19/06/2025
এক হিন্দুত্ববাদীর লেখা পড়লাম। সেখানে আবার কিছু ব্রেইনলেস মুজিববাদীকেও সহমত হতে দেখলাম। লেখার মুল কথা হচ্ছে- ইজরেল মুক্তিযুদ্ধে শুরুতেই একবার, স্বাধীন হবার পর আরেকবার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এবং শেখ মুজিব ’মুসলিম উম্মাহ’কে গুরুত্ব দিয়ে সেই স্বীকৃতি গ্রহন করেনি। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইজরেল মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলো। উলটো অকৃতজ্ঞ মুজিব ইজরেলকে স্বীকৃতি না দিয়ে বিরাট অন্যায় করেছে। মুজিব একটা খারাপ লোক, মুসলিম মৌলবাদী, আরব তোষনকারী। বাংলাদেশের উচিত এখন ইজ্রেলের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
বেশ।
এইসব সস্তা চুটকির বদলে যাদের আসলেই পড়ার ধৈর্য্য আছে- আমার লেখা তাঁদের জন্য।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এসময় এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা- তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে, নতুন নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরী হচ্ছে। এইসকল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা ফিলিস্তিন। সবার চোখে ইজ্রেল হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি, ফিলিস্তিন হচ্ছে প্রতিরোধের চিহ্ন।
এখানে ধর্মের কোন গল্প নেই। ফিলিস্তিন প্রতিরোধ যুদ্ধের আমব্রেলা সংগঠন পিএলও তে আছে- ন্যাশনালিস্ট, মার্কসিস্ট, সেক্যুলার গ্রুপগুলো। ধর্মে মুসলমান ইয়াসির আরাফাত যেমন পিএলওতে আছেন তাঁর ইত্তেফাদার পক্ষ থেকে, ধর্মে খ্রিস্টান জর্জ হাবাশ আছেন পিএলএফ এর পক্ষ থেকে। দীর্ঘবছর পিএলওর আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হানাহ আশরাভী একজন খ্রিষ্টান৷ পিএলও'র স্বাধীনতার সনদে কোন ধর্মীয় উচ্চারন নেই, আছে জাতীয় মুক্তির শপথ। আর এই মুক্তিসংগ্রামে আন্তর্জাতিক সহায়ক শক্তি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অসলো চুক্তির মাধ্যমে অসুস্থ ইয়াসির আরাফাতকে প্রতারণা করে অজনপ্রিয় করা এবং ইসলামী মৌলবাদী হামাসের উত্থান ঘটানোর আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রাম ধর্মনিরপেক্ষ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী।
এবার আসি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্রে। আফ্রো-এশিয়া- ল্যাটিনে স্বাধীনতার যে জোয়ার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তারই একটি। স্বভাবতই চরিত্রে সে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। আরো স্বাভাবিক এই মুক্তির সংগ্রামের প্রধান বিরোধী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হানাদার পাকিস্তান অস্ত্র, অর্থ, কুটনৈতিক সমর্থন পায় মার্কিন আর চীনের থেকে।
যে ইজ্রেল ঐ মার্কিনের প্রধান ক্লায়েন্ট, যে ইজ্রেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পিএলওকে সহায়তা দিচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভরসাতেই ভারত সাহায্য করছে বাংলাদেশকে, সেই ইজ্রেলের স্বীকৃতি সমর্থন বাংলাদেশ বিশ্বাস করবে কোন দু:খে?
