11/06/2025
"মেসেঞ্জারের সবুজ বাতি"
✍🏻 Jahed Hossain
আজ একমাস হল তাকে মেসেঞ্জারে এ্যাক্টিভ দেখি না।
ইতোমধ্যে আমি চল্লিশটা বার্তা ইনবক্স করেছি। এবং সব বার্তা দেখা হয়েছে কিনা তা জানার জন্য দিনকে দিন ফেইসবুক লগইন করে বসে থাকি, এবং মেসেঞ্জারে এসে ঘুরতে থাকি। কিন্তু সব বার্তা অদেখা রয়ে গেছে। আর ভেতরে ভেতরে আমি মুষড়ে যাচ্ছি। আমার সবকিছুতে এখন ভালো না-লাগার বাতাস বইতে শুরু করেছে। যেমন কাল রাতে না-খেয়ে ঘুমাতে গেলাম, গতপরশু খুব করে কাঁদলাম। এখন মনে হয় আমাদের নিজস্ব পৃথিবী বলতে কিছু নেই। কেউ একজন হৃদয়ে ঢুকে বসবাস শুরু করলে তখন পৃথিবীটা তৈরি হয়। আর আমার সেই তৈরি হওয়া পৃথিবীটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, সূর্য যেভাবে অস্ত যাওয়ার জন্য মাথার উপর থেকে সরে যায় ঠিক তেমন। আমি এখন নিজেকে সামলাতে পারি না। কাউকে বিষয়টা জানিয়ে কিছুটা আনুকূল্য নিজের করে নেব, তাও ইচ্ছে করে না। আবার মেয়েটিকেও ভুলতে পারছি না। একটি ভার্চুয়াল আইডির আড়ালের মেয়েটিকে এত ভালোবাসব, তা কোনোভাবেই কোনোকালেও হিসেবের মধ্যেই ছিল না আমার। মেয়েটিকে হয়ত আমিই প্রথম ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম কিংবা হয়ত মেয়েটি। এখন তা আমার স্পষ্ট মনে নেই।অনেক আগে থেকে ইনবক্সে 'হাই, হ্যালো' করতে করতে একদিন বলেছিলাম, ‘কবিতা শুনবেন?'
সে বলেছিল, 'না।'
আমি কিছুটা বিব্রত ও অবাক হয়েছিলাম। আমি এতদিন ভাবতাম কবিতার প্রতি মেয়েদের আলাদা ভালো লাগা আছে, নিজস্ব দুর্বলতা আছে। কিন্তু মেয়েটির মধ্যে তেমন কিছু দেখলাম না বলে হতাশ হলাম।
এর কয়েকদিন পর কথায় কথায় সে বলল, 'কেন কবিতা শুনতেচাই না, তা জানতে চাইলেন না যে?'
আমি কিছুটা স্বাভাবিক মেজাজ ধরে রেখে বললাম, 'আপনি হয়ত কবিতা অপছন্দ করেন, তাই।"
‘না, মোটেও তেমন নয়। আমি কবিতা খুব পছন্দ করি।”
"তাহলে?"
"তাহলে কিছুই না। বিষয়টা বলি, কবিতা একধরনের আশ্রয় আমার কাছে। আর কেউ খুব আপন নাহলে আমি তার কাছে সেই আশ্রয় খুঁজতে যাই না।"
'তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আমি আপনার আপন কেউ না।' 'যে দন্ত-ন এর বেড়া ডিঙাতে পারে না, সে কীভাবে আপন হয়?
"মানে?"
'মানেটা খুব সহজ। আমরা এখনো 'আপনি'র বেড়া ডিঙাতে
পারিনি।
“তাই?'
'হুম, তাই।'
*আপনি-তে কি আপন হওয়া যায় না?'
