
03/07/2025
“অন্ধকারের পরে আলো”
=================
"আলো নিভে গেলে চেনা মুখগুলোও অচেনা হয়ে যায়।"
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ ও নিষ্ঠুর রাজনৈতিক অন্ধকারে দলটি কাটিয়েছে পনেরোটি বছর। সময়ের হিসেব ছিল না, শুধু ছিল ক্ষতির হিসেব—প্রাণের ক্ষতি, বিশ্বাসের ক্ষতি, সাহসের ক্ষতি।
রাশেদ করিম যখন প্রথম জেলে গেলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩২। তিনি ছিলেন এক সময়ের উদ্যমী ছাত্রনেতা। বুকভরা স্বপ্ন, মুখভরা বক্তব্য, হাতে দলীয় পতাকা। দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে সেই পতাকা অনেকবার রক্তে ভিজেছে, নিজের রক্তে—সেই রক্ত কেউ দেখেনি।
রাত ৩টা। বৃষ্টি পড়ছে টিনের চালে। গাজীপুরের একটি পরিত্যক্ত গোডাউনে চোখ বাঁধা অবস্থায় রাশেদকে রাখা হয়েছে। তাঁকে ধরে এনেছে গোয়েন্দা বাহিনীর অজ্ঞাত একটি দল। অভিযোগ? দলীয় মিটিংয়ে অংশগ্রহণ। তারা মারছে, আবার বলছে—“আরো করবি দলীয় রাজনীতি?”
রাশেদের ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে, কিন্তু তাঁর চোখে ভয় নেই। তিনি শুধু বললেন,
“দেশের মালিক জনগণ, এই অন্যায়ের বিচার একদিন হবেই।”
দিনগুলো কেটেছে নির্যাতনে। কয়েকজন নেতাকে গুম করা হয়েছে। অনেকে ভয়ে আত্মগোপনে। কেউবা পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। দলের অফিসগুলো বন্ধ, পোস্টার ছেঁড়া, পতাকা পোড়ানো—তবু কিছু মানুষ বুক বেঁধে ছিল। তারা পরিচয় গোপন করে থেকেছে, কখনো মসজিদের খতিব, কখনো মুদি দোকানদার, কখনো টিউশনির শিক্ষক হয়ে।
রাশেদের স্ত্রী, শবনম ছেলেকে নিয়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রতিবেশীরা বলেছিল, “তোমার স্বামী পাগল! এসব করে কী হবে?”
তিনি শুধু বলতেন—
“যে ভালোবাসা মানুষ ও দেশের জন্য, তা কখনো হারায় না।”
এভাবেই চলে গেছে পনেরোটি বছর।
পথে পথে হোঁচট, রক্ত, গালি, অবমাননা, মামলা, হামলা, জেল, গুম।
তবুও কিছু মানুষ, কিছু নাম—মাটি ও মানুষের সঙ্গে গেঁথে থেকে গেছে।
তাদের জন্যই দলটির নামটুকু মুছে যায়নি।
আরেকটা দৃশ্য—ঢাকা শহরের এক পুরনো গলিতে রাশেদ মুক্তি পেয়ে হেঁটে চলেছে। চারপাশে এখনও সরকারি দলের পোস্টার। চায়ের দোকানে ফিসফিস করে কেউ বলছে,
“শুনছো? আন্দোলনে মানুষ নামতেছে।”
“আগের সরকার পালাইতেছে নাকি?”
“জানো, রাশেদ ভাই আবার ফিরে আসছে!”
