05/04/2025
#গল্প
#তবুও_জীবন
#শ্রাবণী_আজিজ
২য় পর্ব
বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দরজায় কান পাতে রুমেনা। আতাহার কি তবে এসে গেছে! কিন্তু কেউ তো দরজায় টোকা দিচ্ছে না। অস্থির লাগে তার। এতো রাতে দরজা খোলে দেখা কি ঠিক হবে?
ঠায় দাড়িয়ে থাকে সে। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায়। মনে হচ্ছে পাশের ঘরের ভাড়াটিয়া ভাইটি এসেছে। বড় ভাইজান একটা ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। উনিই মনে হয় এসেছে।
বিছানায় বসে ঘামছে সে। কোথায় গেলো আতাহার? এখনো কেনো আসছে না? ফোন ও বন্ধ। কতো কথা মনে পড়ে তার।মাঝে মাঝে দূরে কোথাও গেলে ফোন করে জানাতো, ফিরতে রাত হবে।
মাঝে মাঝে সস্তায় পেলে মাছ নিয়ে আসতো। এসেই বলতো, "রুমু, কড়া করে মাছ ভাজা করো। ঘরে কি পেয়াজ,কাঁচা মরিচ আছে? থাকলে ভেজে মাছের উপর ছড়িয়ে দিও।" মাঝরাতে দুজন মিলে ভাত খাওয়া। বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে যাবে বলে চাপা গলায় কথা আর হাসি।
কিন্তু আজ তো অন্যরকম। রাত পোহালেই ঈদ অথচ মধ্যরাতেও আতাহারের কোনো হদিস নেই। নিজেকে শান্তনা দেয় রুমেনা, হয়তো আতাহারের কোনো বিপদ হয়নি। টাকার জোগাড় হয়নি বলে হয়তো লজ্জা পেয়ে ফিরতে রাত হচ্ছে। কিন্তু মনে তো শান্তি পাচ্ছে না সে।অস্থিরতা আরো বাড়ছে। না, আর বসে থাকা ঠিক হবে না , ভাইজানকে একটা ফোন করে জানাতেই হচ্ছে। ফোন হাতে নেয় সে।
টুং টাং টুং টাং...
লাফ দিয়ে উঠে রুমেনা। কলিং বেল বাজছে। তবে কি ও ফিরে এসেছে। তার শরীর কাঁপছে। এগিয়ে যায় দরজার দিকে। উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করে - কে?
- আমি, রুমু, দরজা খোল।
দরজা খুলেই আতাহারের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে রুমেনা।
ওকে জাপটে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায় আতাহার।
হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে রুমু? কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি? রুমেনা আকুল হয়ে জবাব দেয়, "কোথায় ছিলে তুমি? কোথায় ছিলে বলো?সারাদিন ধরে আমি এত ফোন করেছি।
তুমি ধরনি কেন ?"
"ফোনে চার্জ দেওয়ার সময় পাইনি। এজন্য তুমি এত ভয় পেয়েছো! ঘরে আসো। "
একহাতে ব্যাগ আরেক হাতে রুমুকে আগলে ঘরে আসে।চোখ মুছিয়ে দেয় ওর।
ঘটনা কি হয়েছে শোন। খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে সে।
" বেতনের জন্য অফিসে বসে থাকতে থাকতে ক্যাশিয়ার কুন্ডু বাবুকে বললাম, আমার কি আজ বেতন হবে না? কালকে তো ঈদ। "
"উনি বললেন, অফিস থেকে তো কোন নির্দেশনা নেই।ঠিক আছে,আমি বড় সাহেবের সাথে কথা বলে আপনাকে জানাবো।"
আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতে থাকতে দেখি সন্ধ্যা হয়ে আসছে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কালকে ঈদ। বাচ্চাদের জন্য কিছু কেনা হয়নি এখনো। বাজার করা হয়নি।কোথায় পাব টাকা? কোথায় পাব? হঠাৎ মনে পড়ল বন্ধু শফিকের কাছে কিছু টাকা পাওনা ছিল। ও তো ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছে ঈদের ছুটিতে। যাই ওর কাছে গিয়ে দেখি ,কিছু পাওয়া যায় কিনা?
