25/02/2024
মুফতী মীরাছ উদ্দীন মুমিনী, খতীব আম্বার ডেনিম জামে মসজিদ, বাংলাবাজার, গাজীপুর।
(একটু সময় নিয়ে পড়ুন চোখ খুলে যাবে ইনশাআল্লাহ)
কোরআন ও হাদিসের আলোকে পবিত্র শবে বরাত ও তার মর্যাদা:
ইসলামী ১২ চন্দ্র মাসের মধ্যে পবিত্র শা’বান মাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ মাসের ১৫ তারিখের রাত (শা'বান মাসের ১৪ তারিখ দিনগত রাত) উল্লেখযোগ্য ৫ রাতের একটি। যার ভিত্তি ও তাৎপর্য কুরআন, সুন্নাহ ও ফোকাহায়ে কিরামের অভিমত দ্বারা প্রমাণিত। এতদসত্ত্বেও কতিপয় আলেম বিভিন্ন মিডিয়া যেমন ইন্টারনেট, টিভি, পুস্তিকা, পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, যা আদৌ সঠিক নয়। এ কারণে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা শবে বরাত উদযাপনের ভিত্তি ও তাৎপর্য পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ্ ও ফোকাহায়ে কিরামের সুস্পষ্ট অভিমত দ্বারা প্রমাণ করাই এ প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য।
‘শবে বরাত’ ৫টি মর্যাদাপূর্ণ রাতসমূহের একটি। এ রাত ইবাদতের রাত হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র যুগ থেকে স্বীকৃত হয়ে আসছে। এ রাত স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করেছেন। তাই এ রাতে ইখলাছের সাথে আমল করা অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে কুরআন, সুন্নাহ ও ফোকাহায়ে কিরামের অভিমত তুলে ধরছি যাতে পাঠকরা সহজেই এ রাতের মর্যাদা বুঝতে পারেন।
১। পবিত্র কুরআনের আলোকে : মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ - فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ “নিশ্চয় আমি এটি (কুরআন মাজিদ) নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে; অবশ্য আমি সতর্ককারী। সেই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজের ফয়সালা হয়।" (সূরা আদ-দুখানঃ ৩)
এ আয়াতখানা ‘শবে বরাতের মর্যাদা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এটি প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত ইকরামাহ (রাঃ) সহ এক দল মুফাসসিরীনে কিরামের অভিমত। সকল তাফসীরকারক এ মতটি তাঁদের স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের অভিমত থেকে বোঝা যায় যে, ‘লাইলাতুল বরাতের’ কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে।
* ইমাম কুরতুবী রহঃ, তাফসীরে কুরতুবী, দারুল কুতুব আল-মিসরিয়্যাহ, মিশর, ২য় সংস্করণ-১৩৮৪ হি:, খ-১৬, পৃ: ১২৬।
* ইমাম খাযেন রহঃ, তাফসীরে খাযেন, দারুল ফিকর্ বৈরুত, ১৩৯৯ হিজরী, খ.৬, পৃ: ১৪৩।
* ইমাম বগভী রহঃ, তাফসীবে বগভী, দারু তাইয়িবাহ লিন- নশর ওয়াত্ তাওযীহ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৭ হিজরী, খ: ৭, পৃ: ২২৮।
২। হযরত ইবন আব্বাস, হযরত কাতাদাহ্, হযরত ইবন জুবাইর, হযরত মুজাহিদ, হযরত যাইদ, হযরত হাসান বসরি (রাঃ) সহ জমহুর উলামায়ে কিরামের মতে এ আয়াত লাইলাতুল কদর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।
* ইমাম আলূসি, রুহুল মায়ানি, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ্, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১৫হি, খ.১৩, পৃ.১১০।
* ইমাম কুরতুবি, (প্রাগুক্ত) এটিই অধিকতর নির্ভরযোগ্য বর্ণনা।
৩। সুন্নাহর আলোকে : শবে বরাত উদযাপন ও তাৎপর্য সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস শরিফ বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
ক) হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ : إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا ، فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا ، فَيَقُولُ : أَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ , أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ , أَلاَ مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ , أَلاَ كَذَا أَلاَ كَذَا ، حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.
