
04/01/2024
বিয়ের পর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম আমার বউ রাক্ষসী। বউ রাক্ষসী বললে অনেকেই হয়তো মনে করবেন, আমি নারীদের কটাক্ষ করে ‘রাক্ষসী’ শব্দটা ব্যবহার করছি- বিষয়টা একেবারে তা নয়। বউ আমার ডাকিনি বিদ্যা জানে। ছোটবেলায় কামরূপ কামাক্ষার যেসব রাক্ষসীর গল্প পড়েছি ঠিক সেইরকম।
একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর দরজায় নক করলেও দেখি বউ খোলেনা। সেদিন ঘণ্টা দেড়েক আগেই বাড়ি ফিরেছিলাম। ভেবেছিলাম সে হয়তো কিছু কেনাকাটা করতে বাইরে বেরিয়েছে। পরে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। দেখি পুরোবাড়ি অন্ধকার, কেবল বেডরুম থেকে আলো আসছে। আমি ভাবলাম, ঘরের মেইন সুইচের ইলেকট্রিক সার্কিট হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। বউকে একটু ভয় দেখাবো বলে ঠিক করলাম। ভয় দেখিয়ে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করে দিবো।
পা টিপেটিপে বেডরুমে ঢুকে আমার চোখ কপালে উঠলো। বউ একটা কাপড়ের পুতুল বানিয়েছে। তার সামনে মোমবাতির আগুন জ্বালানো, যেটা আমি ঘরে ঢুকতেই দেখেছি। বউয়ের কপালটা পুরোটা জুড়ে সিঁদুর সম্ভবত। লাল টকটক করছে। চোখ বন্ধ। বিড়বিড় করে কীসব পড়ছে। মন্ত্র! কাপড়ের পুতুলটার চুল ছিল। সেই চুল সে চোখ বন্ধ রেখেই আচমকা টান দিয়ে ছিঁড়লো। তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে জোরে একটা মন্ত্রের মতো পড়ে ফু দিয়ে আগুন নিভিয়ে দিল। এই পুরো সময়টা বউয়ের চোখ বন্ধ ছিল।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। টু শব্দটি করছি না। একসময় বউ চোখ খুললো। অন্ধকারেই আমাকে বললো- খুব ভালো করেছ তাড়াতাড়ি এসে, আজ আমার প্রকৃত রূপটা দেখতে পেলে।
আমি প্রথম প্রথম মনে করলাম- বউ ‘ব্লাফ’ দিচ্ছে। যেভাবে আমি ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম, সেভাবে সে নিজেই তৈরি হয়ে আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু বউ আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমি তোমাকে মোটেও ভয় দেখাচ্ছি না। তুমি দেখো সামনের বাসার ভাবির আগামীকাল সকালে টাক হওয়া লাগবে। সাহস কতো- আমাকে বলে চুলের কোয়ালিটি ভালো না!
একথা বলার সময় বউয়ের চোখে রাগের ঝিলিক দেখেছিলাম। পরদিন সত্যি দেখলাম সামনের বাড়ির ভাবি টাক। তার মাথায় নাকি কীভাবে চুইংগাম লেগে গিয়েছিল, সেটা এতোই আঠালো ছিল যে ভাবি কেরোসিন দিয়ে তুলতে গিয়েছিলেন। আর কীভাবে কীভাবে যেন চুলা থেকে আগুন ধরে গিয়েছিল চুলে!