কোনো একজনের কণ্ঠে ভরসা:
“সব শেষ হয় না। কিছু গল্প শুরু হয় শেষ থেকে।”
"আশা একদিন নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়ায়, ঠিক তখনই যখন সবকিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত বলে মনে হয়।"
বছরের পর বছর ধরে সহ্য করা নিপীড়ন আর অবিচার এক সময় গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। পনেরো বছর নিঃশব্দে সহ্য করার পর জনতার কণ্ঠে জমে থাকা ক্রোধ আগুনের মতো বের হয়ে এলো।
শুরুটা ছোট ছিল— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোটা আন্দোলন দিয়ে । ছাত্রীদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে এবং এক তরুণকে বিনা কারণে গুলি করে মেরে ফেলেছিল ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার বাহিনী। ভিডিওটা ভাইরাল হলো। তাতেই কেঁপে উঠল ঘুমন্ত জনতা। ছেলেটির রক্তে ভিজে ছিল দেশের পতাকা। তার মা বলেছিলেন—
“আমার ছেলেকে মেরেছে যারা, তাদের বিচার হবে জনতার রায়ে। ভোটের দিন আসবে। সেই দিন ফিরবেই।”
এই একটি বাক্য যেন জাগিয়ে তুলল ঘুমন্ত জাতিকে।
শুরু হলো বিক্ষোভ। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারপর রাজপথে। একে একে শ্রমিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী, এমনকি ভীত-সন্ত্রস্ত ব্যবসায়ীরাও নামতে শুরু করল রাস্তায়।
পথে পথে ধ্বনি উঠল—
“দুর্নীতির সরকার চাই না!”
“ভোটাধিকার ফিরিয়ে দাও!”
“গুম-খুনের বিচার চাই!”
আরেক রাতে শাহবাগে লক্ষ জনতার মিছিল থেকে কেউ চিৎকার করে উঠল—
“রাশেদ ভাই কোথায়?”
একটি স্লোগান ছড়িয়ে পড়ল শহর থেকে শহরতলি, গ্রাম থেকে গঞ্জে— “রাশেদের মতো ত্যাগী মানুষ চাই নেতৃত্বে।”
এরপরের ঘটনা যেন ছিল টর্নেডোর মতো।
পুরনো সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের মুখে ভয়।
অনেকে পালিয়ে গেল বিদেশে।
অনেকের বাড়ি ঘেরাও হলো।
গাড়িতে আগুন, প্রাসাদসম বাড়ির সামনে গালিগালাজ,আর ভাঙা গেটের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি জনতা।
অবশেষে তারা পালাতে বাধ্য হলো।
ক্ষমতা ছেড়ে, দুর্নীতি গিলে, একে একে সবাই দিশেহারা হয়ে বিদেশে আশ্রয় নিল।
দেশের ইতিহাসে আবার একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন করা হলো।
নতুন এই সরকার অস্থায়ী, কিন্তু চূড়ান্তভাবে নিরপেক্ষ ও কঠোর।
তাদের লক্ষ্য:
স্বচ্ছ নির্বাচন
সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ
রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা পুনরুদ্ধার
রাশেদ করিম তখন ছিলেন গাজীপুরে, এক ছোট মসজিদের পাশের ঘরে। হঠাৎ একদিন তাঁর কাছে একটি ফোন আসে।
অপর প্রান্ত থেকে কেউ বলেন—
“রাশেদ ভাই, আপনাকে দরকার।
জনতা আপনাকে ডাকে"
চিন্তার বিষয়-
"তুমি যখন অন্ধকার থেকে উঠে এসো, সেই অন্ধকার যদি তোমার ভেতরেই রয়ে যায়—তবে তুমি কাকে মুক্ত করবে?"
