27/04/2025
ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও পরাশক্তির নীরবতা: বিপন্ন বিশ্বশান্তি ও মুসলিম উম্মাহর ক্ষোভ
লেখক: মো: মাজেম আলী মলিন সহকারী অধ্যাপক রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ।সাংবাদিক ও কলামিস্ট ডেইলী অবজারভার, প্রকাশক ও সম্পাদক দৈনিক বনলতা।
"আগুনে পুড়ছে মানবতা, নীরব দর্শক সভ্যতা"
একটি রাষ্ট্র যদি দিনের পর দিন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, শিশুদের হত্যা করে, নারী ও বৃদ্ধদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে, সাংবাদিক ও চিকিৎসাসেবীদের নিশানা করে—আর বিশ্ব যদি তা দেখেও চুপ থাকে, তবে প্রশ্ন জাগে: আমরা আদৌ সভ্য সমাজে বাস করছি কি? আজ ঠিক সেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মানবজাতি। গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলা, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া কিংবা ইরাকের আগের ক্ষতচিহ্নগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। বিশ্বশক্তিগুলো যখন একদিকে শান্তির কথা বলে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে, তখন বোঝা যায়—এই দ্বিচারিতা বিশ্বশান্তির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
ইসরায়েলি আগ্রাসন: রাষ্ট্রীয় সহিংসতার এক নির্মম অভ্যেস
ইসরায়েলের আগ্রাসন নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গাজা অভিযানে যেভাবে একের পর এক বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ চালানো হয়েছে, তা রীতিমতো গণহত্যার নামান্তর। জাতিসংঘের অনুমোদিত মানবাধিকার সনদের একের পর এক ধারা লঙ্ঘিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধকালীন সময়ে হাসপাতাল, স্কুল, শিশুশ্রেণী এবং মানবিক সহায়তাকারী সংস্থার ওপর হামলা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু গাজার বিস্তীর্ণ জনপদজুড়ে এই নিয়ম যেন কেবল কাগজেই রয়েছে।
অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতালে শিশুর মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে কাঁদতে থাকা মা কিংবা পিতা-মাতার লাশ জড়িয়ে ধরা শিশু—এইসব ছবি কেবল মিডিয়ায় আসছে বলেই আমরা জানি। অথচ বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ।
সহিংসতার নেপথ্যে নানামুখী সহযোগিতা
ইসরায়েল এই যুদ্ধযন্ত্র চালিয়ে যেতে পারছে প্রধানত কারণ, বিশ্বশক্তিগুলো সরাসরি বা পরোক্ষভাবে তাদের সহযোগিতা করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়। যুদ্ধাস্ত্র, গোয়েন্দা সহযোগিতা, সাইবার প্রযুক্তি, এমনকি কূটনৈতিক সহায়তা—সব কিছুতেই ওয়াশিংটনের অকুন্ঠ সমর্থন পাওয়া যায়। ইউরোপের অনেক দেশও ভিন্ন ভিন্ন পথে ইসরায়েলের পাশে থাকে। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলো একের পর এক ভেটো হয়ে যাচ্ছে কেবল মাত্র একটি দেশের কারণে।
এই সহানুভূতির নেপথ্যে আছে রাজনৈতিক লেনদেন, অর্থনৈতিক স্বার্থ, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা এবং একটি অন্ধ ভাবাদর্শিক পক্ষপাত। অথচ এসব রাষ্ট্রই অন্য কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা তোলে।
মুসলিম উম্মাহর ধৈর্যের সীমা কোথায়?
