13/08/2025
প্রিয় অনিমেষ,
কেমন আছো? ভাবছো, এতোগুলো বছর পর আমি কোথা থেকে! সেদিন তোমায় দেখলাম অনেকটা দূর থেকে, রাস্তা পার হবার সময়। গায়ে একটা হলুদ পাঞ্জাবী, হাতে বাজারের ব্যাগ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা দেখলাম একটা! বেশ সংসারি লাগছিল তোমায়!
তবু চিনতে এতোটুকু সময় লাগল না! শুধু বয়সের ছাপে একটু মুড়িয়ে গেছো। কিন্তু গালে সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোটের পাশে ছোট কালো তিল, সেই নেশা লাগানো ঘোলাটে চোখ, সবটা এক আছে! কেবল চুলে পাক ধরেছে খানিকটা!
অনি, তোমার মনে পড়ে? তুমি যখন বলতে - চুল দাড়ি না কেটে তুমি রবীন্দ্রনাথ হবে, আমি কি রেগে যেতাম সেটা শুনে?
আমি শুধু ভাবি, জীবনের এই ২২টা বছর কিভাবে চলে গেল আমাদের দুজনের থেকে!
সবতো ঠিক-ই ছিলো, হঠাত...
শেষ যেদিন তোমায় দেখলাম, সেদিন এক বর্ষার সন্ধ্যা! রাস্তাটা মরিচবাতি দিয়ে সাজানো ছিল! দুজনে মুখোমুখি দাড়িয়ে সেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, ''আর একসাথে নয়!''
কতোটা সহজে সেদিন এতোটা কঠিন হয়ে সারাজীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম আমরা?
অনিমেষ, সেই সন্ধ্যায় দুজন দুপাশে হেটে যাওয়ার সময় আমি খুব করে চাইছিলাম, তুমি আমায় একটাবার আটকাও! কিছুটা যাওয়ার পর যখন পিছু ফিরে দেখলাম- তখন নিয়ন বাতির আলোয় তুমি হেঁটে যাচ্ছো! ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছ দূরে কেমন জানি ধূসর হয়ে!
আকাশ ভেংগে খুব জোরে বৃষ্টি পড়েছিল সে রাতে! আমি আমার উত্তরের ঘরটায় বসে তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম! এভাবে রোজ আকাশ কালো করে রাত নামতো, আর আমি আমার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সারাটারাত! তারপর একদিন বুঝে নিলাম,বিধাতা আমাদের সংসারটা একসাথে লেখেননি....
অনি, আমি হাজারবার টের পেয়েছি- "দূরত্ব বাড়ানো সহজ! বিচ্ছেদ সহজ!" জটিল ছিল শুধু তোমার শূণ্যতাটা একেবারে মুছে ফেলা!
অনিমেষ,খুব চেনা রাস্তায় দীর্ঘদিন পরে হাঁটলে এক ধরনের অনুভূতি হয়! সেদিন রাস্তা পার হবার সময় যখন তোমার মুখটা দেখলাম,মুহূর্তেই আমার সমস্ত অতীত চোখের সামনে ওলটপালট হয়ে গেল! সেদিন তোমায় একটু ছুঁয়ে দেখা হয়নি! ২২টা বছর আমাদের এতোটা দূরে সরিয়ে দিল কি করে অনিমেষ??
মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে হয়, পুরাতনে ফিরে যাই! আবার গোধূলীর সময় শহরের শেষ মাথায় বসে জ্যোৎস্নার আলো মাখি!
তোমার মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আবার নেশাগ্রস্থ হই!
আচ্ছা অনি, তোমার সেই বইয়ের নেশাটা এখনো আছে? তুমি ভালোবাসতে "বুদ্ধদেব গুহ" আর আমি "সমরেশ মজুমদার"!?
সেই আঠারো কি কুড়ি বছর বয়স তখন আমার! তারপরেই একদিন বসন্তের মতো জীবনে তুমি এলে!
আমার এখন বয়স বেড়েছে অনি! মুখে কুচকোনো চামড়া,চোখের নিচে কালো দাগ, তলপেটের মেদ, মাথায় কমে যাওয়া চুল,শরীরে রোগের বাসা প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়- আমি কতোটা মুড়িয়ে গেছি বয়সের তুলনায়! সবাই আমায় সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু আমার মন বলে- আমি আর বেশিদিন নেই! অনিমেষ, মৃত্যুর দরজাটা খুব কাছ থেকে দেখছি জানো? এখন একএকটা দিন আমার কাছে কেবল স্রষ্টার উপহার!
বিধাতার খেলা দেখো অনিমেষ, চলে যাওয়ার আগেই বোধহয় তোমায় দেখিয়ে দিলেন তিনি!
অনি, আমরা এখনো এক শহরেই আছি অথচ তাও কতোটা ভীষন দূরে তাইনা? কতোটা পথ হেঁটে গেলে তোমায় ছুঁতে পাবো, তাও জানা নেই!
অনি,তুমি ভালো থেকো! যদি কোনদিন পারো, এসে একবার ছুঁয়ে দিও! হোক সেই মুহূর্তে আমার শরীরটাই আর প্রাণ নেই...! 🙂
কতোগুলো বছর তোমার মুখে "মৃন্ময়ী" ডাকটা শুনিনা অনিমেষ! সখ করে দিয়েছিলে তুমি আমায় নামটা !
অনি...আবার একটাবার ডাকবে আমায় সেই নাম ধরে? চোখ বুজার আগে কেবল একটাবার.....???
এই ব্যস্ত শহরে কোন এক ফিকে সন্ধ্যায়, তোমার সেই পুরোনো ঠিকানায় ফিরে আবার একটাবার... ??
-ইতি তোমার 'মৃন্ময়ী'!