ক্ষমতার দরজা এখনও খোলেনি, নির্বাচন আসেনি, তবে বাতাসে জয়ধ্বনি।
এমন এক সময়—যখন দলের সাধারণ কর্মীরা স্বপ্ন দেখছে, তখন কিছু ত্যাগী নেতাকর্মী, যারা দুঃসময়ে সামনে ছিল, এখন হঠাৎ করে অস্থির হয়ে উঠছে।
রাশেদ করিম তখন দলের পুনর্গঠনে ব্যস্ত। জেলা-উপজেলায় সম্মেলনের পরিকল্পনা, সৎ ও শিক্ষিত কর্মীদের সংগঠনে আনার চেষ্টা। কিন্তু হঠাৎ একদিন ফোন পেলেন পুরাতন সহযোদ্ধা মাহফুজ ভাইয়ের কাছ থেকে।
“রাশেদ, মোনাওয়ার কবিরকে নিয়ে সাবধান হ।
সে এখন নিজের একটা বাহিনী বানিয়ে ফেলেছে।
চাঁদার লিস্ট করছে—কে কোথায় বসবে, কে প্রার্থী হবে, সবই ঠিক করে ফেলছে।
কে কাজ করবে, কে করবে না, সেটাও নাকি এখন সে বলে দেয়।”
মোনাওয়ার ছিল এক সময়কার ছাত্রনেতা। রাশেদের সঙ্গেই ছিল আন্দোলনে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন । জেলে না গেলেও গা ঢাকা দিয়েছিল অনেক বছর।
সেই সময় তার আচরণ ছিল অন্তর্মুখী, অল্প কথা বলত।
কিন্তু সরকার পালানোর পর যেন তার রূপ বদলে যায়।
ঢাকার মিরপুরে একটা অফিস দখল করে বসে।
পাশে কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক।
লোকজন বলছে— “ওই অফিসে না গেলে , তাকে না মানলে গায়ে হাত তোলে।”
একদিন এক সাধারণ কর্মী—সাব্বির, গিয়ে দলের পোস্টার লাগাতে চেয়েছিল।
সে বলে,
“ভাই, পোস্টার লাগাতে চাই। এলাকার কিছু ছেলে তৈরি করছি।”
মোনাওয়ার গর্জে ওঠে—
“তোকে কে বলেছে পোস্টার লাগাতে? আমি অনুমতি দিয়েছি?”
“আমার অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু করবে না।”
লোকজন চুপসে যায়।
এরপর শুরু হয় ভেতরের মারামারি।
এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের অফিসে হামলা করে।
প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধার ছেলেকে দলীয় পদের লোভে খুন করে মোনাওয়ারের এক কর্মী।
কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।
রাবেয়া সুলতানা, যিনি দুঃসময়ে নারীদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছিলেন, এখন ঘরে বসে কাঁদেন।
তার কথায়—
“এরা যদি এমন হয়, তবে আমরা কাদের জন্য লড়লাম?”
রাশেদ করিম বুঝতে পারেন,
বাইরের শত্রু বিদায় হয়েছে,
কিন্তু ভেতরের শত্রু এখন আরও ভয়ানক।
একদিন তিনি বলেন—"যাদের কাঁধে ভর করে ইতিহাস তৈরি হয়, অনেক সময় তাদেরকেই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়—ক্ষমতার দাম্ভিকে।"
বহু বছর ধরে দলে নিষ্ঠাভরে কাজ করা হাজার হাজার সাধারণ কর্মী যখন শুনল, ক্ষমতাসীন দল বিদায় নিয়েছে—তারা আশায় বুক বাঁধল।
তারা ভাবল, এখন তারা সম্মান পাবে, কাজের সুযোগ পাবে, দলীয় ভবিষ্যতের অংশ হবে।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল উল্টো।
‘মাটি ও মানুষের’ কর্মীদের লাঞ্ছনা
সাব্বির হোসেন, এক সময়ের সাহসী যুবক, সাতবার জেল খেটেছেন, একবার গুলিতেও আহত হয়েছিলেন।
তিনি এলাকা থেকে দশজন নতুন কর্মীকে নিয়ে শহরের দলীয় অফিসে গেলেন।
মনে ছিল আশা—পুরনোদের মূল্যায়ন হবে।
কিন্তু গেটেই আটকে দেওয়া হয়।
এক দালালনামা নেতা তাকে দাঁড় করিয়ে বলে—
“এইসব পুরান পচা কংক্রিট লাগবে না এখন। যারা পয়সা দেবে, তারাই থাকবে। ফিরে যাও।”
সাব্বির থতমত খেয়ে বলে,
“ভাই, আমি তো দলের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম।”
লোকটা হেসে বলে—
“বেশি নাটক করিস না। সময় বদলাইছে। তুই এখন বেকার ইতিহাস!”
রাবেয়া সুলতানা, যিনি এক সময় নারী আন্দোলনের নেতা ছিলেন,
তিনিও একটি সভায় যেতে গিয়ে অপমানিত হন।
সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকটি তাকে বলে—
“আপনি তো এতোদিন মাঠে ছিলেন না। হঠাৎ এখন কিসের সভা-ভালোবাসা?”
“আপনি জানেন না, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে?”