যেই ভাবা সেই কাজ, গেলাম শফিকের বাসায়।গিয়ে দেখি শফিক দরজায় তালা মেরে কোথায় যেন চলে গেছে। হয়তো শপিংয়ে বা কোথাও গেছে।
ওদের বাসার পাশের টং দোকানে বসে রইলাম। বসতে বসতে রাত ৯টা বেজে গেল।ওদের আসার কোন নাম নেই।এদিকে চিন্তায় আমার মাথা খারাপ।কোন কিছু না নিয়ে বাসায় ফিরব কিভাবে। রাত দশটার পরে হঠাৎ দেখি শফিক বউকে নিয়ে আসছে। আমার ধরে প্রাণ ফিরে এলো।
আমাকে দেখে বলল, আরে দোস্ত! তুই এখানে? আমি বললাম, খুব বিপদে পড়ে এসেছি ভাই। শফিকের বউ বললো, বাসায় আসেন ভাইয়া।বাসায় এসে কথা বলেন।
ভেতরে যাওয়ার পরে শফিককে বললাম, ভাই, গত মাস থেকে আমার বেতন বন্ধ। আজ পর্যন্ত বেতন পাইনি। তুই তো জানিস আমার হাতে কোন সঞ্চয় থাকে না।তোর কি মনে আছে,মাস ছয়েক আগে তুই আমার কাছ থেকে ৭০০০ টাকা ধার নিয়েছিলি। আজকে কি দিতে পারবি?দিলে খুব উপকার হত ভাই।
ভেতর থেকে ভাবি চা নিয়ে আসলো। বলল,নিশ্চয় দেবে ভাইয়া। আপনি বসুন আপনার টাকা আমি নিয়ে আসছি।
-এই দাও তো চাবিটা।ভাইয়ের টাকাটা নিয়ে আসি।
তারপর ভাবি আমাকে টাকাটা দিয়ে দিলেন।
জানো রুমু, টাকাটা পেয়ে মনে হচ্ছিল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম।
আমার চোখে ভাসছিল বাচ্চাদের মুখের হাসি।এক ছুটে আমি দোকানে চলে গেলাম।
তখন রাত বাজে ১১ টা।"
এই বলে দুই তিনটা শপিং ব্যাগ রুমুর হাতে তুলে দেয় সে। বলে , এখানে রিমি, মিমির জন্য দুটো জামা আছে আর শাওন এর জন্য গেঞ্জি প্যান্ট। তোমার জন্য খুব সস্তার একটা তাঁতের শাড়ি।
তারপর লাজুক মুখে ব্যাগের পকেট থেকে এক ডজন কাঁচের চুড়ি বের করে রুমুর হাতে দিয়ে বলে, এত কম টাকায় তেমন ভালো কিছু আনতে পারি নাই।
তোমাদের হয়তো পছন্দই হবে না।
কিন্তু কি করবো বলো। এর চেয়ে বেশি তো আমি জোগাড় করতে পারিনি। তোমার এই অপদার্থ স্বামী কে নিয়ে তুমি কি বিপদেই না পড়েছ! "
রুমু বলে, "তোমার জন্য কি এনেছো?"
লাজুক হাসে আতাহার, " আমার জন্য কিছু আনিনি ; এত কম টাকা, তোমাদের জন্যই ভালো কিছু আনতে পারিনি। এখানে এখানে কিছু বাজার আছে, একটা মুরগি কিছু পোলাওয়ের চাল আর কিছু হাবিজাবি। সেমাই, নুডুলস এগুলো আর কি।"
রুমু মুখ কালো করে বলে, "এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে, কাল সকালে ঈদ নামাজের আগে গিয়ে তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি নিয়ে আসবে। না হলে আমরা কেউ এই কাপড় পড়বো না।"
আতাহার বিব্রত হয়ে বলে, " কি মুশকিল! আমি একটা ছেলে মানুষ, আমার আবার ঈদের কাপড় কি?"
" এগুলো বলবেনা", রুমু রাগ করে উঠে যেতে চায়। আতাহার হাত ধরে টেনে বসায়।
"আচ্ছা ঠিক আছে, সকাল- সকাল অল্প কয়েকটা দোকান খুলে। আমি ওখান থেকেই না হয় নিয়ে আসবো পাঞ্জাবী। এখন তো বসো? বাচ্চাদেরকে ডাকো, ওদেরকে কাপড় চোপড় দাও।"
রুমু বলে, "শাওন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। ওদেরকে ডেকে তুলি যাই। রুমু জোরে জোরে ডাকতে থাকে, "এই রিমি, মিমি,শাওন, তাড়াতাড়ি উঠো! বাবা চলে এসেছে।"
ওরাও মনে হয় কান খাড়া করেই ঘুমিয়ে ছিল। এক ডাকেই সবাই উঠে পড়ে। সবাই চেঁচামেচি করে দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ছোট মেয়ে মিমি বাবার কোলে বসে, শাওন পেছন থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে, আর রিমি বাবার পাশে দাঁড়ায়।
সবাই বাবাকে বারবার প্রশ্ন করে, " বাবা তুমি এত দেরি করলে কেন? "
বাবা হাসে বলে, " দেখো তোমার কাপড় পছন্দ হয়েছে কিনা? রিমির হাতে কাচের চুড়ি আর মেহেদী তুলে দিয়ে বলে, নাও গো আম্মাজান, তোমার মেহেদী।"
রুমু এসে বলে, আচ্ছা হয়েছে, যাও তুমি মুখ হাত ধুয়ে, কাপড়-চোপড় পালটে এসো। খাবার খাবে। "
আতাহার ভেজা চোখে বলে, " বাচ্চাদের আনন্দ দেখে আমার পেট ভরে গেছে আমি আর এখন খাব না।"
রুমু বলে, "সে কি! তাহলে একটু সেমাই করে দেই? তার সাথে ময়দা চিনি দিয়ে তেলের পিঠা করে দেই।"
বাচ্চারা হই হই করে ওঠে, "হ্যাঁ আম্মু সেমাই কর,পিঠাও কর। আমরাও খাব।"
ছোট ছেলে শাওন বলে , "মা তাহলে আজকেই কি ঈদ হবে? "
রুমু মনে মনে হাসে।বলে, " হ্যাঁ আজই আমার ঈদ। এই চাঁদ রাতে এই চাঁদের হাটে, এইতো আমার ঈদ।"
সমাপ্ত~
(গল্পটি পড়ে কেমন লাগল কমেন্ট করে জানাবেন।)