02/05/2025
বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার আলোকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
-ড. একেএম শামছুল ইসলাম
ভূমিকা: শ্রমিকের ঘাম, রাষ্ট্রের ভিত্তি
মে দিবস শুধু একটি দিবস নয়—এটি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের ইতিহাস, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের এক গৌরবগাঁথা। ১৮৮৬ সালের শিকাগোর হে মার্কেটের আন্দোলনের রক্তিম অধ্যায় আজও বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশে মে দিবসের তাৎপর্য নতুন করে বিশ্লেষণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে একনায়কতান্ত্রিক দুঃশাসন ও ন্যায্য শ্রম অধিকার হরণকারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে। এই প্রস্তাবনাগুলোর আলোকে বর্তমান শ্রমিক-শ্রেণির অবস্থান, তাদের চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করা সময়োপযোগী।
১.৩১ দফার প্রাসঙ্গিকতা ও মে দিবসের অন্তঃসার
বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির মূল উপজীব্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি, আইন, প্রশাসন এবং নাগরিক অধিকার সংস্কারের মাধ্যমে একটি জনগণের রাষ্ট্র গঠন। এতে শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, শ্রমিক ইউনিয়নের স্বাধীনতা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, ও পেনশন প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
যেমন ৩১ দফার ১৮ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়েছে:
"শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) কনভেনশন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন করার পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা হবে।"
এটি শ্রমিকদের সংগঠিত হবার এবং শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে অবস্থান নেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত ভিত্তি প্রদান করে।
২.বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বিশাল অংশ শ্রমজীবী। গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহন, কৃষি, এবং প্রবাসী শ্রমিক—এই পাঁচটি খাতে শ্রমিকদের সংখ্যা কয়েক কোটি। এদের মধ্যে অনেকেই ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মস্থলের নিরাপত্তা এবং সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা বৈষম্য, হয়রানি, এবং শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার একদিকে ‘উন্নয়ন উন্নয়ন’ বলে প্রচার করলেও শ্রমজীবী মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। মজুরি কাঠামো অস্বচ্ছ, শ্রমিকদের দাবিতে দমন-পীড়ন, এবং পেটোয়া বাহিনী দিয়ে আন্দোলন দমন—এসবই প্রমাণ করে মে দিবসের দাবি আজও অপ্রাসঙ্গিক হয়নি।
৩.৩১ দফা ও শ্রমনীতি: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বিএনপির ৩১ দফার আলোকে যে শ্রমনীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত 'শ্রমিক বান্ধব উন্নয়ন' নীতির সঙ্গে মৌলিকভাবে পার্থক্যপূর্ণ এবং আদর্শগতভাবে স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রমনীতি যেখানে বেশিরভাগ সময়েই পৃষ্ঠতলের উন্নয়ন, রাজনৈতিক আনুগত্য, এবং মালিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে বিএনপির প্রস্তাবিত নীতি শ্রমিকের ক্ষমতায়ন, আইনী সুরক্ষা, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির ওপর জোর দেয়।
আওয়ামী লীগের 'শ্রমিক বান্ধব' প্রচারণা মূলত গার্মেন্টস ও নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা, কিছু বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন এবং নির্বাচিত সেক্টরে আংশিক শ্রম আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধ ছিল। বাস্তবে, এই নীতিগুলোর বাস্তবায়নে তদারকি দুর্বল, মালিক পক্ষের আধিপত্য সুস্পষ্ট এবং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
অন্যদিকে, বিএনপির ৩১ দফায় বলা হয়েছে:
ক.স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা হবে, যা আইএলও কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
খ.শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণে স্বতন্ত্র মজুরি কমিশন গঠন করা হবে, যাতে সরকার, শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের সমান অংশগ্রহণ থাকবে।
গ.কারখানা ও কর্মস্থলে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে শ্রম নিরীক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে।
ঘ.সমান কাজের জন্য সমান মজুরি, নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের জন্য বাস্তবায়ন করা হবে।
ঙ.প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান চুক্তির স্বচ্ছতা এবং সুরক্ষা বিধান সংবলিত আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হবে।
চ.অবসরকালীন পেনশন এবং দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ বাধ্যতামূলক করা হবে।
৪.মে দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য ও বাংলাদেশের বাস্তবতা
আজকের মে দিবসে বাংলাদেশে শ্রমিকরা কোনো বর্ণাঢ্য অর্জনের গল্প শোনাতে পারে না। বরং তারা বলবে কীভাবে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে মারা গেছে সহকর্মী, কীভাবে সারা মাস কাজ করেও বেতন পায়নি, কীভাবে ইউনিয়ন করতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি ৩১ দফার আলোকে মে দিবসের তাৎপর্য নতুনভাবে ধরা দেয়—এটি কেবল ‘শ্রমিক দিবস’ নয়, বরং ‘শ্রমিক মুক্তির দিন’-এর প্রতীক হতে পারে, যদি এই সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন করা যায়।
৫.ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার: ক্ষমতার কেন্দ্র না প্রতিবাদীর মুখপত্র?
