12/08/2024
প্রত্যেকটা গণতান্ত্রিক সরকারের উচিৎ ইতালীয় দার্শনিক উমবার্তো ইকোর “ফ্যাসিস্ট দেখতে কেমন হয়” লেখার ১৪টা পয়েন্ট মুখস্ত করা। এই ১৪টা পয়েন্ট মুখস্ত করবে কারণ ভুলেও যাতে একটা সর্বজনবিদিত সরকার এই ১৪টা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটাও নিজের মাঝে না আনতে পারে। যদিও উমবার্তো ইকো তার এই লেখা লিখেছিলেন ফ্যাসিস্ট মুসোলিনিকে চিন্তা করে, তবুও তার এই লেখা সব যুগের ফ্যাসিস্টদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। সকল ফ্যাসিস্টের এই ১৪টা বৈশিষ্ট্যই থাকবে এরকম না, তবে এই ১৪টার মাঝে অন্তত একটা থাকলেও সেই সরকার বা শাসককে ফ্যাসিস্ট বলা যাবে। ইকোর ১৪টা পয়েন্ট নিয়ে লিখতে যেয়ে আমি বিগত সরকারের উদাহারণ টানবো। সবগুলো বৈশিষ্ট্যে হয়তো মিলবেনা তবে যেগুলোতে একদম মিলে যায় সেগুলো বাদ দেই কেমন করে?!
১। ফ্যাসিস্ট রেজিম সবসময় একটা ‘সোনালি অতীত’ কে আঁকড়ে ধরতে চায়। তারা মনে করে সেই সোনালী অতীত তাদেরকে শক্তি যোগায়, ওটাই তাদের আদর্শ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাসিনা সরকার আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কে এই সোনালি অতীত হিসেবে সবসময় (অপ)ব্যবহার করে এসেছে। কথায় কথায় মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে একটা ভ্রমে রাখার চেষ্টা করেছে পুরো জাতিকে যেনো আওয়ামীলীগ ছাড়া আর কেউ এই ‘সোনালি অতীতের’ দাবিদার না হতে পারে।
২। ফ্যাসিস্ট রেজিম ঠিক ততটুকুই পরিবর্তন চায় যতটুকু পরিবর্তনের তার নিজের গদি ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। এক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট রেজিম আধুনিকবাদ বা মডার্নিজমকে ধারণ করেনা। কারণ মডার্নিজম প্রশ্ন করে, জটিল ভাবে ভাবে শিখতে চায়-শেখাতে চায় যেটা ফ্যাসিস্ট রেজিম পছন্দ করেনা। এক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট রেজিম প্রথাবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় যেটা একটাই ছাঁচ বা গঠন পছন্দ করে।
৩। ফ্যাসিস্ট রেজিম খুব আবেগে সিদ্ধান্ত নেয় যেটাকে আমরা বলি impulsive। ২০১৮ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আবেগ-অভিমানে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোটা একদম বাতিল করার। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট রেজিমে আলোচনার সুযোগ কম কিংবা নাই।
৪। বিরুদ্ধমত মানেই রাষ্ট্রদ্রোহী- আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বিগত সরকারের ফ্যাসিস্ট রেজিমের এই অংশটার উদাহারণ দিতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে।
৫। ফ্যাসিস্ট রেজিম ভিন্নতা কে কখনো স্বাগত জানায় না। ভিন্নতা বা তাদের মতো না হওয়াকে বরং হুমকি হিসেবে নেয়। বিগত সরকারের দল আওয়ামীলীগ তাদের দলের বাইরে আর কাউকেই নিতে পারতো না। এই দ্বন্দ্ব কে আমরা self/other এর বাইনারি বলতে পারি।
৬। ফ্যাসিজমকে তুলে ধরার জন্য একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের নিজস্ব কিছু ‘সুশীল’ থাকবে। এই সুশীলরা হবে অনেকটা মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাদের কাছে ফ্যাসিস্ট রেজিমের সবকিছুই গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সাম্প্রতিক সময়ে বিগত প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিক প্রবাস আমিন কিংবা ফারজানা রূপা দ্রষ্টব্য।
