01/10/2025
❤️গোবিন্দ ছিল সুনীতা ও তার তিন সন্তানের পৃথিবী, তাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন। প্রতিদিন ভোরে, সে তার নড়বড়ে কাঠের নৌকা নিয়ে নিচের দিকে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে মাছ ধরতে যেত। তাদের বাড়িটি, কাদা ও খড়ের তৈরি একটি কুঁড়েঘর, বসেছিল ভারতের সুন্দরবনের একটি বিশাল নদীর তীরে। জায়গাটা একদিকে যেমন সুন্দর, অন্যদিকে তেমনি ভয়ঙ্কর—বাঘ এবং লবণাক্ত জলের কুমিরদের (Salties) রাজত্ব।
সেদিন, বাতাসে ছিল এক ধরনের অস্থির আর্দ্রতা। গোবিন্দ অন্যান্য দিনের মতোই সুনীতার কাছ থেকে বিদায় নিল, প্রতিশ্রুতি দিল তাদের প্রিয় এক ধরনের চিংড়ি মাছ নিয়ে ফিরবে। সে চলে যাওয়ার পর, সুনীতা ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, বিশেষ কিছু খেয়াল করল না।
সন্ধ্যার সময়, যখন সূর্য রক্তিম রঙ নিয়ে দিগন্তে ডুবে গেল, নদীর তীরে শুধু গোবিন্দের খালি নৌকাটি ফিরে এল। নৌকাটির সামনের অংশ ভাঙা, পাশে ছিল গভীর আঁচড়ের চিহ্ন। তারপর, প্রতিবেশীরা ভারাক্রান্ত মুখ আর চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সেই ভয়ঙ্কর খবরটি নিয়ে এল: একটা বিশাল কুমির, যাকে স্থানীয়রা 'কালো ছায়া' বলত, গোবিন্দ যখন জাল তুলছিল, তখন তাকে আক্রমণ করেছে। ঘোলা জলে শুধু ভাঙা দাঁড়ের একটি টুকরো খুঁজে পাওয়া গেল।
সুনীতার জগৎ পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। কুমিরটি কেবল একজন মানুষকেই খায়নি, সে একটি পরিবারের ভবিষ্যতকেই গিলে ফেলেছে।
ভয়ংকর বাস্তবতা এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম
পরের দিনগুলোতে, কুঁড়েঘরটিকে এক হিমশীতল নীরবতা গ্রাস করল। সুনীতা যেন এক জীবন্ত লাশ হয়ে গেল। বাচ্চারা, যাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির বয়স মাত্র চার, সারাক্ষণ জিজ্ঞেস করত: “বাবা কখন ফিরবে?” সে শুধু তাদের বুকে জড়িয়ে ধরত, চোখের জলে তাদের চুল ভিজিয়ে দিত।
গোবিন্দকে হারানো মানে হারানো—খাবার, রোজগার এবং ন্যূনতম নিরাপত্তা। মাছ ধরা ছিল তাদের একমাত্র জীবনধারণের উপায়, কিন্তু সুনীতা একজন নারী হিসেবে একা সেই বিপজ্জনক ম্যানগ্রোভে যেতে পারত না।
প্রথম শত্রু হয়ে দাঁড়াল ক্ষুধা। কিছু দিন পর, সুনীতা চোখের জল মুছে ফেলল। সে বুঝল, শোক সন্তানদের পেট ভরাবে না। সে ঘরের হাতে গোনা কয়েকটি তামার বাসন বিক্রি করে সামান্য চাল কিনল।
❤️প্রথম আঘাত: আতঙ্ক ও বিচ্ছিন্নতা
এই অঞ্চলের জীবন খুবই কঠিন। গোবিন্দের মৃত্যু কেবল আর্থিক বিপর্যয় আনেনি, এনেছিল এক গভীর মানসিক আতঙ্ক। কুমির কখন আবার আসবে? তারা কি আর কোনো দিন নদীর কাছাকাছি যেতে পারবে? সুনীতা প্রতি রাতে সামান্য শব্দেও চমকে উঠত, মনে করত কুমিরের শরীর ঘষটানোর শব্দ। এই ভয় তাকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে ফেলল, যা তার রোজগারের পথ আরও বন্ধ করে দিল।
❤️সম্প্রদায়ের সামান্য উষ্ণতা
সুন্দরবনে, প্রতিবেশীদের বন্ধনই হল জীবনরেখা। প্রথম দিনগুলোতে প্রতিবেশীরা কিছু মাছ আর চাল পাঠাল। গোবিন্দের ভাই, যদিও তার নিজের পরিবারও দরিদ্র, কিন্তু সে সুনীতার কুঁড়েঘরটি মেরামত করতে সাহায্য করল এবং তার দশ বছরের বড় ছেলেকে নিরাপদ কাজ শেখানোর প্রতিশ্রুতি দিল।
❤️কঠোর সংগ্রাম🫶
সুনীতা সিদ্ধান্ত নিল যে তাকে দাঁড়াতে হবে। সে মাছ ধরতে না পারলেও, মাছ শুকিয়ে বিক্রি করতে পারত। সে গ্রামের মহিলাদের একটি দলে যোগ দিল। এই মহিলারা নিরাপদ পুকুর বা নদীর অগভীর জায়গা থেকে ছোট মাছ কিনে আনত, তারপর সেগুলোকে কড়া রোদে শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করত।
এটি ছিল কঠিন কাজ। প্রখর রোদে তার ত্বক আরও কালো হয়ে গেল, মাছের আঁশ পরিষ্কার করতে গিয়ে তার হাতে কড়া পড়ে গেল। লাভ ছিল খুবই সামান্য, কিন্তু যখনই সে দেখত বাচ্চারা একবেলা গরম ভাত খেতে পাচ্ছে, তখনই সে বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পেত। সে গ্রামে মানুষের ছেঁড়া জাল সেলাই করা এবং ছোটখাটো কাজও শুরু করল।
ছায়ার মাঝে নতুন আলো
সময় ধীরে ধীরে পার হতে লাগল। সুনীতা এখন আর সেই দুর্বল বিধবা নয়, বরং সে এখন একজন দৃঢ় 'রক্ষক'। তার বড় ছেলে, যদিও কমবয়সী, এখন নদীর ধারে মালপত্র বইতে সাহায্য করে, কিছু পয়সা রোজগার করে।
জীবনের ক্ষত হয়তো কখনো সারবে না। যখনই নদীতে জোয়ার আসে, সুনীতার বুকটা কেঁপে ওঠে, যেন সে আবার শুনতে পায় সেই মারাত্মক জলের শব্দ। কিন্তু এখন, সে যখন তার সন্তানদের লেখাপড়া করতে, খেলতে ও বড় হতে দেখে, তখন তার চোখে এক নতুন জিনিস দেখা যায়—নির্মম ভাগ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সামান্য সুখের প্রতি গভীর মমতা।
এই পরিবারটির জীবন চিরকালের জন্য কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু তারা আর একা নেই। তারা নদীর ধারের বুনো ঘাসের মতো, ঝড়ের মুখে নুয়ে পড়েও একে অপরের ভালোবাসা আর সম্প্রদায়ের উষ্ণতায় শক্তভাবে শিকড় গেঁড়ে আছে। গোবিন্দের মৃত্যু ছিল একটি সমাপ্তি, কিন্তু সুনীতার এই ভয়ংকর সংগ্রাম, একটি পরিবারের কঠিন নতুন জীবন শুরু।