এরপর থেকে প্রতিদিনই বউয়ের এরকম তন্ত্রমন্ত্র দেখা লাগতো। এমনকি আমার হয়েও সে কিছু কাজ করে দিয়েছে। যেমন- মন্ত্র পড়ে আমার অফিসের বসের একবার পেট খারাপ করিয়ে দিয়েছিল।
আমার পেটের অবস্থা খারাপ বলে একদিন অফিস যাইনি। বস আমাকে ইঙ্গিতে ফাঁকিবাজ বলার চেষ্টা করেছিল। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। সেকথা বলতেই, বউ শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করেছিল।
আমার স্ত্রীর নাম মঞ্জনা। আমার দুর্সম্পর্কের এক চাচার মেয়ে। দেখতে ভালোই সুন্দর। গ্রামে থেকেও পড়ালেখা মাস্টার্স পর্যন্ত করেছে। বিয়ের দুই মাসের মাথায় আমি জানতে পারলাম সে আসলে রাক্ষসী! এ কথাটা সে নিজেই আমাকে বললো। আসল মঞ্জনাকে নাকি বিয়ের রাতেই কামরূপ কামাক্ষায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর তার জায়গায় তার রূপেই রাক্ষসী মঞ্জনাকে রাখা হয়েছে।
আমি যতোটা না ভয় পেলাম, তারচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। জিজ্ঞাসা করলাম, আসল মঞ্জনাকে ফিরিয়ে আনার উপায় আছে? বউ আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে বললো- তার এখন আত্মা আছে আমার মানে রাক্ষসীর শরীরে, কামরূপ কামাক্ষায়। আমার আত্মা তার শরীরে। আমার আত্মার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কোনও উপায় নাই!
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার এখানে মিশন কী?
সে বললো- মানুষের পেটে সন্তান তৈরি করা। আমাদের রাক্ষসরা সবাই এক মুনির অভিশাপে ছয়শ বছর আগে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। আমরা বাঁচি হাজার বছর। ধীরে ধীরে আমাদের রাক্ষসরা সবাই মারা গেছে। কেবল রাক্ষসীরা কয়েকজন আছে। এখন আমাদের বংশবৃদ্ধি করতে হবে, আর তার জন্য মানুষের মাধ্যমে গর্ভধারণ করতে হবে।
আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- তোমরা মারা যাও কীভাবে? অসুখ বিসুখ করে? অ্যাক্সিডেন্টে?
রাক্ষসী বললো- উহু, আমাদের মস্তিষ্কের মৃত্যু হলেই কেবল আমরা মরি। আসলে আমরা থাকি মানুষের ব্রেইনে। বুড়ো হয়ে গেলে আমাদের মস্তিষ্ক মরে যায়, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মরে যাই।
আমি দমে গেলাম। অফিসে মন বসেনা। রাক্ষসী, তা সে দেখতে যতোই সুন্দরী হোক, তার সাথে তো স্নেহের চুমোও দেওয়া যায় না, কাম-ভালোবাসা দূরে থাক।
এদিকে বাড়ি ফিরতেই স্ত্রী চাপাচাপি করে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য। আবেদনময়ী হয়ে সামনে আসে। আমার চোখের সামনে কার্টুনে আর ছবিতে দেখা রাক্ষসীর চেহারাগুলো ভেসে উঠে। আমি আদর করতে পারি না।
এভাবে মাস দুয়েক যাওয়ার পর একদিন আফিসে বসে ঝিমোচ্ছি; বউয়ের তন্ত্র-মন্ত্র আর ভালো লাগে না। প্রতিদিনই সে কোনও না কোনও মানুষের অনিষ্ট করার জন্য মেতে আছে। ঠিক করলাম- আগে তাকে একটা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিবো। আমার মনে হয় রোগটা ‘স্কিৎজোফ্রেনিয়া’ হবে। এই মানসিক রোগে রোগী নিজেকে আধ্যাত্নিক বা অন্য জগতের অংশ বলে মনে করে। কিন্তু এটাও ঠিক যে মঞ্জনা, মন্ত্র পড়ে মানুষের ক্ষতি করতে পারে। সেটার প্রমাণ আমি নিজের চোখেই দেখেছি।
তারপরও তাকে ডাক্তারের কাছে নিবো বলে ঠিক করলাম। না যেতে চাইলে জোর করে নিবো। বিজ্ঞানের এই যুগে পরীক্ষা না করে এসব ছেড়ে দেওয়াটা গেঁয়োমি হবে। হয়তো সব ঘটনার পিছে কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।
সেদিন বাড়ি ফেরার পর মঞ্জনাই আমাকে চমকে দিয়ে বললো- দ্যাখো তোমাকে দিয়ে আমার কাজ হচ্ছে না। আমার বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে না। উল্টা তুমি মনে মনে আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছো। এককাজ করি তোমাকে বরং একটা মশা বানিয়ে দেই। আর আমি অন্যপুরুষের সাথে সন্তান উৎপাদন করি। আমাদের রাক্ষসীদের হাতে সময় বড়ো কম। তোমাকে আমি করুণা করে মারলাম না। যেদিন তুমি সন্তান উৎপাদনে রাজি হবে, সেদিন বলো। আবার মানুষ করে দিবো।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- তারপর? বাচ্চা হলে কী করবে?
