23/09/2024
‘মেধাবী ছাত্র’ দিয়ে কী বুঝায় তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। সম্ভবত যে-ছাত্র বড় হয়ে মুচি বা কাঠমিস্ত্রী হতে চায় না, কৃষিকাজ করতে চায় না, সে-ই মেধাবী ছাত্র। আরেকটি বিষয় হতে পারে, যে-ছাত্র বুয়েট বা মেডিক্যালে পড়ছে, সে মেধাবী। না কি? মেধাবী ছাত্রের ধারণা তো আমাদের সমাজে এভাবেই নির্মিত হয়েছে। কোনো শিশু যখন হাতি-ঘোড়ার নাম বাংলার বদলে ইংরেজিতে বলতে শুরু করে, কয়েকটি ছড়া ও দুয়েকটি সুরা মুখস্থ বলতে পারে, বা নানা আজেবাজে তথ্য মগজে ধারণ করতে শেখে, তখন তাকেও আমরা মেধাবী বলি। ঘোষণা দিই— শিশুটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এ ঔজ্জ্বল্য সূর্য বা বাতির আলোর নয়, জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রখরতাও নয়, এটি হলো ভবিষ্যতে শিশুটির আয়-রুজগারের ক্ষমতা। অন্যভাবে বললে, যে-ছাত্র বড় হয়ে কম পরিশ্রমে অধিক অর্থ আয় করতে পারবে, সে-ই মেধাবী ছাত্র। একজন কৃষককে কি সমাজ মেধাবী বলে? মেধাবী কৃষক, মেধাবী খামারি, মেধাবী শ্রমিক, মেধাবী দোকানদার, এমন কথা কি কোথাও শুনতে পাই? পাই না। এর কারণ— ‘মেধা’ শব্দটি এখানে ছিনতাই হয়ে গেছে। অরওয়েলের ‘এনিম্যাল ফার্ম’-এ কিছু প্রাণী আছে, শুয়োর, যারা ঘোষণা করে— ‘আমরা ছাড়া আর কেউ আপেল খেতে পারবে না’। জানেন তো? এ আপেলখেকো শুয়োর মানুষের সমাজেও আছে। পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ খাবার তাদের জন্যে। অন্যরা খাবে ছাতু, গম, খুদকুঁড়ো। যারা খুদকুঁড়োর শ্রেণীতে পড়ে গেছে, তারা মেধাবী নয়। মার্ক্সকে আমরা মেধাবী বলি, কিন্তু মার্ক্স যাদের জন্য ওই মোটা বইটি লিখে গেছেন, তাদেরকে কি মেধাবী বলি? বলি না। শুধু বেছে বেছে ‘শিক্ষিত’, অর্থাৎ ‘ইনডোক্ট্রিনেইটিড’ লোকজনকেই মেধাবী বলা হচ্ছে। ‘আমরা আপেল খাবো, কারণ আমরা ব্রেইন-ওয়ার্ক করি’— শুয়োর সমাজের এই শ্লোগান মানুষের সমাজ থেকে আজও বিলুপ্ত হয় নি।
জে এস মিল তিন বছর বয়সে গ্রিক শিখেছিলেন। আট বছর বয়সে জেনোফোনের অ্যানাবাসিস ও হেরোডোটাসের সমস্ত রচনা পড়ে শেষ করেছিলেন। একই বয়সে ল্যাটিন শিখে তিনি ইউক্লিডের মূল রচনাবলী পড়েছিলেন। দশ বছর বয়সে প্লেটোর সিক্স ডায়ালগসহ পুরো ডেমোস্থিনিস আত্মস্থ করেছিলেন। ইতিহাস ও অ্যালজেব্রায় সে-সময়েই তাঁর অসাধারণ দখল ছিলো। বারো বছর বয়সে স্কলাস্টিক লজিক ও অ্যারিস্টোটোলিয়ান লজিক মূল ভাষায় পাঠ করেছিলেন, এবং তেরো বছর বয়সে বাবার সাথে এডাম স্মিথ ও রিকার্ডো পড়ে শেষ করেছিলেন। এরকম শিশু নিশ্চয়ই মেধাবী। কিন্তু আমাদের শিশুরা কি