18/07/2025
আমার যখন তিন দিন বয়স তখন বাবা আমার মাকে একা রেখে চলে যায়। আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহ, বাড়ির চারপাশে পানি। বাজারের দিকে যেতে গেলে কলাগাছের ভেলায় করে যেতে হয়। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে আছে।
সেই দুর্দিনে মা তার দুই মেয়েকে নিয়ে একা হয়ে যায়। মাকে ছেড়ে বাবার পালিয়ে যাওয়ার একটা কারণ আছে। আমার জন্মের একমাস আগেই মধ্যরাতে বাবা মাকে বলে, দেখো এবার যদি মেয়ে হয় তবে কিন্তু তোমাকে রাখবো না। মা বাবার গায়ে হাত রেখে বলে, কি বলো এসব তুমি? মায়ের ছলছল করা চোখে বাবার মন একটুও গলে না।
আমার জন্মের পরে বাবার মন খারাপ হয়। মা ভেবেছিলো বাবা ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েকে কোলে তুলে নিবে। তবে বাবা তিনদিন পরেই পালিয়ে গেলেন। এক সপ্তাহ পরে খবর আসে বাবা আবার বিয়ে করেছেন। নদীর ওইপাড়ের শহরে নতুন বউ নিয়ে থাকে। লোকের কাছে খবর পাঠিয়েছে মা যেনো তার দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
মায়ের অবশ্য কোথাও যাওয়ার নেই। আমার নানাবাড়িতে কেউ নেই, ভিটেমাটি নদীতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে৷
মায়ের পাশে দাদা ভাই আর বড় চাচা দাঁড়ালেন। বাবার কাছে দাদু খবর পাঠালেন, সে যেনো আর কোনোদিন এই বাড়িতে না আসে আর যদি চিন্তা করে নতুন বউ নিয়ে এখানে আসবে তাহলে তাকে বড় দা দিয়ে কোপানো হবে৷
দাদু ছিলেন রাগী মানুষ, বাড়ির সবাই তাকে ভয় পেতো। বাবা তাই আর হয়তো বাড়ি আসবার সাহস করেনি।
মা দুই মেয়েকে নিয়ে এখানে থেকে যায়। দাদু বয়স্ক মানুষ, বয়সের ভারে এখন শরীর চলে না, কাজ করতে পারে না।
আমার বাবা চাচাদের আয়ের একমাত্র উৎস একটা মাছ ধরার নৌকা। এই নৌকাটা দাদু কিনেছে তেরোশো টাকায়, তারপর প্রতিবছর মেরামত করে চলে। সমুদ্রে যায় এই নৌকা নিয়ে।
আমরা দুই বোন তখন ছোটো সেই থেকে মা চাচা আর দাদুর সাথে নৌকায় মাছ ধরতে নদীতে চলে যেতো। দাদু কোনো কাজ করতে পারতো না নৌকায় বসে থাকতো, মা আর চাচা জাল তুলতো সেই জাল গুছিয়ে রাখতো। মাছ ছাড়িয়ে রাখতো, নদীর কোনদিকে গেলে মাছ পাওয়া যাবে, কোথায় স্রোত কম বেশি দাদু সেইসব বুঝিয়ে বলতেন।
বড় আপা বড় হওয়ার পরে মা আর চাচার সাথে নদীতে চলে যেতেন। আমি যেতে চাইতাম তবে আমাকে নিতো না, হয়তো ছোটো মানুষ বলেই নেওয়া হতো না। তবু একবার চাচাকে অনুরোধ করলে আমাকে নিয়ে যায়, নদীতে সেবার নৌকায় বসে আমার বমি আসে। এরপর আর কখনো যাওয়া হয়নি।
মা বড় আপা চাচা নদীতে যেতো, সাথে চাচা আরেকজন লোক নিতো কিংবা মাঝেমধ্যে দাদু যেতো। দাদুর বয়স বেড়েছে, শরীরে শক্তি পায় না আগের মতো তাই এখন নিয়মিত যেতে পারে না।
নদীতে সবসময় মাছ পাওয়া যেতো না, কিছু সময় আবার অবরোধ থাকে। পেট তো আর অবরোধ মানে না, নয় জনের পরিবার, নয়টা পেটে খাবার দিতে হয়। সেই সময়টায় বড় চাচা মাটি কাটা দলের সাথে কাজে যেতেন। চাচার একার আয়ে পরিবারে খাবার মিটানো হিমশিম হয়ে যেতো, কাছাকাছি মাটির কাজ থাকলে মা চাচার সাথে চলে যেতেন মাটি কাটার দলের সাথে।
