18/04/2025
গোপন জেলের দেয়ালে আটকে থাকা সত্যের ধ্বনি
একটি স্মৃতিচারণ উন্মোচন করল চমকে ওঠার মতো এক সত্য—ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশেই গোপনে লুকিয়ে ছিল এক ভয়ংকর কারাগার।
তদন্তকারীরা যখন তাড়াহুড়ো করে নির্মিত একটি দেয়াল ভেঙে ফেলেন, সামনে আসে একাধিক ছোট ছোট সেল—অন্ধকারাচ্ছন্ন, নিঃসঙ্গ, নিঃশব্দ ঘর যেন জীবন্ত কবর।
একটি নবনির্মিত ইট-দেয়াল দিয়ে চতুরভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল একটি দরজা, যার উদ্দেশ্য ছিল একটাই—ভিতরে চাপা পড়ে থাকা সত্যকে পৃথিবীর চোখ থেকে লুকিয়ে রাখা।
ভেতরে ছিল সরু করিডোর, যার দুই পাশে সারি সারি ক্ষুদ্র কক্ষ। আলোহীনতা যেন ভিতরের বাতাসকেও থমকে দিয়েছিল। আর এই ভয়ংকর জেলের অস্তিত্ব জানতে পারত না কেউ, যদি না মীর আহমদ বিন কাসেমের স্মৃতিতে সেই বিভীষিকার প্রতিধ্বনি বেঁচে থাকত।
বাংলাদেশের এক অপসারিত নেতার সমালোচক কাসেম আট বছর বন্দি ছিলেন সেখানে—একেবারে অদৃশ্য এক অস্তিত্বে। চোখে সবসময় কালো কাপড় বাঁধা থাকত। চারপাশের শব্দই ছিল তার একমাত্র দিকনির্দেশনা—আর সবচেয়ে স্পষ্ট ছিল বিমান অবতরণের শব্দ, যা তার বন্দিদশার অবস্থান প্রকাশ করে।
গত আগস্টে গণবিক্ষোভের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, তদন্তকারীরা শত শত নিরুদ্দেশ ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নিতে শুরু করেন। তখনই আবিষ্কৃত হয় এই গোপন জেলখানা।
বলা হচ্ছে, এই গোপন বন্দিশিবির পরিচালনা করত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা, যাদের কার্যক্রম সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর আদেশে পরিচালিত হতো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, “প্রত্যেকটি গুমের ঘটনার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছিল।”
তবে হাসিনার দল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, এসবের কিছুই তারা জানত না, দায়ও তাদের নয়—যদিও সেনাবাহিনী নিজেও দায় অস্বীকার করেছে।
কাসেম এখনো সেই ভয়কে বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছেন। “আমি কখনোই টুপি ও মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হই না,” তিনি বলেন। “সবসময় মনে হয় কেউ পেছনে আছে, কেউ দেখছে।”
বিবিসিকে নিয়ে তিনি ফিরে যান সেই নিষ্ঠুর ঘরে—যেখানে কাটিয়েছেন জীবনের আটটি দীর্ঘ বছর। একটি ভারী লোহার দরজা ঠেলে, সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামেন—একটি সরু দরজা দিয়ে ঢোকেন তার ‘ঘরে’। ঘরের ভেতর টর্চের আলো ফেলে দেখা যায়—ছোট, ভাঙাচোরা, স্যাঁতসেঁতে ঘরটি যেন দুঃস্বপ্নের মতো।
“এটা যেন জীবন্ত কবর—বাইরের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন,” তিনি বলেন। ঘরে নেই জানালা, নেই আলো প্রবেশের পথ। দিন-রাতের পার্থক্য মুছে গিয়েছিল তার কাছে।
তদন্তকারীরা জানান, এমন সেল ছিল কয়েকশ। প্রতিটি ঘরই ছিল নিখুঁতভাবে সজ্জিত নির্যাতনের জন্য—সাজানো ছিল যেন রাষ্ট্রীয় নিরব যুদ্ধক্ষেত্র। কাসেমের ঘরে এখনো পড়ে আছে হালকা নীল টাইলসের ভাঙা টুকরো, যা তার স্মৃতিকে মিলে যায়। এক পাশে রয়েছে স্কোয়াটিং টয়লেট—ঘরটি তুলনামূলক বড় হলেও তার নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা ছিল না।
এই স্মৃতি ও শব্দই তদন্তকারীদের পৌঁছে দেয় ঢাকার এক সামরিক ঘাঁটির অভ্যন্তরে—বিমানবন্দরের কাছেই অবস্থিত এক নির্জন, সুরক্ষিত ভবন, যেখানে বন্দিদের রাখা হতো।
গ্রীষ্মের উত্তাপে কাসেম মেঝেতে কুঁকড়ে বসে দরজার ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতেন। “মনে হতো, মৃত্যু তার চেয়েও কম ভয়ংকর,” তিনি বলেন।
আজ, সেই ভয়াল জায়গায় ফিরে গিয়ে বিশ্বকে দেখাচ্ছেন, যেন বলতে চান—এই নির্মমতা আর গুম হয়ে থাকা চলবে না।
“আমাদের গল্প সামনে আনতে হবে,” মীর কাসেম পুত্র বলেন, “যাতে যারা ফিরতে পারেননি, তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়, এবং যারা বেঁচে গেছেন, তাদের জীবনে আলো ফিরে আসে।”