Badhon Publications

Badhon Publications সৃজনশীলতা,সত্য,ও সুন্দরের অভিযাত্রায়

09/03/2025

নীলা- মীর আল তারিক

পর্ব- এক

ছেলেটার চলার মধ্যে কেমন যেনো একটা একরোখা ভাব!
বলা চলে... অনেকটা ডোন্ট-কেয়ার ভঙ্গিমায় ছেলেটা হেটে চলে যাচ্ছে র‌্যাবের চেকপোষ্টের সামনে দিয়ে।
সবে সন্ধ্যা নেমেছে তখন।
লাইট পোষ্টে সোডিয়াম বাতির হলদে আভায় শীতের সন্ধ্যার অলস আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। সড়ক জুড়ে জন-মানুষের ধ্রæপদি ব্যস্ততা আর গনপরিবহনগুলোর নড়বড়ে যন্ত্রপাতির একঘেয়ে যন্ত্র-সঙ্গীত। নিমগ্ন এই ছেলেটা এতো কিছুর মধ্যে থেকেও যেনো নেই। সব কিছু উপেক্ষা করে সে লম্বা, লম্বা পা ফেলে হেটে চলেছে দ্রæত-লয়ে। র‌্যাবের চেকপোষ্ট পার হবার সময় পথচারীদের মধ্যে এক ধরনের জড়োসড়ো ভাব চলে আসে। র‌্যাবকে ভয় পায় সবাই, এই ছেলেটা পাচ্ছে না। কারণ কী?
মেজর শাহিন মোর্শেদের ভ্রæ কুঞ্চিত হয়!
ছেলেটা আনসারউল্লা বাংলা টীমের কেউ নয় তো? না কি অন্য কোনো কিছু? ... সে যে-ই হোক, মেজরের অহংকারে লাগে। সে আজ এই চেকপোষ্টের দায়িত্বে আছে। তাই অহংকারে তো একটু লাগবেই। র‌্যাব বলে কথা!

‘থার্টি-ফার্ষ্ট’ রাতে প্রতি বছরই গুলশান-বনানী এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটে। ‘নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন’ নামক এই উচ্ছৃঙ্খলতা সামাল দিতে প্রশাসনকে মাঝে মধ্যে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অভিজাত এই এলাকায় প্রবেশ রাস্তা গুলোর মোড়ে মোড়ে তাই বাধ্য হয়ে প্রশাসনকে চেকপোষ্ট বসাতে হয়।

আজও বসাতে হয়েছে।

গুলশানের পশ্চিম প্রান্তের চেক পোষ্টের দায়িত্বে রয়েছে র‌্যাব অফিসার মেজর শাহীন মোর্শেদ। সব ধরণের অটো-ভেইকেল নজরদারি করা তার দায়িত্ব, কিন্তু পথচারীদের নয়। সে নাইবা হলো... তাই বলে চব্বিশ পঁচিশ বছরের এমন একটা অর্বাচীন ছোকড়া উদ্ধত ভঙ্গিতে তার সামনে দিয়ে চলে যাবে? তাই কি হয়? একে হালকা মেরামত করা দরকার। মেজর বাজখাই গলায় চেচিয়ে উঠলো, ‘হল্ট।’