জেমস মিলের মতো বাবা পাচ্ছে? স্টুয়ার্ট মিল যদি জেমস মিলের ঘরে না জন্মে ঢাকার কোনো আলাউদ্দিনের ঘরে জন্মাতেন? তাহলে কী ঘটতো? আলাউদ্দিন তাঁকে কোনো একটা ইশকুলে ভর্তি করে দিয়ে দায় সারতেন, এবং মাঝেমধ্যে গ্রেড শিট দেখে বাচ্চাটিকে বকাঝকা করতেন। আলাউদ্দিনদের কাছে ভালো গ্রেডই সব। যার গ্রেড ভালো নয়, সে মেধাবী নয়। শিশুরা বেড়ে উঠছে এখানে পরীক্ষা-পাশের মেশিন হিশেবে। জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে তারা আগ্রহী নয়, কারণ আলাউদ্দিনদের কাছে জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্য শূন্য। বেগম আলাউদ্দিনরা ভাতের বাটি নিয়ে ইশকুলের মাঠে গিয়ে বসে থাকে, তবে কোনো বইয়ের বাটি তাদের হাতে আমি দেখি না। কোনো শিশু সারাক্ষণ যদি শরীরের খাবার খায়, তাহলে তার মনের খাবার আসবে কোথা থেকে? মনটি কি মারা যাবে না? মৃত মন নিয়ে যে-শিশু বড় হয়, তার মেধার সাথে কি জে এস মিলের মেধা মিলবে? মিলবে না। কারণ শিক্ষিত হওয়ার জন্য, অর্থাৎ রাষ্ট্র-প্রণীত সিলেবাস অনুসরণ করার জন্য, শুধু ভাত আর পাঠ্যবই খাওয়াই যথেষ্ট। ফলে এখানে যারা মেধাবী ছাত্রের তকমা নিয়ে ডিগ্রি-টিগ্রি নিচ্ছে, তারা কেবলই আহারসন্ধানী গৌণপ্রাণীর জীবনযাপন করছে, এবং এ আহার কৌশলে উৎপাদন করাচ্ছে অন্যদেরকে দিয়ে। তারা নিজেরা তেমন কিছুই উৎপাদন করছে না। না জ্ঞান, না ভাত। শুধু টাকা গুনছে। টাকা কী? টাকা হলো অন্যের উৎপাদিত ফসল কেড়ে নেয়ার অস্ত্র। মাস শেষে একটি নিশ্চিত বেতন, এটিই বাঙালি মেধাবী ছাত্রের প্রধান লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার দিকে তাকালে এটি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। পছন্দের বিষয় বা সাবজেক্ট নির্বাচন করার আগে তারা খোঁজখবর নিচ্ছে, কী নিয়ে পড়লে পাশ করেই চাকরি পাওয়া যাবে। বা সহজে বিদেশ যাওয়া যাবে। ফিজিক্সের চেয়ে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির চেয়ে অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি, এখানে অধিক জনপ্রিয়। আর্টসের সাবজেক্টগুলো তো কেউ পড়তেই চাচ্ছে না। আর্টস নাকি কম মেধাবীদের ফ্যাকাল্টি! কতো বড় আহাম্মক সমাজ! এমন রয়্যাল বেঙ্গল মেধাবী বাঘ আপনি কোন জঙ্গলে পাবেন? আমি জীবিকা উপার্জনকে নিরুৎসাহিত করছি না, কিন্তু জীবিকাকে ‘মেধা’ দ্বারা গ্লোরিফাই করার যে-প্রবণতা, সেটি বন্ধ হওয়া দরকার।
—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
পৃষ্ঠা ১৯৯-২০১, অধ্যায়: মেধাবী মিষ্টিকুমড়া
বই: ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে