18/05/2025
সান্ডা: মরুভূমির নীরব প্রকৃতি-ইঞ্জিনিয়ার
ভূমিকা
শুষ্ক বালিয়াড়ি আর কাঁটাগাছের বৈরী পরিবেশে যে প্রাণী অনায়াসে টিকে থাকে, তার নাম সান্ডা বাংলায় অধিক পরিচিত ‘শণ্ডা’ বা ‘গুঁইসাপ-জাতীয় টিকটিকি’। বৈজ্ঞানিক নাম Saara hardwickii। মরু ও আধা-মরু এলাকার এই বিষ-নিরীহ সরীসৃপ পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত প্রজাতি একদিকে কৌতূহলোদ্দীপক অভিযোজন, অন্যদিকে বেআইনি শিকার আর কুসংস্কারের করাল ছোবল।
১. চেহারা ও পরিচিতি
দেহ লম্বায় ৩০-৪০ সেমি; পুরু, শক্ত আঁশ আর বর্মের মতো ‘কাঁটা-খচিত’ লেজ প্রাণরক্ষার প্রধান অস্ত্র।
রং সাধারণত বালির মতো হলদে-বাদামি; তাপমাত্রা ও আবাসভেদে হালকা রঙ বদলাতে পারে।
চোখ বড়, পলক নেই; মাথা চওড়া ও সরু চোয়াল সবুজ পাতা চিবোতে অনুকূল।
২. আবাস ও ভূগর্ভস্থ রাজ্য
থর মরুভূমি (ভারত-পাকিস্তান), গুজরাট, রাজস্থান থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব ইরান
সবখানেই বেলে মাটি দেখলেই এরা সুড়ঙ্গ খোঁড়ে। এক একটি গহ্বর জটিল গোলকধাঁধা
দৈর্ঘ্য: ১-৩ মিটার পর্যন্ত, কখনও শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে আরও বেশি।
কাজ: তীব্র গরমে শীতল আশ্রয়, শীতকালে ব্রুমেশন (শীতঘুম), শিকারি রুখে নিরাপদ হেডকোয়ার্টার।
এ কারণে বিজ্ঞানীরা সান্ডাকে ‘ইকো-ইঞ্জিনিয়ার’ বলেন এই গহ্বর অন্য ছোট স্তন্যপায়ী, সাপ, পোকামাকড়কেও আশ্রয় দেয়; মরুভূমি জীববৈচিত্র্যের হটস্পট তৈরি করে।
৩. খাদ্যাভ্যাস: শাক-সবুজ-বীজেই ভরপুর
বেশির ভাগ আগামি টিকটিকির বিপরীতে, সান্ডা প্রায় পুরোপুরি শাকাহারী। কাঁটাগাছ, তৃণ, বুনো ফুল-বীজ যা পায় তাই খায়। উচ্চত্র ফাইবার ও আর্দ্রতা তাদের শরীরকে দ্রুত ‘ওভারহিট’ থেকে বাঁচায়। দিনের গরমের ভাঁজে ভাঁজে বাইরে এসে খাবার নেয়, আবার গহ্বরে ঢুকে ‘এসি-ব্রেক’!
৪. প্রজনন চক্র
মার্চ-এপ্রিল মাসে জোড়া বাধে; মাটির গহ্বরেই স্ত্রী ৬-১০টি ডিম পাড়ে।
প্রাকৃতিক উষ্ণতা ও আর্দ্রতায় ৬-৮ সপ্তাহে ডিম ফেটে বাচ্চা বেরোয়।
বাচ্চারা প্রথম থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ; লেজের কাঁটা তুলনামূলক নরম, কিন্তু টিকে থাকার লড়াই তখনই শুরু।
৫. হুমকি ও সংকট
বিপদ ব্যাখ্যা
বেআইনি শিকার কথিত ‘সান্ডা তেল’ যৌনশক্তি বাড়ায় এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসে নির্বিচার হত্যা।
আবাস ধ্বংস চাষাবাদ, খনি-কার্যক্রম, নগরায়ণ মরুঅঞ্চলের নীরব ভূগর্ভ ভেঙে দিচ্ছে।
পোষা প্রাণীর ব্যবসা রঙিন টিকটিকি হিসেবে আন্তর্জাতিক পাচার বাড়ছে।
IUCN এর তালিকায় প্রজাতিটি Vulnerable অর্থাৎ বিলুপ্তির ভয় প্রকট।
৬. ‘সান্ডা তেল’ বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ
লোকবিশ্বাস: লেজের চর্বি গলিয়ে বানানো তেল পুরুষ যৌনক্ষমতা ও বাতব্যথা সারায়।
বিজ্ঞান বলছে: কোনও প্রামাণ্য ক্লিনিক্যাল ডেটা নেই। বরং অশিক্ষা-কুসংস্কারকে পুঁজি করে কালোবাজারি। অধিকাংশ দেশে শিকার, পাচার দণ্ডনীয় অপরাধ; জেল-জরিমানার বিধান স্পষ্ট।
৭. সংরক্ষণে করণীয়
1. সচেতনতা: স্কুল-কলেজ, সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচার ‘মিথ ভাঙুন, সান্ডা বাঁচান’।
2. নিরাপদ অভয়ারণ্য: মরুভূমি জাতীয় উদ্যান, সংরক্ষিত বনাঞ্চল সম্প্রসারণ; গহ্বরাঞ্চল চিহ্নিত করে ‘নো-মাইনিং জোন’।
3. আইন প্রয়োগ: বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইন শক্ত হাতে বাস্তবায়ন; সীমান্তে স্ক্যানার-ড্রোন নজরদারি।
4. স্থানীয় অংশীদারিত্ব: ইকো-ট্যুরিজম, গাইড-ট্রেনিং, গবেষণা-সহায়ক কর্মসংস্থানের মুনাফা স্থানীয়দের অথবা তারা শিকার বন্ধ করবে কেন?
৮. শেষকথা
সান্ডা শুধু মরুভূমির এক টুকরো জীবই নয়, পুরো একটি ইকোসিস্টেমের প্রাণপ্রবাহ। লেজের চর্বির মিথ্যা মোড়কে তাকে নিঃশেষ করা মানে মরুর জৈববৈচিত্র্য ও স্থানীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। কুসংস্কারে নয়, বিজ্ঞান-সতর্কতায় মানুষ-প্রকৃতির সহাবস্থানে প্রাণ পায় মরুভূমি, বাঁচে সান্ডা বাঁচে নীরব প্রকৃতি-ইঞ্জিনিয়ার।
#সান্ডা