LiveBarta24.com

LiveBarta24.com Online News Portal in Bangladesh.

Artical 24-07-2025বিমান দুঘর্টনা : মাইলস্টোনে শিশুদের কফিন : কিছু ক্ষোভ আর জিজ্ঞাসা।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।০১. ‘পিতা...
24/07/2025

Artical 24-07-2025

বিমান দুঘর্টনা : মাইলস্টোনে শিশুদের কফিন : কিছু ক্ষোভ আর জিজ্ঞাসা

।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
০১. ‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ’ পৃথিবীতে সবচাইতে ভারী বস্তু। আর সেটা যদি হয় ছোট ছোট কোমলমতিদের লাশ তাহলে তা বহন করা আরও দুঃসাধ্য’। ছুটির পর যে স্কুল ক্যাম্পাস থাকতো কোলাহলে মুখর তা ভেসে গেল আর্তনাদে। স্কুল ছুটির পর জীবন থেকেও ছুটি নিলো কোমলমতিরা। মুহূর্তেই তারা হয়ে গেলো আকাশের তাঁরা। বিষাদে ছেয়ে গেল আকাশ-বাতাস। এতো শোক সহ্য করা বড়ই কঠিন।

দেশে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে, একের পর এক তাজা প্রাণ চলে যাচ্ছে। কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেলিভিশনের পর্দা থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে সরগরম থাকে এসব ইস্যুতে। প্রশাসন থেকে নেওয়া হয় নানান পদক্ষেপ, আবার সব চুপচাপ হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠে জনগনের মনে মৃত্যুর মিছিল কোথায় থামলে টনক নড়বে রাষ্ট্রের ?’ দুর্ঘটনার ওপর মানুষের হাত নেই। তাই বলে এমন দুর্ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না, যাতে বিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যাওয়া শিশুরা ফিরে এল লাশ হয়ে। একটি দুর্ঘটনায় এত বেশি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা বিরল। এ ঘটনায় কেবল স্বজনহারা পরিবার নয়, পুরো বাংলাদেশ শোকাহত।’

রাষ্ট্রসহ আমাদের সকলকে আরো বেশী সচেতন হতে হবে। যাতে করে আর কোনো শিশু-কিশোর যেন অকালে ঝরে না যায় সে জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রকে। মৃতের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। যারা স্বজন হারিয়েছেন কোনও প্রতিদানই তাদের শোক ভোলাবে না। তবুও সরকারকে শিশু হারানো পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং ঝলসে যাওয়ারা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন রাষ্ট্রকে তাদের পাশে থাকতে হবে। উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্থেরর ঘটনাটি কিভাবে ঘটল, সরকারকে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এটি কি নিছক কোন দুঃঘর্টনা নাকি ষড়যন্ত্র। প্রয়োজনে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

০২. মাইলস্টোন কলেজে বিমান দুর্ঘটনাকে কোনোভাবে শুধু ত্রুটির কারণে ঘটেছে বলে শিশু-কিশোরদের হত্যার সরকার দায় এড়াতে পারবে না। প্রশিক্ষন বিমানের এই দুর্ঘটনাকে স্মরণকালের ইতিহাসের অন্যতম দুঃখজনক ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এই দুঘর্টনা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে ‘বসতিপূর্ণ এলাকায় এমন বিমান চলাচল বা প্রশিক্ষণের যৌক্তিকতা কী থাকতে পারে ? এই দুঘর্টনায় যে ক্ষতি হয়েছে সেগুলো কি আদৌ পূরণযোগ্য?’ শাহাদাত বরণকারী ও আহত শিশু-কিশোরদের বাবা-মা ও পরিবারের পাশাপাশি আমরা সবাই শোকাহত, এই শোকে সান্ত্বানার কোনও ভাষা নাই। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। এই মুহুর্তে মৃত্যু ২৭ ছাড়িয়েছে। যারা বেঁচে থাকবে তারাও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে বলে চিকিৎসকরা আশা করতে পারছেন না। এই শিশুরা মরে গেলো, ওদের মা-বাবার চোখের জল কী দিয়ে পূরণ করবে এই রাষ্ট্র ? যে মায়ের বুক খালি হয়েছে সে মা আজীবন এই কষ্ট বয়ে বেরাবে।

সরকারকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ করে নিহত প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, আহতদের যথাযথ চিকিৎসার সব ধরনের সহায়তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে এবং বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো বিমানগুলো বাতিল করে আধুনিক বিমান চালু করতে হবে।’

এই ঘটনার দায় শুধু পাইলট বা প্রশিক্ষক প্রতিষ্ঠানের নয়। এটি রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থার। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন—কেউই দায় এড়াতে পারে না। কেন স্কুলের ছাদে বিমান পড়লো? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোথায় ছিল? আগুন লাগার পর উদ্ধার কাজে কতটা প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী? আহতদের চিকিৎসায় কতটা সক্ষমতা দেখিয়েছে হাসপাতালগুলো? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকে দিতে হবে। এই ঘটনা যেন আগুনে পুড়ে যাওয়া কিছু ভবনের মেরামতে আটকে না যায়। সন্তান হারানো মা-বাবার বুকফাটা আর্তনাদ কি রাষ্ট্র শুনবে? আজ যারা কাঁদছে, আগামীকাল তারা ন্যায়বিচারের জন্য পথে নামবে। এই শোক যদি প্রতিবাদে পরিণত হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে তাদের জবাব দিতেই হবে। কারণ যারা হারিয়েছে তারা কেবল সন্তান নয়, নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। তাই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

