08/07/2025
স্বাস্থ্যকর একটি সুন্দর জীবন যাপনে শারীরিক কসরত কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে তা আমাদের সকলেরই জানা। এর ফলে আমরা শারীরিক ও মানসিক দুই দিক দিয়েই সুস্থ থাকি। কিন্তু কখনো কি এমন প্রশ্ন এসেছে যে গর্ভবতী নারীদের ইতিবাচক শারীরিক কসরত কি শিশুর উপরও কোনো প্রভাব ফেলে? ফেললে, তা কি ইতিবাচক না নেতিবাচক? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা ও বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনার মাধ্যমে যা পেয়েছেন তা সত্যিই দুর্দান্ত। তারা বলছেন, কোনো ধরনের চিকিৎসাগত জটিলতাহীন সুস্থ গর্ভবতী নারীদের মধ্যে যারা শারীরিকভাবে তুলনামূলক বেশি সক্রিয়, তাদের নবজাতকদের কর্টিকাল মস্তিষ্কের বিকাশ উন্নততর হবে। এ অবস্থায় শারীরিক কার্যকলাপের পাশাপাশি সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা জাতীয় কার্যকলাপে গর্ভবতী নারীরা যদি সময় দেন তবে ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশ তথা কর্টিকাল পুরুত্বের (cortical thickness; শৈশব ও কৈশোরে মস্তিষ্ক বিকাশের একটি সূক্ষ্ম নির্দেশক) বিকাশকে তা দারুনভাবে উৎসাহিত করে; যা পরবর্তীতে সন্তানের দীর্ঘমেয়াদি স্নায়বিক ও জ্ঞানগত উন্নয়নে প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, গর্ভাবস্থায় মায়েদের শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয় থাকার সঙ্গে তাদের সন্তানের মাত্র ১৫ মাস বয়সে শব্দভাণ্ডার স্কোর বৃদ্ধি এবং ২ বছর বয়সের মধ্যেই সামগ্রিক ভাষা বিকাশের একটি ইতিবাচক সম্পর্ক দেখা গেছে! তাছাড়া, গর্ভাবস্থায় বেশি শারীরিক কার্যকলাপ থাকা সন্তানদের Battelle Development Inventory এর স্কোর বৃদ্ধি, ১ বছর বয়সে Ages and Stages Questionnaire এ অস্বাভাবিক ও নেতিবাচক ফলাফলের ঝুঁকি হ্রাস, এবং ৫ বছর বয়সে Wechsler Preschool and Primary Scale of Intelligence ও পুরোপুরিভাবে সামগ্রিক ভাষা দক্ষতা উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশুরা জন্মের পর থেকেই পরিমাণ, প্যাটার্ন, সিকোয়েন্সিং ইত্যাদি গাণিতিক ধারণা বুঝতে শেখে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের সক্রিয়তা ও সৃজনশীলতা এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব আর্কানসাস ফর মেডিক্যাল সায়েন্সেস এর অধিনস্থ ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ড সম্পূর্ণ গবেষণা পদ্ধতিটির অনুমোদন দেয়। পূর্বে সংঘটিত গর্ভবতী নারীদের বিএমআই এর সাথে নবজাতক মস্তিষ্কের কর্টিকাল বিকাশের সম্পর্ক নির্ণয়ক একটি গবেষণার কোহর্টের সাথে উক্ত গবেষণার কোহর্ট সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। এখানে টেস্ট সাবজেক্ট হিসেবে একটি বৃহত্তর গবেষণা কোহর্ট হতে কিছু ২১ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী কোনো ধরনের কৃত্রিম পদ্ধতির প্রয়োগ ছাড়াই দ্বিতীয়বার গর্ভধারণকারী নারী এবং এককভ্রূণ গর্ভধারণকারী নারীদের নির্বাচন করা হয়। অতঃপর মোট ৪৪ জন গর্ভবতী মা এবং শিশু যুগলকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গর্ভাবস্থার ৪র্থ–১০ম, ১২তম, ১৮তম, ২৪তম, ৩০তম এবং ৩৬ তম সপ্তাহে সকল গর্ভবতী নারীরা ছয়টি গবেষণা পরিদর্শনে অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রত্যেক সময়ে ৩-৭ দিনের জন্য একটি অ্যাক্সিলেরোমিটার ব্যবহার করে তাদের শারীরিক কার্যকলাপ পরিমাপ করা হয়। প্রতিটি গবেষণা পরিদর্শন বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত হতে অংশগ্রহণকারীকে কমপক্ষে তিনটি বৈধ দিন রেকর্ড করতে হতো যার মধ্যে কমপক্ষে দুটি কর্মদিবস এবং একটি সপ্তাহান্তের দিনের অ্যাক্সিলেরোমিটার ডেটা অন্তর্ভুক্ত থাকতো। পরীক্ষাকালীন গর্ভধারণের সম্পূর্ণ সময় জুড়ে বিভিন্ন শারীরিক কার্যকলাপের ডেটা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করা হয়। সমস্তদিনের মোট পদক্ষেপ সংখ্যা, সকল কার্যকলাপ এবং প্রতিটি কাজের তীব্রতার (নিষ্ক্রিয়, হালকা, মাঝারি, প্রবল, নির্মাতার সুপারিশ অনুযায়ী নির্ধারিত) ভিত্তিতে ব্যয়িত মিনিটের সমষ্টিকে মোট বৈধ দিনের সংখ্যা দ্বারা ভাগ করে পরিমাপগুলোর গড় দৈনিক মান নির্ণয় করা হয়।