চেচিয়ে উঠে, সে নিজেই আবার থমকে গেলো।

আশ্চর্য! সে ‘হল্ট’ বলে ছেলেটাকে থামতে বলছে কেনো? বাংলায় কি ধমক দিয়ে থামতে বলার যুতসই কোনো শব্দ নেই? চিন্তায় প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে মেজরের। পাকিস্তানী আর্মিরাও না-কি এই ভাবে ‘হল্ট’ বলে যেখানে সেখানে পথচারীদের গতি রোধ করতো।
মেজর শাহিনের ‘হল্টে’ কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ছোকড়া আগের মতোই দিব্যি হেটে চলে যাচ্ছে। মিলিটারি মেজাজ খিচড়ে গেল শাহিনের। দু’ আঙ্গুলের ফাঁকে ধরে রাখা জলন্ত সিগারেট-টা ছুড়ে ফেলে এবার সে মাতৃভাষায় হাবিলদারকে নির্দেশ দিলো, ‘ধর শুয়োরের বাচ্চাটাকে!’
হাবিলদারের বয়স হয়েছে। সে আর আগের মত দৌড়াতে পারে না। তবু স্যারের নির্দেশ...! যতোটা সম্ভব দ্রæত গিয়ে সে ছেলেটার পেছন থেকে জামার কলার ধরে দিলো এক হ্যাচকা টান। আচমকা এই টানে ছেলেটাও যেনো একটা চাল-কুমড়োর মতো উল্টে পড়ে গেলো রাস্তায় জমে থাকা সুয়েরেজের কাদা-পানির গর্তের মধ্যে। হাবিলদার সেখান থেকেও ওকে টেনে তুললো। মেজর শাহিন তার ঘাড় চেপে ধরে বললো, ‘কী খবর চান্দু, খুব স্মার্ট তাই না? কোথায় চলেছেন?’
ছেলেটার চোখে মুখে আতঙ্ক! কন্ঠ থেকে ‘গো’ ‘গো’ ধরণের একটা আওয়াজ বেরোচ্ছে। শাহিন তাচ্ছিল্যের সাথে বললো, ‘একটু আগে দেখি কতো দেমাগ! এখন তো কোনো কথাই বেরোচ্ছে না। এই, এটার বডি সার্স করো।’

ছেলেটার এখনকার হাব ভাব, আর স্যারের নির্দেশ শুনে হাবিলদার হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠলো। শাহিনকে বললো, ‘স্যার, আমার মনে হচ্ছে অন্য সমস্যা। ছেলেটা বোবা!’
মেজর অবাক হয়ে বললো, ‘বোবা...! তাই নাকি?’ তারপর ‘অবাক’ ভাবটা দ্রæত গিলে ফেলে কপোট মেজাজের সাথে বলে উঠলো, ‘আচ্ছা, না হয় বোবাই হলো, তাই বলে আমার কম্যান্ড মানবে না? বোবারা কি আইন আদালতের উর্দ্ধে না-কি? ...ক্রিমিনাল প্রসিডিংস্, ধারা ফিফটি ফোর। সন্দেহ জনক গতিবিধির দায়ে ওকে ধরে নিয়ে আসো চেক পোষ্টে।’

স্যারের এই নির্দেশটা শুনেও হাবিলদার শংকিত হলো। ভাবে, স্যারকে বার বার জ্ঞান দিতে যাওয়া কি ঠিক হবে? রাগী মানুষ...! কিন্তু, চুপকরে থাকলে তো সমস্যা আরো জট পাকাবে। সাহসে ভর করে অবশেষে সে বললো, ‘স্যার, এই ধরণের বোবারা তো কানেও শোনে না। ...ঠিক কী ভাবে বুঝাবো স্যার...এরা কানে শুনতে পায় না বলেই বোবা।’

‘ও আচ্ছা... তাই না কি? কানেও শোনে না, কথাও বলতে পারে না!’ মেজর চিন্তিত গলায় বললো, ‘ তা হলে তো তখন আমার কম্যান্ড-ও শোনে নি!’
‘জি, না স্যার।’

‘আপনি তো ভালোই নলেজ রাখেন দেখছি! একটা ঝামেলা হয়ে গেলো, কি বলেন?’