রাবেয়ার চোখে জল এসে পড়ে।
তিনি বোঝেন,
যে দলে তিনি মনের খাঁচা খুলে কাজ করেছিলেন, সেই দল এখন তাকে দেখে না—জানে না।
এসব ঘটনা শুধু এক-দুই জায়গায় না।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এমন অপমান আর অবহেলার কাহিনি।
দলীয় অফিসে সাধারণ কর্মীদের বসতে দেওয়া হয় না।
জেলা-উপজেলায় “অন্তঃপট সিন্ডিকেট” তৈরি হয়—যারা টাকার বিনিময়ে পদ দেয়।
স্লোগান বদলে যায়—
“ত্যাগ নয়, টাকা চাই।”
আর সাধারণ মানুষ?
তারা দলীয় প্রার্থীর গায়ে পচা ডিম ছোঁড়ে,
ফেসবুকে লিখে—
“আমরা এই দলকে ফিরিয়ে আনিনি, চাঁদাবাজদের রাজত্ব দিতে।”
রাশেদ করিম এসব দেখে রাতে ঘুমাতে পারেন না।
একদিন পুরনো একটি পোস্টার বের করেন—
যেখানে লেখা—
“আদর্শে গড়া সংগ্রামী দল”
সে লেখার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন—
“এই শব্দগুলো এখন শুধু স্মৃতি। অথচ আমরা ভেবেছিলাম এগুলো ভবিষ্যৎ হবে।”
"যখন নির্দেশ আসে না ওপর থেকে, তখন নিচের হৃদয়গুলো জেগে উঠে নিজের পথ খোঁজে।"
দলের ঐতিহ্য ছিল এক কঠিন শৃঙ্খলার। একসময় নেতার এক কথায় হাজার মানুষ পথে নামত। কিন্তু এখন?
সবাই বলছে, “উপরে কেউ নেই। যারা আছে, তারা নিজের ভাগের জন্য ব্যস্ত। আর নিচের দিকে, আদর্শ মৃত।”
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আসন্ন।
কিন্তু বিরোধী দলটির ভেতরে নেতৃত্ব নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব।
জেলা ও মহানগরের নেতারা নিজের মতো করে সভা ডাকছেন, নিজের লোক বসাচ্ছেন, নিজের নামে দল চালাচ্ছেন।
রাশেদ করিম বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় এক নেতাকে ফোন করলেন।
জিজ্ঞেস করলেন—
“ভাই, সম্মেলন হবে কবে?”
উত্তর এল—
“সম্মেলন বাদ দাও, এখন যেভাবে চলছে চলুক। সময়মতো সবাই বুঝে যাবে কে আসল নেতা।”
রাশেদ ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কারন তিনি ছিলেন আদর্শবান পিতার উরসজাত সন্তান। তার পিতা কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করে নাই। তিনিও এই দলের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন, এমপি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন। আজ বেঁচে নাই। পিতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে রাশেদের মধ্যে। তাইতো এত জনপ্রিয় । রাশেদ ভাবে-
“এই কথাটাই তো আমাদের শেষ করে দিচ্ছে। সবাই বুঝে যাবে মানে কেউ কিছু বলবে না, কেউ কিছু করবে না।”
কিছু সাহসী ও শিক্ষিত তরুণ কর্মী, যারা দলের নিচতলার সংগঠনে সক্রিয় ছিল, তারাই প্রশ্ন তুলতে শুরু করল।
মেহেদী হাসান, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি ছাত্র জীবনে রাশেদের পিতার বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে দলে এসেছিলেন, মেহেদী এক সভায় স্পষ্ট বললেন—
