12/11/2022
মহান নেতা এমএন লারমার জীবনের শেষ দিনটি:-
১৯৮৩ সনের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ।বিরুপ আবহাওয়া।প্রায়ই ঝড়ো হাওয়া এসে গোটা পরিবেশটাকে বিষণ্ন করে তুলছে।ডাঃ জুনির নিরবিচ্ছিন্ন পরিচর্যার সত্বেও লীডার(লারমা) নিরাময় লাভ করতে পারলেন না।রাত প্রায় তিনটে, লীডার অসুখে ছটপট করছে,নিরন্ন মুখে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন।আমরা যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়লাম।এদিকে সন্তু স্যারও প্রেসিডেন্ট এরশাদের ৩ অক্টোবরের ঘোষণার বিপরিতে চিঠি লিখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছেন।তাই আর অস্থায়ী ব্যারাক স্থানান্তরিত করা সম্ভব হলো না।নভেম্বরের ৯ তারিখ বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কমেছে বটে কিন্তু দমকা হাওয়া বিদ্যমান।সারাক্ষণ কাকের কা-কা রবে প্রকৃতি যেন কিসের এক আশঙ্কায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে।বিকেলে লীডারকে কিছু বিস্কুট খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলো কিন্তু তিনি খেতে পারলেন না।ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।সবাই যার যার বিছানায় শুয়ে পড়েছে।রাত ৮টা নাগাত পাশের ঝিরিতে কিযেন একটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ শোনা গেলো।দু'জন সৈনিক টর্চ লাইটের আলোয় জায়গাটা সার্চ করে এলো।কিছুই দেখতে না পেয়ে প্রকৃতির ঘটনা ভেবে তারাও ঘুমিয়ে পড়লো।রাত ১১_১২টা পর্যন্ত আমরা ৪জন প্রহরায় ছিলাম।তখনও শুষ্ক হাওয়া বয়ে চলেছিল।মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জোছনার আলো যেন পৃথিবীর সাথে লুকোচুরি খেলছিল।তখন কে-ই বা জানতো প্রকৃতির মধ্যে কোন বিভীষিকাময় ঘটনা কারোর জন্য প্রতিক্ষা করছে কি-না। প্রহরী বদল করে আমরা শুয়ে পড়লাম।আমার পাশের সঙ্গীর সামান্য জ্বর ছিলো।তাই তাকে বিরক্ত না করে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
১০ নভেম্বর ভোর রাত সাড়ে তিনটে বাজতে কিছু সময় বাকি।গভীর তন্দ্রা থেকে বিদঘুটে এক স্বপ্নের শিহরনে আমি জেগে গেলাম।শয্যার উপর বসে চারদিকে একটু তাকালাম_দেখলাম প্রহরী বদল হচ্ছে। হাতের ঘড়িটা টর্চের আলোয় একটুখানি দেখে নিয়ে আবার গা এলিয়ে দিলাম।ভাবলাম হয়তো একটু অসুবিধার মধ্যে ঘুমাতে গিয়ে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙলো।তারপর আস্তে আস্তে ঘুমের তন্দ্রা পাচ্ছে। পায়ের কাছে একটু কড়মড় শব্দ হওয়ায় টের পেলাম কে যেন টর্চের আলো নিয়ে বাহিরে যাচ্ছে__আর একটু পরেই অকস্মাৎ কারবাইনের ব্রাশ ফায়ার হলো ট-ট-ট-টশ।সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে পায়ের কাছে মাটিতে লাইন পজিশন নিলাম।"মুই রিপন","মুই রিপন"_কথাটা শুনতেই তাকিয়ে দেখি রিপন দা ''ওমা" ''ওমা'' করতে উঠনে গড়াগড়ি দিচ্ছে।
