
01/07/2025
✨ শ্রীজগন্নাথ_সুধা_লহরী_লীলা_হেরা_পঞ্চমী🥰
✨আজ শুভ হেরা পঞ্চমী বা লক্ষ্মী বিজয়োৎসব🥰
শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসবের মধ্যে হেরা পঞ্চমী একটি বিশেষ তিথি । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথ পুরীতে বিপ্রলম্ভ লীলা প্রকাশ করে শ্রী জগন্নাথদেবের সন্মুখে বিরহের যে মিলনের সুখ তা তিনি আস্বাদন করে জগতে হরিনাম সংকীর্তনের দ্বারা এক অপূর্ব শিক্ষা প্রদান করলেন ।শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং কৃষ্ণ এবং তিনি রাধারানীর অঙ্গকান্তি ও রাধারানীর ভাবে ভাবিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে উদ্দীপ্ত
আবার আরেক দিকে শ্রী জগন্নাথের প্রতি লক্ষ্মীদেবীর অভিমানের চূড়ান্ত শুদ্ধভক্তিমূলক ভাব তা স্বপার্ষদ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উপভোগ করতেন বিশেষ করে এই শ্রীজগন্নাথ পুরীর রথযাত্রার হেরা পঞ্চমী তিথিতে।
এই প্রসঙ্গে রথযাত্রার পঞ্চম দিনের
উৎসব সমাগত দেখে রাজা প্রতাপরুদ্র কাশী মিশ্রকে বললেন -- “আগামীকাল হেরা পঞ্চমী বা লক্ষ্মী বিজয় উৎসব। এমন উৎসবের আয়োজন করতে হবে, যা কেউ পূর্বে দেখেনি।”
রথযাত্রার পঞ্চম দিবসে হেরা পঞ্চমী উৎসব। ভগবান জগন্নাথদেব তাঁর পত্নী সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে (গুণ্ডিচা মন্দিরে) গিয়েছেন। তাই শ্রী জগন্নাথ- বিরহকাতরায় লক্ষ্মীদেবী জগন্নাথ দর্শনে গুণ্ডিচা মন্দিরে আসেন। লক্ষ্মীদেবীর এই আগমণই হেরা পঞ্চমী উৎসবরূপে উদযাপিত হয়।
রাজা প্রতাপরুদ্র বললেন, “এমন উৎসবের আয়োজন করতে হবে যেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রসন্ন হন। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা ও বিগ্রহের সংগ্রহশালা থেকে যত লাগে বিচিত্র রংয়ের কাপড়, ছত্র, ঘণ্টা ও চামর নিয়ে যাও। ছোট-বড় বিভিন্ন পতাকা সংগ্রহ কর। বিচিত্র সজ্জায় রথটিকে সজ্জিত কর। বিভিন্ন বাদক ও নৃত্য গোষ্ঠীকে নিমন্ত্রণ জানাও। প্রসাদের পরিমাণও দ্বিগুণ করতে হবে, যেন তা রথযাত্রা মহোৎসবকেও ছাড়িয়ে যায়। আর এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন মহাপ্রভু ও তাঁর পার্ষদগণ কোনো বাধা ছাড়াই বিগ্রহ দর্শনে যেতে পারে। আসলে প্রতাপরুদ্র মহারাজ চৈতন্য মহাপ্রভুকে অবাক করতে চেয়েছিলেন।
প্রাতে মহাপ্রভু সপার্ষদ শ্রীজগন্নাথ দর্শনে সুন্দরাচলে গেলেন। গুণ্ডিচা মন্দির হচ্ছে সুন্দরাচল (বৃন্দাবন) আর জগন্নাথপুরী হচ্ছে নীলাচল (দ্বারকা)। তাই জগন্নাথ দেবের নীলাচল থেকে সুন্দরাচল যাত্রা, তাঁকে দ্বারকা থেকে বৃন্দাবনে নিয়ে যাবার মতো। তারপর চৈতন্য মহাপ্রভু এবং তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তেরা প্রবল আগ্রহের সাথে হেরা পঞ্চমী দর্শনে নীলাচলে এলেন। কাশী মিশ্র মহাপ্রভুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে বরণ করে ভক্তগণসহ একটি সুন্দর আসনে বসালেন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তখন এই বিশেষ রসকথা আস্বাদন করতে চাইলেন। মৃদু-স্মিতহাস্য বদনে স্বরূপ দামোদর প্রভু বললেন, “যদিও জগন্নাথদেব দ্বারকাতে তাঁর লীলা বিস্তার করেছেন, তবুও সেখানে (সুন্দরাচলে) আরও গুঢ় রহস্য প্রকাশ করেছেন। তাই বছরে একবার হলেও তিনি সেখানে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যান। পার্শ্বস্থ উপবনের দিকে দেখিয়ে মহাপ্রভু বললেন, “এ স্থান হচ্ছে বৃন্দাবনের প্রতিভূ। আর জগন্নাথদেব তাদের পুনরায় দেখতে চান।”
বাহ্যে যদিও তিনি রথযাত্রার অজুহাতে সেখানে যান, বাস্তবে তিনি জগন্নাথপুরী ত্যাগ করে সুন্দরাচলে (বৃন্দাবনের প্রতিভূ) গুণ্ডিচা মন্দিরে থাকতে চান। ভগবান সেখানে পুষ্পাদি পূর্ণ কাননে দিবারাত্র বিহার করেন, কিন্তু লক্ষ্মীদেবীকে কেন সেখানে নিয়ে যাননি?"