‘যায় হয়ত-বা, তবে আপনি-তে আমি আপন হই না।' তার এমন আচরণে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। সত্যিইতো, বন্ধুতা মানে কোনো দেয়াল তুলে দেওয়া নয়, বরং দেয়াল ভেঙে দেওয়া কিংবা দেয়াল ডিঙিয়ে ওই পাশে চলে যাওয়া।
সে বলেছিল, 'এই দেয়ালটাই হচ্ছে 'আপনি'।' তারপর আমি খুব সহজেই ‘আপনি’র বেড়া ডিঙালাম। এরপর ইনবক্সে যত কথা হয়েছে মেয়েটিকে 'তুমি' করে বলেছি। আমার মনে হয়েছিল কাউকে 'তুমি' বলতে পারার মধ্যে গৌরব আছে। মনে হতে লাগল 'তুমি' বলতে না-পারলে ট্রেন মিস হয়ে যায়, চোখে ঠিক করে স্বপ্ন ওঠে না, রাতে ঘুম আসে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরে ধীরে সে ও আমি খুব আপন হয়ে গেলাম। আমরা ঘুরতে লাগলাম আকাশের ছায়া ধরে ধরে, জোছনার ভেতর দিয়ে। ফিসফিস শব্দে, কানে কানে আমরা ইনবক্স আলাপ চালিয়ে যেতে লাগলাম।
এভাবে কীভাবে যে একটি বছর কেটে গেল আমরা টের পাইনি। এই একবছরে কত-কিছুই-না হয়ে গেছে আমাদের। একবার সে আমাকে আচার খাওয়াল, আমি মেঘ থেকে পেড়ে বৃষ্টি খাওয়ালাম। আমার প্রিয় ছিল মেঘ, তার বৃষ্টি। প্রতিদিন ফেইসবুক লগইন করে সে আমাকে বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিত। আমি ভিজতাম শৈশবের মতো। এভাবে আমরা একে অপরকে শৈশবের গল্প শুনাতে লাগলাম। আমার শৈশব সাদা-কালো, তার হাজার রঙে রঙিন।
সে বলত আমার সাদা শৈশবে সে প্রেম হয়ে ঢুকে পড়বে। আমি বলতাম, 'তুমিতো আমার হৃদয়ে ঢুকে পড়েছ সেই কবে!' আমার প্রতিটি কথার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস আমাকে মুগ্ধ করত। আমি বুঝতে শিখেছিলাম, এই নারীদের যেদিন বিশ্বাস উঠে যাবে সেদিন পৃথিবী অনেক ডিগ্রি দূরে সরে যাবে। কিন্তু আমাদের দুজনার পৃথিবী মোটেও সরে যায়নি।
আমার অসুখ হলে তার যে কষ্ট হত তা আমি অনেক দূর থেকেও বুঝতে পারতাম। আমার বুকের ভেতর এর আগে কখনো কোনো নারীকে এভাবে বিচরণ করতে দেখিনি। সেও বলত তার চোখের স্বপ্ন হয়ে, ঘুম হয়ে আমি তার ভেতর বাস করতে শুরু করেছি। আমাদের এই বসবাস অজান্তে আমাদেরকে নিয়ে গেছে ভালোবাসার দিকে। যদিও এই একবছরে কেউ কাউকে বলিনি 'ভালোবাসি'। আমি বলতাম ভালোবাসা বলার বিষয় নয়, বুঝতে পারার বিষয়। আমি বুঝতে পারতাম, হয়ত-বা সেও। এভাবে আমরা যে বন্ধনে জড়িয়ে গেলাম তার নামই প্রেম, তার নামই ভালোবাসা। আমি তাকে বলতাম মানুষ এভাবেই ভালোবাসে। আর যারা পারে না, তারা আমাদের মতো মানুষ না। হ্যাঁ, আমরা মানুষ ছিলাম বটে! এই একবছরে আমরা কেউ কারও সেলফোন নাম্বার পর্যন্ত চাইনি! দেখা করার কথাও ভাবিনি একটিবার। সে বলত আমার জন্য সে বেঁচে থাকবে। আমি বুঝতে পারতাম না কেউ যদি আমার জন্য বেঁচে থাকে তাহলে তার জন্য কী করা উচিত। আমার খারাপ লাগত এই ভেবে যে, হয়ত আমি তার প্রাপ্য দিতে পারছি না। হয়ত আমি তাকে ঠিক সেভাবে সম্মান কিংবা শ্রদ্ধা করতে পারছি না। আমি তাকে প্রায়ই বলতাম, 'ক্ষমা কর।' সে অবাক হয়ে বিস্ময়ে প্রশ্নের সুরে বলত, 'কেনো মিছেমিছি ক্ষমা চাইছ?' আমি আমার সন্দেহের কথা জানাতাম, বলতাম ততটা তোমায় ভালোবাসি না
যতটা তুমি মনে কর। সে হাসত আর অবাক হত। আমি সেই হাসির কোনো মানে এখনো খুঁজে পাইনি, পাব না কোনোদিন।
