26/10/2025
অনুচ্ছেদ ৭ (জনগণের ক্ষমতার উৎস):
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১)-এ বলা হয়েছে—
> “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সকল ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত, এবং সেই ক্ষমতা এই সংবিধানের অধীনে প্রয়োগ করা হইবে।”
এখানে জনগণকে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ, আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে।
কিন্তু ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী আইন প্রণয়নের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।
> আল্লাহ তাআলা বলেন:
“নিশ্চয়ই হুকুম (আইন প্রণয়ন) একমাত্র আল্লাহর।” — (সূরা ইউসুফ ১২:৪০)
এখানে স্পষ্ট যে, ইসলাম আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে সর্বোচ্চ স্থানে স্থাপন করেছে, আর গণতন্ত্র জনগণের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে — যা একে অপরের পরিপন্থী।
---
গণতন্ত্রকে হারাম মনে করার প্রধান যুক্তি
১️⃣ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা
গণতন্ত্রে মানুষ আইন প্রণয়নের অধিকার রাখে। অথচ ইসলামে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।
> “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারা কাফির।” — (সূরা মায়িদা ৫:৪৪)
এ কারণে অনেক আলেম বলেন, মানব-প্রণীত আইন প্রণয়ন করা আল্লাহর কর্তৃত্বকে অস্বীকারের সামিল।
২️⃣ শরিয়াহর স্থলে মানব-প্রণীত আইন
গণতন্ত্রে এমন আইন অনুমোদিত হতে পারে যা শরিয়াহবিরোধী, যেমন—সুদভিত্তিক অর্থনীতি, ব্যভিচারের বৈধতা বা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা।
এসব ইসলামে স্পষ্টভাবে হারাম। তাই শরিয়াহর পরিবর্তে মানব-প্রণীত আইন গ্রহণ করা ইসলামী আকীদার পরিপন্থী।
৩️⃣ সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সর্বদা সঠিক নয়
> “অধিকাংশ মানুষ সত্যের পথে চলে না।” — (সূরা ইউসুফ ১২:১০৩)
গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের উপর নির্ভর করে, অথচ সত্য সবসময় সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে নাও থাকতে পারে। ইসলামে সিদ্ধান্তের ভিত্তি সত্য ও শরিয়াহ, সংখ্যার ওপর নয়।
৪️⃣ ইসলামী শাসনব্যবস্থার বিকল্প প্রতিষ্ঠা
ইসলামে খিলাফত বা শরিয়াহনির্ভর শাসনব্যবস্থা নির্দেশিত হয়েছে। খলিফা নির্বাচিত হতেন বায়আতের মাধ্যমে, যা ছিল শরিয়াহনিষ্ঠ ও আল্লাহভীতির উপর ভিত্তি করে।
অন্যদিকে গণতন্ত্রে যে কেউ, এমনকি শরিয়াহবিরোধী ব্যক্তি পর্যন্ত, নেতৃত্ব লাভ করতে পারে — যা ইসলামী নীতির পরিপন্থী।
গণতন্ত্রকে জায়েজ বলার যুক্তি ও তার খণ্ডন
১️⃣ যুক্তি: গণতন্ত্র শূরার আধুনিক রূপ
অনেকে বলেন, ইসলামে যেমন শূরা (পরামর্শ) ব্যবস্থার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তেমনি গণতন্ত্রেও জনগণের অংশগ্রহণ ও ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। তাই গণতন্ত্র শূরার আধুনিক রূপ হতে পারে।
🔹 খণ্ডন:
ইসলামী শূরা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো শরিয়াহর অধীনতা।
শূরায় কোনো সিদ্ধান্ত আল্লাহর আইন অমান্য করে নেওয়া যায় না।
কিন্তু গণতন্ত্রে জনগণ ও প্রতিনিধি শরিয়াহর পরোয়া না করেই আইন প্রণয়ন করতে পারে।
অতএব, গণতন্ত্র শূরার অনুকরণ নয় — বরং তার বিকৃতি।
---
২️⃣ যুক্তি: জনগণের ভোট একটি আমানত
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া একটি আমানত বা দায়িত্ব। জনগণ তাদের প্রতিনিধিকে বেছে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে, যা ইসলামী দৃষ্টিতে আমানত পালন করারই অংশ।
🔹 খণ্ডন:
ইসলামে আমানত অবশ্যই শরিয়াহর সীমার মধ্যে থাকতে হবে।
যদি সেই ভোট বা প্রতিনিধিত্ব এমন কারও হাতে যায় যে শরিয়াহবিরোধী আইন প্রণয়ন করে, তবে সেটি আমানত নয় বরং গুনাহের কাজ।
অতএব, শরিয়াহ-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে জনগণের ভোটকে ইসলামী “আমানত” বলা যায় না।
---
৩️⃣ যুক্তি: সাহাবাদের বায়আত গণতন্ত্রের মতো
কেউ কেউ বলেন, ইসলামে খলিফা নির্বাচনে সাহাবারা বায়আত দিতেন, যা একধরনের জনগণের সম্মতি। এটি গণতন্ত্রের মতোই একটি জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক প্রক্রিয়া।
🔹 খণ্ডন:
সাহাবাদের বায়আত ছিল শরিয়াহর পরিপূর্ণ আনুগত্যের মধ্যে এবং শুধুমাত্র যোগ্য, তাকওয়াবান ব্যক্তির জন্য।
গণতন্ত্রে যে কেউ নির্বাচিত হতে পারে, এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধানের বিরোধী ব্যক্তিও।
অতএব, বায়আত গণতন্ত্রের মতো নয় — বরং শরিয়াহনির্ভর আনুগত্যের চুক্তি।
---
৪️⃣ যুক্তি: গণতন্ত্র জনগণের মতামতের মূল্য দেয়
অনেকের ধারণা, গণতন্ত্রে জনগণের মতামত ও অধিকার রক্ষা করা হয়, যা ইসলামের পরামর্শ ও ন্যায়বিচারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
🔹 খণ্ডন:
ইসলাম জনগণের মতামতকে মূল্য দেয়, কিন্তু সেই মতামত শরিয়াহর সীমার মধ্যে হতে হবে।
যেখানে মানুষের ইচ্ছা শরিয়াহর চেয়ে বড় হয়ে যায়, সেখানে আল্লাহর আইন অবমানিত হয়।
গণতন্ত্রে আইন পরিবর্তনের ক্ষমতা জনগণের হাতে — এটি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরোধী।
---
উপসংহার:
গণতন্ত্রে মানুষের ইচ্ছা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতই সর্বোচ্চ আইন,
আর ইসলামে আল্লাহর বিধানই একমাত্র আইন।
অতএব, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্র শর্তহীনভাবে গ্রহণযোগ্য নয় — বরং শরিয়াহনির্ভর না হলে তা হারাম ও শিরকের পথে নিয়ে যেতে পারে।