কিছু না বুঝে চিৎকার করে বললাম, কি হয়েছে! তখন উত্তর পশ্চিম কোণের পায়খানার রাস্তার মুখ(বড় ব্যারাকের একদম সন্নিকটে এলএমজি ম্যানের খুব কাছাকাছি)থেকে একজন সোজা দক্ষিণে লীডারকে লক্ষ করে ক্রমাগত ব্রাশ ফায়ার করছে,অন্যজন আমাকে ও সন্তু স্যারকে লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করে চলেছে।আর বিশ্বাসঘাতকেরা ”ইয়া আলী...,ইয়া আলী.." শব্দ করছে এবং এ্যাবুল্যা এডভান্স... এডভান্স করে বিকৃত গলায় শব্দ গুলো উচ্চারণ করছে।ততক্ষণে আরো ৪/৫ জন আমাদের ব্যারাকের খুব কাছে এসে ব্রাশ ফায়ার করছে।বোঝা গেল চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশ আর্মির বেশ ধরে আক্রমণ করতে এসেছে।ট্রেঞ্চে গিয়ে পজিশন নিলাম। সেখানে সন্তু স্যার ও মিহিরদাকে পেলাম।ততক্ষণে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মণিময় ও কর্পোরেট অর্জুন উত্তর দিকের ট্রেঞ্চ গুলোয় পজিশন নিতে গিয়ে সরাসরি শত্রুদের ফায়ারের মুখে পড়ে মৃত্যু বরণ করে। ঐ দুটো অস্থায়ী ব্যারাকে আমরা ২০/২২ জন ছিলাম।সেই মুহুর্তে অসুবিধার দিকটা ছিল যে,শত্রুরা রয়েছে উত্তর প্রান্তে আর আমরা পজিশন নিতে বাধ্য হয়েছি দক্ষিণ প্রান্তে। মাঝখানে রয়ে গেছে দুটো ব্যারাক আর মানুষ গুলো।তাই বাদবাকি মানুষদের কথা চিন্তা করে আমরা ঠিকমতো ফায়ার করতে পারছিলাম না।কারন সেই অন্ধকারে কাউকে ঠিকঠাক চেনা যাচ্ছিলো না।
আমরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে অবস্থান করছিলাম।পাহাড়ের সর্ব উত্তর দক্ষিণ লম্বালম্বি ব্যারাক,সেখান থেকে ৪০/৫০ গজ নিচে সামনাসামনি দুটো ব্যারাক।ব্যারাকের পাশে দক্ষিণ মুখি হয়ে একজন সেন্ট্রি থাকে।সেখান থেকে ২০/২৫ গজ নিচে ঝর্ণার কাছাকাছি পাকঘর-কাম-ব্যারাক পাশাপাশি। সেদিন পূর্ব মুখি একজন সেন্ট্রি ও উপরের ব্যারাকের উত্তর-দক্ষিণ হয়ে দুইজন সেন্ট্রি মিলে সর্বমোট ৪জন সেন্ট্রি সবসময় থাকতো।কিন্তু শত্রুরা মুহূর্মুহু ফায়ার ও হাত বোমার আওয়ার করতে করতে মধ্য ব্যারাকের উঠোন বরাবর ও ব্যারাকের নিচে ঢুকে পড়েছিল।
উপুর্যুপরি ব্রাশ ফায়ার ও হাত বোমার বিস্ফোরণে মনে হচ্ছিল প্রতিহিংসার উন্মত্ততায় শত্রুরা যেন প্রতিটি লতা গুল্মকেও ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে।সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ট্রেঞ্চের কাছাকাছি দুটি হাত বোমা বিস্ফোরণ ঘটে এবং প্রবল বেগে গোলা বর্ষণ করতে থাকে।ফিল্ড কমান্ডার সন্তু স্যার উপরের ফাইটিং গ্রুপ নিয়ে পাল্টা আক্রমন করতে থাকে।ইতোমধ্যে কর্পোরেল জাপানকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে চিকিৎসা ব্যাবস্থা ও পার্টির বিভিন্ন ইউনিটের সাথে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে সন্তু স্যার অ্যাকটিভ থাকেন।এমন সময় উপর থেকে আমাদের ফাইটিং গ্রুপ এসে শত্রুদের পাল্টা আক্রমন করতে থাকে। চতুর্দিকে ফায়ারের আওয়াজ শুনে শত্রুরা মন্ত্রী মন্ত্রী বলে ডাকাডাকি শুরু করে দেয় এবং কয়েকবার লম্বা করে বাঁশি বাজানোর পর পূর্বদিকে ছড়া বেয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে ঘটনাস্থলেই লীডারসহ(লারমা) আরো ৮ জন শহীদ হয় এবং কর্পোরেল সৌমিত্র ও বকুল আহত হয়।এরপর কর্পোরেল সৌমিত্র আহত অবস্থায় দুই দিন বেঁচে থাকার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
