31/08/2025
(১)
রাঙামাটিতে বেড়াতে গিয়ে আপনারা লেকে ঘুরতে যান না বোটে করে? লেকটার নাম কাপ্তাই লেক। লেকের নিচে ডুবে আছে হাজার মানুষের ঘরবাড়ী, চাষের জমি। সেই লেকের মধ্যে ছোট একটা নামহীন দ্বীপ, সেখানে একটা সমাধি আছে- সেই সমাধিতে শায়িত আছেন আমাদের একজন বীর, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রঊফ। মুন্সি আব্দুর রউফ কিভাবে শহীদ হয়েছিলেন জানেন?
তাঁর সমাধিটা যেখানে সেখান থেকে কাছেই পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে লড়ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট একটা দল। এর মধ্যেই সেখানে এসে হাজির হয় পাকিস্তানী বাহিনীর কয়েকটি লঞ্চ, স্পীড বোট আর ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বড় একটি দল। সিদ্ধান্ত হয় রিট্রিট করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? মুন্সি আব্দুর রউফ এগিয়ে আসেন, আমি পাকিস্তানীদের সামলাবো, বাকিরা চলে যান। মুন্সি আব্দুর রউফ একটা মেশিনগান নিয়ে একা পাকিস্তানীদের পুরো দলটিকে আটকে রাখেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বাকি দলটি এর মধ্যে নিরাপদে সরে যায়।
সাথীদের প্রাণ বাঁচাতে শেষ নিঃশ্বাসটি থাকা পর্যন্ত লড়েছেন ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ। তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তাঁকে দাফন করার কেউ ছিল না সেখানে। দয়াল চাকমা নামে একজন আমাদের ঐ বীরের নিথর দেহটি সংগ্রহ করে এই ছোট্ট দ্বীপটিতে দাফন করেন। আপনি কি জানতেন ইতিহাসের এই ছোট অধ্যায়টির কথা? ঐ যে গানটিতে একটা লাইন আছে না? 'বড় বড় লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুনিদের আসরে, তোমাদের নাম কেউ কবে না', শুনেছেন না? দয়াল চাকমা হচ্ছেন সেইরকম একজন যার নাম আপনারা কোনদিন লিখবেন না।
(২)
তবু তো দয়াল চাকমার কথা আমরা জানি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পুরো ইতিহাসে কতজন চাকমা বীরের গৌরবজনক ভূমিকা ছিল সেইসব কথা কি আপনি জানেন? জানেন না। পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও আছেন কয়েকজন যাদের গৌরবজনক ভূমিকার কথা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। আপনারা তো জানেন কেবল একজন ত্রিদিব রায়ের কথা, ত্রিদিব রায়ের পরিবারেরই অন্যদের ভুমিকার কথা জানেন? জানেন না। শোনেন, ত্রিদিব রায় একটা রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, সেজন্যে তাঁকে নিন্দা করতে চান করেন। কিন্তু চাকমা জাতিকে ছোট করবেন না।
শোনেন, শুনতে কটু শোনাবে অনেকের কাছে, তবুও বলি। চাকমাদের মধ্যে কোন গোলাম আজম নাই, চাকমাদের মধ্যে কোন নিজামি নাই, সাইদি নাই, কাদের মোল্লা নাই। চাকমাদের মধ্যে কোন আলবদর নাই, কোন আল শামস নাই। একাত্তরে এই সময়টাতে যারা আমাদের প্রিয়দের চেয়ে প্রিয় শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী (আজাদ), শহীদ আবু বকর (বকর), শহীদ শাফী ইমাম (রুমী), শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী (জুয়েল), শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান (হাফিজ) ও শহীদ বদিউল আলম (বদি) ওদেরকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওদের মধ্যে কোন চাকমা ছিল না- ওরা সবাই ছিল মুসলমান।
এক বেয়াদব মেয়ে, শিবিরের প্যানেল থেকে ইলেকশন করছে নাকি মেয়েটা, সে নাকি বলে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নাকি চাকমাদের কোন স্টেক নাই। ওরে ফাজিল স্টেক আবার কিরে। চাকমা আর বাঙালি কাঁধে কাঁধ রেখে একসাথে লড়েছে ১৯৭১ সনে। চাকমা জাতি বীরের জাতি, ভারতবর্ষের সব জনগোষ্ঠী যখন মুগলদের ভয়ে থরথর করে কাঁপতো ওদের সাথে লড়তে সাহস করতো না, তখনো চাকমারা যুদ্ধ করেছে মুগলদের বিরুদ্ধে। ইতিহাস খুলে দেখ বেয়াদব মূর্খ কোথাকার। স্টেক আবার কিরে? ১৯৭১ যতটুকু বাঙালীর ঠিক ততটুকুই চাকমাদেরও। স্টেক আবার কিরে?