আমার বয়স যখন তেরো বছর তখন নৌকায় চাচা আর মায়ের সাথে যাই। বড় আপার বিয়ে হয়েছে, সে থাকে শ্বশুরবাড়ি। আপার বিয়েতে বেশকিছু টাকা ধার করতে হয়েছে সেই টাকা মাছ বিক্রি করে পরিশোধ করতে হবে।
বিকালবেলা নদী থেকে মাছ নিয়ে আসলে সন্ধ্যায় বড় বাজারে চলে যেতাম একটা হ্যারিকেন নিয়ে। মা আর আমিই যেতাম। বাজারের এক কোনায় বসে মাছ বিক্রি করতাম, সব মাছ বিক্রি করতে করতে অনেক রাত হয়ে যেতো। মায়ের সাথে বাড়িতে ফিরতাম, হাঁটু সমান কাদা ভেঙে, কখনো বৃষ্টিতে পেয়ে যেতো। মা কলাগাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে মাথার উপর দিতো, সেই কলাপাতায় কোনোরকমে মাথা রক্ষা করে বাড়িতে ফিরতাম।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। এলাকার সবাই আমার বিয়ের কথা বলছে। মা চাইছেন বিয়ে দিয়ে দিতে। তবে তেমন ভালো ছেলে পায় না। মেয়ের মা মাছ ধরে, মাটি কাটে এসব শুনে পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙে দেয়। মা মাছ ধরা নৌকায় তার মেয়ে আর কি সংসারী হবে এমনও কথা শুনতে হয়েছে।
চাচা মায়ের সাথে এক রাতে বলেন, আমি বলি কি মুনিয়াকে আরো পরে বিয়ে দাও। পড়াশোনা করুক। মুনিয়ার স্যারের সাথে বড় বাজারে দেখা হলো, মুনিয়া আমার ভাইয়ের মেয়ে শুনে ওর বেশ সুনাম করলো। মুনিয়ার হাতের লেখা নাকি খুব সুন্দর। স্যার বললো ওরে পড়াইলে একদিন ভালো চাকরি করবে। বংশের ভিতরে এমনিতেও পড়াশোনা জানা মানুষ নেই, মেয়েটা যখন পড়াশোনায় ভালো পড়ুক।
মা বলে, ভাইজান পড়াশোনা করানো তো টাকার বিষয়। এতো টাকা কই পাবো?
চাচা বলেন, হয়ে যাবে টাকা। আর আমি স্যারদের কাছে যেয়ে অনুরোধ করবো, আমরা তো গরিব মানুষ বলবো কিছু কম রাখতে।
আমার বড় চাচা নিজের নাম লিখতে পারে না, টিপ সই দেন। সেই চাচার পড়াশোনার প্রতি টানেই ক্লাস এইটে আমাকে বিয়ে করতে হয় না।
স্কুল থেকে পরীক্ষায় সবার প্রথম হই। তবে কলেজ আমাদের এলাকা থেকে সাত কিলোমিটার দূরে, পুরো রাস্তা কাচামাটির। হেঁটে যেতে হবে, তারপর রাস্তার পাশে জঙ্গল।
ঠিক হয় সপ্তাহে তিনদিন আমি ক্লাস করবো, সেই তিনদিন নদীপথেই চাচা দিয়ে আসবে। যেহেতু আমাদের নৌকা আছে।
চাচা তিনদিন নৌকায় করে দিয়ে আসতো, বিকাল পর্যন্ত কলেজের পাশে বাজারে কাজ করতো। ট্রলারে জিনিসপত্র তুলে দিতো। কখনো কাজ শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো, সন্ধ্যায় নৌকায় চাচার সাথে বাড়িতে ফিরতাম।
সপ্তাহে দুদিন মা আর চাচার সাথে নদীতে নৌকায় চলে যেতাম। জাল টানতাম, কখনো নৌকার বৈঠা ধরে বসে থাকতাম। চাচার একটা রেডিও ছিলো, সেই রেডিওতো বাংলা ছবির গান চলতো। গান শুনতে শুনতে নদী থেকে জাল টেনে তুলতেন।
কলেজে পরীক্ষার রেজাল্ট দেখতে চাচার সাথেই আসি। আমাকে কলেজের রহমান স্যার খুব পছন্দ করতেন, স্যারের মেয়ে রুমা আমার সাথেই পড়তো।
কলেজের বারান্দায় আমাকে দেখে লাইব্রেরিতে ডেকে নেয়। আমার বুক কাঁপতে থাকে। চাচার দিকে তাকিয়ে বলেন, বুঝলা সোবহান তোমার ভাতিজী তো সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে এই দেখো। যদিও চাচা কিছুই বুঝে না, তবু স্যারের মুখে ভালো রেজাল্টের কথা শুনে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায়।