তার প্রত্যাক্ষ বিবরন থেকে জানা যায়, লীডার প্রথমে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়।কিন্তু অসুস্থ ও দুর্বল ব্যবস্থার হেতু তিনি সড়ে যেতে পারেননি।শত্রুরা ব্যারাকের ভিতরে ঢুকে লীডারকে আহতাবস্থায় দেখতে পায়। তখন লিডার হত্যাকারিদের সাথে কথা বলার সুযোগ পায়।লীডার প্রথমে বলেন___"কি,তোমাদের ক্ষমা করে আমরা অন্যায় করেছি?আমাকে কিংবা তোমার বন্ধুদের মেরে জাতি কি মুক্ত হবে?যাক,তোমরা প্ররোচিত হয়ে যাই করো না কেন জাতির দুর্দশাকে কখনো ভুলে যেও না আর জাতির এ আন্দোলন কখনো বানচাল হতে দিও না"।লীডারের কথা শুনে দুজন বিভেদপন্থী নীরবে চলে যায়। তারা আর ফিরে আসেনি।ততক্ষণে তাদের মধ্যে কড়া ভাষায় কথা কাটাকাটি হতে শোনা যায় এবং সন্ত্রস্ত কন্ঠে "ও যেদং ভিলে...যেদং" শব্দ শোনা যায়। সেই মুহুর্তে বিদ্যুৎগতিতে কেউ একজন এসে লীডারের গায়ের উপরে উঠে কোন কথা বলো না বলে ব্রাশ ফায়ার করে দ্রুত চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরে জায়গাটি আমাদের পুনদখলে আসে।সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মীরা এসে শ্রদ্ধেয় লীডারকে বুকে জড়িয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বলতে থাকে__"স্যার.. ও স্যার আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।তুমি ছাড়া আমরা কোথায় থাকব স্যার"।
শ্রদ্ধেয় লীডারের বুক তখনও উষ্ণ ছিল।তিনি কোনমতে চোখ মেলে তাকালেন এবং হাত দিয়ে কি যেন সান্ত্বনা দিতে চাইলেন কিন্তু তার মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না,কোন অশ্রু ঝড়ল না।শুধু বুকের তাজা রক্ত বিছানা গড়িয়ে টপটপ করে পড়লে লাগলো।তারপর চোখ খোলা রেখে লম্বা এক বুকভরা শ্বাস নিয়ে অতি স্বাভাবিক ভঙিমায় চির শায়িত হয়ে গেলেন।নির্মম এই পৃথিবী যিনি নিপিড়ীত, নির্যাতিত, শোষিত জাতির সেবায় নিজের শেষ রক্ত বিন্দুটুকুও দান করে গেলেন সেই জাতি তাদের জাতীয় জাগরনের অগ্রদূতকে একফোটা পানি খাওয়ানোর সুযোগও পেল না।
তার স্বাভাবিক উজ্জ্বল চেহারা তার খোলা চোখ যেন তিনি এখনো স্বাভাবিক। দেখে মনে হয় মৃত্যুর পূর্ব ক্ষনেও যেমনি কোন ভয়ভীতি তাকে ছোঁয়াতে পারেনি, তেমনি জন্মভূমির মায়া,প্রকৃতির আলো বাতাস দু-চোখ ভরে দেখার স্বাদ এখনো মেটেনি।উত্তপ্ত রক্ত প্রবাহের বিদ্যুৎ খেলানো শান্তিবাহীনির বীর যোদ্ধারা শত্রুকে তাড়া করে ঘড়ে ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করে লীডার কোথায়? যখন দেখে লীডারের নিষ্প্রাণ দেহখানি পড়ে রয়েছে তখন আর কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারে না। কান্না জড়িত কন্ঠে বলে" শেষ...সব শেষ..চক্রান্তকারীরা লীডারকে হত্যা করে সব শেষ করল।তোমাদের একদিন এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে "।
লেখা:মেজর তাতিন্দ্র লাল চাকমা(পেলে)