০৩. বিমান দুঘটনার পর নানা প্রশ্ন উঠেছে ? জনমনে ধেখা দিয়েছে নানা উদ্বেগ ? প্রশ্ন উঠেছে ১৯৬৬ সালের একটি চাইনিজ রেপ্লিকা প্লেন দিয়ে আপনি কি এখনো প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাবেন? ‎ফলে বিমান দুঘর্টনায় প্রাণহানির দায় আপনি এড়াতে পারেন না। ‎৯ মে, ২০২৪ স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ একটি ট্রেনিং মিশনে প্রাণ হারান। প্লেনটি যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হয়। তিনি শেষ মুহূর্তে জনবহুল এলাকা থেকে প্লেনটি সরিয়ে বড় ক্ষতি ঠেকিয়েছিলেন। ‎কিন্তু, স্কোয়াড্রন লিডার তাওকির ইসলাম সাগর আরেকটি ভাঙারি বিমানের যান্ত্রিক ব্যর্থতায় প্রাণ দিলেন। ‎প্রশ্ন একটাই: কতজন মারা গেলে সরকার বা কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারবে এসব প্লেন আর “ট্রেনিং” উপযোগী নয়? ‎একটি রাষ্ট্র যখন নিজের ব্রিলিয়ান্ট পাইলটদের পরীক্ষার নামে মে*রে ফেলে, সেটা আর দুর্ঘটনা নয় সেটা অবহেলা। সেটা কি অপরাধ নয় ?

‎বাংলাদেশের আকাশে এখনো সত্তরের দশকের প্লেন উড়ছে, যেগুলো আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে তো নয়ই, প্রশিক্ষণের জন্যও উপযুক্ত নয়। এই প্লেনগুলো পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ৩০ বছর আগেই রিসাইক্লিং কারখানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ‎বাংলাদেশের একজন পাইলটের জীবন কি এতটাই সস্তা? আপনি যদি নিজের সেনাবাহিনী, এয়ারফোর্সের ভবিষ্যৎ নিয়েই উদাসীন থাকেন, তাহলে কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন? ‎ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সেরা মেধাবীদের হাতে যখন আপনি ভাঙারি প্লেন তুলে দেন, তখন আপনি শুধু তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলছেন না দেশকে দুর্বল করে দিচ্ছেন ভিতর থেকে। ‎দায় কার? নেতাদের ? মন্ত্রণালয়? প্রতিরক্ষা বাজেটের দায়িত্বপ্রাপ্তরা? যারা উন্নয়নের নামে বাস্তব নিরাপত্তার কাজ ফাইলেই রেখে দেন?

‎হাসপাতালে প্রতিদিনই কিউ না কেউ যাচ্ছে, যাবেনও। কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায় ‎কিছু সহানুভূতি, ক্যামেরার সামনে দু-একটা কথা, পরিবারকে সামান্য টাকা তারপর সব আগের মতো চলবে। ‎নতুন করে “টেন্ডার”হবে পরোনো প্লেনের জন্য।
‎নাম হবে "আধুনিকায়ন", কিন্তু আসলে হবে আরও কয়েকটি জীবন ঝুঁকিতে ফেলা। ‎‎এই মৃত্যুগুলোর দায় কোনো “মেইনটেন্যান্স টিম” বা মরিচা ধরা যন্ত্রাংশের" নয় এই দায় আপনার, যিনি সিদ্ধান্ত নেন, বাজেট দেন, তদারকি করেন, আর প্রতিবার চুপ থাকেন। ‎এবার চুপ থাকবেন না। এবার প্রশ্ন তুলুন। ‎আরও একটি প্রাণ হারানোর আগেই এবার ব্যবস্থা নিন।

০৪. সরকারীভাবে এখনো মৃতু্্যর সঠিক সংখ্যা বর্ণনা করা হয় নাই। চূড়ান্ত সংখ্যা কত এখনো জানা যায় নাই। তবে, শোনা যায় কমবেশি দুই শতাধিকের কাছাকাছি নিষ্পাপ কোমলপ্রাণ শিশু বাচ্চা মারা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। অন্যরাও মৃত্যুর পথযাত্রী হয়ে আছে। এই সমস্ত সকল শিক্ষার্থীরা হয়তোবা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পরিবার-পরিজন-আত্মীয় স্বজন এমন কেউ নয় ! সেই জন্যই হয়তো কারো গায়ে লাগেনি। সবকিছুর হিসাবনিকাশ মিলিয়ে দেখে নিতে হবে। আগাপিছু করে এই ধরনের শোকাবহ বেদনাদায়ক দৃশ্য সকলের ক্ষেত্রেই মুখোমুখি হতে হবে ! আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু সীমালঙ্ঘন অবিচারের কথা নির্যাতন নিপিড়ীত শিকারের অংশভুক্ত মজলুম দেশের বিভিন্ন স্তর নাগরিকদের বুক ফাটা আর্তনাদ সহ্য করেন না। স্বৈরাচারী খুনি হাসিনার গণ পতনের মতনই কমবেশি সকল রাষ্ট্র হর্তাকর্তারা অসম্মানের সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হতে হবে। যদি পাপের বোঝা ভারি হয়ে উঠে।