র‌্যাব জওয়ানদের একজন ছেলেটিকে তাদের ছাউনিতে এনে বসালো। ময়লা, কাঁদা-পানিতে একাকার ওর শরীর। হাতে পায়ে বিভিন্ন জায়গায় ছিলে গেছে। শরীরের কাঁদা-পানি পরিস্কার করে বোবা ছেলেটাকে ফাস্ট এইড দেয়া হলো। মেজর শাহিন আক্ষেপ করে বললো, ‘ইশ! কেমন রাগ হয়! এখন এই আপদটাকে নিয়ে কী করি? বাপ-মা কেমন! এমন ছেলেকে কেউ বাইরে পাঠায়?’
মেজরের এখন এই সব ঝামেলা মিটিয়ে রাস্তার দিকে নজর দেয়া দরকার।

অসংখ্য গাড়ির আড়ালে হঠাৎ দু একটা উন্মত্ব গাড়ি ধেয়ে আসছে, রাস্তা কাপিয়ে হ্যাভি মেটাল র‌্যাপ সং বাজাতে বাজাতে। গাড়িতে ঠাসাঠাসি উৎসব মুখর তরুণ তরুণীর দল। র‌্যাবের চেকপোষ্ট দেখে ওরা চট্ জলদি লাউড স্পিকার থামিয়ে দিব্যি গোবেচার বনে যাচ্ছে। রাত যতো গভীর হবে, এদের তৎপরতাও ততো বাড়তে থাকবে। গাড়িগুলো চেককরা খুবই জরুরি!
বোবা ছেলেটার সমস্যা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলতে মেজর শাহিন ছেলেটাকে একটা সিএনজিতে তুলে দিতে নির্দেশ দিলো। ছেলেটার ‘আই কিউ’ ভালই বলতে হয়। শাহিন কী বলছে, তার ঠোট নাড়ানো দেখেই বুঝে ফেললো। ইশারায় বললো, সে নিজেই যেতে পারবে। ওর কথায় কেউ পাত্তা দিলো না। কোথায় যাবে, ওর কাছ থেকে লিখিয়ে জেনে নিয়ে, একটা সিএনজি দাড় করানো হলো। ওকে এক প্রকার জোর করেই তুলে দেয়া হলো সিএনজি-টাতে। ভাড়ার টাকা মেজর শাহিন অগ্রিম মিটিয়ে দিলো। হয়ত অপরাধ বোধ...!
সিএনজি ষ্টার্ট নেওয়ার আগ-মুহূর্তে ঘটল মহা বিপত্তি। ছেলেটা হঠাৎ এক লাফে সিএনজি থেকে নেমে, মুহুর্তের মধ্যে মেজর শাহিন মোর্শেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হতভম্ভ¢ শাহিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারমুখি ছেলেটা তাকে ঠেসে ধরলো সিএনজির উইন্ড শিল্ডের সাথে। মেজরের কালো ইউনিফর্মের বুক পকেটের উপর সাদা নেমপ্লেটে লেখা ‘মেজর শাহিন মোর্শেদ’, ছেলেটি পড়লো সেটা। তার পর ডান হাতের ঘুষি তুললো মেজরের নাক বরাবর। ... এই বুঝি ঝেড়ে দেয়! কিন্তু তার আগেই অন্য র‌্যাব জওয়ানরা তড়িৎ এসে ওকে জাপটে ধরলো। ছেলেটাকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার সিএনজি তে তুলে দিলো।
পল্লবির নিজ ফ্লাটে তখন উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন সুফিয়া বেগম। অনেক রাত হয়েছে, তার বড় ছেলে তন্ময় এখনও বাড়ি ফেরেনি। কোন বিপদ হলো নাতো? থেকে থেকে সুফিয়া বেগম তার ছোট ছেলেটিকে তাগিদের স্বরে বলছেন, ‘ও তমাল, বাবা, মোড় পর্যন্ত গিয়ে একটু দেখে আয়, ভাই বাড়ি ফিরছে না কেন! একটা এস. এম. এস করতে বলেছিলাম, করেছিস? ...ওর অফিসে ফোন কর!’
তমালের কোলের উপর তার ল্যাপটপ। সে চোখ তুলছে না, কোনো সাড়াও দিচ্ছে না। মায়ের তাগিদ তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দুই ছেলে, এক মেয়ে- তন্ময়, তমাল আর তন্দ্রাকে নিয়ে সুফিয়া বেগমের এই সংসার। স্বামী বিগত হয়েছেন অনেক আগে। একমাত্র মেয়ে, তন্দ্রা ঢাকা মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। তমাল নর্থ-সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ে আই টি এ্যন্ড কমউিটর ইজ্ঞিনিয়ারিং-এ মাষ্টার্স করছে। সুফিয়া বেগমের বড়ো ছেলে তন্ময় বাক প্রতিবন্ধি, একটা প্রাইভেট কনসাল্টিং ফার্মের সহকারি স্থপতি। ঢাকা পলিটেকনিক কলেজ থেকে তন্ময় আর্কিটেক্চারে ডিপ্লোমা করে এই চাকরিটা নিয়েছে। তন্ময় যে ফার্মে চাকরি করে, তন্ময়ের আব্বা সেই ফার্মের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সাহেবের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন।

