31/07/2025
“ভাই, মরিচ কত করে?”
--“ভাই, মরিচ এইগুলি বেচুম না।”
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মটা তখনও অনেকটাই ফাঁকা। ট্রেন আসতে আরো কিছুটা সময় বাকি। ঘড়ির কাঁটা তখন সবে আটটা ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ চোখে পড়লো, একজন লোক, পরনে টি-শার্ট আর লুঙ্গি, মলিন তার পায়ের স্যান্ডেল, বসে আছেন রেললাইনের উপর, পাশে একটা বড় পলিথিনের ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি লাল আর সবুজ বোম্বাই মরিচ।
কৌতূহল বসত জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, মরিচ কত করে?”
জিজ্ঞেস করতেই লোকটি মাথা নিচু করে বলল, “ভাই, মরিচ এইগুলি বেচুম না।”
আমার কৌতূহল বেড়ে গেল।
ব্যাগ ভর্তি মরিচ নিয়ে বসে আছেন, অথচ বলছেন বেচবেন না? আমি হেসে বললাম, “মরিচ নিয়ে বসে আছেন আর বলছেন বেচবেন না! কাহিনী কী ভাই?”
লোকটি মাথা নিচু করে ছিল, মুখ তুলতেই বুঝতে পারলাম এতক্ষন কান্না করছিলো। চোখে পানি আর কান্না জড়ানো কণ্ঠে লোকটি যা বললো শুনে আঁতকে উঠলাম।
ঠোঁট কাঁপছিলো তার, কণ্ঠে অসহায়ত্ব আর কান্নার মিশ্র ধ্বনি।
“এই মরিচগুলা আমি আমার মাইয়ার জন্য আনছিলাম, ভাই, কিন্তু আমার মাইয়াটা আর নাই, আর আমার নিজের কিছুই নাই।”
আমি চুপ করে গেলাম। আমার মনে হল সময় থেমে গেছে।
আমি বসে পড়লাম তার পাশে, রেললাইনে। বললাম, “মেয়ের জন্য মরিচ আনছিলেন কেন? আর মেয়ে নাই মানে, কি হইছে আপনার মেয়ের?”
আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটি । একটু সময় নিলো-
আমার বাড়ি কালীগঞ্জ আড়িখোলা, ছোড একটা জমি আছে, তাতেই ক্ষেত খামারি করতাম।
আমার একটাই মাইয়া, নাম রাখছিলাম রুহি। ফুটফুইট্টা মাইয়াডা আমার সারাক্ষন খালি হাসতো। বকলেও হাসতো, মা&%রলেও হাসতো। জন্মের সময় ওর মায় ম&%ইরা গেছিলো। এই একটা মাইয়ার মুখের দিকে চাইয়াই বাইচা আছিলাম।
রুহির বয়স এহন সাত, তিন মাস ধইরা জ্ব&%র, ওষুধেও জ্ব&%র কমে না । গেরামে ডাক্তার দেখাইলাম, কইলো নরমাল জ্ব&%র, সাইরা যাইবো।
কিন্তু জ্বর কমে না, মাইয়াডা আমার আর হাসে না, খালি চাইয়া থাকে, কি জানি কইতে চায়, বুকের মইদ্দে তার কত কতা জইম্মা আছে কিন্তু মুখ ফুইট্টা কইতে পারে না।
শহরে নিয়ে আইলাম, ডাক্তার পরীক্ষা কইরা কইলো, লিউকেমিয়া।
খালি দেখলাম মাইয়াডা কেমন হুগায়া যাইতাছে, চুলডি সব পইড়া যাইতাছে, আর দিনে দিনে চোক দুইডা কেমন ঘোলা হইয়া যাইতাছে।
রুহি একদিন কইলো, “আব্বা, আমি ম&%রতাম চাই না। আমি স্কুলে যামু, ডাক্তার হমু , তোমার লাইগা টাকা কামাই করমু।”
জমিডা বেইচা দিলাম, একটা দুধের গরু আছিলো, হেইডাও বেইচা দিচ্ছি, তাও টেহা কম পরে।
চক্ষে মুখে আন্ধার দেহি, একটা মাত্র মাইয়া আমার, তারে কি বাচাইতে পারুম না?
