29/10/2025
জারাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের হাতির গোলাপী শাবকটি মারা গেছে-
শাবকটির মৃতদেহ হাতির মা ও তার পরিবার থেকে সরিয়ে না নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল বন বিভাগকে। কারণ হাতি শাবকের মৃতদেহ ঘিরে মা হাতি ও দলের অন্য সদস্যদের মাঝে অতি সংবেদনশীল একটি মনস্তত্ব কাজ করে। বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত জানায়, হাতি শাবকের শোকার্ত মা ও দলের অন্যরা শাবকটির মৃতদেহ রেখে নিজে থেকে চলে যাওয়া না পর্যন্ত মৃতদেহটি সরানো হবে না।
বাংলাদেশ বন বিভাগ কর্তৃক হাতি শাবকের মৃতদেহ মা এর কাছ থেকে জোর পূর্বক সরিয়ে নিয়ে ময়নাতদন্ত না করার এই সংবেদনশীল সিদ্ধান্তকে প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মীদের পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মাননীয় উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এর প্রতি।
শাবকটির মৃত্যুতে পুরো দল শোকাবহ। এই অবস্থায় শোক প্রকাশ করতে না দিয়ে মৃত শাবকটিকে সরিয়ে নেয়া হবে চরম অমানবিক ও অসংবেদনশীল আচরণ। বনের প্রাকৃতিক নিয়মে যেমন অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহ বনেই জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে, তেমনি হাতিও।
বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যায় হাতিরা তাদের কোন সদস্য মারা গেলে তার মৃতদেহকে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় শেষ বিদায় জানায়। আর সেটি যদি হয় শাবক, তাহলে মা হাতি সেই শাবকের মৃতদেহ বেশ কয়েকদিন আগলে রাখে। এর আগে গবেষকরা আফ্রিকার সাভান্না হাতির এই আচরণ বিষয়ে অবগত ছিলেন। সম্প্রতি এশিয়ান বন্যহাতিদের উপর গবেষণাতেও মৃত শাবক কবর দেয়ার চিত্র উঠে এসেছে।
ছবি সংগৃহিত।
ভারতীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা পারভিন কাসওয়ান এবং পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের গবেষক আকাশদীপ রায় এর গবেষণার লেখাটির অনুবাদ নিচে তুলে ধরা হল। যার মূল লিংক কমেন্টে থাকবে।
বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই জেনেছেন, আফ্রিকার সাভান্না অঞ্চলের হাতিরা তাদের মৃতদের জন্য শোক প্রকাশ করে। কিন্তু বন্য এশীয় হাতিদের মধ্যে এমন আবেগের প্রকাশ খুব কমই দেখা গেছে। এবার এক নতুন ও আকর্ষণীয় গবেষণায় দেখা গেছে—তারা তাদের মৃত শাবকদের কবর দেয়।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে ভারতের উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে পাঁচটি ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন হাতির পাল তাদের মৃত শাবকদের টেনে নিয়ে গেছে সেচ খালে এবং সেখানে মাটি চাপা দিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গবেষকরা দেখেছেন, শাবকদের পা মাটির উপরে বেরিয়ে আছে, আর তাদের মাথা, শুঁড় ও পিঠ ঢাকা মাটির নিচে।
প্রাণীজগতে কবর দেওয়ার আচরণ খুবই বিরল। আফ্রিকান ও এশীয় হাতি, এমনকি ম্যাগপাই পাখিও তাদের মৃতদের পাতা-ডাল দিয়ে ঢেকে দেয়—যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন “দুর্বল কবর” বা weak burial। কিন্তু এই ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা, বলেন গবেষণার সহলেখক ভারতীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা পারভিন কাসওয়ান এবং পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের গবেষক আকাশদীপ রায়।
তাদের দাবি, এটি এশীয় হাতিদের মধ্যে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ কবর দেওয়ার প্রমাণ।
“এ আচরণ কোনো অন্য প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়নি,” বলেন রায়। “এটা হাতিদের আলাদা করে তোলে। এটি তাদের প্রিয়জনদের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও যত্নের ইঙ্গিত দেয়।”
তবে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এই দাবি নিয়ে সতর্ক। কারণ কেউই নিজ চোখে কবর দেওয়ার ঘটনাটি দেখেনি। “গবেষণায় যথেষ্ট প্রমাণ দেওয়া হয়নি যে হাতিরাই সচেতনভাবে কবর দিয়েছে,” বলেন হাইডি রিডল, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘের (IUCN) এশীয় হাতি বিশেষজ্ঞ দলের সহসভাপতি।
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ রমন সুকুমার বলেন, “আমি এসব আচরণকে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা করতে চাই না।” তার মতে, মৃত শাবক বহন করা বা মৃতদেহের ওপর মাটি ছুঁড়ে দেওয়ার মতো আচরণ হাতিদের মধ্যে সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু সেটিকে কবর দেওয়া বলা ঠিক হবে না।
এখনও রহস্য
অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে—ধান চাষের মৌসুমে, যখন হাতির দল খাবারের খোঁজে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যায়। বনভূমি খণ্ডিত হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে চলতে হয়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, হাতিরা রাতের বেলা অপেক্ষা করে, তারপর মৃত শাবককে নিয়ে যায় এমন নির্জন জায়গায়, যেখানে মানুষ বা বন্য প্রাণীর হুমকি কম। তারা সেচ খাল বা নিচু জায়গা খুঁজে মৃতদেহ কবর দেয়। দুটি ঘটনায় এস্টেটের কর্মীরা রাতে হাতিদের ডাকার শব্দ শুনেছেন, আর পরদিন সকালে মৃতদেহ পেয়েছেন। বাকি তিনটি ক্ষেত্রে স্থানীয়রা হঠাৎ করেই কবর দেওয়া মৃতদেহ খুঁজে পান।
পশ্চিমবঙ্গ বন বিভাগ মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করে, যেখানে দেখা যায়, শাবকদের মৃত্যু ঘটেছে নানা কারণে—যেমন অপুষ্টি ও সংক্রমণ।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় ছিল শাবকদের পা উপরের দিকে থাকা। গবেষকদের মতে, হাতিরা শাবকদের পা ও শুঁড় ধরে বহন করেছিল, তাই সেই অবস্থাতেই তারা মৃতদেহ খালে রেখেছে। সাধারণত এসব খালের গভীরতা দেড় ফুটের মতো।
তবে রায়ের মতে, এতে বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। “যদি জায়গাগুলো একটু গভীর হতো, হাতিরা নিশ্চয়ই পাগুলোও ঢেকে দিত,” তিনি বলেন।
যত্নের ছাপ
কাসওয়ান ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেছেন—মৃতদেহের দুই পাশে ও উপরে বিভিন্ন আকারের হাতির পায়ের ছাপ। “এটা স্পষ্ট করে যে, কবর দেওয়ার কাজটা একসাথে, সমন্বিতভাবে করেছে তারা,” বলেন রায়।
“এসব হলো মাটি সমান করার ছাপ,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। “তারা জানে কোথায় কতটা চাপ দিতে হবে, আর সেটাই দেখায় তাদের সচেতন যত্নের আচরণ।”
লেখা: রাকিবুল এমিল
স্থপতি ও এনিম্যাল রাইট এক্টিভিস্ট।