সোমবার উত্তরায় স্কুলভবনে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ঘন কালো ধোঁয়া, মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা আর প্রিয়জন হারানো পরিবারের কান্না দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। পুরো পরিস্থিতি বুঝে উঠতে সময় লাগছে, কিন্তু একটা কথা সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল: এমন বিপদে কী বলতে হবে বা কী করতে হবে, তার জন্য আমাদের সংস্থাগুলো তৈরি ছিল না। আমরাও নাগরিক হিসেবে তৈরি ছিলাম না, আটা স্পষ্ট। ঘটনার পরেই উপলব্ধি করা গেলে, বাংলাদেশে বিপদ সামলানোর ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। আমরা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে একটা এক্স পোস্ট (টুইট) দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, অথচ বিপদ নিয়ে কথা বলার আমাদের পদ্ধতি এখনো অনেক পুরোনো আমলের। এই দুঃখজনক ঘটনা বার বার বিভিন্নভাবে গঠলেও আমাদের জাগিয়ে তুলতে পারছে না। বাংলাদেশের এখনই দরকার ভালো পরিকল্পনা করে কথা বলা এবং বিপদ মোকাবেলায় বিভিন্ন কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করা। বিপদ হওয়ার পর তা নিয়ে ভাবলে হবে না, বরং এগুলো দেশ পরিচালনার এবং নাগরিকের দায়িত্বের মূল অংশ হতে হবে।

সময়মতো সুনির্দিষ্ট সরকারি তথ্য প্রদানে সরকার ব্যর্থ হবার কারণেই নানা ভুল তথ্য ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে একটি মহল। এবং তারা ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টাও করেছে। জনমনে নানা ধরনের আতংক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে তারা। যাচাই না করা ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশি ষড়যন্ত্র, পাইলটের আত্মহত্যা, এমনকি অদ্ভুত সব গুজবও মানুষের মুখে মুখে এখনো ঘুরছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, ভালো মানুষ আর সুযোগসন্ধানী—সবাই মিলে তা ছড়াচ্ছিল। যখন সত্যি খবর দ্রুত পাওয়ার সুযোগ থাকে না, তখন মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, মানুষ আতঙ্কিত হয়। যখন বিপদ আসে, তখন সবার আগে বিশ্বাস ভেঙে যায় না—তথ্য না থাকলেই বিশ্বাস মরে যায়।

২১ জুলাই বাংলাদেশের জন্য এমন এক অবর্ণনীয় শোক নিয়ে এল, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুল ভবনে আছড়ে পড়া বিমান এখন পর্যন্ত কেড়ে নিল পাইলটসহ অনেকগুলো প্রাণ, যার প্রায় সবাই শিশু। আরও বহু শিশু হাসপাতালের বিছানায় পোড়া শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে। অনেক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা আমরা দেখেছি। বিগত সরকারগুলোর নানা দমন-পীড়ন আমরা দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে কত সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীকে হারিয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু এমন করে ছোট ছোট শিশুকে আকুতি নিয়ে চলে যেতে দেখিনি।

রাষ্ট্রকে তার জনগণের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে যা করণীয়, তাই করতে হবে। তা বাস্তবায়ন করার জন্য আর বসে থাকার মতো কোনো সময় কারো হাতে নাই।

[ এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া, কলাম লেখক, রাজনীতিক কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক]
E-mail : [email protected]

BDNAP NEWS 22-07-2025মৃত্যুর মিছিল কোথায় থামলে টনক নড়বে রাষ্ট্রের ? : জেবেল রহমান ‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ’ পৃথিবীতে সব...
22/07/2025

BDNAP NEWS 22-07-2025

মৃত্যুর মিছিল কোথায় থামলে টনক নড়বে রাষ্ট্রের ? : জেবেল রহমান

‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ’ পৃথিবীতে সবচাইতে ভারী বস্তু। আর সেটা যদি হয় ছোট ছোট কোমলমতিদের লাশ তাহলে তা বহন করা আরও দুঃসাধ্য বলে’ মন্তব্য করে বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেছেন, ‘ছুটির পর যে স্কুল ক্যাম্পাস থাকতো কোলাহলে মুখর তা ভেসে গেল আর্তনাদে। স্কুল ছুটির পর জীবন থেকেও ছুটি নিলো কোমলমতিরা। মুহূর্তেই তারা হয়ে গেলো আকাশের তাঁরা। বিষাদে ছেয়ে গেল আকাশ-বাতাস। এতো শোক সহ্য করা বড়ই কঠিন।’

তিনি বলেন, ‘দেশে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে, একের পর এক তাজা প্রাণ চলে যাচ্ছে। কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেলিভিশনের পর্দা থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে সরগরম থাকে এসব ইস্যুতে। প্রশাসন থেকে নেওয়া হয় নানান পদক্ষেপ, আবার সব চুপচাপ হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠে জনগনের মনে মৃত্যুর মিছিল কোথায় থামলে টনক নড়বে রাষ্ট্রের ?’

