23/11/2025
বাংলাদেশের জাতীয় মিডিয়া থেকে শুরু করে, কত শত ইউটিউবার, ফেসবুকার এবং আতকা ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা শুধু গুজব ছড়াচ্ছে।
বিভিন্ন জন বিভিন্ন লিংক ছবি মেসেজে দিচ্ছে- আসছে সেই মহাপ্রলয়! ৯মাত্রার ভূমিকম্প হবে বাংংলাদেশে!!
অথচ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বাংংলাদেশে ৯মাত্রার ভূমিকম্প সম্ভবই না।
১৭৬২ সালের ২রা এপ্রিল আরাকানে হয়েছিল সর্বোচ্চ ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প। তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এরপর বাংলাদেশের আশেপাশে এমন মাত্রার ভূমিকম্পন হয়নি। মানে দুইশ বছরের মধ্যে কোন বড়সড় ভূমিকম্পের নজির নেই।
ভূমিকম্পের কোন আগামবার্তা করা যায় না। তারপরও কত ফেসবুক পেইজ, বিশেষজ্ঞরা দাবী করছে, সামনে ৮ বা ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হবে। আর পুরো দেশ শেষ।
দেখেন, পরশুদিন একদম বাংলাদেশের মাঝখানে নরসিংদীতে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলো, মাটির মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। ঢাকা থেকে দুরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। এটা কিন্তু বেশ বড়সড় ভূমিকম্প বাংলাদেশের ইতিহাসে। কারণ এর আগে যত বড় ভূমিকম্প হয়েছে, তার উৎপত্তিস্থল ছিল হয় ভারতে নতুবা মিয়ানমারে।
সেগুলোতেই আমরা কত জোরে কেঁপে উঠেছিলাম।
আর খোদ বাংলাদেশের কেন্দ্রে এত বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলো, সেখানে পুরান ঢাকার তো দূরের কথা খোদ উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর কোন ভবন ধসে পড়েনি। আর ৯ মাত্রার ভুমিকম্পকে বলা হয় মহাপ্রলয়। তা হলে খোদ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মত বড় বড় দেশের বিল্ডিংও রক্ষা পাবে না। সেই হিসেব বাদ দেন।
আমাদের সবচেয়ে বড়সড় ভূমিকম্পটা হয়ে গেছে। এর থেকে বড় হওয়া হয়ত সম্ভব না। আর হলেও তা ৬ এর বেশী হবে বলে আমার মনে হয় না। এবং সেটা খুব শীঘ্রই হবে বলে মনেও হয় না। আমি বাপু প্লেট, প্লেটের গুতাগুতি এতসব বুঝি না। যারা বুঝেন, তারা একেকজন একেকরকম কথা বলবেন না প্লিজ।
গতকাল চ্যাটজিপিটিকে জিঙ্গেস করেছিলাম, বাংলাদেশে যে এতবড় ভূমিকম্প হলো, এবং একই উৎপত্তিস্থলে পরপর ৩টা ছোট ভূমিকম্প হলো, এটা কি বড় ভূমিকম্প হওয়ার লক্ষন?
চ্যাটজিপিটি বলল- ভূমিকম্পের ব্যাপারে কোনকিছুই নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে না। হতে পারে এগুলো আফটারশক। আর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এটুকু বলা যায়, ৯ মাত্রার ভূমিকম্প কেবল মাত্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘মেগা থ্রাস্ট সাবডাকশন জোনে’ এ সম্ভব। বাংলাদেশের প্লেটে সম্ভব না। যেমন:
উত্তর আমেরিকার কাসকাডিয়া সাবডাকশন জোন, ইন্দোনেশিয়া – আন্দামানের সুমাত্রা–আন্দামান সাবডাকশন জোন, জাপান ট্রেঞ্চ, চিলি সাবডাকশন জোন, আলাস্কা অঞ্চলের আলেউটিয়ান সাবডাকশন জোন, রাশিয়ার পূর্বাঞ্চল – জাপানের উত্তরে কামচাটকা–কুরিল সাবডাকশন জোন, নিউজিল্যান্ডের উত্তরেটোঙ্গা–কর্মাডেক সাবডাকশন জোন, হিকুরাঙ্গি সাবডাকশন জোন এগুলোতে হবে।
বাংলাদেশের নিকটবর্তী প্রধান সাবডাকশন জোন হলো সুমাত্রা–আন্দামান সাবডাকশন জোন—এটি বাংলদেশে সরাসরি নয়, তবে বড় সুনামির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেগা-থ্রাস্ট নেই, তবে ইন্ডিয়া–বার্মা কোলিশন জোন একটি শক্তিশালী টেকটোনিক সীমান্ত।
তবে এটা সত্য যে, বাংলাদেশের নিচের প্লেটে অনেক শক্তি জমে আছে শত শত বছর ধরে।
বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠনকে বিজ্ঞানীরা একটি "লকড মেগা-থ্রাস্ট" (Locked Megathrust) জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের নিচে: হাজার হাজার বছরের পলিমাটি (Sediment) জমে থাকার কারণে আমরা ওপর থেকে মাটির নিচের ফাটল দেখতে পাই না।
প্লেটের গতি: ইন্ডিয়ান প্লেটটি বার্মা প্লেটের নিচে আটকে আছে (Locked)। এটি গত কয়েকশো বছর ধরে প্রচুর শক্তি জমা করেছে।
ডাউকি ফল্ট: সিলেটের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কাছে 'ডাউকি ফল্ট' নামে একটি বড় ফাটল আছে, যেখানে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে চাপ দিচ্ছে।
সংক্ষেপে, বাংলাদেশ মূলত একটি ইন্ডিয়ান প্লেটের পিঠে বসে আছে, যা প্রতিনিয়ত পূর্বদিকের বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকছে এবং উত্তরের ইউরেশিয়ান প্লেটকে ধাক্কা দিচ্ছে। এই তিনমুখী সংঘর্ষই বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রেখেছে।
তবে সবার উদ্দেশ্যে বলব- অযথা গুজব ছড়াবেন না। গতকাল দেখলাম একদল গুগলের পরশুদিনের ম্যাপের ছবি দেখিয়ে বলছে, একটু আগে আবার ভূমিকম্প হলো। নরসিংদীতে রাস্তায় নেমে এলো অনেক মানুষ রাতেই।
মানুষকে সতর্ক করেন, প্যানিক করিয়েন না। ভয় দেখিয়েন না। আমার ছোট মেয়েটা অনেক ভয় পেয়েছে, এখন একুট শব্দ হলেই সে ভয় পায়। আমি নিজেই কতবার ভাবি এই বুঝি হলো। ট্রমায় আছি মনে হচ্ছে।