মঞ্জনা আমার দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিলো যার অর্থ হচ্ছে- তুমি একথা আবার জিজ্ঞাসা করছো? তোমার তখন প্রাণ থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি!
যেই কথা সেই কাজ। মঞ্জনা আমাকে একটা মশা বানিয়ে দিলো। আমি এক মুহূর্তেই আবিষ্কার করলাম, আমি খুব ক্ষুদ্র হয়ে গেছি এবং গুণগুণ করে পাখা দুলিয়ে উড়ছি। মঞ্জনা আমাকে দেখে খিলখিল করে হাসছে। হাসিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছে। বলছে- যেদিন বলবে ‘বাবু নিবে’, সেদিন আবার মানুষ বানাবো। তবে তোমার কথা তো বুঝবো না। আমার ডান গালে বসলেই আমি বুঝে নিবো তুমি আমার শর্তে রাজি।
তৃতীয়দিনের দিন আমি মঞ্চনার ডান গালে বসলাম। আসলে মশার ব্যাপক শত্রু। এ কয়দিন সব ধরনের টিকটিকি, পোকাখেকো মাকড়সা দেখে ভয় পেয়েছি। আর না!
মঞ্জনার গালে বসতেই সে আমাকে আবার মানুষ বানিয়ে দিলো। বললো- এই তো লক্ষ্ণী ছেলে, আজ রাতেই তবে আমরা মিলিত হবো সন্তান উৎপাদনের জন্য।
আমি সায় দিলাম। গোসল করলাম। রাতে দুজন নিরাভরণ হলাম এবং মিলিত হলাম। প্রচণ্ড ঘেন্নার মধ্য দিয়েই আমি এক রাক্ষসীর সাথে সঙ্গম করলাম। কিন্তু পরদিন মঞ্জনা বিকারগ্রস্ত হয়ে গেল। তার প্রচণ্ড মাথা ধরলো। বমি হওয়া শুরু হলো। সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। মাত্র দুদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটলো। এ পুরো সময়টা আমি তাকে ঘেন্না নিয়ে দেখলাম।
মশা জীবনে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ‘সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া’র জীবাণু বহনকারী এক মশাকে। তার সাথে একরাত প্রেম করার পর সে আমাকে কথা দিয়েছিল, আমার মানব জন্ম ফিরিয়ে দিবে। বিনিময়ে তার মতো একটা মশার বীরত্বগাঁথা সবাইকে জানাতে হবে। আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কেনা জানে, সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া ভয়াবহ হলে, মাথায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, চিন্তা শক্তিও। মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়।
আমার আর রাক্ষসীরূপী মঞ্জনার সঙ্গমের সময়, সেই মশাটাই তার
নিরাভরণ দেহে কামড়েছিল। মস্তিষ্কের চিন্তা রাক্ষসীর মতো হলে কী হবে, শরীর তো মানুষ মঞ্জনারই। তাই তাকে ‘সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া’ ধরেছিল এবং মৃত্যু হয়েছিল।
অবশ্য পুরোপুরি মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর মঞ্জনার জ্ঞান আবার ফিরে এসেছিল। আর সে মঞ্জনা ছিল আমার বিয়ে করা বউ মঞ্জনা-ই।
(নানা আঙ্গিকে গল্প লিখতে ভালো লাগে। আজ একটু অন্য ধাঁচে ট্রাই করলাম।)
#রাক্ষ'সীর_কবলে (গল্প)
তন্ময় ইমরান
আবারো চলে আসলাম 💖নতুন একটি গল্প নিয়ে 🥳 আপনাদের ভালো লাগার উপর নির্ভর করবে 👏এর সামনের পথচলা✨। ভালো লাগলে অবশ্যই শেয়ার 😍করুন লাইক করুন 👍এবং অবশ্যই সুন্দর একটা মন্তব্য🗣️ করবেন। ❤️ধন্যবাদ❤️ আপনাকে💖, উৎসাহিত করার জন্য🙏, পেজে ফলো 👍 দিয়ে অ্যাক্টিভ থাকুন💯