আওযামী লীগ সরকারের আমলে ট্রেড ইউনিয়ন পুরোপুরি সরকারনির্ভর ও দলীয় অনুগত হয়ে পড়েছিল। শ্রমিকের ভাষায় নয়, বরং মালিক ও সরকারের ভাষায় কথা বলতো। অথচ ৩১ দফায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি এবং মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ের কাঠামো গড়ে তোলার কথা। ফলে মে দিবসে শ্রমিকের কণ্ঠস্বরকে কেবল স্মরণ নয়, বরং পুনর্জাগরণের একটি উপলক্ষ হিসেবে বিবেচনা করাই বাস্তবসম্মত।
৬.প্রবাসী শ্রমিক: বৈদেশিক রেমিটেন্সের নায়ক, রাষ্ট্রের অবহেলিত সৈনিক
বিএনপির ৩১ দফার আলোকে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য একটি পৃথক নীতির কথা বলা হয়েছে—যাতে তাদের সুরক্ষা, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, এবং প্রত্যাবর্তনের পর পুনর্বাসন নিশ্চিত হয়। মে দিবসে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অবদানকে স্মরণ করার পাশাপাশি, তাদের অধিকারের প্রশ্নে একটি রাষ্ট্রনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি।
৭.নারীর শ্রম: 'শ্রমিক' না 'দুই নম্বর মানুষ'?
নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বৈষম্য দ্বিগুণ। গার্মেন্টস, চা বাগান, এবং বাসাবাড়ির গৃহকর্মী হিসেবে যেসব নারী কাজ করেন, তাদের অনেকেই যৌন হয়রানি, বেতন বৈষম্য এবং সামাজিক অবহেলার শিকার। ৩১ দফায় নারী শ্রমিকদের জন্য পৃথক সুরক্ষা আইনের কথা বলা হয়েছে—যা বাস্তবায়ন হলে মে দিবস কেবল পুরুষ শ্রমিকদের জন্য নয়, বরং সকল শ্রমিকের মুক্তির দিনে রূপান্তরিত হতে পারে।
৮.রাজনৈতিক মুক্তি ও শ্রমিক অধিকারের সংযোগ
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলন বরাবরই সংযুক্ত। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শ্রমিকদের ভূমিকা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য, ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ২০২৪ ছাত্র জনতার সাথে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ—এই ধারাবাহিকতা আজও চলমান। বিএনপির ৩১ দফা এক অর্থে এই ঐতিহাসিক ঐক্যকেই পুনরুজ্জীবিত করতে চায়, যার মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের বাহন হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
৯.ভবিষ্যতের বাংলাদেশ: শ্রমিকবান্ধব রাষ্ট্রের রূপরেখা
মে দিবসের তাৎপর্য কেবল অতীত স্মরণ নয়—এটি ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারণেরও দিন। বিএনপি যদি ৩১ দফা বাস্তবায়ন করে, তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মানবিক, শ্রমিক-মেধানির্ভর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে পারে। যেখানে শ্রমিক হবে অংশীদার, করুণার বিষয় নয়।
উপসংহার: মে দিবস হোক ৩১ দফা বাস্তবায়নের আহ্বান
২০২৫ সালের মে দিবস এমন এক সময়ে এসেছে যখন দেশের শ্রমিক শ্রেণি একদিকে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের শিকার, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দমন-পীড়নের মাঝে একটি পরিবর্তনের আশা খুঁজছে। বিএনপির ৩১ দফা সেই আশার আলো জ্বালাতে পারে। তবে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার, জনসম্পৃক্ততা এবং শ্রমিক নেতৃত্বের নতুন ঐক্য।
মে দিবসে এটাই হোক আমাদের দৃপ্ত প্রতিজ্ঞা—আমরা একটি গণতান্ত্রিক, শ্রমিকবান্ধব, সুশাসিত বাংলাদেশ চাই। যে বাংলাদেশে শ্রমিক কেবল উন্নয়নের উপকরণ নয়, বরং উন্নয়নের শরিক হবে।
লেখক: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামছুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অব.), সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।