“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন শা’বান মাসের ১৫ তারিখ উপনীত হলে তোমরা ইবাদতের মাধ্যমে রাত্রটিকে উদযাপন কর এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা, মহান রাব্বুল আলামীন সূর্য অস্তমিত হবার পর প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, ক্ষমা প্রার্থনা করার কে আছে যাকে আমি ক্ষমা করব? রিযিক প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি রিযিক প্রদান করব? কে বিপদগ্রস্ত আছে, যাকে আমি বিপদ মুক্ত করব? এভাবে ফজর পর্যন্ত বিভিন্ন কিছু প্রার্থনার জন্য আহ্বান করতে থাকবেন।”
(★ ইমাম ইবনু মাজাহ, আস্ সুনান, দারুল ফিকর, বৈরুত, খ: ১ম, পৃ: ৪৪৪।
★ কাযী শাওকানী, তুহফাতুজ জাকেরীন, দারুল ক্বলস, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৪ইং, খ: ১ম, পৃ: ২১৭।
★ ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, মাকতাবাতুর রুশদ, ১ম সংস্করণ, ১২১৩ হিজরী, খ: ৫ম, পৃ: ৩৫৪)
উল্লেখ্য, হাদিস শরিফে বর্ণিত “আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন” এর মর্মার্থ হচ্ছে শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তায়ালা আপন বান্দাদেরকে অতীব নৈকট্য প্রদান করেন।
(★ মুল্লা আলি কারি, মিরকাত, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪২২হি, খ.৩, পৃ.৯৬৯;
★ আল্লামা সনদি, হাশিয়া আলা সুনানু ইবনে মাজাহ্, প্রকাশনা ও তাং অনুল্লিখিত,খ.৩,পৃ.১৫৭।
★ আল্লামা সনদি, হাশিয়া আলা সুনানু ইবনে মাজাহ্, প্রকাশনা ও তাং অনুল্লিখিত,খ.৩,পৃ.১৫৭)
বাক্যটি রূপাকার্থে প্রয়োগ হয়েছে। যেমন আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। “কেউ যদি আমার জন্য এক হাঁটু পানিতে নামে, আমি তার জন্য একগলা পানিতে নামি। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে -সামান্য কিছুর বিনিময়ে অধিক প্রতিদান দেয়া। কারণ; আল্লাহ তায়ালা উঠা-নামা, স্থান-কাল ইত্যাদি অবস্থা থেকে পবিত্র।
(★ ইমাম তাফতাযানি, শরহুল মাকাসিদ, দারুল মায়ারিফুন নুমানিয়্যাহ, পাকিস্থান, প্র.১৪০১ হি., খ.২, পৃ.২৭০)
৪। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
فَقَدْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فَإِذَا هُوَ بِالْبَقِيعِ فَقَالَ أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ فَقَالَ إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لِأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ.
“আমি এক রাত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কে ঘরে পাইনি। অতঃপর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁকে জান্নাতুল বাকীতে পেয়েছি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি ভয় কর যে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) তোমার উপর অন্যায় করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! মূলত তা নয়; বরং আমি মনে করেছি যে আপনি আপনার কোন স্ত্রীর নিকট এসেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত [১৫তম রাতে] কুদরতিভাবে প্রথম আসমানে আসেন আর ‘কাল্ব’ নামক গোত্রের ছাগলের সমুদয় পশমের চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষদেরকে ক্ষমা করে দেন।” সুবহানাল্লাহ।
(★ ইমাম তিরমিযী, আল-জামেঈ আস-সহীহ, দারু ইহইয়ায়িত্ তুরাসিল আরবি, বৈরুত, খ.৩য়, পৃ. ১১৬।
★ ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, মুসনাদ, আলামুল কুতুব, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১৯ হিজরী, খ. ৬, পৃ. ২৩৮।
★ বদরুদ্দীন আইনী, উমদাতুল ক্বারী, খ. ১৭, পৃ: ৪৯।
★ ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান; দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১০ হিজরী, খ. ৩য়, পৃ. ৩৭৯)
রাসূলুল্লাহর এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী বলেন, خَصَّهُمْ لِأَنَّهُمْ أَكْثَرُ غَنَمًا مِنْ سَائِرِ الْعَرَبِِ. “কাল্ব গোত্রের ছাগল সবচেয়ে বেশি হবার কারণে তিনি এ গোত্রের ছাগলের কথা উল্লেখ করেছেন।” মূলত সংখ্যা নয়; বরং আধিক্য বোঝানোই উদ্দেশ্য। উল্লিখিত হাদিস শরিফ দ্বারা বোঝা গেল যে, ‘লাইলাতুল বরাত’ রাসূলের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
(মোল্লা আলী ক্বারী, প্রাগুক্ত, খ.৩য়, পৃ.৯৬৮)
* লাইলাতুল বরাতের নামকরণ :
‘লাইলাতুল বরাতের’ বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে। এটি বিভিন্ন কিতাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন হাদিস শরিফে এটি ‘লাইলাতুন নিসফ মিন শা’বান’ নামে এসেছে। মুহাদ্দিসিনে কিরাম, মুফাসসিরীনে ইজাম এবং ফুকাহায়ে কিরামসহ অন্যান্যদের নিকট বিভিন্ন নামে পরিচিত। আবার স্থানভেদে এর পরিচিতির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন উপমহাদেশে এটি ‘শবে বরাত’ নামে অধিক পরিচিত। তবে ‘লাইলাতুল বরাত’ নামটিও অধিকাংশ মানুষ জানে। ‘লাইলাতুল বরাতের’ কতিপয় নাম হল