ফেইসবুকে ও মেসেঞ্জারে সকালে একটি ঠান্ডা মৌসুম আছে। তার এই মৌসুম খুব ভালো লাগত। এ সময়টায় মানুষের উৎপাত তেমন একটা থাকত না। মেসেজের বন্যায় কম্পিউটার/মোবাইল হ্যাং হত না। তাই আমরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সেই সময়ে স্বপ্ন পোহাতাম।
সে বলত, 'এইবার একগ্লাস জল খেয়ে নাও, তারপর এককাপ চা। আমি যে আন্তরিকতার জল খেয়ে বড় হচ্ছি, তা তাকে বলতাম না। আমি লজ্জা পেতাম। আমার মনে হত ভালোবাসলেই কেবল মানুষ লজ্জা পায়। হয়ত এই লজ্জার জন্য কোনোদিন সেলফোন নাম্বার পর্যন্ত চাইতে পারিনি, দেখা করে ঘেমে যাব তা হয়ে ওঠেনি। তবুও সে আমার কাছে অনন্যা হয়ে ওঠেছিল। আমি ভাবতাম, হয়ত এভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়। কিংবা মানুষ এভাবেই ভালোবাসা পেতে চায়।
আমাকে কল্পনায় সে প্রতিদিন একটি নদীতে নিয়ে যেত, তারপর আমরা নদীর পাড়ে ভিড়ে থাকা একটি নৌকায় ওঠতাম। সে বৈঠা হাতে ওপাড়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু পরাজিত হত প্রতিবার। তখন কেনো জানি মনে হত, তার বসবাস হয়ত ওপাড়ে। হয়ত বা কিছুদিনের জন্য সে এপাড়ে বেড়াতে এসেছে, কিংবা ভালোবাসতে এসেছে আমাকে। আমি বলতাম, 'কেনো নদী এত ভালো লাগে?”
সে বলত, ‘আমি নদী হয়েই জন্মেছি। তাই মূলত নিজেকেই এত্তো ভালো লাগে আমার।'
আমার গর্বে বুক ফুলে ওঠত। আমি ভাবতাম আমি একটি নদীকে ভালোবাসি যে নদী শান্ত হতে জানে, যে ভালোবাসার ঢেউ তুলতে জানে হৃদয়ে। সেই নদীটিকেই আমি ভালোবাসি যেখানে ভেসে থাকা যায় জনম জনম। এভাবে আমি আরও দুর্বল হয়ে গেলাম তার কাছে, আমার নদীর কাছে, একটি নারীর কাছে কিংবা জ্বলে উঠা একটি মেসেঞ্জারের সবুজ বাতির কাছে।
আগেই বলেছি আজ একমাস তার নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলে না। আদতে আজ একমাস আমি অসুখে ভুগছি। আমার এই অসুখ পৃথিবীর কেউ টের পায় না। আমি চুপি চুপি ফেসবুকে লগইন করে তার প্রোফাইলে গিয়ে বসে থাকি। এবাউট মি-তে ক্লিক করে তার সম্পর্কে পড়ি। আসলে ওখানে কিছু লেখা নেই। তার সবটাই শূন্য। আমার ভেতরটা কেমন জানি মোছড় দিয়ে ওঠে।
তাহলে কি এটি ফেইক আইডি? যার সামনে এতবার দাঁড়িয়েছি, বাক্যের পর বাক্য বিনিময় করেছি, সে আদতে আসল কেউ না? আমি শঙ্কায় ভুগলেও ঠিক এভাবে তাকে ভাবতে পারিনি। সে আমার ভেতরের সত্তা। যতদিন আমি সত্য হব ঠিক ততদিন সেও সত্য হবে। তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি বিশ্বাস করি সে একদিন-না-একদিন মেসেঞ্জারের এই নীল ছায়ার ভেতর এসে দাঁড়াবে। তারপর 'হ্যালো, এই শোনছ' বলে আমাকে ডাকবে। -
আমি শান্ত পুকুরের মতো তার সামনে গিয়ে বলব, 'এতদিনে মনে পড়ল বুঝি?' আমার সমস্ত অভিমান ঝরে পড়বে তার উপর। এভাবে ভেবে ভেবে আমার আরও একটি সপ্তাহ কেটে গেল। আমিখুব কষ্ট পেতে লাগলাম। এতদিন যাবৎ যত কথা হল তা একে একে পড়তে লাগলাম। আর খুব করে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছে নিলাম।
সে যা বলেছিল ইনবক্সে তার কয়েকটা চুম্বক অংশ ঠিক এ রকমই—
'শোন, আমি পাথর হয়ে গেলে আমাকে কীভাবে ফেরাবে বল?” 'আমি সাঁতার জানি না। তবুও তোমার কাছে নৌকা নিয়ে ছুটে আসি। যদি কখনো ডুবি তুমি কি শুনতে পাবে?”