কলেজ থেকে বের হয়ে বাজার থেকে এক কেজি জিলাপি কিনেন। আমাকে দোকানে বসিয়ে জিলাপি খাওয়ান। বাড়িতে ফিরে সবাইকে জিলাপি দিয়ে জানায় আমার ভালো রেজাল্টের কথা।
গ্রামের সবাই বললো আর পড়াশোনার দরকার নেই, এবার যেনো আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তবে চাচা বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। আমাকে নিয়ে রহমান স্যারের সাথে কথা বলেন। কিভাবে শহরে ভর্তি করানো যায়, কেমন খরচ হবে, কোথায় থাকবো সেসব নিয়ে কথা বলেন।
চাচা রহমান স্যারকে অনুরোধ করে বলেন, আমি তো আর এসব চিনি না। আপনি একটু যাবেন মুনিয়াকে নিয়ে? রহমান স্যার বলে যাবো। চাচা বলেন, খরচাপাতি যা লাগে আমি দিয়ে দিবো চিন্তা করবেন না।
রহমান স্যারকে নিয়েই চাচার সাথে আমি প্রথমবার শহরে আসি। স্যারের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় থাকবার সুযোগ করে দেয়। তাদের ছেলেমেয়েকে পড়াতে হবে, আর এখানেই এই বাসার দুই মেয়ের সাথে এক বিছানায় আমি থাকবো।
চাচা আর রহমান স্যার পরদিন ভোরে বাড়ির দিকে চলে যায় আমাকে শহরে রেখে। চাচা যাবার সময় মাথায় হাত রেখে বলেন, মা আমি আবার আসবো একমাস পরেই। আর চিঠি দিবো, রহমান স্যারকে দিয়ে লেখাবো।
চাচা মাথায় হাত রাখতেই চোখে পানি এসে যায়। চাচার চোখেও পানি দেখি।
আমি যার বাসাতে থাকি সেই ভদ্রলোক পুলিশে চাকরি করেন। বাড়ির বাইরেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। বাড়ির সবাই ভালো মানুষ। একমাস পরেই আমাকে একটা জামা কিনে দেয়। শানু এবং শিউলীকে আমি পড়াই, শানুর মাকে ডাকতাম ফুপু। ফুপু সেবার আমাকে একটা জামা কিনে দেয়, সেই একটা জামা পরেই আমি ভার্সিটিতে যেতাম।
চাচা প্রথমে একমাস পরে একবার আসেন। তারপর বছরে দুবার আসতেন, আমি চাচার সাথে বছরে একবার বাড়িতে যেতাম, দশদিন সেখানে থাকতাম। তারপর শহরে কোনো লোক আসলে তার সাথে আবার শহরে আসতাম।
দেখতে দেখতে বহুবছর চলে যায়। আমাদের নৌকাটা কয়েকদিন পর পর ঝামেলা করে, মেরামত করতে হয়। চাচার ইচ্ছে একদিন বড় একটা নৌকা কিনবে সেই নৌকায় লোক রাখবে দুজন, তারা মাছ ধরবে। তবে চাচার ইচ্ছে ইচ্ছেই থেকে যায় নতুন নৌকা কেনা হয় না, পুরাতন নৌকা মেরামত করেই চলতে হয়।
আমাদের ভার্সিটির একজন শিক্ষক ছিলেন পত্রিকায় লিখতেন। পত্রিকায় স্যারের অনেক লেখা পড়িছি। একবার সাহস করে স্যারকে আমার কিছু লেখা দেই। স্যার আশ্বাস দেয় আমার লেখা পত্রিকায় ছাপা হবে।
সত্যি সত্যি একদিন পত্রিকায় আমার লেখা একটা ছোটোগল্প ছাপা হয় ‘নদীর জীবন’ শিরোনামে , যদিও স্যার কিছু সম্পাদনা করেন। যে গল্পে নদীর পাশের ঘর থাকা একটা পরিবারের কথা লেখা থাকে। এরপর স্যার আমার কাছে গল্প কবিতা চায়, প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতো।
পড়াশোনা শেষে সেই পত্রিকায় তিনমাস চাকরি করি। চাচাকে নৌকা মেরামত করতে কিছু টাকা দেই, দাদুর কিছু ওষুধ কিনে দেই।