একদিন রুহি কইলো, “আব্বা, তুমি বাড়িত গেলে আমার লিগ্গা লাল-সবুজ রঙ্গের বোম্বাই মরিচ আনবা।”
আমি কইছিলাম, “ব্যাগ ভইরা তোর লাইগা বোম্বাই মরিচ আনমু মা।”
শুইন্না হেইদিন কি সুন্দর হাসি সে দিছিলো, কেডায় জানতো ওই আমার মায়ের শেষ হাসি।
গতকাল কে&%মোথেরা&%পি দেওনের পর বাড়িত গেছিলাম, কয়ডা টেহা ধার করেনের লেইগ্গা। আইজকা সকালে ট্রেনে কইরা আহনের সময় হাসপাতাল থন ছোড বাই ফোন দিয়া কইলো আমার রুহি আর নাই।
টেরেনের মইদ্দে হাজার হাজার মানুষ, দুনিয়াডা জুইড়া কোটি কোটি মানুষ, কিন্তু আমার এই দুনিয়াতে আর কেউ নাই, আমার আর কিছুই নাই এই এক ব্যাগ লাল-সবুজ বোম্বাই মরিচ ছাড়া. আমি এই মরিচ কাউরে দিমু না বাই, কাউরে না।
আমার ট্রেন চলে এসেছে, কিন্তু আমার পা জোড়া এতটাই ভারী হয়ে গিয়েছিলো যে সেখান থেকে উঠে আমার ট্রেন পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি ছিল না।
আমি কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চারপাশে শহরের কোলাহল, ট্রেন প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে গেলো বাঁশি বাজিয়ে, এর সবই যেন এক অসহায় বাবার কান্নায় মিশে যাচ্ছিলো।
গলার কাছে কান্না টা দলা পাকিয়ে উঠেছিল আমার। কি শান্তনা তাকে আমি দিবো, কোন ভাষায় তাকে আমি ভোলাব সে আমার জানা ছিল না।
অনেক কষ্টে বললাম, “হাসপাতালে যান, মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে যান. আপনার মেয়ের শেষ ইচ্ছা ছিল বোম্বাই মরিচ খাওয়ার। তার ক&%বরে অনেক গুলো বোম্বাই মরিচের গাছ লাগিয়ে দিবেন।
আর দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিন।“
পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে তার হাতে দিতেই সে বললো, “বাই আমার টেহার দরকার নাই আর”, আমার রুহি নাই, টেহা দিয়া আমি আর কি করমু”?
এই দুনিয়াতে আমার কষ্টের কথা শোনার আর কেউ নাই, আপনি শুনছেন, এটুকুই যথেষ্ট।
তার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। বললাম, “রুহির নামে আমিও একটা বোম্বাই মরিচের গাছ লাগাবো, আরও যারা রুহির কথা জানবে সবাইকে বলবো একটা করে গাছ রুহির নামে লাগাতে, রুহি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে”।
চোখ থেকে তার তখন অনবরত পানি পড়ছিলো, ঠোঁট কাঁপছিলো, শুধু হাতটা শক্ত করে ধরে রাখা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিলো না ।
আমার ট্রেন আসে, জীবিকার প্রয়োজনে আমাকে তার হাত ছাড়িয়ে ছুটতে হয় ট্রেন ধরবার জন্য। সবার গন্তব্য আছে, তাড়া আছে, রুহির বাবার কোনো গন্তব্য নেই, আর কোনো তাড়া নেই। মেয়ের ওষুধ কিনবার জন্য তাকে আর ছুটতে হবে না, চিকিৎসার টাকা জোগাড় করবার জন্য আর এর ওর কাছে হাত পাততে হবে না। রুহির কথা আমরা হয়তো ভুলে যাবো, ছোট্ট রুহি যে জীবনের শেষ আবদারে তার বাবার কাছে বোম্বাই মরিচ খেতে চেয়েছিলো । আমাদের সন্তানের মাঝে ছায়া হয়ে রুহি বেঁচে থাকুক। ❤️
© Kayas Hossain