(১) ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ তথা বরকতময় রাত; কেননা এতে নেককারদের ওপর অধিক পরিমাণে বরকত অবতীর্ণ হয়। এ বরকত ‘আরশ’ থেকে ‘তাহ্তাস্ সারা’ পর্যন্ত পৌঁছে
(২) ‘লাইলাতুর রাহমাহ’ বা রহমতের রাত; কেননা এ রাতে আল্লাহ্র বিশেষ রহমত অবতীর্ণ হয়
(৩) ‘লাইলাতুল বরাত’ বা মুক্তির রাত; কেননা এ রাতে মুমিন ব্যক্তির মুক্তি লেখা হয় এবং অসংখ্য জাহান্নামীদের মুক্তি দেয়া হয়।
(৪) লাইলাতুল ক্বিসমাহ্ ওয়াত্-তাক্বদীর বা বন্টনের রাত; কেননা, এ রাতে মানুষের রিযিক বণ্টন করা হয়।
(৫) ‘লাইলাতুর তাগফীর’ বা ক্ষমার রাত। ইমাম সুবকী বলেন, এ রাতে অপরাধীদের অপরাধ ক্ষমা করা হয়।
(৬) ‘লাইলাতুল ইজাবা’ বা দোয়া কবুলের রাত, কেননা এ রাতে দোয়া কবুল হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন ওমর (রাঃ) বলেন, এ রাতটি দোয়া কবুল হয় এমন পাঁচ রাতের একটি।
(৭) ‘লাইলাতুল হায়াত’ বা হায়াতের রাত।
(৮) ‘লাইলাতু ঈদিল মালায়িকা’ বা ফেরেশতাদের খুশির রাত; কেননা এটি ফেরেশতাদের দুটি ঈদের একটি।
(৯) ‘লাইলাতুত্-তা'জীম’ বা সম্মানিত রাত।
(১০) ‘লাইলাতুল গুফরান ওয়াল ইতকি মিনাল নিরান’ বা ক্ষমা করার রাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত।
(১১) ‘লাইলাতুল ক্বদর’ বা নির্ধারণের রাত; কেননা এ রাতে মানুষের হায়াত-মৃত্যু ও রিযিক নির্ধারণ করা হয়।
(১২) ‘লাইলাতুস্ সক্’ বা দফতর লিপিবদ্ধের রাত। কেননা এ রাতে আমলের দফতর লিপিবদ্ধ করা হয়।
(১৩) ‘শবে বরাত’ বা মুক্তির রাত। এটি উপমহাদেশে প্রচলিত।
(* শাইখ সালিম সনহুরী, ফাদায়িলু লাইলাতি নিসফি শাহরি শাবান, পৃ: ২-৪।
* বদরুদ্দীন আইনী, প্রাগুক্ত, খ.২য়, প.৪১৬)
★ লাইলাতুল বরাত উদযাপন :
‘লাইলাতুল বরাতের রাতটি তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার কারণে নবী করিম (সাঃ) নিজেই ইবাদতের মাধ্যমে এ রাত উদযাপন করেছেন। যেমন-
* হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন-
قَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ اللَّيْلِ يُصَلِّي فَأَطَالَ السُّجُودَ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ قَدْ قُبِضَ، فَلَمَّا رَأَيْتُ ذَلِكَ قُمْتُ حَتَّى حَرَّكْتُ إِبْهَامَهُ فَتَحَرَّكَ، فَرَجَعْتُ، فَلَمَّا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السُّجُودِ، وَفَرَغَ مِنْ صَلَاتِهِ، قَالَ: " يَا عَائِشَةُ أَوْ يَا حُمَيْرَاءُ ظَنَنْتِ أَنَّ النَّبِيَّ خَاسَ بِكِ؟ "، قُلْتُ: لَا وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ وَلَكِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ قُبِضْتَ لِطُولِ سُجُودِكَ، فَقَالَ: " أَتَدْرِينَ أَيَّ لَيْلَةٍ هَذِهِ؟ "، قُلْتُ: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: " هَذِهِ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَطْلُعُ عَلَى عِبَادِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِلْمُسْتَغْفِرِينَ، وَيُؤَخِّرُ أَهْلَ الْحِقْدِ كَمَا هُمْ
“রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এ রাতে নামায পড়ছিলেন এবং সিজদায় দীর্ঘ অবস্থানের কারণে আমি মনে করলাম যে, তিনি ইনতেকাল করেছেন। তাঁর অবস্থা জানার জন্য আমি তাঁকে নাড়া দিলে তিনি নড়ে উঠেন এবং আমি তাঁকে সিজদায় বলতে শুনেছি “হে আল্লাহ্, আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে আপনার শাস্তি থেকে পানাহ চাই, আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আপনার রাগ থেকে আশ্রয় চাই আর আপনার যথাযথ প্রশংসা আমি করতে পারব না; এজন্য আমি আপনার সেই প্রশংসা করছি, যা আপনি আপনার জন্য করেছেন। এরপর সিজদাহ থেকে মাথা উত্তোলন করেছেন। অতঃপর নামায শেষ করে আমাকে বললেন, হে আয়েশা, আল্লাহ্র রাসূল কি তোমার সাথে কোন ধরণের খিয়ানত করেছেন? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ করে বলছি, এ ধরণের কোন কিছু নয়; বরং সিজদায় আপনাকে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারণে আমি মনে করেছি যে, আপনি ইনতেকাল করেছেন। এ কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি কি জান না এটি বরাতের রাত ? আমি বললাম, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল ভাল জানেন। এরপর তিনি বললেন, আজ ‘শাবান মাসের ১৫তম রাত। এ রাতে মহান রাব্বুল আলামীন ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন। রহমত প্রার্থনাকারীদের রহমত প্রদান করেন এবং বিদ্বেষীদের অবকাশ দেন।”
(* ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, প্রাগুক্ত, ঘ: ৫ম, পৃ: ৩৬১।
* আব্দুল আজীম আল-মুনাভী, আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব, দারুল কুতুব আল-ইলমিয্যাহ, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি:। খ:২,পৃ:৭৪।
* আব্দুর রহমান মুবারক পুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, খ: ৩, পৃ: ৩৬৬।)
★ হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন-
قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: من أحيا الليالي الخمس وجبت له الجنة ليلة التروية و ليلة عرفة و ليلة النحر و ليلة الفطر و ليلة النصف من شعبان
“রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি চন্দ্র বছরের ৫ রাত তথা শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আযহার রাত, আরাফার রাত এবং জিলহাজ্ব মাসের ৮ তারিখ রাত উদযাপন করবে, সেই জান্নাতের হক্বদার হবে যাবে।”
(* আব্দুল আজীম আল-মুনাভী, প্রাগুক্ত, খ:২, পৃ:৯৮;
* আলা উদ্দিন মুত্তাকী আল হিন্দী, কানযুল উম্মাল, মুয়াস্ সাসাতুর, রিসালাহ, ৫ম সংস্করণ, ১৪০৮ হিজরী, খ. ৮, পৃ: ৪৪৮)
হযরত কাসীর বিন দীনার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-
من قام ليلتي العيدين محتسبا لم يمت قلبه يوم تموت القلو ب
“যে ব্যক্তি সওয়াবের নিয়তে শা’বান মাসের ১৫তম রাত তথা লাইলাতুল বরাত এবং দুই ঈদের দুই রাত উদ্যাপন করবে, তাঁর অন্তর মরার দিনেও মরবে না।”
(ইবনু নুজাইম,আল-বাহরুর রায়েক্ব, কিতাবুস সালাত, দারু ইহইয়ায়িত্ তুরাসিল আরবি, বৈরুত, খ.৪র্থ, পৃ. ১৪৬-১৪৭;
আব্দুল আজীম আল-মুনাভী,প্রাগুক্ত,খ.২,পৃ:৯৮)
এভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এই রাত উদ্যাপন করে স্বীয় উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা এ রাতে নামায আদায় কর, আল্লাহ্কে স্মরণ কর এবং দিনে রোযা রাখ।
উল্লিখিত হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল যে, ‘শবে বরাত’ ইবাদতের মাধ্যমে উদ্যাপনের প্রমাণ
রাসূলুল্লাহ থেকে পাওয়া যায় এবং এটি নব প্রচলিত কোন কিছু নয়।
★ লাইলাতুল বরাত’ উদ্যাপনে ফোকাহায়ে কিরামের অভিমত :
ইবাদতের মাধ্যমে লাইলাতুল বরাত উদ্যাপনে ফোকাহায়ে কিরামের অভিমত নিম্নে উল্লেখ করা হল।
১. প্রখ্যাত ফকীহ ইবনু নুজাইম হানাফী (রহঃ) বলেন-
وَمِنْ الْمَنْدُوبَاتِ إحْيَاءُ لَيَالِي الْعَشْرِ مِنْ رَمَضَانَ وَلَيْلَتَيْ الْعِيدَيْنِ وَلَيَالِي عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ وَلَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ كَمَا وَرَدَتْ بِهِ الْأَحَادِيثُ وَذَكَرَهَا فِي التَّرْغِيبِ وَالتَّرْهِيبِ مُفَصَّلَةً وَالْمُرَادُ بِإِحْيَاءِ اللَّيْلِ قِيَامُهُ وَظَاهِرُهُ الِاسْ
“শা’বান মাসের ১৫তম রাত, যিল হজ্জের ১০ম রাত্রি, দু’ঈদের দু’রাত এবং রমজান মাসের শেষ ১০ রাত রাত্রিজাগরণ করে ইবাদত করা মুস্তাহাব। কেননা এ ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত রয়েছে।
★ আল্লামা আব্দুল আজীম আল-মুনাভী (রহঃ) স্বীয় কিতাব ‘আত্-তারগিব ওয়াত তারহিব’গ্রন্থে এ সকল হাদিস শরিফ বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। এখানে ‘উদযাপন করা’ অর্থ হলো সারা রাত জেগে ইবাদত করা।”
(ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রায়েক্ব, কিতাবুস সালাত, দারু ইহইয়ায়িত্ তুরাসিল আরবি, বৈরুত, খ: ৪র্থ, পৃ: ১৪৬-১৪৭)
২. প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা ইবন আবেদীন শামী (রহঃ) বলেন-
وَيَحْصُلُ الْقِيَامُ بِالصَّلَاةِ نَفْلًا فُرَادَى مِنْ غَيْرِ عَدَدٍ مَخْصُوصٍ، وَبِقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ، وَالْأَحَادِيثِ وَسَمَاعِهَا، وَبِالتَّسْبِيحِ وَالثَّنَاءِ، وَالصَّلَاةِ وَالسَّلَامِ عَلَى النَّبِيِّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
“নির্দিষ্ট সংখ্যার হিসাব না করে একাকি নফল নামায আদায় করা, কুরআন-হাদিস পাঠ ও শ্রবণ করা, তাসবিহ, আল্লাহর প্রশংসা এবং নবীর ওপর দরূদ শরিফ পাঠের মাধ্যমে লাইলাতুল বরাত উদযাপন করা হয়ে থাকে।”
(ইবন আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৪২১ হিজরী, খ. ২য়, পৃ: ২৬)
৩. ইমাম হাসান শুরুনবুলালি (রহঃ) বলেন-
ندب "في ليلة براءة" وهي ليلة النصف من شعبان لإحيائها وعظم شأنها إذ فيها تقسم الأرزاق والآجال
“লাইলাতুল বরাত উদযাপন করা মুস্তাহাব। কেননা; এ রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এ রাতে রিযিক বন্টন করা হয় আর মৃত্যু নির্ধারণ করা হয়।”
(ইমাম হাসান শুরুনবুলালি, মারাকিউল ফালাহ, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ, বৈরুত, ১৪২৫হি, খ.১, পৃ.৭৩)