পত্রিকায় কাজের আটমাস চলে যায়, একটা কলেজে চাকরির কথা চলছে। তবে কোনো আশার বানী দেখতে পাইনি। বেশকিছু চাকরির পরীক্ষা দিয়ে রাখা আছে।
সেদিন বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ঢাকা শহর একেবারে ফাঁকা, দুই একটা গাড়ি দেখা যায়। রিক্সা আসে থেমে থেমে। সেই বৃষ্টির ভিতরেই ছাতা নিয়ে বের হয়ে যাই।
ভার্সিটির কাছে আসতেই দেখি আমার বান্ধবী জয়িতা দাঁড়িয়ে আছে। জয়িতাকে নিয়ে আলতাফ স্যারের বাসাতে যাই। আজকে বিসিএসের রেজাল্ট দিবে দুপুরের দিকে, আলতাফ স্যারই আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্টদের রেজাল্ট দেখেন।
স্যার ভার্সিটির ভিতরেই কোয়ার্টারে থাকে। আমাদের দেখে সামনের ঘরে বসতে দেয়। জয়িতা আর আমি দুজনেই অপেক্ষা করতে থাকি। স্যারের স্ত্রী চা বিস্কুট দিয়েছে, তবে গলা দিয়ে কোনো খবার নামছে না।
স্যার কিছুসময় পরে তার ঘরের ভিতরে ডাকে, কম্পিউটারে রেজাল্ট দেখেন।
স্যার আমার দিকে তাকায়, হেসে বলে মুনিয়া মিষ্টির দোকানে যাও এক দৌড়ে। তোমার তো চাকরি হয়ে গেছে।
আমি কথা বলতে পারিনা, দুই চোখে পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। জয়িতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি।
জয়িতা বড়লোক বাবার মেয়ে, ওর বাবার নিজস্ব গাড়ি আছে। স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে ওর গাড়িতে করেই ঢাকা শহর ঘুরায়। আমি কাঁদতে থাকি গাড়িতে বসে, বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি।
চাচাকে চিঠি লিখতে বসে যাই। তবে কান্নায় কাগজ ভিজে যায় কিছুই লিখতে পারি না। শুধু লিখে জানাই চাচা আমার চাকরি হয়েছে, অনেক বড় চাকরি। আমার কলেজের শিক্ষক রহমান স্যারের কাছে একটা চিঠি লিখি। স্যারকে বলি চাচাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে।
একবছর পরে চাচাকে একটা ইঞ্জিনচালিত ট্রলার কিনে দেই। চাচা এখন ট্রলার দিয়ে মাছ ধরে, অবশ্য দুজন লোক রেখেছেন। শুধু ট্রলারে বসে থাকে তার রেডিও নিয়ে, নদীতে বসে গান শুনতে তার ভালো লাগে।
চাচা দুই বছরের ভিতরে মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে আরো দুটো ট্রলার কিনেন, একটা মাছের আরত দেয়। চাচাকে এখন এক নামে সবাই চিনে। বাড়িতে নতুন ঘর তুলেছেন। আমার বেতনের টাকায় সাথে চাচার ব্যবসার টাকায় বেশ ভালোই জীবন কাটে।
এর ভিতরে একদিন খবর আসে আমার বাবার সে নদীর ওইপাড়ে আছে। তার বউ ছেলেমেয়েরা হাসপাতালে ফেলে রেখে গেছে অসুস্থ অবস্থায়। দুদিন পরে সেখানেই মা রা গেছে, শেষ সময়ে কেউ পাশে ছিলো না তার। বড় চাচা লোক পাঠিয়ে লা শ বাড়িতে নিয়ে আসে।
আমার জীবন শুধু বড় চাচা মা আর দাদুকে নিয়ে। দাদু এখনো বেঁচে আছেন, লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন।
বড় চাচা যখন রেডিওতে খবর কিংবা গান শুনেন তখন তাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখি৷
প্রিয় পাঠক এই লেখাটা একজনের বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া৷ জীবন কখনো একরকম থাকে না, বদলায় এবং রহস্য ঘেরা।
বড় চাচার রেডিও এবং জীবনের গান
©-মুস্তাকিম বিল্লাহ
© Mosthakim Billa লিখা।