একই রনাঙ্গনে তারা নৌ-কমান্ডো হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।

ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সাহেব তন্ময়কে তার ফার্মের এই চাকরিটা দিয়েছিলেন। তবে তন্ময়ের কাজের দক্ষতায় এখন তিনি মুগ্ধ। ছোট বড় যে কোনো প্রকল্পের প্রিলিমিনারি ডিজাইন থেকে, ডিটেইল ওয়ার্কিং ডিজাইন, সে একাই তুলতে পারে। বড় সাহেবের নজর কাড়ার এটাই মুল কারণ। স্থপতি হিসাবে তন্ময়ের আবাসন প্রকল্পের দিকে ঝোক তুলনামুলক বেশি। ছেলেটার ছবি আঁকবার হাতও বিস্ময়কর! জয়েনিং-এর প্রথম দিনেই বড় সাহেবের একটা পোর্ট্রটে এঁকে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো।
তন্ময় রুটিন মেনে চলা ছেলে। কাজ শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা বাজতে সে বাসায় ফেরে। আজ তার ফিরতে এতো দেরী হচ্ছে কেন?
সুফিয়া বেগম তমালকে আবার তাগাদা দিলেন। তমাল এবার বিরক্ত হয়ে ল্যাপটপটা পাশে সরিয়ে রেখে বললো, ‘মা, আর কতোবার বলবো ভাইয়ার কিচ্ছু হয়নি! এই দেখ, এই মাত্র ভাইয়ার একটা এস.এম.এস পেলাম।’ তমাল ওর মোবাইল ফোনের স্ক্রীনটা মায়ের সামনে তুলে ধরে। তমালের অনেক গুলো এস.এম.এস-এর উত্তরে তন্ময় সংক্ষেপে লিখেছে, ‘ঔঁংঃ পড়সরহম!’
‘ভাইয়া একজন ‘অতি-সাবধানি’ মানুষ।’ তমাল বিরক্ত কণ্ঠে বলতে থাকে ‘অতি সাবধানিরা নিজেরা নিরাপদে থেকে অন্যদের বিপদে ফেলে। যেমন এখন আমাকে ফেলেছে। তুমি ঘুমাও গিয়ে, যাও। খামোখা প্রেসার বাড়িও না।’

তন্দ্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে, ‘অবুঝ মাতা...!’
সুফিয়া বেগম তাকিয়ে দেখেন, কথাটা বলে তন্দ্রা অন্য দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। রোশের সাথে উঠে দাড়ালেন সুফিয়া বেগম। চলে যেতে যেতে ছেলে-মেয়েদের উপর ভেংচে উঠে বলেন, ‘আমি অবুঝ মাতা...! তাই না? আর তোরা এই বয়সে অনেক কিছু বুঝে ফেলেছিস!
আধা ঘন্টা না যেতেই হঠাৎ ওই ফ্লাটের কলিংবেলটা বেজে উঠলো।
নিশ্চয়ই ভাইয়া এসেছে! তন্দ্রা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। হ্যা, তন্ময়ই এসেছে, কিন্তু এ কী অবস্থা তার প্রতিবন্ধি ভাই এর...! এই অবস্থা ওর কী করে হলো? তন্দ্রা তারস¦রে চেচিয়ে ওঠে, ‘মা, তাড়া তাড়ি এসো...ভাইয়ার যেন কী হয়েছে!’

