12/09/2025
'তুমি (আওয়ামী লীগ) অধম, তাই বলে আমি (বিএনপি) উত্তম হবো না কেন?'
ভেবেছিলাম ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কিছুই লিখব না, কিন্তু বিএনপি-পন্থী অনেক ফেসবুক যোদ্ধার নিজেকে না-সুধরানোর মনোভাব দেখে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। প্রথমেই আমি আমার ব্যক্তিগত একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করছি।
আমাদের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানার ১নং বাগান বাজার ইউনিয়নের একেবারে দূরবর্তী ও দুর্গম একটি প্রান্তিক এলাকায় অবস্থিত। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে একটি সরু (চিকন) খাল বয়ে গেছে—রুপাই খাল। লোকমুখে প্রচলিত আছে, এই ‘চিকন খাল’-এর নাম অনুসারে আমাদের গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে চিকনের খিল।
জনপ্রতিনিধিদের অবহেলা ও অনিচ্ছার কারণে এই খালের উপর কোনো ব্রিজ নির্মিত না হওয়ায় স্বাধীনতার ৫ যুগ পরেও হাজার হাজার মানুষকে এ খালটি হেঁটে পার হয়ে বহু কষ্টে পাহাড় বেয়ে আমাদের গ্রামে পৌঁছাতে হয়। তাই বর্ষার সময় যেমন চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদী, আমাদের দুঃখ ছিল এই চিকন খাল (রুপাই খাল)। এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা উন্নত কোনো এলাকায় বাড়ি না বানিয়ে এই পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি জনপদের মানুষকে ভালোবেসে পিতৃভিটায় প্রকৃতির ঋণ শোধ করার জন্য ছোট্ট একটি বাড়ি বানিয়েছি। ঐ পাহাড়ি জনপদের মানুষ কিংবা আমরা এই দুঃখটাকে মেনে নিতাম, কারণ বর্ষাকাল তিন থেকে চার মাসের বেশি স্থায়ী থাকত না। তাই বাকি সময়টা হাজারো ভালোলাগার স্মৃতি নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঐ পাহাড়ি জনপদের মানুষ বেশ আনন্দেই দিনাতিপাত করছিল।
ঐ গ্রামের মানুষের দুঃখ ও সমস্যার সূত্রপাত মূলত আওয়ামী লীগের কিছু পাতি নেতার অবৈধ বালি উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হয়। তবে যেহেতু বালি উত্তোলন খুব সীমিত পরিসরে ছিল, তাই ওই এলাকার মানুষ সরাসরি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তারপরও যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা এর প্রতিকারের জন্য নানা তদবির করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
শেখ হাসিনা ৫ই আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে আমাদের এলাকায় একজন কৃষককে হত্যা এবং আমার আপন মামাতো ভাইকে নির্মমভাবে পেটানোসহ আরো বহু অপ্রীতিকর ঘটনা ও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দূরদূরান্ত থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভাড়া করে এনে আমাদের এলাকার স্থানীয় বিএনপি নেতৃবৃন্দ রুপাই খালে অন্তত ৩০০-৪০০ গজ পরপর বালি উত্তোলনের ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পুরো পাহাড়ি জনপদকে বিপন্ন করে দেওয়ার এক হীন চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারা এমনভাবে বালি উত্তোলন করছে যে খুব শীঘ্রই আমাদের বাড়িসহ অন্তত ৫০টি বাড়ি ও বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই কাজটির সাথে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী জড়িত তারা উচ্চশিক্ষিত থেকে শুরু করে অশিক্ষিত—সবাই অন্তর্ভুক্ত। এবং সকল শ্রেণি-পেশার নেতৃবৃন্দকে আমি বহুবার অনুরোধ করেছি এ অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য। কিন্তু তারা আমাকে একটাই যুক্তি দেন—যেহেতু আওয়ামী লীগের আমলেও অবৈধ বালু উত্তোলন হয়েছে, তাই এখন অবৈধ বালু উত্তোলনে কোনো সমস্যা নেই 🥲।
এখন আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন—তারা অধম ছিল, তাই বলে আপনারা উত্তম হবেন না কেন?
আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, ডাকসু নির্বাচনের সাথে আমার বাড়ির পাশের খালে বালু উত্তোলনের সম্পর্ক কী? এর উত্তর হলো, এটি কেবল আমার গ্রামের চিত্র নয়—এটি সারা বাংলাদেশের চিত্র। বিএনপি নেতাকর্মীরা গত এক বছরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, অবৈধ মাটি উত্তোলন, অবৈধ পাথর উত্তোলন (সিলেটের ভোলাগঞ্জ) এবং নানান চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে যুক্ত হওয়ার কারণে ছাত্রদলের একজন পরিচ্ছন্ন নেতা এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে রাজপথ কাঁপানো জুলাই যোদ্ধা আবিদকেও খুব বাজেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হতে হয়েছে। তাই বিএনপি যত হম্বিতম্বি করুক না কেন, তাদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি যদি অব্যাহত থাকে তবে সামনে বিএনপির জন্য মহা চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে—যে চ্যালেঞ্জের কাছে হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো নতুন একটি ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। সেই ন্যারেটিভের কারণেই হাসিনা তার পতন ডেকে এনেছিল। আর তা হলো—যাকে তাকে রাজাকার ট্যাগ দেওয়া, পাকিস্তানি ট্যাগ দেওয়া, বট বাহিনী বলে কটাক্ষ করা, লুঙ্গির নিচে লুকিয়ে থাকা নেতা বলে উপহাস করা।
একটি কথা মনে রাখা উচিত—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা শুধু নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর নিয়ে পড়ে থাকে না; বরং তারা সারাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই তাদের নেতা নির্বাচন করেছে। এখানেই বিএনপির বয়স্ক নেতৃবৃন্দ তরুণদের পালস বুঝতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশকে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় রাখতে হলে বিএনপিকে জামায়াত, এনসিপিসহ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সকল শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
মো: কবির হোসেন,
লেকচারার (ইংরেজি বিভাগ) ৩৫ তম বিসিএস, চট্টগ্রাম কলেজ।