৭। ফ্যাসিস্ট রেজিম সর্বদাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী। দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, আমাদের জাতীয়তার উপর আঘাত আসছে, বিদেশী শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, জঙ্গী উত্থান হচ্ছে- ইত্যাদি নানান রকমের প্লট সর্বদাই জনগণের দিকে ছুঁড়ে দেয় ফ্যাসিস্ট রেজিম।
৮। ফ্যাসিস্ট রেজিম একই সাথে নিজেকে দুর্বল ও সবল হিসেবে প্রতিফলিত করতে চায়। দুর্বল অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট রেজিম জনগণ কে বোঝাবে, ‘আপনাদের ছাড়া আমরা অচল, একসাথে আমরা সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করবো’ আবার সবল হিসেবে বলবে, ‘আমাদের কেউ হটাতে পারবেনা কারণ আমাদের আছে জনগণের শক্তি’। খুব সুক্ষ্ণভাবে ফ্যাসিস্ট রেজিম এই কাজটা করে।
৯। ফ্যাসিস্ট রেজিমের অন্যতম একটা কাজ হচ্ছে ঐতিহাসিক কোনো যুদ্ধ কে গ্লোরিফাই করা। ১নং বৈশিষ্ট্যের সাথে অনেকাংশেই মিলে এটা। মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে ধারণ করে সবকিছুতেই মুক্তিযুদ্ধ ব্যবহার প্রতিটা অন্যায়কে জায়েজ করা হয়েছিলো বিগত সরকারের আমলে।
১০। ফ্যাসিস্ট রেজিম সবসময় শক্তিকে তোষণ করে। সেটা অর্থের হোক কিংবা মিলিটারি। শেয়ার বাজার কেলেংকারি, ব্যাংক লুটপাট, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সাথে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো তারা বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমের খুব কাছের। ফ্যাসিস্ট রেজিমের কাছে দুর্বল বা ভালনারেবল মানুষের কোনো স্থান নেই।
১১। ফ্যাসিজম হিরো তৈরি করে খুব সুক্ষভাবে। জনগণের কাছে হিরো বানায় কাউকে কাউকে। গত সরকারের আমলে সেই শাহবাগ গণজাগরণের ইমরান এইচ সরকার থেকে শুরু করে হালের ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন কিংবা সাকিব আল হাসান/মাশরাফি মর্তুজা- এই সব ম্যানুফ্যাকচার্ড হিরোকে তো বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমই তৈরি করেছিলো।
১২। ফ্যাসিজম নিদারুণভাবে পুরুষতান্ত্রিক। ফ্যাসিস্ট রেজিমের বাহক মহিলা হলেও যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণ করতে পারে তা আমরা বিগত সরকারের সময় দেখেছি। নারীর ক্ষমতায়ন শুধু মুখে মুখেই ছিলো। পাহাড়ি আদিবাসী নারী, কিংবা সাধারণ নারীদের নিরাপত্তার কোনোরূপ আয়োজন ফ্যাসিস্ট সরকার করেনি।
১৩। ফ্যাসিস্ট রেজিম বলে তারা জনগণকে সাথে নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু আদতে তারা খুব নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠিকে ছাড়া আর কাউকেই তাদের সাথে রাখেনা। সেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠি হলো তাদের দল কিংবা দলীয় আদর্শের ধারক বা তল্পিবাহক।
১৪। সর্বোপরি ফ্যাসিস্ট রেজিম নিজেদের মত করে সংবাদ ম্যানিপুলেট করে। তাদের চ্যানেলগুলোর শব্দচয়ন বা সংবাদ পরিবেশনের ধরণ দেখলেই বোঝা যায় সংবাদগুলো আরোপিত। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশ যখন নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের গুলি করছিলো তখন বেশিরভাগ সংবাদ চ্যানেলগুলো রাষ্ট্রের অবকাঠামোর কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা দেখাতে ব্যস্ত ছিলো। মেট্রোরেল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য কান্না ঢেকে দিয়েছিলো নিরীহ শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ।
একটা ফ্যাসিস্ট রেজিম ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। এই ভয় তৈরি করে আজ্ঞাবহ কর্মী, আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক তল্পিবাহক।