মা দৌড়ে আসেন। ‘কী! কী হয়েছে আমার তন্ময়ের?’

তমালও ছুটে আসে। ওরা সবাই মিলে ধরাধরি করে তন্ময়কে নিয়ে সোফায় বসালো। উদ্বিগ্ন সুফিয়া বেগম কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি তমালকে ভর্ৎসনা করতে থাকেন, ‘প্রেসার বাড়িও না... অবুঝ মাতা... এখন কেমন লাগে? কতোবার তোকে বললাম, একটু এগিয়ে গিয়ে দেখ! মনে রাখিস, মায়ের মন... !’ কান্নার দমকে সুফিয়া বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না।

তন্দ্রা তাড়াতাড়ি ভাইয়ের জন্যে পরিষ্কার জামা কাপড় নিয়ে আসে। ভাইয়ের জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলে, ‘কেউ একজন ভাইয়াকে ফার্স্ট এইড দিয়েছে। যে দিয়েছে, সে প্রফেশনাল। ভাইয়ার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা।’

তন্ময়ের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে কিছুই বলছে না। বোবা মানুষটা যেন দুঃখে কষ্টে আরো বোবা হয়ে গেছে।

তমাল অপরাধীর মতো মুখ ভোঁতা করে বসে ছিলো। এবার সে তন্ময়কে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাইয়া, তোমার এ অবস্থা কি করে হলো? কে তোমাকে ফার্স্ট এইড দিয়েছে?’

তন্ময় এবার মুখ খোলে। বোবা শব্দ করতে করতে সে গুলশান চেক পোষ্টে কি কি ঘটেছে, সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে সব ওদের বলতে শুরু করে। বলতে বলতে সে বার বার হাফিয়ে উঠে ক্ষোভে, অভিমানে কাঁদতে থাকে। সবটুকু বলা হলে সে হীপ-পকেট থেকে তার নোটবুকটা বের করে ‘মেজর শাহিন মোর্শেদ’ নামটা লিখে রাগের সাথে নোট বুকটা ছুড়ে ফেলে দেয়।

যা বুঝার সুফিয়া বেগম বুঝে ফেলেছেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি রুশে ওঠেন। যেনো নিজেই নিজেকে বলছেন, এমন ভাবে বলেন, ‘ওরা কী মনে করেছে? আমার কেউ নেই, তাই ভেবেছে?’

অসহায় ছেলের মাথায় সান্ত¡নার হাত বুলিয়ে সুফিয়া বেগম গিয়ে হুড় মুড়িয়ে পড়েন টেলিফোনের উপর। ফোন নম্বর তার মুখস্ত। দ্রæত ডিজিট গুলো প্রেস করে সুফিয়া বেগম কানে রিসিভার রেখে অপেক্ষায় থাকেন।
মোকলেসুর রহমান সাহেবের কলার আইডি ল্যান্ড-ফোনটা বেজে ওঠে অপর প্রান্তে। তার ভরাট কন্ঠের আওয়াজও পাওয়া যায় সাথে সাথে। বড়ো ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে সুুফিয়া বেগম ফের ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
ভাইকে সব অভিযোগ খুলে বলেন।
হুঙ্কার ছাড়েন ডি.আই.জি (অব) মোকলেসুর রহমান, ‘কোন চেকপোষ্ট বললি?’
সুফিয়া বেগম বলেন, ‘গুলশান, দুই নম্বর।’
‘নাম কী বললি হারামজাদার?’
‘তোমার ভাগ্নে তো কাগজে লিখে দিয়েছে, মেজর শাহিন মোর্শেদ। ...দাদা, তুমি কিন্তু একটা কিছু করবাই, করবা। তুমি কিন্তু মানুষকে মিথ্যে সান্ত¡না দাও...’
‘আরে, তুই আগে ফোনটা রাখতো! আমাকে ব্যবস্থা নিতে দে!’