দীর্ঘকাল ধরেই মুসলিম উম্মাহ নিপীড়নের শিকার। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, চেচনিয়া, বসনিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন—কোথাও মুসলিমদের ওপর নির্যাতন থেমে নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক গাজা পরিস্থিতি নতুন করে ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে।
প্রথমদিকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। কেউ কেউ কিছুটা বিবৃতি দিয়েছে, কেউ আবার কূটনৈতিক ভাষায় ‘উদ্বেগ’ প্রকাশে সীমাবদ্ধ থেকেছে। তবে আরব বিশ্বের জনসাধারণ, তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ বহু রাষ্ট্রের তরুণেরা আজ সোচ্চার। তারা ফিলিস্তিনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ জোরালো হচ্ছে, রাস্তায় মিছিল হচ্ছে।
এই ক্ষোভ আর দীর্ঘদিন বদ্ধ অবস্থায় থাকবে না। একসময় এই আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হতেই পারে। তার পরিণতি হবে বিধ্বংসী, এবং তাতে কেবল একটি অঞ্চল নয়, গোটা বিশ্ব রাজনীতি কেঁপে উঠবে।
মানবিক সহায়তা ও মিডিয়া: যুদ্ধে সত্যের নতুন শত্রু
এই যুদ্ধের আরেকটি নির্মম দিক হলো—ইসরায়েল কেবল ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর নয়, সাহায্যকারী সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক, চিকিৎসাকর্মী এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদেরও টার্গেট করছে। বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন World Central Kitchen, Doctors Without Borders, Al Jazeera, Reuters—তাদের প্রতিনিধিরা হামলার শিকার হয়েছেন।
এর অর্থ একটাই—ইসরায়েল চায় না যে যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্র বিশ্ব জানুক। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী ‘সেফ জোন’ বা চিকিৎসা ক্যাম্পে হামলা চালানো রীতিমতো যুদ্ধাপরাধ। অথচ এইসব হামলার সঠিক আন্তর্জাতিক বিচার হচ্ছে না।
বিশ্ব শান্তির জন্য এক বিপজ্জনক মোড়
ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং পরাশক্তির নীরবতা বিশ্বে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করছে। যে কোনো মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম সংঘবদ্ধভাবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এর প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও আন্তঃরাষ্ট্র সংঘাতে।
এই নৈতিক বিপর্যয় যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে একদিন মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং শান্তির প্রচলিত ধারণাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জিজ্ঞেস করবে—কেন আমরা চুপ ছিলাম? কেন আমরা অন্যায় দেখে প্রতিবাদ করিনি?
সম্ভাব্য করণীয়: মানবতার পক্ষে এক নতুন মোর্চা
বিশ্বশক্তি ও সাধারণ মানুষের কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত:
১. যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ: জাতিসংঘে চাপ বাড়ানো, ভেটো সংস্কার, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সহায়তা বৃদ্ধি
২. ইসরায়েলি পণ্যের বয়কট: নাগরিক পর্যায়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও প্রযুক্তিতে বয়কট
৩. মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য: ওআইসি ও মুসলিম লীগের কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ
৪. মিডিয়া ও তথ্য যুদ্ধ: স্বাধীন ও নির্ভীক সংবাদ মাধ্যমের পাশে দাঁড়ানো
৫. জনগণের সোচ্চার ভূমিকা: সামাজিক আন্দোলন, সচেতনতামূলক প্রচার ও মানবিক সহানুভূতির জাগরণ
ইতিহাস আজ প্রশ্ন করছে—তুমি কোন পক্ষের?
ইসরায়েল ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো যদি এই আগ্রাসন বন্ধ না করে, তবে শুধু একটি জনগোষ্ঠী নয়, গোটা মানবতা বিপন্ন হবে। তখন শান্তি, মানবাধিকার কিংবা সভ্যতার বুলি আর কাগজে লিখে রাখার জন্যও কোনো জায়গা থাকবে না। ইতিহাস সাক্ষী রাখবে—কে পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, আর কে নীরব ছিল। এখনো সময় আছে, সত্য ও মানবতার পাশে দাঁড়ানো যায়। একদিন যেন বলতে পারি—আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। কপি করলে লেখকের না পদবি রাখার অনুরোধ রইলো।