"আমি আকাশকন্যা, তুমি ছায়ামানুষ।'
'আমাকে তোমার করে তোল; নচেৎ হারিয়ে যাব।'
আমি আর পড়তে পারছিলাম না। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। হৃদয়ের খুব কাছে তখন একটি কষ্টের ঘণ্টা শুনতে পেলাম। পেন্ডুলামের দোল খেয়ে ওঠল মন। আমি নিজের ভেতর হাঁটতে লাগলাম। ভাবলাম হাঁটতে হাঁটতে আমি ঠিক পেয়ে যাব আমার আকাশকন্যাকে। যে ভালোবাসা আমি দিতে পারিনি এতদিন তার সবটুকুন উজাড় করে দেব তাকে। এখন আমার নিঃস্ব হওয়া দরকার। আমি এই ভালোবাসার ভার আর বইতে পারছি না। আমাকে উদ্ধার কর খোদা। এভাবে আমি প্রার্থনায় মশগুল হলাম। কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজ ভিজিয়ে ফেললাম।
তারপরঘুম থেকে উঠে রাত দুইটায় ফেইসবুকে লগইন করলাম, তারপর মেসেঞ্জারে গেলাম। আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটি সবুজ বাতি জ্বলে আলো ছড়াচ্ছে নীল বারান্দায়। দেখলাম আমার সবগুলো বার্তা ইতোমধ্যে দেখা হয়েছে।
আমি আর দেরি করলাম না। ইনবক্সে টোকা দিয়ে বললাম, “যদি মরে যেতাম তুমিতো জানতেও না, তাই নয় কি?'
এরপর আরও আধঘণ্টা চলে গেল। কোনো উত্তর নেই দেখে আমি ফের অবাক হলাম। ভাবছিলাম সে কি আমাকে ভুলে গেছে, আমাকে এড়িয়ে চলছে ইত্যাদি। খুব ভোরে আবার ঘুম থেকে উঠে ফেইসবুকেই লগইন করলাম এবং মেসেঞ্জারে গিয়ে দেখলাম, একটি বার্তা এসেছে গোপনে। আমি পড়তে শুরু করলাম...
যেমনটা লিখা ছিল............
“ভাইয়া! আমি জান্নাত বলছি। আপির কাছে আপনার অনেক গল্প শোনেছি। আমি জানি আপনি আপিকে অনেক পছন্দ করেন, হয়ত- বা অনেক ভালোবাসেন। আপি দুঃখ করে বলত, আপনাকে সে কিছুই দিতে পারেনি। আপনি নাকি বলতেন, আপনার বন্ধু আয়না। তাই একটি আয়না রেখে গেছে। একটি স্নেহের রুমাল রেখে গেছে। খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মানুষের ঘ্রাণ রেখে যেতে পারেনি। একবার এসে নিয়ে যাবেন। আপনি কষ্ট পাবেন তাই কোনোদিন আপনাকে বলেনি; আপনিও হয়ত জানেন না; আপি অনেক করে নিষেধ করেছিল যেন সত্যটা না বলি। সে বলতে বলেছিল, আপনাকে ছেড়ে সে নতুন সংসার পেতেছে। আদতে এমন কিছুই নয়। জানি এই সত্য বলাতে ভীষণ কষ্ট পাবেন আপনি। তবু বলছি। আপি দীর্ঘ একবছর ক্যান্সারের সাথে সংসার করে কিছুদিন আগে গত হয়েছেন। সর্বশেষ কেমোথেরাপি দিতে গিয়ে সব চুল হারিয়েছিল বলে আপনার সামনে দাঁড়ায়নি। জানতে চেয়েছে, এখন কয়গ্লাস জল হলে আপনি সেরে ওঠেন মন খারাপের অসুখ থেকে। সময় হলে আসবেন। ঠিকানা জানিয়ে দেব।
ভালো থাকবেন।'
#সমাপ্ত