৪. ইমাম শাফিঈ (রহঃ) বলেন-
أن الدعاء يستجاب في خمس ليال: ليلة الجمعة والعيدين وأول رجب ونصف شعبان قال: وأستحب كل ما حكيت في هذه الليالي
“বছরের পাঁচটি রাতে দোয়া কবুল হয়। এগুলো হল শুক্রবারের রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত), দুই ঈদের দুই রাত, রজব মাসের প্রথম রাত এবং শাবান মাসের ১৫তম রাত। এ রাতগুলো সম্পর্কে আমি যা বর্ণনা করেছি, তা আমি পছন্দ করি।”
(> ইমাম শাফি, কিতাবুল উম, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪০০হি, খ.১ম, পৃ.২৬৪;
> ইবন রজব হাম্বলি, লাতায়িফুল মায়ারিফ, দারু ইবন হাজম, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪২৪হি, পৃ.১৩৭)
৫. ফকীহ মনসুর বিন ইউনুস বুহুতী হাম্বলী রহঃ বলেন-
اسْتِحْبَابِ قِيَامِهَا) أَيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ)
“শাবান মাসের ১৫তম রাতে কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব।”
(ইমাম বহুতী, কাশফুল ক্বিনা, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৪০২ হি:, খ. ১ম, পৃ. ২)
৬. আল্লামা রুহায়বানী হাম্বলী (রহঃ) বলেন-
اسْتِحْبَابُ قِيَامِهَا كَلَيْلَةِ الْعِيدِ
“শাবান মাসের ১৫তম রাত ঈদের রাতের মত কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব।”
(> রুহায়বানী, মাতালিবু উলিন নেহী, আল মাকতাবাতুল ইসলামী, দামেস্ক, ১৯৬১ ইং, খ: ১ম, পৃ: ৫৮১)
৭. গাউসুল আজম আব্দুল কাদের জিলানি হাম্বলী (রহঃ) বলেন-
وقد جمع بعض العلماء الليالي التي يستحب إحياؤها فقال: إنها أربع عشرة ليلة في السنة، وهي أول ليلة من شهر المحرم، وليلة عاشوراء، وأول ليلة من شهر رجب، وليلة النصف منه، وليلة سبع وعشرين منه، وليلة النصف من شعبان، وليلة عرفة، وليلتا العيدين، وخمس ليال منها في شهر رمضان وهي وتر ليالي العشر الأواخر.
“কতিপয় আলেম ওই ১৪টি রাতকে একত্রে করে লিখেছেন, যেগুলোকে ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব। তিনি বলেন- এ রাতগুলোর সংখ্যা হচ্ছে বছরে ১৪টি। এগুলো হল-
১. মুহাররাম মাসের ১ম রাত ২. আশুরার রাত (মুহাররাম মাসের ১০ম রাত) ৩. রজব মাসের ১ম রাত ৪. রজব মাসের ১৫তম রাত ৫. রজব মাসের ২৭ তারিখের রাত (শবে মি’রাজ) ৬. শাবান মাসের ১৫তম রাত তথা শবে বরাত ৭. আরাফার রাত (৯ যিলহজ্ব’র রাত) ৮. ঈদুল ফিতরের রাত ৯. ঈদুল আযহার রাত। ১০ থেকে ১৪ রমজান মাসের শেষ ১০দিনের বেজোড় পাঁচ রাত।”
(ইমাম আব্দুল কাদের জিলানি, গুনইয়াতুত তালেবিন (আল-গুনইয়াতু লিতালিবি তরিক্বিল হক্ব), দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭হি., খ.১, পৃ.৩২৮)
৮. ইবন রজব হাম্বলীর মতেও এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। এ রাতে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) পূর্ণ রাত ইবাদত করতেন। ( ইবনু রজব হাম্বলি, প্রাগুক্ত, পৃ.১৩৮)
৯.আল্লামা ইবনুল হাজ্ব মালেকী (রহঃ) বলেন-
فهذه الليلة وإن لم تكن ليلة القدر فلها فضل عظيم وخير جسيم وكان السلف رضي الله عنهم يعظمونها ويشمرون لها قبل إتيانها فما تأتيهم إلا وهم متأهبون للقائها والقيام بحرمتها على ما قد علم من احترامهم للشعائر
“শাবান মাসের ১৫তম রাতটি যদিও লাইলাতুল কদর নয়, তথাপি অত্যাধিক সম্মানিত ও বরকতময়। সলফে সালেহীনরা এ রাতকে খুব সম্মান করতেন এবং এ রাত আগমণ করার পূর্বে এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। আগমনের পর শরিয়ত সমর্থিত বিষয়ের মাধ্যমে এর সম্মান করতেন।” (ইবনুল হাজ্ব মালেকী, আল-মাদহাল, দারুল ফিকর, ১৪০১ হিজরী, খ: ১ম, পৃ: ২৯৯)
১০. মিশর দারুল ইফতার ফতোয়া :
‘লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে মিশর দারুল ইফতার ফতোয়াটি সুদীর্ঘ যার মূল বক্তব্য উল্লেখ করা হল। লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে তথা এর গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে যার মধ্যে কিছু হল সহিহ আর কিছু যয়ীফ। উলামাগণ ‘যয়ীফ হাদিস’ এর উপর আমল করার বৈধতা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) লাইলাতুল বরাতে নামায পড়তেন; কিন্তু তাঁর রাত্রি জাগরণের বিষয়টি নজরে না পড়ার কারণ হল তিনি প্রায় রাত জেগে নামায পড়তেন। তাঁর লাইলাতুল বরাত পালনটি ছিল ব্যক্তিগত, সম্মিলিতভাবে নয়। বর্তমানে যেভাবে সবাই সম্মিলিতভাবে এ রাত উদযাপন করে, তা তাঁর যুগে এবং সাহাবায়ে কিরামের যুগে ছিল না; তবে এটি তাবেয়ীনদের যুগে শুরু হয়েছিল। এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই; তবে মসজিদে সম্মিলিতভাবে পড়বে, না-কি ঘরে একাকী পড়বে এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এ মতবিরোধের যে কোন একটি অভিমতের উপর আমল করা যাবে। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে মসজিদেও নামায পড়া যাবে অথবা একাকী ঘরেও নামায পড়া যাবে।