বাংলাদেশ তার যুদ্ধে সব ধরনের সামরিক ও মানবিক সহযোগীতা গ্রহন করেছে ভারতের কাছ থেকে, এটি অফিসিয়াল। ভারত যদি অন্য কারো কাছ থেকে কিছু গ্রহন করে সেটা ভারতের বিষয়। বাংলাদেশ যখন জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম করছে তখন সে আরেক সাম্রাজ্যবাদী ক্লায়েন্ট যার বিরুদ্ধে আরেক মুক্তির সংগ্রাম চলছে, অত্যন্ত নৈতিক কারনেই বাংলাদেশ তার কোন সহায়তা গ্রহন করেনি। যেখানে স্বয়ং ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ডিসেম্বর মাসে সেখানে এপ্রিল মাসে ইসরাইলের স্বপ্রনোদিত স্বীকৃতি চেষ্টা নিয়ে বাংলাদেশের আদিখ্যেতার কোন কারন ছিলো না। ইজ্রেল পাত্তা না দেয়া ছিলো অত্যন্ত ম্যাচিওর সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র নয় যারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি। দক্ষিন আমেরিকার কয়েকটি রাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি, ভিয়েতনাম স্বীকৃতি দেয়নি ১৯৯৩ সালের আগে। ১৯৭৩ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আরব- ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের সমর্থন দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রকাশ্যে বলেছিলেন- ❝our freedom is incomplete without the freedom of the Palestinians.❞। আর্চ বিশপ ডেসমন্ড টুটু সক্রিয় বিরোধীতা করেছেন ইজ্রেল আগ্রাসনের। ল্যাটিন আমেরিকান সোশ্যালিস্ট লিডাররা এখনো ইজ্রেল বিরোধী।
ক্যাস্ট্রো, ম্যান্ডেলা, টুটু- এরা সবাই ’ইসলামী উম্মাহ'কে খুশী করার জন্য ইজ্রেল বিরোধী সেজেছিলেন? নাকি শেখ মুজিব ধর্মে মুসলমান বলেই সে একা অপরাধী।
মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিলো- এটাও একটা গড়পরতা কথা। যেখানে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে সেখানে জর্দান পাকিস্তানের যুদ্ধ বিমানের হার্ডওয়ার সাপ্লাই দেয়া ছাড়া আর কোন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা করেনি( জর্দান ফিলিস্তিনীদেরও হত্যা করেছে)। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আগ পর্যন্ত সৌদী আরব যেমন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, কমিউনিস্ট চীনও দেয়নি। আবার ইরাক স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে, আফগানিস্তান দিয়েছে ফেব্রুয়ারী মাসে, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ থাকলেও ইরান স্বীকৃতি দিয়েছে ফেব্রুয়ারী মাসে, ইন্দোনেশিয়া মে মাসে। বহু পশ্চিমা রাষ্ট্র তখনো স্বীকৃতি দেয়নি।
শেখ মুজিবুর রহমানের আরব প্রীতি ছিলো। রবীন্দ্রনাথেরও আরব প্রীতি ছিলো। মহাত্মা গান্ধীরও আরব প্রীতি ছিলো। এগুলো মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়। ইতিহাস ও মানসভ্যতার গভীর পাঠ থেকে।
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আইডল ছিলেন সুভাষ বসু, তুরস্কের কামাল আতার্তুক, মিশরের জামাল আবদেল নাসের। তাঁর দুই পুত্রের নাম কামাল এবং জামাল। শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলার মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন - তখন আলজেরিয়ায় ক্ষমতাসীন হয়েছেন বুমেদিন, সিরিয়ায় হাফিজ আল আসাদ, মিশরে নাসেরের উত্তরসূরী আনোয়ার সাদাত, ইরাকেও ক্ষমতাসীন বাথ সোশ্যালিস্ট পার্টি। এরা সবাই ধর্মে মুসলমান হলেও দীর্ঘ লড়াই করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র ও ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে। আরবে এরাই শেখ মুজিবের বন্ধু। কোন বাদশাহ বা মুসলিম ব্রাদারহুড মুজিবের বন্ধু ছিলো না।
হিন্দুত্ববাদীদের চোখে ’ইসলামী মৌলবাদী', ইসলামী মৌলবাদীদের চোখে 'ইসলাম বিরোধী'- এই দুই অক্ষের মাঝখানে যে স্পেশাল নিস জায়গাটুকু সেটুকুতেই শেখ মুজিব। সেখানেই তাঁর গ্রেটনেস। হিন্দুর না, মুসলমানের না তাঁর রাজনীতি ছিলো বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের। আর যেহেতু মানুষের অধিকারের রাজনীতি, সেহেতু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর অবস্থান নিপীড়িতের পক্ষে থাকাই স্বাভাবিক ছিলো।
সাম্প্রদায়িকতার হ্রস্ব দৃষ্টি দিয়ে শেখ মুজিবের মতো উজ্জ্বল জ্যোতিস্ককে দেখা যায় না।