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) রাজধানীর গুলশানে দলীয় চেয়াম্যানের কার্যালয়ে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় শাহাদাতবরণকারী শিক্ষার্থীদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও আগুনে দগ্ধ শিক্ষার্থীদের সুস্থতা কামনায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ আয়োজিত দোয়া অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার ওপর মানুষের হাত নেই। তাই বলে এমন দুর্ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না, যাতে বিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যাওয়া শিশুরা ফিরে এল লাশ হয়ে। একটি দুর্ঘটনায় এত বেশি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা বিরল। এ ঘটনায় কেবল স্বজনহারা পরিবার নয়, পুরো বাংলাদেশ শোকাহত।’

জেবেল রহমান গানি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রসহ আমাদের সকলকে আরো বেশী সচেতন হতে হবে। যাতে করে আর কোনো শিশু-কিশোর যেন অকালে ঝরে না যায় সে জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রকে। মৃতের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। যারা স্বজন হারিয়েছেন কোনও প্রতিদানই তাদের শোক ভোলাবে না। তবুও সরকারকে শিশু হারানো পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং ঝলসে যাওয়ারা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন রাষ্ট্রকে তাদের পাশে থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্থেরর ঘটনাটি কিভাবে ঘটল, সরকারকে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এটি কি নিছক কোন দুঃঘর্টনা নাকি ষড়যন্ত্র। প্রয়োজনে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। ’

এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া, যুগ্ম মহাসচিব মো. নুরুল আমান চৌধুরী, আতিকুল ইসলাম, এহসানুল হক জসিম, অর্থ সম্পাদক শ্রী প্রদ্যুৎ রায়, ভারপ্রাপ্ত প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, সাংগঠনিক সম্পাদক মিতা রহমান, মো. সুমন মিঞা, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল আলম শাহীন, উপ-প্রচার সম্পাদক রবিউল আওয়াল কনক, কেন্দ্রীয় সদস্য এস এম কামরুল হাসান ফরিদ, জাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিমান দুঘর্টনায় নিহতদের রুহের মাগফেরাত ও আহতের সুস্থতা কামনা করে বাংলাদেশ ন্যাপ চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, নীলফামারী, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা জেলার উদ্যোগে দোয়া অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

BDNAP NEWS 21-07-2025প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বাংলাদেশ ন্যাপ'র শোক রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় বিমানবাহিনীর প্রশি...
21/07/2025

BDNAP NEWS 21-07-2025

প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বাংলাদেশ ন্যাপ'র শোক

রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ।

সোমবার (২১ জুলাই) এক শোক বার্তায় বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেন, রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক‍্যাম্পাসে আজ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ ন্যাপ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছে।

তারা বলেন, এই দুর্ঘটনায় বিমানসেনা ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক-কর্মচারীসহ অন্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ। আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালসহ সব কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

নেতৃদ্বয় বলেন, বাংলাদেশ ন্যাপ'র সর্বস্তরের জনশক্তি ও এলাকাবাসীকে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ, আহতদের চিকিৎসায় সর্বাত্মক সহায়তার উদাত্ত আহ্বান জানান। একই সাথে সরকার দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতিও আহ্বান জানান।

Artical 21-07-2025ন্যাপ প্রতিষ্ঠা : মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ ত্যাগ   ।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।০১. স্বাধীন বাংলাদেশের...
21/07/2025

Artical 21-07-2025

ন্যাপ প্রতিষ্ঠা : মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ ত্যাগ

।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
০১. স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তিযুদ্ধকালিন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান, আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার নির্যাতিত-নিপিড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামে কন্ঠস্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠিত হয় ১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ত্যা করেই তিনি ন্যাপ গঠন করেছিলেন। ২০২৫ সালে ২৬ জুলাই সেই ন্যাপ'র ৬৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।

১৯৫৭ সালের ৬-১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে, দলের ডানপন্থী নেতারা সোহরাওয়ার্দীর সাথে একমত পোষণ করেন, কিন্তু ভাসানী পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনার পক্ষে ছিলেন।

এই মতভেদের কারণে, ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। ন্যাপ মূলত বাম বা ডান নয়, মধ্যপন্থী এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ন্যাপ।

০২. আওয়ামী মুসলিম লীগ তৈকে আওয়ামী লীগ
ঢাকার স্বামীবাগে কে এস দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। তবে দলটির জন্মসূত্রের সঙ্গে পুরনো ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে শওকত আলীর বাসভবনের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। উপমহাদেশ বিভক্তির আগে ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিতে স্থাপিত হয়েছিল ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প' ও মুসলিম লীগ পার্টি হাউস। কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মীশিবিরের নেতাদের নিয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। ১৫০ নম্বর মোগলটুলির শওকত আলীর বাসভবন ও কর্মীশিবির অফিসকে ঘিরে কয়েকমাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। ওই সময় দলের স্থায়ী কোনও কার্যালয় না থাকায় ১৫০ মোগলটুলিকেই অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ছাত্রলীগের গোড়াপত্তনও হয়েছে মোগলটুলির এই ঠিকানায়। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার ৬ বছরের মাথায় ১৯৫৫ সালের সম্মেলনে অসাম্প্রদায়িক রূপ দিতে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক ও শেখ মুজিবর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমদকে যুগ্ম সম্পাদক করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। ‘আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইয়ে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন দলটি গঠনের পেছনের কথা। তিনি বলছেন, ‘১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ [উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোগলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার কারিগর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী অথচ শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে তার কন্যা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এই চরম বাস্তবতা কখনো স্বীকার করেন নাই

০৩. আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন :
১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষার স্যান্টো ও সিয়াটো চুক্তি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। এ প্রশ্নে দলের ডানপন্থী পাতি বুর্জোয়া নেতা-কর্মীরা সোহরাওয়ার্দীর পক্ষাবলম্বন করেন এবং বামপন্থী অংশ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন।