সুফিয়া বেগম ফোন রেখে আবার ছেলের কাছে ফিরে আসেন। তন্ময় ততোক্ষণে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। সুফিয়া বেগম ছেলের পাশে বসে তার কপালের উপর আস্তে করে একটা হাত রাখেন। ছেলে চোখ বুজে শুয়ে আছে, জেদী ছেলে ঘুমায়নি। হয়ত সারা রাত ঘুমাবেও না। তেমনই মুখ ভোঁতা করে তন্দ্রা আর তমাল বসে আছে একটু দূরে, সোফায়। সুফিয়া বেগম ওদের ঘুমাতে যেতে বললেন। অনিচ্ছা সত্তে¡ও ওরা উঠে গেল।

সুফিয়া বেগম এখন পড়েছেন অন্য চিন্তায়।

আগামিকাল সন্ধ্যায় তন্ময়ের জন্যে কনে দেখতে যাওয়ার কথা। প্রোগ্রামটা আগে থেকেই ঠিক ছিলো। কিন্তু ছেলের যা হাল হয়েছে! এই অবস্থায় ওকে নিয়ে যাওয়াটা কি উচিৎ হবে? ওরা অন্য কিছু ভাববে না তো?

যে মেয়েটাকে দেখতে যাবার কথা, সে তন্ময়ের ফেসবুক ফ্রেন্ড। ফেসবুকে ওদের অনেক দিনের জানা শোনা। কিন্তু ওরা না-কি এখন পর্যন্ত কেউ কাউকে সামনা সামনি দেখেনি। ইচ্ছে করেই...এটা নাকি এক ধরণের মর্ডান থ্রীল!

সুফিয়া বেগম এত সবের কিছুই জানতেন না। তিনি তো তন্ময়ের জন্য কনে খুঁজেই হয়রান হচ্ছিলেন।

মাত্র দিন তিনেক আগের কথা-
অফিসে যাবার আগক্ষণে তন্ময় হঠাৎ ওর ল্যাপটপটা মায়ের সামনে মেলে রেখে, একটু লাজুক হেসে বেরিয়ে গেলো। ল্যাপটপের স্ক্রীনে অপরূপা একটা মেয়ের ছবি! তন্ময়ের ঠোঁটের লাজুক হাসি... মাকে বুঝিয়ে বলতে হলো না কিছুই। তন্ময় হয়তো বুঝতে পেরেছিলো, তার জন্যে কনে খুঁজতে খুঁজতে মা হয়রান হচ্ছেন। মাকে আশ^স্থ করার জন্যেই কি তন্ময়ের আধুনিক প্রযুক্তির এই ব্যবস্থা?

ঐ দিন অফিস থেকে তন্ময় বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত সুফিয়া বেগমের কাটে অস্থিরতায়। তন্ময়ের কাছ থেকে বাকি ঘটনাটুকুও জানতে হবে... তন্ময় কি আদৌ মেয়েটাকে প্রোপোজ করেছে? পরীর মতো এমন সুন্দরি একটা মেয়ে তন্ময়ের বৌ হয়ে আসবে! সুফিয়া বেগমের যেন আর দেরী সয় না। মেয়েটা হাত ছাড়া না হয়ে যায়...!

সুফিয়া বেগমের ভাবনায় ছেদ পড়ে, ল্যান্ড-ফোনটা বেজে উঠলো।

এই ফোনের অপেক্ষায়-ই তিনি ছিলেন। বড় ভাইয়ের গলা বুঝতে পেরে সুফিয়া বেগম উদগ্রীব ভাবে জানতে চাইলেন, ‘দাদা, কিছু করতে পারলে?’