(> ফাতায়ায়ে দারুল ইফতা আল মিসরিয়্যাহ, ওযারাতুল আওকাফিল মিসরিয়্যাহ, মিশর, ১৯৯৭ইং, খ: ১০ম, পৃ: ১৩১)
১১. কুয়েত সরকারের ফতোয়া : কুয়েত সরকারের ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বিশ্বকোষ তথা ইসলামিক বিশ্বকোষে রয়েছে-
ذَهَبَ جُمْهُورُ الْفُقَهَاءِ إِلَى نَدْبِ إِحْيَاءِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ ، لِقَوْلِهِ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ : إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا
“শাবান মাসের ১৫তম রাত পালন করার ক্ষেত্রে সকল ফকীহ একমত। তাঁদের মতে এ রাত পালন করা মুস্তাহাব। কেননা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, এ রাতে তোমরা কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে আর দিনে রোযা রাখার মাধ্যমে পালন কর।”
(সম্পাদনা পরিষদ আল-মুসুয়াত ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ, ওয়ারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনুল ইসলামী, কুয়েত, ২য় সংস্করণ, ১৪০৪ হি:, খ. ২য়, প. ২৩৫)
১২. দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া :
“এ রাত অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ। এ রাতে একাকী নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির করা, কবর যিয়ারত করা, দোয়া এবং ক্ষমা চাওয়া মুস্তাহাব। তবে সম্মিলিতভাবে মসজিদে নয়।”
(ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত, খ.১, পৃ.১০২ ও ২৯৩)
তারা মূলত দিতীয় অভিমতের উপর ফতোয়া দিয়েছেন
১৩. দেওবন্দ গুরু আশরাফ আলী থানভী বলেন- ‘১৫ শাবান রাত জেগে ইবাদত করা উত্তম; প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক।’ (মাওলানা আখতারুজ্জমান, লাইলাতুম মুবারাকাহ্, আজিমপুর দায়রা শরিখ খানকা, ঢাকা, ২য় সংস্করণ, ২০০৭ইং, পৃ.৫২)
১৪. আব্দুল হাই লাকনভী বলেন-
لا كلام في استحباب إحياء ليلة البراءة بما شاء من العبادات وبأداء التطوعات فيها كيف شاء لحديث ابن ماجة والبيهقي في شعب الإيمان عن علي مرفوعا إذا كان ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا من مبتلي فأعافيه ألا من سائل فأعطيه ألا كذا وكذا حتى يطلع الفجر ...البيان دالة على أن النبي أكثر في تلك الليلة من العبادة والدعاء وزار القبور ودعا للأموات فيعلم بمجموع الأحاديث القولية والفعلية استحباب إكثار العبادة فيها فالرجل مخير بين الصلاة وبين غيرها من العبادات فإن اختار الصلاة فكمية أعداد الركعات وكيفيتها مفوضة إليه ما لم يأت بما منعه الشارع صراحة أو إشارة
“লাইলাতুল বরাতে জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনু মাজাহ এবং ইমাম বায়হাকি হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-
“শা’বান মাসের ১৫ তারিখ উপনীত হলে তোমরা ইবাদতের মাধ্যমে রাত উদযাপন কর এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা, মহান রাব্বুল আলামীন সূর্য অস্তমিত হবার পর প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, ক্ষমা প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি ক্ষমা করব? রিযিক প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি রিযিক প্রদান করব? কে বিপদগ্রস্ত আছে, যাকে আমি বিপদ মুক্ত করব? এভيقتضজর পর্যন্ত বিভিন্ন কিছু প্রার্থনার জন্য আহ্বান করতে থাকবেন।”..উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেই রাতে অধিক ইবাদত, দুয়া, কবর যিয়ারত এবং মৃতদের জন্য দুয়া করতেন। সকল প্রকার হাদিসে কাওলি এবং হাদিসে ফে’লি দ্বারা ঐ রাতে অধিক পরিমাণে ইবাদত করা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়েছে। নামায বা অন্য ইবাদত করার ব্যাপারে সে স্বাধীন। যদি নামায পড়াকে সে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সে যত রাকাত ইচ্ছা পড়তে পারবে। যে বিষয় নিষেধ হবার ব্যাপারে রাসূলের কোন নির্দেশ সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে রয়েছে, তা অবশ্য বর্জনীয়।”
(আব্দুল হাই লকনবী, আল-আছারুল মারফুআহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, খ.১ম, পৃ: ৮১-৮২)
১৫. লা-মাযহাবীদের নির্ভরযোগ্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী (রহঃ) বলেন-
ليلة النصف من شعبان ، فقد روى في فضلها من الأحاديث المرفوعة والآثار ما يقتضي أنها ليلة مفضلة، وأن من السلف من كان يخصها بالصلاة فيها، وصوم شهر شعبان قد جاءت فيه أحاديث صحيحة. ومن العلماء : من السلف، من أهل المدينة، وغيرهم من الخلف، من أنكر فضلها، وطعن في الأحاديث الواردة فيها ...