ফলে আওয়ামী লীগ আদর্শিক কারণে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ওই বছর ১৮ মার্চ মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের বামপন্থী এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার অংশের উদ্যোগে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ২৫ ও ২৬ জুলাই 'নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে ১৭ জুন তিনি এই সম্মেলন করার ঘোষণা দেন। ঘোষণা মোতাবেক ১ জুলাই ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের সভাপতিত্বে ঢাকা জেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক কর্মীসভায় ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সভাপতি ও মহিউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। প্রগতিশীল, বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন নেতাকর্মীদের মধ্যে এই সম্মেলন নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেয়। ২০ জুলাই ঢাকার শাহবাগ হোটেলে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা মাহমুদ আলী কাসুরীর সভাপতিত্বে প্রস্তুতি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে কেন মওলানা ভাসানী এই কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করলেন কিংবা কেনই বা তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নতুন দল গড়ার দিকে মনোনিবেশ করলেন? অনেকেই এর কারণের গভীরতায় না গিয়ে ঢালাওভাবে তার দল ত্যাগের সমালোচনা করে থাকেন। এ বিষয়ে রাজনীতিক ও কবি বুলবুল খান মাহবুব তাঁর মওলানা ভাসানী- অনন্য ব্যতিক্রম নিবন্ধে লিখেছেন, "মওলানা ভাসানীর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রায় সব সময়েই কোন না কোন পার্লামেন্টারী দলের সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছেন। কিন্তু কখনই জনতার স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থ তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি। তাই যে মূহুর্তে তাঁর দল ক্ষমতার মোহে জনতার স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেই মুহূর্তেই তিনি তাঁর প্রাণ প্রিয় সংগঠনকে ছিন্ন বস্ত্রের ন্যায় ত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি।

বহু বছরের ত্যাগের বিনিময়ে ক্ষমতা দখলের পর সংগঠনের সুদিনে যখন একটু অবসর নেয়ার পালা সেই মুহূর্তে জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে আবার নতুন করে জনতার দাবি নিয়ে তাঁকে নতুন বিরোধীদলের জম্ম দিতে হয়েছে মওলানা ভাসানীকে। বহু তথাকথিত দেশপ্রেমিক নেতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিরোধী দলের নেতা হিসাবে যে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজের জীবনে বারবার লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন দীর্ঘদিন সংগ্রামের পর ক্ষমতা দখল করে অতীতের অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে জনতা এবং তার বিরোধীদের উপর তিনি তার পূর্বসুরীদের একই কায়দায় অত্যাচার চালাচ্ছেন।

মওলানা ভাসানী তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এই কপটতাকে স্বীকার করতে পারেননি- জনগণ এবং তাদের সুখ-দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি বলেই তাঁকে দু’তিনবার নিজের হাতে গড়া সংগঠন ত্যাগ করতে হয়েছে। নিজের দীর্ঘ দিনের দুঃসময়ের সহকর্মীরা যখন ক্ষমতায় গিয়ে জনতার কথা ভুলে গেছে তখন নিজের হাতে গড়ে তোলা কর্মীদের ত্যাগ করে নতুন কর্মী সৃষ্টি করার কাজে নতুন করে আত্মনিয়োগ করেছেন। জনতার স্বার্থে নিজ দলের বিপক্ষেও ভোট দিতে কুন্ঠিত হন নাই মওলানা ভাসানী। যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য একদিন তিনি আন্দালন সংগ্রাম করেছেন; সেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ বাজেট অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে তিনি নিজ দলের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বলেছেন, আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? মুসলিম লীগ সরকারের অপকৃর্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুসলিম লীগ সরকারের জেল জুলুম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত দলটিকে প্রদেশব্যাপী জনপ্রিয় করেছেন। '৫২-র ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটা সেই সময় যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কথা বলাকে আল্লাহর নাফরমান বলে প্রচার করা হতো।

১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর তারিখে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে দলটিকে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' নামকরণ করেছেন। আওয়ামী লীগে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অন্তর্ভূক্তি একদিকে যেমন দলকে শক্তিশালী করেছে; অন্যদিকে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ থেকে বিচ্যুতিও ঘটিয়েছে। যার প্রকাশ ঘটতে থাকে '৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়লাভের পর থেকে। নির্বাচনের পূর্বে যুক্তফ্রন্টের দেয়া ২১ দফার প্রতি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জনগণের মোহভঙ্গ ঘটে। এমতাবস্থায়, যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও নিজেদের অন্তর্দন্দ আর অন্তঃকলহের কারণে ৩০ মে মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হক মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করে পূর্ববাংলায় গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করে। এসময় বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য লন্ডনে অবস্থানরত মওলানা ভাসানী সাংবাদিক সম্মেলন করে তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন।

এরপর অনেক পানি ঘোলা করে সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী হয়েই তাঁর বিখ্যাত 'জিরো প্লাস জিরো ইকুয়েল টু জিরো' থিউরী দিলেন। ঘোষণা করলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়া মানে পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% স্বায়ত্বশাসন লাভ হয়ে গেছে’। এসময় ক্ষমতাসীনরা দল এবং ২১-দফার আদর্শ উদ্দেশ্য বিরোধী গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দফার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করতে থাকলে মওলানা ভাসানী প্রকাশ্যেই তার সমালোচনা শুরু করেন। এহেন পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন এবং একই সাথে এক সাংস্কৃতিক সম্মেলন আহ্বান করেন। কেন্দ্রে ও প্রদেশে তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়।

