27/08/2024
৬০ হাজার শিক্ষকের সনদ জাল!
নওগাঁর মান্দা উপজেলার বড় বেলালদহ ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক (বাংলা) মোছা. উম্মাতুন নেছা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় (এনটিআরসিএ) উত্তীর্ণ হননি। তবে তার 'সনদ' রয়েছে। তিনি সেই জাল সনদের বলে চাকরি করছেন এবং এমপিওভুক্তও হয়েছেন। গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) একটি টিম সরেজমিনে তদন্তে গিয়ে ওই শিক্ষকের জাল সনদ শনাক্ত করে। পরে এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষও ওই সনদ জাল বলে প্রত্যয়নপত্র দেয়। এতে ওই শিক্ষকের সরকারি বেতন (এমপিও) বন্ধ হয়ে যায়। তার পরও গত ২৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই শিক্ষককে জাল সনদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সহকারী সচিব নূরজাহান বেগম স্বাক্ষরিত এক পত্রে তাকে এ অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নূরজাহান বেগম সমকালকে প্রথমে বলেন, 'এটা হতেই পারে না।' পরে তার সই করা পত্র তাকে দেখানো হলে তিনি বলেন, 'হয়তো ওই শিক্ষক পরে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে থাকতে পারেন অথবা পরে পাস করেছেন জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে নতুন করে কোনো জাল সনদও জমা দিয়ে থাকতে পারেন।' তবে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। শিক্ষকদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নগদ টাকায় 'রফা করে' ভুয়া সনদধারীদের অনেকেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাখা-৫ (অডিট ও আইন) থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। নিয়ে যাচ্ছেন অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে অব্যাহতিপত্র।
জানা গেছে, সারাদেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক স্তরের চিহ্নিত প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক এখন জাল সনদে শিক্ষকতা করছেন। তারা সরকারের 'মান্থলি পে-অর্ডার' বা এমপিও পেয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন। কেবল চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ২৬৮ শিক্ষকের সনদ জাল বলে তদন্তকালে ধরা পড়েছে। ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ডিআইএ।
ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক মো. মফিজ উদ্দিন আহমদ ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ মে পর্যন্ত তদন্তকালে ২৬৮ শিক্ষকের সনদ জাল বলে তারা প্রমাণ পেয়েছেন। তাদের কাছ থেকে আট কোটি ৫৪ লাখ ৩৪ হাজার ৩১ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি জানান, এই ২৬৮ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮২ জন জাল সনদধারী শিক্ষক বেতন-ভাতা তুলেছেন দুই কোটি ২৯ লাখ ২১ হাজার ৬৯৭ টাকা। এভাবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১১ শিক্ষক ৪৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১০৯ শিক্ষক তিন কোটি ৩৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ৬৬ শিক্ষক দুই কোটি ৪০ লাখ ৪১ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ডিআইএর প্রতিবেদনে দেখা যায়, কেবল এক বছরে (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) সারাদেশে এক হাজার ৫১৮ শিক্ষকের সনদ জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই এক হাজার ৫১৮ শিক্ষক ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা বাবদ তুলেছেন ৭৩ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৭ টাকা। ডিআইএ এই টাকা ওই শিক্ষকদের কাছ থেকে আদায় করার জন্য সুপারিশ করেছে। অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ভূঁইয়া এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, এসব শিক্ষক তদন্তকালে চিহ্নিত হয়েছেন। জনবল সংকট ও সামর্থ্যের কারণে সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে সরেজমিনে তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, তার ধারণা তদন্তের বাইরে থাকা জাল সনদধারী শিক্ষকের প্রকৃত সংখ্যা অন্তত ৪০ গুণ বেশি হবে। সে হিসাবে সারাদেশে এ মুহূর্তে জাল সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি।
জাল সনদের এ ব্যবহার শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। ডিআইএর নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৮১ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৩৫ বছরে সারাদেশে ৫১ হাজার ৯৯২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষকের সনদ জাল বলে চিহ্নিত করেছে ডিআইএ।
এসব শিক্ষক এই সময়কালে সরকারি কোষাগার থেকে ৪৮২ কোটি ৭৮ লাখ ৫১ হাজার ৫৫৭ টাকা বেতন-ভাতা তুলেছেন। ডিআইএ বলছে, সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে অবৈধ উপায়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এসব শিক্ষক সরকারি বেতন তুলেছেন। তাদের কাছ থেকে সমুদয় টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত আনতে হবে।