لكن الذي عليه كثير من أهل العلم، أو أكثرهم، أصحابنا وغيرهم -على تفضيلها، وعليه يدل نص أحمد، لتعدد الأحاديث الواردة فيه
“শাবান মাসের ১৫তম রাতের ফযিলত সম্পর্কে অসংখ্য শুদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে এ রাতের মর্যাদা বোঝা যায়। সলফে সালেহীনগণ এ রাতে নামাজ পড়ার জন্য নির্ধারণ করে রাখতেন এবং দিনে রোজা রাখতেন। কেননা এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদিস রয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের কিছু আলেম এ রাতের মর্যাদাকে অস্বীকার করেছে এবং সহীহ হাদিসের ওপর অপবাদ দিয়েছে। কিন্তু আমাদের হাম্বলী মাযহাবসহ অন্যান্য মাযহাবের অধিকাংশ আলেমদের মতে এ রাতটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল এর মতও এটি। কেননা এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস শরিফ রয়েছে।”
(ইমাম ইবন তাইমিয়া, ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম, দারু আলামিন কুতুব, বৈরুত, ৭ম সংস্করণ, ১৪১৯হি, খ.২, পৃ.৯৭)
১৬. গায়রে মুকাল্লিদিন’র প্রখ্যাত আলেম শায়খ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী শবে বরাত উদযাপনের পক্ষে একাধিক হাদিস উল্লেখ করে বলেন-فَهَذِهِ الْأَحَادِيثُ بِمَجْمُوعِهَا حُجَّةٌ عَلَى مَنْ زَعَمَ أَنَّهُ لَمْ يَثْبُتْ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ شَيْءٌ “ এ সকল হাদিস তাদের জন্য প্রমাণ যারা মনে করে যে, শবে বরাতের কোন ফযিলত প্রমাণিত নয়।”
(শায়খ মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযি, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, খ.৩, পৃ.৩৬৭)
১৬. লামাযাহাবিদের অতি প্রিয় ও নির্ভযোগ্য ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানি স্বীয় কিতাব “সিলসিলাতুল আহাদীসিল সহিহা” গ্রন্থে লাইলাতুল বরাত সম্পর্কিত অনেক হাদিস উল্লেখ করত: এগুলোর মান যাচাই করার পর বলেন-
و جملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب و الصحة تثبت بأقل منهاعددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث ، فما نقله الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في " إصلاح المساجد عن أهل التعديل و التجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح ، فليس مما ينبغي الاعتماد عليه ، و لئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول فإنما أوتي من قبل التسرع و عدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديك . و الله تعالى هو الموفق .
