16/07/2025
শৃঙ্খল ভাঙার দিন ১৬ জুলাই
—-
রাজনীতির ইতিহাসে কিছু কিছু ঘটনা ঘুরে ঘুরে আসে। যদি বলা হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিন মুছে ফেলা যাবে না। পাকিস্তানি শাসকেরা তাঁকে নানা অপবাদ দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে কুচক্রীরা তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছে। তাঁর নাম-গন্ধ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার অনেক চেষ্টা করেছে। তারা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকেও বঙ্গবন্ধুর মতোই অনেক চরাই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। বারবার মৃতু্্যর মুখ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। গুলি, বোমা, গ্রেনেড হামলা অনেক কিছুুই মোকাবিলা করতে হয়েছে। ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। কিন্তু জনগণকে আস্থায় নিয়ে জনকল্যাণের যে পথযাত্রা তিনি শুরু করেছিলেন, তা থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যায়নি।
দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে নিঃসঙ্গ পরবাস। স্বামী-সন্তান নিয়েও গভীর বেদনার দিন পার করতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েও স্বদেশে ফিরতে পারেননি তিনি। দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করেছে ঘাতক। একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
একসময় রাজনীতি থেকেই তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা করা হয়। সাল ২০০৭। সে এক দুঃসহ দিন। বাংলাদেশে তখন চলছে চেপে বসা অপশক্তির দুঃশাসন। দেশের রাজনীতিকে নতুন করে কলুষিত করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা হয়েছে। গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী তখন রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননে ব্যস্ত। রাজনীতি তখন যেন গর্হিত অপরাধ। রাজনীতিক পরিচয়টিও যেন হানিকর। শাসনের নামে ত্রাসের রাজত্ব। ওয়ান-ইলেভেন নামের পটপরিবর্তনের পর চেপে বসা তত্ত্বাবধায়ক নামের অপব্যবস্থায় জনজীবনে নাভিশ্বাস। সেই দুর্বিষহ দিনে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
টেলিভিশনের পর্দায় সেই গ্রেপ্তার-নাটক চাক্ষুষ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরাপত্তারক্ষীদের অপ্রয়োজনীয় অথচ অতিনাটকীয়তায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের সেই বার্তা দেশ থেকে বিদেশে প্রচার হতেও সময় লাগেনি।
চার বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রের যে বিষয়টি সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে তা হচ্ছে তাঁর গভীর প্রত্যয়। দেশ ও মানুষের কল্যাণে তিনি সব সময় নিবেদিত। গভীর সংকটেও তিনি জনগণের কল্যাণ চিন্তা করেন। তাঁর সেই চিন্তার প্রতিফলন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব অর্জনে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তারের পর নিঃসঙ্গ কারাবাসে শুধু শুয়ে-বসেই দিন কাটেনি তাঁর। সৃজনশীল জননেত্রী সেই নিঃসঙ্গ-একাকিত্বের দিনগুলোতে তিনি দেশ ও জনগণের কল্যাণে ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার পরিকল্পনা করেছেন। জেলখানায় বসেই উত্তরণের পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার আগে পর্যন্ত দেড় দশক ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে দেশকে এগিয়ে নিতে। সারা বিশ্ব তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে।
বন্দী জীবনের স্মৃতিচারণা করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয়েছিল, একদম একা। আমি জানি আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলা, আমি যাতে নির্বাচন করতে না পারি, আরো অনেক রকম পরিকল্পনা ছিল বা আমি যেন আর রাজনীতিতে থাকতে না পারি সে ধরনের অনেক ষড়যন্ত্র।...সেই সময় বসে বসে আমি লিখে রেখেছিলাম, ২০০৮-এর মধ্যে নির্বাচন হলে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়, তাহলে দেশের জন্য কী করব? ...২০১১ সালে আমরা কী করব, ২০১২ সালের মধ্যে কী করব, ২০১৩ সালের মধ্যে কী করব, ২০১৪ সালে মধ্যে, ২০১৫ সালের মধ্যে কী করব, এভাবে আমি প্রত্যেকটা বিষয় লিখে রেখেছিলাম।’ সেদিনের বক্তৃতায় শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, কারাগারে যাওয়ার সময় একটি খাতা সঙ্গেই নিয়েছিলেন তিনি। পরে আরো কিছু খাতা কিনিয়ে নেন।
জরুরি অবস্থার অবসানের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। রাজনীতির জটিল পথে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করেন তিনি। নিঃসঙ্গ কারাগারে বসে দিনের পর দিন যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, দেশ ও জাতির অগ্রগতির যে চিন্তা করেছেন, তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তাঁর শাসনামলে। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরের আর্থ-সামাজিক ও মানবোন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছে।
অনেকের ধারণা ছিল ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তারের পর শেখ হাসিনা আঁতাতের পথে যাবেন। রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আবার মনোনিবেশ করবেন গৃহকর্মে। কিন্তু কল্যাণমন্ত্রে দীক্ষা যাঁর, তাঁকে জনকল্যাণের পথ থেকে বিচ্যুত করা যায় না। জনকল্যাণকে ব্রত করে তাই পথ চলেছেন জনগণের নেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা। আজ নতুন যে ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি হয়েছেন, সেই ষড়যন্ত্রের জালও তিনি একইভাবে ছিন্ন করবেন। বীরদর্পে ফিরে আসবেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এটি সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
জনগণের জয় হোক। আসুন, ১৬ জুলাই মন্ত্রে নতুন করে উজ্জীবিত হই আমরা। সকল ষড়যন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে বাংলাদেশকে নতুন আলোয় আলোকিত করি।
লেখক:
এম. নজরুল ইসলাম
সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]