
13/06/2025
অজানা সন্ধ্যা
_________________________________
ডিসেম্বর, ২০২১। শীতের ঘন কুয়াশায় ঢাকা এক বিকেল। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। মামার বিয়ে উপলক্ষে নানাবাড়িতে ছুটি কাটাতে এসেছি। চারদিকে উৎসব, আলো, মানুষের হাসি — যেন সময় থেমে আছে আনন্দে।
কিন্তু আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক অজানা সন্ধ্যার ডাক….
বিয়ের কোলাহল শেষে একদিন আমি আর আমার ফুফাতো ভাই সাইফুল বের হলাম গ্রামের পথ ধরে। পুরনো একটা সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম—গ্রাম ঘোরার অজুহাতে একটু দূরে যেতে ইচ্ছা করছিল। দিনের শেষ আলো তখন ধীরে ধীরে নেমে আসছে।
আমরা পৌঁছালাম একটা পরিচিত জায়গায়—উপজেলার সবচেয়ে বড় কবরস্থান। কবরস্থানের দুই প্রান্ত দিয়ে চলে গেছে দুটো রাস্তা—একটি উত্তর দিকে, একটি দক্ষিণে। আমরা উত্তর দিক ধরে এগিয়ে গেলাম, পরিকল্পনা ছিল দক্ষিণ দিক দিয়ে বাড়ি ফিরব।
সেই সময়টা ছিল আসরের আজান শেষ হওয়ার কিছু পরে। কিন্তু শীতকাল বলে সন্ধ্যা যেন ছুটে আসছে পেছন থেকে, ধীরে ধীরে চারদিকের আলো নিভে আসছিল।
আমরা গোরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় বুঝতে পারলাম—আমরা ভুল পথে ঢুকে পড়েছি। স্থানীয় এক লোককে জিজ্ঞেস করে সঠিক দিক জেনেও আমরা যেন কোনো অদৃশ্য টানে এগিয়ে চলেছি ভুল দিকে...
চারদিক নিস্তব্ধ, এমনকি বাতাসটাও থেমে গেছে। হঠাৎই শুরু হলো ঝিঁঝিঁ পোকার পাগল করা শব্দ। আমাদের পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ যেন অনেক বড় কিছুর আগমনের পূর্বাভাস।
আমরা তখন বুঝতে পারি আমরা গোরস্থানের মাঝ বরাবর। একদিকে দাফন হওয়া মানুষের শান্ত কবর, অন্যদিকে আমাদের হৃদকম্পন। চারদিকের বাতাস ঠান্ডা, অথচ আমাদের শরীর ভেজা ঘামে। মনে হচ্ছিল, কারো দৃষ্টি আমাদের পেছনে লেগে আছে। কেউ হাঁটছে আমাদের সাথেই... কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
ঝাপসা আলো, হঠাৎ নিঃশ্বাসের শব্দ, মাঝে মাঝে শুকনো গাছের পাতায় হালকা চপচপ আওয়াজ...
১৫–২০ মিনিট পার হয়ে গেল। আমরা হেঁটে চলেছি, কিন্তু যেন বেরোনোর রাস্তা আর নেই। চারপাশ কবরের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের খোঁজ করা সেই মাটির রাস্তায় পৌঁছালাম — যেখানে মুহুরী নদী কবরস্থানের পাশে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। তার ধার ঘেঁষে ফেরার সেই দক্ষিণ দিকের পথ।
ঠিক তখনই ভেসে এলো মাগরিবের আজান।
কিন্তু আজানটাও ছিল অদ্ভুত। যেন অনেক দূর থেকে আসছে, শব্দে কোনো ভারী ক্লান্তি, হাহাকার। কানে বাজতেই শরীরে কাঁপুনি।চারপাশে মাগরিবের আযানের সুর ভেসে আসা বন্ধ হলো।
আমরা দৌড়ে বাড়ি ফিরি।
তবে আমাদের যাত্রা সেখানেই শেষ হয়নি। সেদিন রাতেই শুরু হয় নতুন আতঙ্ক — পেটে তীব্র ব্যথা, শরীর দুর্বল, বারবার বমি আর ডায়রিয়া। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলেও পেট ব্যাথা ভালো হলো না।
তিনদিন পরও যখন সুস্থ হই না, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আমাদের একজন বুযুর্গ হুজুরের কাছে নিয়ে যাওয়ার। তিনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কিছু একটা পড়লেন। তারপর বললেন:
“ওদের ওপর খারাপ চীনের প্রভাব পড়েছে।”
তিনি দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন, পানি দিলেন। কিছুদিনের মধ্যে আমরা সুস্থ হই।
কিন্তু আজও যখন কুয়াশা নেমে আসে, বা মাগরিবের ওয়াক্তে ঝিঝিঁ পোকা ডাকে — আমার মনে পড়ে সেই রাস্তাটা। কবরস্থানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া সেই যাত্রা, যেটা আমরা শুরু করেছিলাম নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু শেষ করেছিলাম কারো অজানা ইশারায়।
__________________________________________
© GolpoGraphie 2025 | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
এই গল্পের সমস্ত স্বত্ব GolpoGraphie কর্তৃক সংরক্ষিত। লেখকের অনুমতি ব্যতীত আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে অনুলিপি, পুনঃপ্রকাশ বা ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয়।
__________________________________________
📜 Disclaimer:
"অজানা সন্ধ্যা" গল্পটি একটি ভৌতিক থিমভিত্তিক সাহিত্যকর্ম, যা লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, লোকবিশ্বাস এবং কল্পনার মিশ্রণে নির্মিত।
গল্পের সূচনালগ্নের বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিত সত্য ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও, পরবর্তী অতিপ্রাকৃত ঘটনা ও অলৌকিক উপাদানগুলো সম্পূর্ণরূপে লেখকের কল্পনাপ্রসূত এবং সাহিত্যিক রচনার অংশ।
এই গল্পের উদ্দেশ্য পাঠকের মনে ভয়, কৌতূহল ও আবেগের সাড়া জাগানো—এতে কোনো ধর্মীয়, সামাজিক বা বাস্তবিক অনুভূতিতে আঘাত করার অভিপ্রায় নেই।
GolpoGraphie কেবলমাত্র সাহিত্যিক ও বিনোদনমূলক চেতনাকে প্রাধান্য দেয়।
#লেখালেখি #ভৌতিক #গল্প #হরর #কবর #কবরস্থান #জিন #জ্বীন