“আমরা চাই নেতৃত্বে আসুক তারা, যারা নির্যাতিত হয়েছেন, জেল খেটেছেন, ত্যাগ করেছেন।
আমরা টাকাওয়ালাদের দখলে দল দেখতে চাই না।”
সেই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
হাজার হাজার কমেন্ট—
“ঠিক কথা বলেছে।”
“এটাই তো আমরা বলতে চাই।”
“রাশেদ ভাই, ফিরে আসুন।”
দলের একাংশ এখন চিন্তা করছে,
শুধু নির্বাচন জেতাই যথেষ্ট নয়।
জিতলে যদি টেন্ডারবাজরা আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই ত্যাগ-তিতিক্ষা বৃথা যাবে।
রাশেদ নিজেই এক বৈঠকে বলেন—
“দল বাঁচাতে হলে চিন্তা বদলাতে হবে।
নইলে এই দলে শুধু ক্ষমতা থাকবে, আদর্শ থাকবে না।
আর আদর্শহীন ক্ষমতা শয়তানের হাতে বন্দুক।”
রাশেদ, মেহেদী, রাবেয়া এবং আরও কিছু ত্যাগী কর্মী মিলে
একটি "পুনর্গঠনের প্ল্যাটফর্ম" তৈরি করেন।
তারা বলেন—
“আমরা দল ভাঙছি না, কিন্তু দল বাঁচাতে চাই।”
তাদের উদ্দেশ্য—
সব জেলার ত্যাগীদের একত্র করা
সুস্পষ্ট নীতি ও আচরণবিধি তৈরি
দলীয় নেতৃত্বে নৈতিকতা ফেরানো
"আলো যখন ফিরে আসে, তার সঙ্গে আসে প্রতিধ্বনি—ভবিষ্যতের ডাক আর অতীতের হিসেব।”
নতুন কিছু শুরু হয়েছিল নিঃশব্দে।
রাশেদ করিম, রাবেয়া সুলতানা, মেহেদী হাসান এবং আরও কিছু নীতিবান কর্মী গড়ে তুলেছিলেন এক প্ল্যাটফর্ম—
“আদর্শ পুনর্গঠন পরিষদ”।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট:
দলীয় আদর্শ ফিরিয়ে আনা
ত্যাগীদের স্বীকৃতি দেওয়া
টাকার বদলে চরিত্রকে প্রাধান্য দেওয়া
দলকে গডফাদার-মুক্ত রাখা
তারা বলতেন—
“আমরা দল ভাঙছি না, আমরা দলকে বাঁচাচ্ছি।”
তাদের ছোট ছোট বৈঠক একসময় পরিণত হলো বড় মিছিল ও জনসভায়।
তাদের পোস্টার আলাদা ছিল—
কোনো নেতার ছবি নয়,
ছিল রক্তাক্ত দলের প্রতীক, তার নিচে লেখা—
“তোমার ত্যাগ ব্যর্থ হতে দেবে না।”
জনতা সাড়া দিল।
শহর-বন্দরে মানুষ বলল—
“এই তো আমাদের কথা।
আমাদের রক্ত-ঘাম দিয়ে গড়া দল ফেরত চাই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবার একত্রিত হলো।
শ্রমিক সংগঠন বলল—
“আমরাও আছি। এখন থেকে আদর্শ ছাড়া কাউকে মানা হবে না।”
দলের কিছু দুর্নীতিবাজ পুরনো নেতা, যারা সিন্ডিকেট চালাত,
তারা আঁতকে উঠল।
তারা ভাবল—
“রাশেদদের দমিয়ে না রাখলে, আমাদের ব্যবসা শেষ।”
তাদের চক্রান্ত শুরু হলো।
ফেসবুকে মিথ্যা প্রচার চালানো হলো—
“রাশেদ করিম সরকারপন্থী হয়ে গেছেন।”
“এই প্ল্যাটফর্ম দল ভাঙার জন্য বানানো।”
এক রাতে ঢাকায় রাশেদের গাড়িতে হামলা হয়।
তবে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
সেই হামলার ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
মানুষ চিৎকার করে ওঠে—
“আর না! আবার চক্রান্ত, আবার রক্ত?”
এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের একজন নীতিবান কর্মকর্তা,
মুরাদুল ইসলাম,
রাশেদ করিমের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করেন।
তিনি বলেন—
“জনগণ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আপনারা এগিয়ে গেলে সরকার সহায়তা করবে সুষ্ঠু নির্বাচন ও দলীয় পুনর্গঠনে।”
রাশেদ উত্তর দেন—
“আমরা চাই না কোনো পক্ষপাত।
আমরা চাই দল হোক জনগণের, পয়সাওয়ালাদের নয়।”
তখনই তারা ঘোষণা দেন—
আগামী মাসে “জাতীয় আদর্শ সম্মেলন” হবে,
যেখানে সব জেলার ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীরা আসবেন,
এবং একটি নতুন নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলার রূপরেখা তৈরি হবে।
"যখন চারদিক ধ্বংসে ডুবে থাকে, তখন একফোঁটা আশাও পৃথিবী বদলে দিতে পারে।"
নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এসেছে।
সারা দেশে অস্থিরতা।
পুরনো নেতারা নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত।
আর নতুনদের নিয়ে মানুষের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক ধরনের আশাবাদ।
“আদর্শ পুনর্গঠন পরিষদ” এখন গণজোয়ারে রূপ নিয়েছে।
বিভিন্ন জেলা থেকে আসছে দলীয় কর্মীরা, যাঁরা বছর ধরে অবহেলিত ছিলেন।
সবার একটাই দাবি—
“ব্যক্তি নয়, আদর্শ হোক মূল নেতৃত্ব।”
এখন দল দাঁড়িয়ে আছে দুটো পথে:
পুরনো পন্থা:
চাঁদাবাজি, গডফাদার, টাকা, শক্তি ও দখলের রাজনীতি।
নতুন পথ:
নৈতিকতা, ত্যাগ, আদর্শ, স্বচ্ছতা ও গণভিত্তির রাজনীতি।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক বিশেষ বৈঠক বসে।
রাশেদ করিম, মেহেদী হাসান, রাবেয়া, মোনাওয়ার কবির, এবং অন্যান্য প্রভাবশালী নেতারা উপস্থিত।
মোনাওয়ার হুঙ্কার দেয়—
“রাজনীতি কোনও আদর্শের খেলা না, এটা ক্ষমতার খেলা!
আদর্শ দিয়ে ভোট কেনা যায় না।”
রাশেদ শান্ত কণ্ঠে বলে—
“ভোট কেনা যায়, তবে মানুষের হৃদয় কেনা যায় না।
আমরা ভোট নয়, আস্থা অর্জন করতে চাই।”
বৈঠক উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
সম্মেলনের আগের রাতে রাশেদের প্ল্যাটফর্মের একটি মিছিলের ওপর হামলা হয়।
তিনজন আহত, একজন নিহত।
রাশেদ ঘটনাস্থলে এসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে
“এটা আমাদের শেষ লড়াই নয়,
এটা এক নতুন শুরু।
আমরা মরে গেলে একটা আদর্শ বাঁচবে।”
এই বক্তব্য ভাইরাল হয়।
মানুষ ফুঁসে উঠে।
সারাদেশে প্রতিবাদ শুরু হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়ে দেয়—
যে দল শৃঙ্খলা ফেরাতে পারবে না, তাদের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে।
এবার কেন্দ্রে চাপ তৈরি হয়।
জনতার চাপ, আন্তর্জাতিক চাপ, ও দলীয় কর্মীদের দাবিতে
দলীয় পুনর্গঠন প্ল্যাটফর্মের রাশেদ করিমকে প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
মোনাওয়ার ও তার গ্যাং একপাশে সরে যেতে বাধ্য হয়।
রাশেদ ঘোষণা দেন—
“এই নির্বাচন হবে জনগণের।
আমরা এমন প্রার্থীদের দিচ্ছি যারা জেল খেটেছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে একটিও দুর্নীতির অভিযোগ নেই।
আমাদের প্রতিশ্রুতি—সততার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন পথ গড়ব।”
নির্বাচনের দিন।
ভোরবেলা রাশেদ করিম মসজিদের বারান্দায় বসে আছেন।
এক বৃদ্ধ ভোটার এসে বলেন—
“বাবা, তোর বাবার মতো চোখ তোর।
তোর বাবা আমার সঙ্গে একসময় আন্দোলনে ছিল।
ভোট দেবো তোর আদর্শকে।”
রাশেদ কাঁপা গলায় বলেন—
“ভোট আমাকে নয়, দিও এক নতুন সম্ভাবনাকে।
কারণ আমাদের প্রয়োজন একজন নেতা নয়—একটা ভবিষ্যৎ।”
সমাপ্ত।
লেখক -
অধ্যাপক জাহিদুল ইসলামের ।