মোকলেসুর রহমান বলেন, ‘শোন, ওর ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ওকে খাগড়াছড়ি বদলী করিয়েছি। আগামি পাঁচ বছরেও আর বউ, ছেলে-মেয়েদের মুখ দেখতে হবে না। আর ওর প্রমোশনও আটকে যাবে।’

‘দাদা, সত্যিই কি এটা তুমি করেছো? আমি কি এই কথাগুলো তোমার ভাগ্নেকে বলবো?’

‘শোন্, কথা না বাড়িয়ে ইনফরমেশনগুলো ওকে দে। রাতটা অন্তত শান্তিতে ঘুমাক।’

‘শান্তির কথা বলছো দাদা?’ সুফিয়া বেগম বলতে থাকেন, ‘তন্ময়ের হাত পায়ের কয়েক জায়গায় ছিলে গেছে। কপালটাও ফুলে উঠেছে সুপারির মতো। এই অবস্থা দেখে কাল কন্যা পক্ষ যদি উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে বসে? তখন কি হবে?’

‘এটা কোনো সমস্যা না।’ মোকলেসুর রহমান ছোট বোনকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘রাস্তা ঘাটে চলতে গেলে আজ কাল এমন একটু আধটু হয়েই থাকে। আমি যত দূর খোঁজ নিয়েছি, পাত্রীপক্ষ শিক্ষিত পরিবার। ওরা কিছু জিজ্ঞেস করলে তুই সত্য কথা বলবি। সত্য কথার একটা আলাদা শক্তি আছে। ওরা ঠিকই বুঝবে। তবে একটা কথা...?’
‘কী কথা?’
‘শেষ পর্যন্ত একটা ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে মেয়ে আনবি?’
‘কী করব? আমার ছেলেটাও তো প্রতিবন্ধি। অনেকের কাছেই তো বললাম, তুমি জানো। কই, কেউ কি দিলো আমাকে একটা মেয়ের সন্ধান? যাও-বা প্রস্তাব আসে, সব ওই মায়ে খেদানো, বাপের তাড়ানো!’
‘ওই সব বাদ দে...। আগে কথা শোন, পাত্রীর মা-বাবার মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে প্রায় বছর সতের আগে। কারণ বলে, ব্যক্তিত্বের দ্ব›দ্ব...! মেয়ে থাকে বাপের সাথে...এই সব ক্ষেত্রে অবশ্য মেয়েদের বাপের সাথে থাকাই সম্মানজনক। পাত্রীর মা আবার বিয়ে করেছেন। কিন্তু বাপটা এখনও ব্যাচেলর।’
‘তুমি ব্যাচেলর বলছো কেনো?’
‘ওই হলো আর কি! উনি উচ্চ-পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, মেয়ের ভালাই চিন্তা করে কোনো দিন আর বিয়ে’ থা করেন নি, হাঃ হাঃ হাঃ... ভন্ড! দেখ গিয়ে গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে কতো গন্ডা...!’
মোকলেসুর রহমান বলতে থাকেন, ‘সমাজ বিজ্ঞানীরা কি বলে জানিস? বলে, পরিবার একটা সামাজিক সংগঠন যেখানে সন্তানরা গুরুজনদের কাছ থেকে মূল্যবোধ শিক্ষা নেয়...। একটু ভেবে দেখ, সেই পরিবারই যদি হয় ভাঙ্গা...! আমার কথা তুই এখন বুঝবি না। ওই মেয়ে এসে যেদিন তোর মুখের উপর বেয়াদপের মতো চ্যাটাং চ্যাটাং করে বুলি আওড়াবে, তখন বুঝবি। তোর উচিৎ, গৃহস্থ পরিবার থেকে সংসারি একটা মেয়ে আনা।’
‘দাদা, মেয়েটা কিন্তু শিক্ষিতা। শিক্ষাও মানুষকে মূল্যবোধ শিখায়। একটা অশিক্ষিতা মেয়ে আমার ছেলেটাকে মূল্যায়ন করতে পারবে না। আমি চাই মেয়েটা শুধু শিক্ষিতা হোক। চাকরি বাকরি তো করার দরকার নাই, সংসারেই থাকবে।’
‘তোর ছেলে ষ্টিফেন হকিন্স নয়, যে মূল্যায়ন করতে হবে। আর কোনো শিক্ষিতা মেয়ে ঘরে বসে থাকার জন্যে তোর বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। তুই তো শুরু না হতেই ঝামেলা পাকাচ্ছিস!’
‘দাদা, তুমি সব সময় আমার ছেলেটাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলো, এটা উচিৎ না।’
‘তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলাম, এটা বুঝাবার জন্যে যে, শিক্ষিত মানুষরাও তোর ছেলেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারে। তুই কি মনে করিস, আমি অশিক্ষিত? হাঃ হাঃ হাঃ।’ মোকলেসুর রহমান আবার উচ্চস¦রে হেসে উঠলেন।
‘দাদা, তুমিও চলো না কাল আমাদের সাথে!’
‘না, না, পাগল হয়েছিস? দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের মাথা ঘুরাবার ফুসরত নেই। তোরা যাচ্ছিস যা! যদি পছন্দ হয়, পাকা কথা-বার্তা বলার সময় আমি থাকব। এখন রাখি!’
ডি আই জি (অব) মোকলেসুর রহমান সাহেব হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিলেন।