এছাড়াও, টেস্ট সাবজেক্ট এবং তাদের জীবনসঙ্গীর শিক্ষাজীবনের ইতিহাস এবং রোজগারসহ স্বপ্রতিবেদিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ১২তম সপ্তাহের উচ্চতা এবং ওজন দ্বারা বিএমএই গর্ভাবস্থার প্রারম্ভে মায়েদের বিএমএই নির্ণয় করা হয়। নবজাতকদের জন্মকালীন ওজন এবং শারিরীক দৈর্ঘ্য মেডিকেল রেকর্ড হতে সংগ্রহ করা হয়। জন্মের ২ সপ্তাহের সময় নবজাতকদের কোনো ধরনের ঘুমের ঔষধ দেওয়া ছাড়া স্বাভাবিক ঘুমন্ত অবস্থায় ব্রেইনের MRI পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। স্ক্যানের ১৫-৩০ মিনিট পূর্বে তাদের খাইয়ে, উষ্ণ কাঁথায় জড়িয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। স্ক্যানের সময় তাদের অক্সিজেন সম্পৃক্তি ও হার্ট রেট পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি পালস অক্সিমিটার প্রোব তাদের পায়ের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। এসময় MRI মেশিন থেকে উদ্ভূত উচ্চস্বরের শব্দ থেকে রক্ষা করতে তাদের কানে হেডসেট পড়ানো হয়েছিল। স্ক্যানের পর প্রাপ্ত ছবিগুলো একজন নিউরোরেডিওলজিস্ট দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
প্রাপ্ত ফলাফলগুলোতে দেখা গেছে, মায়ের শারীরিক কার্যকলাপ যত বেশি, শিশুর কর্টিকাল পুরুত্ব তত বেশি! বিশেষ করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে মায়ের বেশি হাঁটা বা মাঝারি মাত্রার অ্যাকটিভিটিতে অংশ নেওয়া শিশুর মস্তিষ্কের কর্টেক্সকে করে তোলে পুরু ও বিকশিত। কর্টিকাল থিকনেস যেহেতু ভবিষ্যতের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আচরণগত দক্ষতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাই গর্ভাবস্থার নিয়মিত হাঁটা-চলা শুধু মায়ের সুস্থতার জন্যই নয়, সন্তানের মস্তিষ্ক গঠনের জন্যও এক ধরনের ‘Brain Booster’ হিসেবে কাজ করে।
তাই গবেষণার আলোকে স্পষ্টভাবে বলাই যায়, মাতৃত্বের যাত্রা শুধুই শারীরিক পরিবর্তনের নয় বরং এটি ভবিষ্যৎ এক সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল মস্তিষ্কের বীজ রোপণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। নিয়মিত শারীরিক কসরত যেমন মা'কে সুস্থ রাখে, তেমনি গর্ভস্থ শিশুর কর্টিকাল পুরুত্ব বিকাশে রাখে গভীর ইতিবাচক ছাপ। গর্ভাবস্থায় সক্রিয় ও সচল থাকা কেবল একটি স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণই নিশ্চিত করে না, বরং ভবিষ্যতের এক দক্ষ, মেধাবী ও চিন্তাশীল মানুষ গঠনের ভিত্তিপ্রস্তরও রচনা করে দেয়। তাই প্রতিটি সচেতন মায়ের প্রতিটি হাঁটা, প্রতিটি নড়াচড়াই হতে পারে তার শিশুর মস্তিস্কের উন্নতির নিঃশব্দ কারিগর; হোক তা মৃদু কিংবা মাঝারি মাত্রার কার্যকলাপ। এই গবেষণা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়; একজন সচল ও সক্রিয় মা মানেই হতে পারে একটি বিকশিত, সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল শিশুমস্তিষ্কের সম্ভাবনা।
Team Cognitores
Md Mahdin Al Abrar, Zakiya Afroj Tamnna, Fariba Nehreen Binti, Joya Dutta, Tasnimul Islam,Mohammad Nazir Tiham, Farhan Mashuk, Taznin Mehjabin, Sumita Bosu
Science Bee SohanXplore 0.9