08/03/2025
আজ ফ্রান্সের নিস শহরে আমার অফিসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজিয়ে শুনলাম। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। জলদভাবগম্ভীরভরাট সে গলা। বৃষ্টির হ্যাচলার মতো সে কন্ঠস্বরের উঁচু-নিচু শরীরে গুজবাম্প দিয়ে যায়।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙলার মানুষের নয়নমনি, শালপ্রাংশু বজ্রমানব শেখ মুজিবুর রহমান।
তাঁর প্রজ্ঞাবান, তেজস্বী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে পরাধীনতার শিকল ভেঙে ১৯৭১ সালে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতার অম্লান সূর্যমুখী।
বঙ্গবন্ধুর নোটে (৩ মে ১৯৭৩) একটা শব্দ আছে- "abiding involvement"।
শব্দটির একটি য্যুৎসই তর্জমা হতে পারে "বিনম্র সম্পৃক্তি"। যার উৎস বঙ্গবন্ধুর জবানে "অবিনশ্বর ভালবাসা", যা তাঁর রাজনীতি ও বেঁচে থাকায় মানে এনে দেয়। আদালতের সেরেস্তাদার শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা বানুর "খোকা" মুজিব তাই বিস্ময়ী-বিনয়ী ঢঙে আলগোছে তাঁদের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকেন, মাওলানা ভাসানীকে কদমবুসি করেন বিনয়াবনত হয়ে, রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাশে হাঁটেন শিক্ষকাবেশভারানতভাবে।
তাঁর পদপ্রান্তে অস্ত্র সমর্পণকারী মুক্তিসেনাকে তিনি কুর্ণিশ করেন, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি বুকে মাখেন, বীরাঙ্গনাদের বাবার ভূমিকা নেন, কিশোরীর মাথায় তিনি হাত বুলান, বৃদ্ধার রেখে দেয়া দুধের বাটি আর কয়েকটি আঁচলবাধা পয়সাপ্রসূত ভালবাসা থেকে তিনি বুঝে যান যে মানুষের ভালবাসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা তাঁর পক্ষে কোনদিন সম্ভব হবেনা। ১৯৭২-এর অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠানে দীর্ঘদেহী শেখ মুজিবের সামনে সিরাজুল আলম খানকে মুজিববাদের ঝান্ডা তুলে ধরার দীপ্ত শ্লোগান দিতে দেখা যায়।
জেলের গেটের দুটি হলুদ পাখিকে তিনি চিনতে পারেন, জয়নুল আবেদীন-হাশেম খান-কামরুল হাসানকে ডেকে তিনি রক্তেভেজা সংবিধানের আল্পনা করান, লাখো মানুষের সমাবেশে তিনি কাঁদেন, একটা বাক্যে তিনি আবহমান বাঙালির বেদনাকে তুলে ধরেন:
"তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই... ৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল 'ল জারি করে আমাদের দশ বছর পর্যন্ত গোলাম করে রেখেছিলো..."।
"আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায় ...."
"কি অন্যায় করেছিলাম আমরা?"-- খেকিয়ে ওঠেন মুজিব।
শেখের বজ্রনিনাদ যেন আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে।
মোহাম্মদ শাহ বাঙালির একটা লোকগানে রূপক টেনে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নদীর জলও ছলাৎ করে নেচে উঠতো। শাহ বাঙালির আরেকটা গানে আছে:
"ও ভাইরে শ্যাখ মুজিবার সত্য যুগে সত্য রাজা .."
ভারী ভালো লাগে শুনতে সে গান।
এই ব্যাপারগুলোই একসাথে বিনম্র সম্পৃক্তি- যার মাধ্যমে তিনি "বাঙলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর হেঁটে যান।" তিনি শুধু বলে যাননা যে:
"তোমরা যদি আমাকে হত্যা-ই করবে, তবে এত ভালবেসেছিলে কেন?"