সমকালের অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, শিক্ষকরা মূলত চার ধরনের জাল সনদ চাকরিতে বেশি ব্যবহার করছেন। এক. শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, দুই. নিবন্ধন সনদ, তিন. কম্পিউটার শিক্ষার ভুয়া সনদ এবং চার. অভিজ্ঞতার জাল সনদ।
ভুয়া সনদধারীদের ধরেও ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শাখা-১১-এর যুগ্ম সচিব অজিত কুমার ঘোষ। তবে একই শাখার সহকারী সচিব নূরজাহান বেগম বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আগের উইং প্রধান রফিকুজ্জামানের সময়ের সিদ্ধান্তের কারণে কম্পিউটার বিষয়ে জাল সনদধারীদের অনেককে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে একাডেমিক ও এনটিআরসিএ সনদ জালকারীদের ছাড় দেওয়া হয় না। তিনি এ কথা বললেও সমকালের হাতে একাধিক নথি আছে, যাতে ছাড় পাওয়া শিক্ষকদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সমকালকে বলেন, জাল সনদধারীদের তিনি শিক্ষক বলতে চান না। তারা প্রতারক। প্রমাণিত হলে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। মন্ত্রণালয়ের কেউ জাল সনদধারীদের অনৈতিক সুবিধা দিলে তিনি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেবেন বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
যেসব ভুয়া সনদধারী ছাড় পেয়েছেন: নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার হাজি আবদুল মালেক উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক মো. আবদুল লতিফ খান (কামিল সনদ), একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ইসমাইল হোসেন (বিজ্ঞান শিক্ষক), গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সনমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) মো. আশরাফুল ইসলাম, মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) এস এম আশরাফুল আলম, ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার শিয়ালদি আদর্শ আলিম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক (কৃষি) মো. হাসান মৃধা, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার গুলেস্তা হাফিজ মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক মাজহারুল ইসলাম এবং টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলার লোকমান ফকির মহিলা কলেজের প্রভাষক (সাচিবিক বিদ্যা) খন্দকার মাসউদুর রহমান।
ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের ছড়াছড়ি: হাজার হাজার জাল সনদধারীর মধ্যে মাত্র কয়েকজনের নাম সমকালের এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হচ্ছে। ডিআইএ এসব শিক্ষককে জাল সনদধারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের মধ্যে নিবন্ধন (এনটিআরসিএ) সনদ জাল করে চাকরি করছেন নাটোরের লালপুরের মনিহার রামকৃষ্ণপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ট্রেড ইন্সট্রাক্টর (ফিশ কালচার অ্যান্ড ব্রিডিং) মো. সাইদুর রহমান, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর পাঁচপীরের দরগাহ দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক (উদ্ভিদ) আবদুল কাইয়ুম, নাটোরের সিংড়া উপজেলার ভাগনাগরকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (বাংলা) সাবিনা ইয়াসমিন, একই উপজেলার আলহাজ আবদুর রহিম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (জীববিদ্যা) অনিতা প্রামাণিক, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার আসলেউদ্দিন প্রধান সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক (বিজ্ঞান) আলমাস আলী, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লোলপুকুর ডিএম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (হিন্দুধর্ম) জসোদা বালা দেবীসহ আরও অনেকে।
কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ের সনদ জাল করেছেন পাবনার সুধীর কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রদর্শক নাছিমা খাতুন, পাবনার শহীদ এম মনসুর আলী কলেজের প্রভাষক মাসুমা জাহান. সাইদুল ইসলাম ও ল্যাব সহকারী আবদুল জলিল, লালমনিরহাটের লামুড়ি দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক রমজান আলী, হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রৌশনারা খাতুনসহ অনেকে।
লাইব্রেরি ও বিপিএড সনদ জাল করেছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের করতোয়া কলেজের সহকারী গ্রন্থাগারিক হাসান তারেক, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের মনোহরপুর হাইস্কুলের সহকারী গ্রন্থাগারিক রেজওয়ানুল ইসলাম, নাটোরের লালপুরের চক নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক মলিনা খাতুন, একই উপজেলার মাজার শরীফ টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস কলেজের সহকারী গ্রন্থাগারিক আবুল কালামসহ অনেকে।