জহিরুল আবেদীন জুয়েল
প্রকাশক, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
অধুনালুপ্ত বাংলার বাণীর সাংবাদিক ছিলেন তিনি, কাজ করতেন পাহাড় আর চায়ের শহর শ্রীমঙ্গলে। সেখান থেকে লিখতে লিখতে অনেক বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়ে গেল তার ঢাকায়। এমনকি তার লিটল ম্যাগাজিনেও সারাদেশ থেকেই লেখকরা লেখা পাঠাতেন। এভাবেই এই সময়ের একজন সফল প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েলের যাত্রা শুরু। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় এসে বন্ধু আদিত্য অন্তরকে সাথে নিয়ে শুরু
করেন প্রকাশনা সংস্থা। প্রথম বের করেছিলেন কবিতার বই। ওমর আলীর 'রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ছিলাম নয় মাস' এবং তানভীর আহমেদ হৃদয়ের 'পদচিহ্ন' দিয়ে প্রকাশনার জগতে তাদের পথচলা শুরু। যদিও ২০০০ সালের প্রথম দিকে জুয়েল ঢাকায় আসেন, চাকরি নেন বনানীর একটি রিক্রুটিং এজেন্সিতে। চাকরিতে মন বসাতে পারেন না জুয়েল। সারাক্ষণই সৃষ্টিশীলতা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সাহিত্যের ভাজপত্র 'ইত্যাদি' (সম্পাদক : জহিরুল আবেদীন জুয়েল) ও 'নবযাত্রা' (সম্পাদক : আদিত্য অন্তর) দিনে দিনে লিটলম্যাগে উন্নীত হয়েছে। চাকরি করলেও 'ইত্যাদি'র প্রকাশনা কিন্তু বন্ধ করেননি জুয়েল। ঢাকার বাংলাবাজারের একটি প্রেস থেকে লিটলম্যাগটি ছাপা হয়। বাংলাবাজারে সস্তায় ছাপা যায়, তাই বন্ধু আদিত্যের 'নবযাত্রা'ও বাংলাবাজার থেকে ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন জুয়েল। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? চাকরি যে আর ভালো লাগছে না তার। বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে জানালেন, তিনি আর চাকরি করবেন না, ব্যবসা করবেন। কিন্তু বাবা-মা তাতে সম্মতি দেয় না। তাদের এক কথা, 'হয় চাকরি কর, নয় চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আস, কিন্তু ব্যবসা করার নামে টাকা নষ্ট করা চলবে না।' আদিত্যের বাবা-মারও সম্মতি নেই ব্যবসার ব্যাপারে।
অনেকটা বিষাদক্লিষ্ট মনে ওরা দু'বন্ধু বাড়ি থেকে চলে আসেন। আগ-পিছু না ভেবে, বিকল্প কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে চাকরি ছেড়ে দিলেন জুয়েল।
চাকরি তো ছেড়ে দিলেন, কিন্তু কী করবেন এখন! সারাদিন বাংলাবাজারে আড্ডা দেন, রাতে মামা (আজিজুর রহমান)-এর বাসায় এসে ঘুমান। এ ছাড়া আর কাজ নেই। এভাবেই চলছে তাদের দুজনের দিন।
২০০৩-এর জুলাই। সিদ্ধান্ত হয় দুজনে মিলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। মৌলভীবাজার থেকে এক লেখক এলেন একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে। পরামর্শ চাইলেন, তার পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে কীভাবে বের করা যায়। জুয়েল ও আদিত্য সিদ্ধান্ত নেন, বইটি তারাই বের করবেন। সেদিন রাতেই মৌলভীবাজারের আরেক কবি বন্ধু মুজাহিদ আহমদের উপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক হলো তার লিটলম্যাগের নামে—ইত্যাদি প্রকাশন। স্লোগানও ঠিক করা হলো, 'আপনার সন্তানের হাতে বই তুলে দিন, সে বিকশিত হবে ফুলের সৌরভ নিয়ে।' প্রথম বইটিতে প্রকাশনার নাম ছিল 'ইত্যাদি প্রকাশন'। কিন্তু পরবর্তীতে এ নাম পরিবর্তন করে 'ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ' রাখা হয়। সেই থেকেই শুরু ইত্যাদির পথ চলা। ইত্যাদির লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতে নতুনমাত্রা যোগ করে লেখক-প্রকাশকদের সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হাতে মানসম্মত সৃজনশীল ও মননশীল বই তুলে দেওয়া। নবীন-প্রবীণ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় শতাধিক।
২০০৩ থেকে ২০১৬ সাল—এ দীর্ঘ সময়ে নানা ধরনের প্রকাশনার জন্য ইত্যাদির অর্জনও অনেক। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০০৯ সালে সেরা মানের গ্রন্থ সম্মাননা এবং ২০১১ সালে সর্বাধিক মানসম্মত গ্রন্থ প্রকাশের জন্য শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বই তিন বার এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার, একবার করে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ও জেমকন সাহিত্য পুরস্কার জিতেছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিত অংশগ্রহণ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত বইমেলাতেও রয়েছে ইত্যাদির অংশগ্রহণ। ২০১২ থেকে ২০১৯ সালে সাতবার আমেরিকার নিউইয়র্কে বাংলা বইমেলায় এবং ২০১২, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ সালের লন্ডনে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলায় এবং ২০১৫ সালে আগরতলা (ভারত) বইমেলায় অংশগ্রহণ করে। এই হচ্ছে ইত্যাদির পথচলার গল্প।
জহিরুল আবেদীন জুয়েল
ডাকনাম : জুয়েল
জন্ম তারিখ ও স্থান : ২৯ ডিসেম্বর, মৌলভীবাজার
মায়ের নাম : সুরজাহান বেগম
বাবার নাম : জয়নাল আবেদীন
বোন : সুরাইয়া নাসরিন সুমি
স্ত্রী : জুলেখা আক্তার জুলি
সন্তান : মিনহাজুল আবেদীন সিয়াম ও জান্নাতুল আবেদীন হৃদি
প্রিয় মানুষ : বাবা-মা
প্রিয় উক্তি : সবকিছুর আগে ভালো মানুষ হও
প্রিয় পোশাক : শার্ট ও প্যান্ট
অবসর কাটে যেভাবে : বই পড়ে ও গান শুনে
সাফল্যের সংজ্ঞা : জীবনটা সার্থক করা, ন্যায়ের সঙ্গে বেঁচে থাকা।