রাত এখন অনেক হয়েছে। সুফিয়া বেগম পায়ে পায়ে তন্ময়ের ঘরে গিয়ে ঢোকেন। তন্ময়ের কপালে হাত রেখে বুঝতে পারেন, একরোখা ছেলে এখনও জেগে আছে। কিন্তু চোখ মেলছে না। সুফিয়া বেগম তার চোখ মেলান। ছেলেকে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে বলেন, ‘মেজর শাহিনের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুমি বিশ্রাম নাও।’
তন্ময় ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা তাকে বলেন, ‘তোমার মামা ওই মেজরকে খাগড়াছড়ি বদলী করে দিয়েছেন। আগামি পাঁচ বছরে ওর বউ ছেলে-মেয়ের মুখ দেখতে পাবেনা। ওর প্রমোশনও আটকে যাবে।’
তন্ময়ের চেহারার মধ্যে আস্তে আস্তে প্রশান্তি চলে আসছে।
মা তাকে এবার ঘুমাতে বলেন। তন্ময় চোখ বোজে। এবার সে ঘুমাবে...। শিশুর মত সরল ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সুফিয়া বেগম একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ছাড়েন।

একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার এতো কিছু করার ক্ষমতা কি আছে? এক গাদা মিথ্যে কথা দিয়ে ভাগ্নেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্যে মনে মনে দাদাকে তিনি ধন্যবাদ দেন। ...আর এমনও তো হতে পারে, সত্যি সত্যিই তার দাদা বদলির এই কঠিন কাজটা করিয়েছেন!

ইলমা ইকরা আজ লাইব্রেরিতে
03/11/2024

ইলমা ইকরা আজ লাইব্রেরিতে

31/10/2024

লোভী, বোকা এবং মিথ্যুক মানুষের সঙ্গ নিতে নেই। তাতে উপকারের চেয়ে বিপদেই বেশি পড়তে হয়।

22/10/2024
06/10/2024

সেরা উপন্যাস আহমদ ছফা
মূল্য ৮০০ টাকা অফার মূল্য ৬০০ টাকা

With Md Mahabub Rahman Roni – I just got recognised as one of their rising fans! 🎉
04/10/2024

With Md Mahabub Rahman Roni – I just got recognised as one of their rising fans! 🎉

09/09/2024

Address

12/13 Pyari Das Road. Banglabazar
Dhaka

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Badhon Publications posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Badhon Publications:

Share

Category