৭ ফেব্রুয়ারির কাউন্সিল অধিবেশনে ভাসানী স্বায়ত্বশাসন, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট চালু; বিশেষ করে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর তীব্র সমালোচনা করেন। এরপর থেকে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী দ্বন্দ্ব প্রকট হতে থাকে। একই সম্মেলনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে 'আসসালামু আলাইকুম' জানিয়ে একদিকে যেমন ভাঙনের আওয়াজ তোলেন; অন্যদিকে সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পর্বে তিনি নতুন একটি দেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক চেহারার স্বরূপ উন্মোচন করেন। কাগমারী সম্মেলনের পূর্বাপর দৈনিক ইত্তেফাক বিশেষ উস্কানীদাতার ভূমিকা পালন করতে থাকে। সোহরাওয়ার্দীপন্থীরা মওলানা ভাসানীকে ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর বলে আক্রমণ করে।

অথচ এই সোহরাওয়ার্দীকেই একদিন মওলানা ভাসানী দলে টেনেছিলেন। তার প্রমাণ আমরা পাই শেখ মুজিবুর রহমান এর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থে। এই গ্রন্থের ২১৬ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীকে উল্লেখ করে লিখেছেন, আমি তাঁকে জানালাম, "আপনি জিন্নাহ আওয়ামী লীগ করেছেন, আমরা নাম পরিবর্তন করতে পারব না। কোনো ব্যক্তির নাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগ করতে চাই না। দ্বিতীয়ত আমাদের ম্যানিফেস্টো আছে, গঠনতন্ত্র আছে, তার পরিবর্তন করা সম্ভবপর নয়। মওলানা ভাসানী সাহেব আমাকে ১৯৪৯ সালে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখনও তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তাঁরও কোনো আপত্তি থাকবে না, যদি আপনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র মেনে নেন।"

এখানে উপলব্ধি করার বিষয় যে, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নয়; সুসময়ে দল ছেড়েছেন। যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিই নন, দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি এই দলটিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল অঞ্চলে সকল সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলেছিলেন। সেই দল পরিত্যাগ করার সময় তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন বৈকি! কিন্তু আদর্শের কাছে আপোষ করা তাঁর ধাতে ছিল না। তাই তিনি '৫৭ সালের ১৮ মার্চ অলি আহাদের মাধ্যমে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বরাবর এক পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। সপ্তাহখানেক পর ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন শিরোনামে এক প্রচারপত্রে তিনি বলেন, '২১-দফা দাবি আদায়ের জন্য সারা দেশময় আন্দোলন করুন।' এই প্রচারপত্র এটাই প্রমাণ করে যে তখনও তিনি আওয়ামী লীগ ছাড়েন নাই। কিন্তু ৩০ মার্চ ৫৬/সিম্পসন রোডে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাহী পরিষদের এক জরুরি সভায় বহিস্কার-পাল্টা বহিস্কার প্রশ্নে দল ভেঙে যাওয়ার সমস্ত আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়ে যায়। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান ভাসানীকে তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য জোর অনুরোধ জানান।

একই বছর ১৩-১৪ জুন ঢাকার 'শাবিস্তান' প্রেক্ষাগৃহে ফের আওয়ামী লীগ নির্বাহী পরিষদের অধিবেশন বসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকের অনুরোধে মওলানা ভাসানী কিছুক্ষণের জন্য সভায় উপস্থিত হন। কিন্তু "ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিছানা থেকে আগত অসুস্থ নেতা মওলানা ভাসানীকে 'ভারতের দালাল মুর্দাবাদ' জাতীয় অশালীন শ্লোগানের মাধ্যমে অপমান করা হয়, তাঁকে স্বচ্ছন্দে বলতে দেয়া হয়নি এবং ফলে তিনি দ্রুত ভাষণ 'শেষ' করেই ফিরে গিয়েছিলেন হাসপাতালে।" এরপর '৫৭-র ২৪ জুলাই ভাসানী আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটান।

‌১৯৫৭-র ২৫ জুলাই মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সম্মেলন আরম্ভ হয় একদিকে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা অন্যদিকে হুমকি ও ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে। সম্মেলনে ভাসানী তাঁর দীর্ঘ লিখিত ভাষণে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে নতুন দল গঠনের প্রেক্ষিত বর্ণনা করেন। কৃষিপ্রধান পাকিস্তানের কৃষকদের সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার দশ বছর পরও দেশের কৃষক সমাজ স্বাধীনতার কোনো আস্বাদন পায় নাই। তারা আজ ভুখা।' শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সরকারের নিন্দা করে তিনি বলেন, 'শ্রমিকরা নূন্যতম মজুরি থেকে বঞ্চিত, তারা কোনো আন্দোলন করতে গেলে তাদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি।' তিনি তাঁর ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন, পররাষ্ট্রনীতি ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কেই তিনি বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বস্তুত সরকারের সঙ্গে মনোমালিন্যের সেটাই ছিলো মুখ্য কারণ।

সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তান হতে যোগ দিয়েছিলেন পাক-ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপকথার নায়ক সীমান্ত প্রদেশের লালকোঠা নেতা সীমান্ত গান্ধী খান, আবদুল গাফফার খান, পাঞ্জাবের জননেতা মিয়া ইফতেখার উদ্দিন, সিন্ধুর জননেতা ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান জিএম সৈয়দ, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী, বেলুচিস্তানের আবদুস সামাদ খান আচাকজাই, খান আবদুল ওয়ালী খান, পাঞ্জাবের মেজর ইসহাক, ব্যারিস্টার মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী, আফজল খান, প্রিন্স আবদুল করিম, গাউস বকস বেজেঞ্জো, খায়ের বকশ মারী, আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল, আবরার আবদুল গফুর, আবরার সেকেন্দর খান, গোলাম মোহাম্মদ লেঘারী, হাশিম খান গিলয়াই, এয়ার কমান্ডার জানজুয়া, আবদুল মজিদ সিন্ধী প্রমূখ।

যে সকল নেতাকর্মী সম্মেলন সফল করতে নিরলস ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মোহাম্মদ তোয়াহা, মোজাফ্ফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, চৌধুরী হারুন-উর রশীদ, পীর হাবিবুর রহমান, অলি আহাদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আতাউর রহমান, বেগম সেলিনা বানু, মণিকৃষ্ণ সেন, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, আবু জাফর শামসুদ্দিন, হাতেম আলী খান, মোহাম্মদ সুলতান, শওকত আলী খান, ইয়ার মোহাম্মদ খান, ডা. আবদুল করিম, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম, মাহমুদ আলী, মোখলেসুর রহমান সিধু মিয়া, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মীর্জা গোলাম হাফিজ, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সাইদুল হাসান, নুরুল হক চৌধুরী, সলিমুল হক খান মিল্কি, আবদুল মোত্তাকিম চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ প্রমূখ।

সম্মেলনে উপস্থিত রণেশ মৈত্রের ভাষায়, দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচিতে "পিনপতন নিরবতার মধ্যে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সম্মেলন অগ্রসর হতে থাকলো, তর্ক-বিতর্কও চললো। দলের নাম, দলীয় পতাকা (সবুজ এবং লাল কাপড়ে- লাল অংশে পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের স্মারক হিসেবে পাঁচটি সাদা তারকা খচিত), ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র, দু'টি কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন হলো বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। সেদিন আসলেই এক অভূতপূর্ব প্রাণবন্যা পরিলক্ষিত হয়েছিলো পাকিস্তানের সকল প্রদেশ ও অঞ্চল থেকে আগত নেতা ও কর্মীদের মধ্যে। হলটি বারবার ফেটে পড়েছিলো মুহুর্মুহু করতালি ও গগণবিদারী শ্লোগানের মধ্যে। প্রতিনিধি সম্মেলনের কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করার সাথে সাথে রূপমহল সিনেমা হলের সামনে সকলকে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়াতে বলা হলো। পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দসহ সমবেত সকল প্রতিনিধি স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মী মিছিল করে যাবেন ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জনসভা করতে। যেভাবে বলা হলো, সেভাবেই মুহূর্তের মধ্যে সকলে প্রস্তুতি নিয়ে ফেললো। গগণবিদারী শ্লোগান, করতালি ও নতুন পার্টি "ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি জিন্দাবাদ", "মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক", "পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে", "পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিল করো", "মাশরেকী ঔর মাগরেবী পাকিস্তান কি আওয়াম কি ইত্তেহাদ", (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ঐক্য জিন্দাবাদ) প্রভৃতি ধ্বনিতে মুখরিত হলো এই ঐতিহাসিক মিছিল, যার সামনের সারিতে ছিলেন মওলানা ভাসানী, খান আবদুল গাফ্ফার খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।"

পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি ব্রড বেইজড পার্টি হিসেবে জন্ম নিলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সংক্ষেপে ন্যাপ। পরদিন দৈনিক সংবাদ এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো এরূপঃ 'পাকিস্তানের উভয় অংশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সমন্বয়ে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে নয়া রাজনৈতিক দল গঠিত। ঢাকায় অনুষ্ঠানরত গণতান্ত্রিক সম্মেলনের অভূতপূর্ব সাফল্যঃ বার শতাধিক প্রতিনিধির সমাবেশে জাগ্রত জনমতের অভিব্যক্তি।' নবগঠিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মওলানা ভাসানী ও মাহমুদুল হক উসমানী। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে মওলানা ভাসানী ও মাহমুদ আলী এবং পশ্চিম পাকিস্তান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে খান আবদুল গাফ্ফার খান ও মাহমুদ আলী কাসুরী নির্বাচিত হন। পার্টির নীতি ও আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। চূড়ান্ত লক্ষ্য সমাজতন্ত্র।

১৯৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ন্যাপের উদ্যোগে ব্রহ্মপুত্র নদের চরে ফুলছড়িতে কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় এবং ঐ সম্মেলনে ‘কৃষক সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করেন। বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের দাবিতে মওলানা ভাসানী কারাগারে আমরণ অনশন শুরু করেন। মওলানা ভাসানীর আহবানে সর্বদলীয় প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ১৮ মার্চ সর্বজনীন ভোটাধিকার দিবস পালিত হয়। ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ন্যাপ সংযুক্ত বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে মিস ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে।

