আমি মূল প্রাঙ্গনের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
একটা বড় প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে—প্রথমে বুঝিনি এটা কী! পরে জানলাম, ১৫০ জনের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা এখানে। হালকা বিরিয়ানি, কিন্তু আয়োজন বিশাল।
ক্যামেরা নিষিদ্ধ, তবে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করা গেল। তাই নিরাপত্তাকর্মীরা চোখ ফিরালেই অনেকেই দ্রুত ছবি তুলে নিচ্ছেন। বগুড়ার নাট্যকর্মী এঞ্জেল ভুল করে বঙ্গভবনে চলে গিয়েছিল, শেষমেশ ঠিকঠাক ঢুকতে পেরে আমাদের আনন্দ আরও বেড়ে গেল।
খাবার শেষে ঢুকলাম মূল ব্যাঙ্কুয়েট হলে। মাথার উপরে ঝলমলে ঝাড়বাতি, ঝলকে ঝলকে আলো ঝরছে। সেট সাজানো ‘লেটস টক’ অনুষ্ঠানকে ঘিরে। সঞ্চালক ডা. নুজহাত চৌধুরী—শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা। তাঁর আবেগী বক্তৃতা আগেও ইউটিউবে শুনে চোখ ভিজে গিয়েছিল আমার।
তিনি বললেন, "পরীক্ষার আগে যেমন সবার মধ্যে টেনশন থাকে, প্রশ্নপত্র হাতে পেলেই তা কেটে যায়। আজকের এই টক-এ ঘটনা উল্টো—প্রশ্ন তোমাদের, উত্তর দেবেন প্রধানমন্ত্রী।"
আমি শুধু একনাগাড়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি। কখন আসবেন শেখ হাসিনা? হঠাৎ মাইক থেকে ঘোষণা এলো—প্রধানমন্ত্রী দশ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হবেন। ছবি তুলতে চাইলে মোবাইল বের করা যাবে, তবে সিট ছেড়ে উঠা যাবে না।
ঘটনা মজার হয়ে উঠলো। সবাই মোবাইল বের করে সেটের ছবি তুলছে, কেউ দাঁত কেলিয়ে সেলফি তুলছে। আমার পাশে বসা গ্রামীণফোনের এক আপু বললেন, “আপনি চাইলে আপনার একটা ছবি তুলে দিতে পারি।”
ঠিক তখনই এসএসএফ সদস্যরা সতর্ক করলেন। এর মধ্যেই হালকা আলোয় ভরে উঠলো পুরো হল। শান্তির এক মুগ্ধ আলোয় ঢুকলেন শেখ হাসিনা। কাঁচা-পাকা চুলের সঙ্গে মানানসই শাড়ি, প্রশান্তির হাসি মুখে। যেন সকালের রোদে স্নান করা কোনো শুভবার্তা।
তাঁকে জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নাতি রেদওয়ান মুজিব ববি চুপিচুপি পেছনের সারিতে চলে গেলেন। শুরু হলো আলোচনার পর্ব।
প্রথমেই প্রশ্ন করা হলো—কেমন আছেন? শেখ হাসিনা মায়াভরা গলায় বললেন, “আর কেমন থাকবো বলো, এই বয়সে এত অত্যাচার!” কথাটা বলতেই আমার মায়ের মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সত্যিই, বাংলার সব মায়েরা যেন এভাবেই কথা বলেন।
এরপর তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা আমার নাতি-নাতনির মতো। তোমরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।”
এরপর একে একে উঠে এলো তাঁর শৈশব, কৈশোর, রাজনীতিতে আসা, সংগ্রামের দিনগুলোর গল্প। ছোটবেলায় তিনি জাল দিয়ে মাছ ধরতেন, খালে ঝাঁপ দিতেন, স্কুল পালিয়ে মিছিলে যেতেন। একবার হেডস্যারকে ফাঁকি দিয়ে স্কুলের ঘণ্টা চুরি করে ছুটি নিয়েছিলেন!
৬৬-তে যখন বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করেন, তখন কলেজছাত্রী হাসিনা নির্বাচনে অংশ নিতে চান। মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেন, “জিততে না পারলে মানুষ ভাববে ৬ দফা চায় না।” হাসিনা হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করেন। শেষে দাদার সহায়তায় নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়ী হন।
একজন প্রশ্ন করলেন, “৭১ সালে আপনি কোথায় ছিলেন?”—তিনি বলেন, “তখন আমি গর্ভবতী। আমার পেটে ছিল জয়। বাবাকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়, আর আমাদের বন্দী করে রাখে। জয়কে নতুন কাপড় পর্যন্ত দিতে পারিনি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও আমাদের মুক্তি দেওয়া হয় ১৭ তারিখ।”
সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত এলো ১৯৭৫-এর প্রসঙ্গে। জার্মানিতে থাকা স্বামীর অনুরোধে শেখ হাসিনা বিদেশ যান, বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা না করেই। পরে সেন্টু গেঞ্জি পড়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি মাত্র ছবি থাকে তার স্মৃতি হয়ে।
চোখে জল, মুখে দৃঢ়তা নিয়ে তিনি বলেন, “আমাকে বলেছিল—দেশে এলে মেরে ফেলবো। আমি জানতাম, আমার কাজ করতে হবে। আমি ভয় পাই না। আমার শক্তি তোমাদের মাঝেই।”
এই মানুষটার জীবনের গল্প শোনার পর একটাই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল—
এত শক্তি কোথায় পেলেন আপা?
আপনার কি কখনও ভয় লাগে না?