'৭৫ পরবর্তী প্রজন্ম হলেও বঙ্গবন্ধু আমার সুতীব্র আবেগের জায়গা। তবে এও সত্য জানি যে, আবেগের পাশাপাশি তিনি আমাদের জাতিসত্তার কাছে বারবার এক জিজ্ঞাসার বিষয়। তাই আমাদের ফিরে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার কাছে, তাঁর দূরদৃষ্টির কাছে, তাঁর দিক্-নির্দেশনার কাছে।
বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে আমাদের সংগ্রামকে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ও ‘মুক্তির সংগ্রাম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আপাত:দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ হয়তো নিছকই স্বাভাবিক শব্দচয়ন। কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসেনা। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল মুক্তি সম্ভব।
পঞ্চম সংশোধনীতে সামরিক ফরমান দিয়ে জেনারেল জিয়া "মুক্তি" শব্দটি তুলে দিয়ে "স্বাধীনতা" এবং 'সংগ্রাম" শব্দটি সরিয়ে "যুদ্ধ" শব্দটি বসিয়ে দেন। 'জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম করিয়া" শব্দমালার জায়গা লিখে দেন, "জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ করিয়া।"
রক্তে লেখা সংবিধান শুধু মুখের কথার একটা শব্দ পরিবর্তন করে যে ১৯৭১-এর পূর্ব ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসকে যে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়, তা এই সাংবিধানিক হারাকিরি না দেখলে বুঝা যায় না।
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের ঋদ্ধ অভিজ্ঞতায় এবং রক্তাক্ত উপলব্ধিতে যখন কার্যিক অর্থেই কৃষক-শ্রমিক-দুঃখী-শোষিত শ্রেণীর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেন তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়। পেন্টাগনের হ্যারল্ড স্যান্ডার্স, সিআইয়ের জর্জ গ্রিফিন ও ফিলিপ চেরির সঙ্গে যুক্ত সামরিক বাহিনীর একাংশ, সিআইয়ের ট্রেনিংপ্রাপ্ত জাঁদরেল অফিসার, কূটনৈতিক, বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিভ্রান্ত এবং হটকারী শক্তির বিচ্ছিন্ন ও সম্মিলিত চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তান কারাগার থেকে ফেরত এসে লাখ জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: "কবি গুরু তুমি বলেছিলে, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবি গুরু, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।"
অথচ বাঙালির 'মানুষ' হওয়ার গর্বে গর্বিত বাংলার রাখাল রাজা শেখ মুজিব ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে নিজ বাড়ির সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। আহ! হোয়াট এ্যা ফল দ্যাট ওয়াজ! কি মর্মন্তুদ! দুঃসহ! ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেট স্তব্ধ করেছে পিতার দেহ।
আর এই সেদিন বুনো উল্লাস করে খুনিদের উত্তরাধিকারীরা ভস্ম করেছে বত্রিশ।
সাতই মার্চের ভাষণে একটি উপেক্ষিত বাক্য আছে:
"যে রক্ত দিয়ে আপনারা একদিন আমাকে জেল থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন, এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম,আমার রক্ত দিয়ে, আমি রক্তের ঋণ শোধ করবো। মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত।"
কথা রেখেছেন তিনি।
রক্ত দিয়েছেন তিনি। সেই লাল টকটকে রক্ত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটির সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে পদ্মা-মেঘনার জলে মিশে গেছে। তিনি দিয়ে গেছেন একটি আলাদা পতাকা, বাঙালির নিজের করে একটি দেশ-বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়। আর রেখে গেছেন একটি সংবিধান যেখানে জ্বলজ্বল অক্ষরে লেখা আছে:
"প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।"
যে মানুষটিকে উচ্চাভিলাষী বলে খুন করেছিলাম আমরা বা বিভিন্ন যুক্তিতে খুন মেনে নিয়েছিলাম এই আমরা, তিনি সংবিধান নামক ইচ্ছাপত্রে লিখে গেছেন: "জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন।"
[ছবিটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের চেয়ারম্যান কক্ষের। চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে গত ২৭ ফেব্রয়ারি ফ্রান্স চলে আসার দুইদিন আগে পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর ছবিটি যত্নে টাঙিয়ে রেখেছিলাম। আসার আগে পরম মমতায় যত্ন করে নামিয়ে রেখে এসেছি। বলা ভুল হলো। বঙ্গবন্ধু তো হৃদয়ে।
বিল্পব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই মুজিব!
Billah Masum