“সার কথা হল (হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত উপরিউক্ত) হাদিস শরিফটি (বর্ণিত) সকল সূত্রের সমন্বয়ে নি:সন্দেহে সহিহ। হাদিস অতিশয় দুর্বল না হলে আরো কম সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদিস দ্বারা হাদিসের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয় তথা কোন দুর্বল হাদিসও অন্য সূত্রের কারণে সহিহ হয়ে যায় যেমন এ হাদিসে (শবে বরাত বিষয়ে হযরত আয়েশ সিদ্দিকা (রা:) থেকে বর্ণিত) হয়েছে। শাইখ কাসেমি তাঁর ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’ গ্রন্থের ১০৭ পৃষ্ঠায় হাদিস বিশারদগণের উদ্ধৃতিতে লিখেছেন যে, ‘শবে বরাতের ফযিলত সম্পর্কে কোন সহিহ হাদিস নেই।’ তাঁর এ কথার ওপর আস্থা রাখা উচিত নয়। আর যদি তাঁদের থেকে কেউ এ কথা বলেও ফেলে, তাহলে বুঝতে হবে যে, চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অতি তাড়াহুড়া হেতু এবং বর্তমান পদ্ধতির ন্যায় হাদিসের বিভিন্ন সূত্র অন্বেষণের প্রচেষ্টা সীমিত হবার কারণেই এমনটা হয়েছে। মহান আল্লাহই তাওফিকদাতা।”
(নাসিরুদ্দিন আলবানি, ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিল সহিহা’, দারুল মাআরিফ, রিয়াদ, খ.৩, পৃ.২১৮)
উল্লেখিত বর্ণনা থেকে বোঝা গেল, লাইলাতুল বরাত উদযাপন করার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই; তবে এ রাতে নামাযের পদ্ধতি দিয়ে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, সম্মিলিতভাবে মসজিদে নামায পড়া মাকরুহ, আর কেউ কেউ বলেন, সম্মিলিতভাবে মসজিদে নামায পড়া মুস্তাহাব। এ মতপার্থক্য সমাধানে ‘ফতোয়ায়ে আযহার’ এ উল্লেখ আছে, ‘যেহেতু এ মতপার্থক্য তাবেয়ীনদের মধ্যে হয়েছে, সেহেতু যে কোন একটি মতের ওপর আমল করা যাবে।’
এ রাতের তাৎপর্য : লাইলাতুল বরাতের তাৎপর্য বর্ণনাতীত। যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তন্মধ্যে কতিপয় তাৎপর্য উল্লেখ করা হল-
১। হযরত রাশেদ বিন সাদ (রাঃ) বলেন-
أن النبي صلى الله عليه وسلم قال إن الله تبارك وتعالى يطلع إلى عباده ليلة النصف من شعبان فيغفر لخلقه كلهم إلا المشرك والمشاحن وفيها يوحي الله تبارك وتعالى إلى ملك الموت لقبض كل نفس يريد قبضها في تلك السنة
“রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: নিশ্চয় মহান রাব্বুল আলামীন লাইলাতুল বরাতে বান্দার নিকটে আসেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। সেই বছর আল্লাহ তায়ালা যাদের মৃত্যুদানে ইচ্ছুক, তাদের সম্পর্কে তিনি হযরত আজরাইল আলাইহিস সালামকে অবহিত করেন। ”(আহমদ দীনাওয়ারী মালেকী, আল-মুজালাসাহ্ ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম, দারু ইবনি হাযয, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হিজরী, খ. ১ম, পৃ: ২০৬)
★ লাইলাতুল বরাতের আমল:
☞ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-
من أحيا ليلتي العيدين وليلة النصف من شعبان لم يمت قلبه يوم تموت القلوب
“যে ব্যক্তি শাবানের ১৫তম রাত এবং দুই ঈদের দুই রাত উদযাপন করবে, তাঁর অন্তর মৃত্যুর সময়েও মরবে না এবং সে জান্নাতের উপযোগী হয়ে যাবে।’
(ইবনুজ জাওযী, আত্ তাবছিরাহ, প্রাগুক্ত, খ. ২য়, পৃ: ৫০)
এ রাত উদযাপনে কী কী কাজ করা যায়, তার ব্যাখ্যায় ‘মারাক্বিউল ফালাহ’ গ্রন্থকার হাসান শুরুন বুলালী, ইমাম তাহত্বাভী, ফিকহুল ইবাদাত গ্রন্থকার আল্লামা আল-হাজাহ নাজাহ আল-হালাভী, ইবনু রজব হাম্বলী প্রমুখ ফকীহগণ বলেন, “লাইলাতুল বরাত উদযাপন বলতে সম্পূর্ণ বা অধিক রাত পর্যন্ত জেগে কোন ইবাদতে মশগুল থাকা যেমন নামাজ পড়া বা কুরআন তিলাওয়াত করা বা কুরআন পাঠ শোনা বা হাদিস শরিফ পাঠ করা বা তাসবীহ পড়া বা যিকির করা বা দরূদ শরিফ পাঠ করা।”
(> হাসান শুরুন বুলালী, প্রাগুক্ত, খ: ১ম, পৃ: ১৯৩-১৯৪।
> ইমাম তাহত্বাভী, হাশিয়া আল মারাক্বিউল ফালাহ, প্রাগুক্ত, খ. ১ম, পৃ: ৭০ ,
> ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়িফুল মায়ারিফ, প্রাগুক্ত, খ. ১ম পৃ: ১৩৮,
> আল হাজাহ নাজাহ আল-হালাভী, ফিকহুল ইবাদাত, প্রকাশনা ওতারিখ বিহীন, খ. ১ম, পৃ: ১০৭)
এ রাতের উল্লেখযোগ্য কতিপয় আমলের বিবরণ সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে উল্লেখ করা হল।
(ক) নামায : নামায নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত। উত্তম সময়ে পড়ার কারণে এটির সওয়াব ও মর্যাদা আরো দ্বিগুণ হয় যেমন কোন সরকারি কর্মচারীর বেতন বিশেষ দিনের কারণে দ্বিগুণ হয়। অসংখ্য সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ রাতে নামায পড়তেন এবং তাঁর উম্মতকেও ইবাদতে মশগুল থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই সলফে সালেহীণগণ এ রাতে বিশেষ গুরুত্বের সাথে নামায পড়ত