০৪. ন্যাপ'র বিভক্তি :
৬০ দশকে সারা পৃথিবীতে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও গণমানুষের মুক্তির সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার প্রভাব নিখিল পাকিস্তান ন্যাপ এর উপরও পড়ে। ফলে ১৯৬৭ সালের দিকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় কারণে ন্যাপ নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরোধ চলতে থাকে। ১৯৬৭ সালের কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে মস্কোপন্থী নেতারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা চালায়। তাই মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পরামর্শে রংপুরে কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের পর দেশিয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে ন্যাপ চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। পূর্ব পাকিস্তান ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত হয়।

১৯৬৭ সালে মওলানা ভাসানী ন্যাপের কাউন্সিল ও কৃষক সমিতির অধিবেশন আহবান করেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় রিকুইজিশন কাউন্সিল অধিবেশন। ১৯৬৮ সালে মওলানা ভাসানির নেতৃত্বে ন্যাপ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী গণঅভ্যূত্থানের সূচনা করে। ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে ৩ নভেম্বর ‘দাবি দিবস’ এবং ৬ ডিসেম্বর ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ঐদিন পল্টনে এক জনসভা শেষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে জনগণ গভর্নর হাউজ ঘেরাও করে এবং ৭ ডিসেম্বর হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঢাকায় হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ৮ ও ১০ ডিসেম্বর সারা প্রদেশব্যাপী হরতাল আহবান করা হয়।

০৫. স্বাধীনতা উত্তর ন্যাপ :
১৯৭২ সালে ন্যাপ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণতান্ত্রিক সরকারের এক কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ভাসানীর নেতৃত্বে ৭ দলীয় মোর্চা গঠিত হয়। ভাসানী ন্যাপ ১৬৯টি আসনে প্রার্থী দেয়। কিন্তু প্রশাসনিক নগ্ন পক্ষপাত্তিত্বের ফলে ৭ দলীয় মোর্চা নির্বাচন থেকে সরে আসে । ১৯৭৩ সালে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন ভাসানীর নেতৃত্বাধিন ন্যাপে যোগদান করে প্রথম জাতীয় সংসদে ন্যাপের প্রতিনিধিত্ব করেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্যশস্যের দুষ্প্রাপ্র্যতার প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী ১৯৭৩ সালের ১৫ থেকে ২২ মে ঢাকায় অনশন করেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যজোট খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। সরকার ১৯৭৩ সালের ৩০ জুন মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে তার বাড়িতে গৃহবন্দি করে।

১৯৭৩ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ, জাতীয় লীগ (অলি আহাদ), জাতীয় লীগ (আতাউর রহমান), জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (হাজী দানেশ), কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল (খান সাইফুর রহমান), কমিউনিস্ট পার্টি (নাসিম আলী), লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে এক বিরোধী ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ন্যাপ এই চুক্তির বিরোধিতা করে।

১৯৭১ সালে মশিউর রহমান যাদু মিয়া ন্যাপ'র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ১৫ মে ভাসানী ন্যাপের এডহক কমিটি গঠন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় ন্যাপ পুনরায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৫ জুলাই জাতীয় রিকুইজিশন কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়। দলের তরুণ বামপন্থী অংশ কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনাইটেড পিপল্স পার্টি (ইউপিপি) গঠন করে। কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেনন ইউপিপি গঠন করলে মূল ন্যাপের দায়িত্ব মশিউর রহমান যাদু মিয়ার উপর ন্যাস্ত হয়। ১৯৭৪ কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী সভাপতি ও যাদু মিয়া সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করলে ন্যাপ মোজ্জাফর ন্যাপ বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগ দেন। আর মওলানা ভাসানি ও যাদু মিয়ার নেতৃত্বে বাকশালের তীব্র বিরোধিতা করে।

০৬. ১৯৭৫'র পরবর্তী ন্যাপ :
১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার উদ্যোগ নিলে সারা বাংলাদেশে ন্যাপের সকল নেতা কর্মী নিয়ে মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। পরবর্তীতে জেষ্ঠ্যপুত্র সাবেক মন্ত্রী শফিকুল গানি স্বপনের নেতৃত্বে ন্যাপ পূর্নগঠন হয়। ২০০৯ সালের ২৩ আগষ্ট শফিকুল গানি স্বপনের ইন্তেকালের পর তার জেষ্ঠ্য পুত্র ও মশিউর রহমান যাদু মিয়ার দৌহিত্র জেবেল রহমান গানি ন্যাপের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দলটি "বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ" নামে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। যার বর্তমান চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া। নিবন্ধন নং-০২৭, নির্বাচনী প্রতীক : গাভী। জেবেল রহমান গানি ও গোলাম মোস্তফা ভুইয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন বর্জন, ২০১৮ সালে নিজস্ব প্রতিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহন আবার ২০২৪ সালে তৎকালিন ফ্যাসীবাদী শাসকের প্রচন্ড চাপ ও হুমকিকে উপেক্ষা করে আমি আর ডামি নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। ২০২৪ এর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সমর্থন প্রদান করে নিজের দলের সাধ্য অনুযায়ী আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহন করেছে।

[ এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া, কলাম লেখক, রাজনীতিক কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক]
E-mail : [email protected]

Address

Dhaka

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when LiveBarta24.com posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to LiveBarta24.com:

Share