(৩)
নির্বাচন করতে গেছে রাজাকারের প্যানেল থেকে, আরে তুই তো নিজেই চেতনাগতভাবে একজন রাজাকার। রাজাকারদের প্যানেলে থেকে সে আবার চাকমাদের দিকে আঙ্গুল তোলে- সেটেলারের বাচ্চা। পড়া নাই লেখা নাই, দেশপ্রেমের লেশ মাত্র নাই, বিচিত্র সব শব্দ মুখস্ত করে একেকটা, আর ঐসব মুখস্ত জারগণ ঝেড়ে দিয়ে বিজ্ঞের মতো ভাব ধরে, ভণ্ড কোথাকার।
শোনেন, আমাদের সমতলের সব বড় বড় নবাব, জমিদার, খান বাহাদুর রায় বাহাদুররা যখন ইংরেজদের পা চাটার জন্যে জিহ্বা বের করে থাকতো, সেই সময়েই একজন চাকমা রানী ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। লড়াই করার বাস্তবতা ছিল না, সংঘর্ষ হলে ছোট এই জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিপন্ন হতো। ইংরেজরা প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে একটা সমঝোতা করি, একজন ইংরেজ অফিসার জেবে রানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে। রানী বলে দিয়েছে, ঐ লাল বাঁদরের চেহারাই আমি দেখবো না (ডায়লগটা হুবহু ভুলে গেছি)। ভাবতে পারেন! এই দুঃসাহসী রানীর নাম জানেন? তিনি ছিলেন রানী কালিন্দী।
রানী কালিন্দী রানী ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি নিজে কোন রাজ পরিবারের সন্তান ছিলেন না। সামান্য একজন জুমচাষির কন্যা ছিলেন তিনি, খুব একটা পড়ালেখা করতে পারেননি। শিকারে গিয়ে রাজামশাই এই হালাবিকে দেখে প্রেমে পড়ে যান, রাজাকে বিয়ে করে রানী হয়েছিলেন। এই জুমচাষির কন্যাই চাকমা জাতির দুর্দিনে কুকি ও লুসাইদের সাথে যুদ্ধ করে চাকমা রাজ সার্কেল রক্ষা করেন। চাকমা জাতিকে নিয়ে কথা বলার আগে এই জাতি সম্পর্কে জেনেও নিতে পারেনা এরা।
(৩)
আপনারা যখন কোটা আন্দোলন করছিলেন, ওরা জানতো যে এই আন্দোলন সফল হলে ওদের নিজেদেরই ক্ষতি হবে, তথাপি চাকমা ছেলেমেয়রা আপনাদের আন্দোলনের সাথে ছিল না? ছিল তো। আর প্রতিদানে এখন কিনা ওদের কটু কথা শুনতে হয়। ওদের প্রত্যাশা ছিল আন্দোলনে বিজয় হলে দেশের সংবিধানে 'আদিবাসী' কথাটা যুক্ত হবে। এই যে আপনারা দিনের পর দিন সংবিধান ইত্যাদি নিয়ে কত লম্বা লম্বা আলোচনা করলেন- একবারও কি কেউ তুলেছেন কথাটা? তোলেননি।
এসেছে চাকমাদের নিয়ে কথা বলতে, বলে কিনা কোন স্টেক নাই। কি বলবো এদেরকে বলেন! মানুষের প্রতি সম্মান থাকতে হয়। নাইলে যতই ডিগ্রী ফিগ্রি নেন না কেন, আপনি একটা মূর্খ নিচু মানুষ। থাক, কটু কথা বললাম না।লিখেছেন ইমতিয়াজ আহমেদ।