19/08/2025
কিছুক্ষেত্রে নিজের মা–বাবাই সন্তানের সবচেয়ে বড় শত্রু...
যেসব বাবা–মা নিজেদের শৈশবের আঘাত, মানসিক কষ্ট, ট্রমা বা অপূর্ণতা থেকে সেরে উঠতে পারেননি, তারা অনেক সময় অজান্তেই সেই ক্ষত সন্তানের ওপর ছড়িয়ে দেন। Unhealed Parent (ট্রমাটাইজড/মানসিকভাবে অমীমাংসিত বাবা–মা) নিজের ভেতরের ক্ষোভ, হতাশা, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা দিয়ে সন্তানের প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে চান।
তাদের বড় হয়ে ওঠা ছিল এমন এক বিশ্বাসে “বড়রা যা বলবে তাই সঠিক”। ফলে নিজের সাথে হওয়া অন্যায়েরও প্রতিবাদ করার সাহস তারা পাননি। আজ তাদের সন্তান যখন চাপিয়ে দেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখায়, তখনই সন্তানকে “বেয়াদব” মনে হয়। অনেকেই সারাজীবন পড়াশোনা করেছেন বাবা–মায়ের স্বপ্নপূরণের টার্গেট নিয়ে; তাই ব্যর্থতার মোড়ে এসে চান, সন্তান যেন তাদের ইচ্ছেমতো ক্যারিয়ার বেছে নেয় সন্তানের নিজের ইচ্ছা বা মতামতের জায়গা থাকে না।
ফল কী? এই মানসিক ক্ষত ঠিক না হলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একই ক্ষত সঞ্চারিত হয়।
অমীমাংসিত বাবা–মায়ের সাধারণ আচরণ (লক্ষণ)
অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ: পোশাক, পেশা, বন্ধুত্ব সবকিছুতে হস্তক্ষেপ।
গিল্ট-ট্রিপিং/ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল: “তুই আমাকে ভালোবাসিস না, তাই কথা শুনিস না।”
গ্যাসলাইটিং: সন্তানের বৈধ অনুভূতিকে “নাটক/অভিমান” বলে উড়িয়ে দেওয়া।
তুলনা ও অপমান: কাজিন/পড়শির সঙ্গে অবিরাম তুলনা।
সীমা-লঙ্ঘন (Boundaries): সন্তানের গোপনীয়তা ও ব্যক্তিসীমার প্রতি সম্মান না থাকা।
অ্যাপোলজি-অ্যাভার্সন: ভুল স্বীকার না করা, কখনো “সরি” না বলা।
কর্তৃত্বপরায়ণতা (Authoritarian): ভয় দেখিয়ে শাসন; নিয়ম আগে, সম্পর্ক পরে।
সন্তানের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
People-pleasing: সবার খুশি রাখতে গিয়ে নিজের প্রয়োজন ভুলে যাওয়া।
Perfectionism/ফেলিয়ার-ফোবিয়া: ভুল করলে ভালোবাসা হারাব এ ভয়।
Hyper-independence বা Freeze/Fawn প্রতিক্রিয়া: সাহায্য চাইতে না পারা বা চুপ মেরে যাওয়া।
Low self-worth: নিজেকে অযোগ্য ভাবা, সিদ্ধান্তহীনতা।
সীমানা স্থাপন করতে অস্বস্তি: ‘না’ বলতে অপরাধবোধ।
সুস্থতার পথে: বাবা–মায়ের করণীয়
1. স্ব-পরীক্ষা (Self-audit)
নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: “আমি কি সন্তানের ভয় পাইয়ে ‘হ্যাঁ’ শুনছি, নাকি বোঝাপড়া করে সম্মতি পাচ্ছি?”
2. অভিভাবকত্বের ধরন বদলান
কর্তৃত্বপরায়ণ (Authoritarian) থেকে দৃঢ়-স্নেহশীল (Authoritative)—নিয়ম থাকবে, কিন্তু সম্পর্ক আগে; শুনবেন, তারপর সিদ্ধান্ত।
3. মেরামত > পরিপূর্ণতা
ভুল হলে বলুন: “আমি তখন রেগে বলেছি, সেটা ঠিক হয়নি। আমি শুনতে চাই তুমি কেমন বোধ করছো।”
4. ব্যক্তিসীমা (Boundaries) মানুন
বয়স অনুযায়ী গোপনীয়তা, পছন্দ, ব্যক্তিমতকে জায়গা দিন।
5. হিলিং প্র্যাকটিস
জার্নালিং, নিয়ন্ত্রিত শ্বাস (breathing), ট্রিগার নোট করা, দাম্পত্য/পারিবারিক কাউন্সেলিং, প্যারেন্টিং-এডুকেশন।
6. ফ্যামিলি রিচুয়াল
সাপ্তাহিক ‘ফ্যামিলি মিটিং’: ১৫–২০ মিনিট—কেউ কাউকে না থামিয়ে “আমি-বাক্য” (I-statements) এ শোনা-বলার অভ্যাস।
সন্তানের করণীয় (যদি আপনি প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান হন)
সীমানা স্থাপন: “আমি ক্যারিয়ার বিষয়ে পরামর্শ শুনব, কিন্তু সিদ্ধান্ত আমি নেব।”
স্ক্রিপ্ট ব্যবহার (স্বল্প, শান্ত, পুনরাবৃত্তি): “এটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে সিদ্ধান্তটা আমি করছি।”
সহযোগী খুঁজুন: পরিবারের ভেতরে কোনো সেফ অ্যাডাল্ট/আত্মীয়/মেন্টর।
নিজের সাপোর্ট সিস্টেম: থেরাপি/কাউন্সেলিং, সমবয়সী সাপোর্ট গ্রুপ, আত্মসম্মান গড়ার কাজ।
রেড-লাইন চিনুন: মানসিক/শারীরিক নির্যাতন হলে নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিন এবং বিশ্বস্ত সাহায্য নিন।
ভুল ভাবনা ভাঙা
“King can do no wrong”—এ যুগে চলে না।
বড়ও ভুল করতে পারে; দায়িত্বশীল বড়রা ভুল বুঝলে সংশোধন করেন।
“ভালোবাসা মানেই নিয়ন্ত্রণ” নয়।
ভালোবাসা মানে নিরাপদ জায়গা দেওয়া, যেখানে সন্তান নিজের মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
এক লাইনের চেকলিস্ট (প্যারেন্টদের জন্য)
আমি কি সন্তানের কথা পুরোটা শুনেছি?
আমার সিদ্ধান্ত কি সন্তানের কল্যাণ নাকি আমার অপূর্ণতা পূরণে?
আজ কি আমি একটা ক্ষমা চেয়েছি/একটা ধন্যবাদ বলেছি?
আজ কি আমি সন্তানের একটা পছন্দ স্বাধীনভাবে হতে দিয়েছি?
শেষকথা
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে হলে, বাবা–মাকেই আগে সুস্থ হতে হবে। নিজের অতীত দিয়ে সন্তানের বর্তমানকে বাঁধবেন না। সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হোক সম্মান, শ্রবণ আর মেরামত তবেই ক্ষত আর ক্ষত নয়, হয়ে উঠবে শেখার পথ। ❤️🩹
©