স্বরূপদামোদর বললেন, “প্রভু, এর কারণ শ্রবণ করুন। সৌভাগ্যদেবী লক্ষ্মী বৃন্দাবনের লীলার যোগ্য নন। বৃন্দাবন লীলায় একমাত্র গোপীদেরই অধিকার । গোপীগণ ব্যতীত কেউ কৃষ্ণের মন আকর্ষণ করতে পারে না।”
মহাপ্রভু বললেন, “রথযাত্রার ছলে কৃষ্ণ বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর সাথে সেখানে যান। কিন্তু অরণ্যানীতে গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের বিবিধ বিহার কেউ জ্ঞাত নন। তবে লক্ষ্মীদেবী কেন ক্রোধান্বিতা হবেন?” এভাবে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কৃষ্ণলীলার বিচিত্র রস আস্বাদন করতেন। তিনি গভীর থেকে গভীরতর পর্যায়ে পৌঁছে, স্বরূপ দামোদরের নিকট প্রশ্ন করে তত্ত্ব নির্ধারণ করতেন।
বাহ্যে অন্যরকম দেখালেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি জানতে চাইতেন কৃষ্ণ কেমন বোধ করছেন, কী উপভোগ করছেন, কোন রস আস্বাদন করছেন? বিশেষভাবে তিনিই এসকল দুর্বোধ্য প্রশ্নের দ্বারা রহস্যতত্ত্ব উন্মোচিত করেছিলেন। স্বরূপ দামোদর প্রত্যুত্তরে বলেন, “নায়িকা স্বভাবতই প্রিয়ের সামান্যতম উদাসীনতায় ক্রুদ্ধ হয়ে যান।”
স্বরূপ দামোদর ও মহাপ্রভুর কথোপকথনের মাঝখানেই লক্ষ্মীদেবীর শোভাযাত্রা চলে এল। তিনি বিচিত্র রত্নমণ্ডিত স্বর্ণদোলায় আরোহিতা। সেই দোলার চারপাশে অসংখ্য লোক চামর, পতাকা ও ছত্র ধারণ করে, গায়ক ও নর্তক দলের অনুগমন করেছিল। মেয়েরা বিভিন্ন রত্নাভরণে সুসজ্জিতা হয়ে জলের কলস, চামর, পানের বাটা বহন করছিল। অত্যন্ত ক্রুদ্ধা লক্ষ্মীদেবী জগন্নাথদেবের প্রধান সেবকদের বন্দি করতে লাগলেন। অনুচরীগণও জগন্নাথদেবের সেবকদের চোরের মতো হাতকড়া পরিয়ে লক্ষ্মীদেবীর পদতলে নিক্ষেপ করতে লাগলেন।
রথযাত্রার পূর্বে জগন্নাথদেব, পরদিনই চলে আসার কথা বলে লক্ষ্মীদেবীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জগন্নাথের আগমনের বিলম্ব সহ্য করতে না পেরে তিনি রেগে যান। তাঁর স্বামী তাঁকে অবহেলা করেছেন, তাই তিনি অনুচরীসহ সুসজ্জিতা হয়ে মন্দির থেকে বের হয়ে প্রধান ফটকে আসেন। অনুচরীগণ জগন্নাথদেবের প্রধান প্রধান সেবকদের বন্দি করে লক্ষ্মীদেবীর কাছে নিয়ে আসেন। লক্ষ্মীদেবী অগ্নিমূর্তি হয়ে বলেন, “বদমাশের দল আমার স্বামীকে কোথায় রেখেছ?”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদেরা অনুচরীগণের গর্ব দেখে মুখ লুকিয়ে হাসেন। স্বরূপ দামোদর বললেন, “ত্রিভুবনে এমন অহংকারের কথা আমি কখনো দেখিনি বা শুনিনি। আমরা মাঝে মাঝে কূলবধূকে দেখি যে, প্রিয়ের সামান্যতম অবহেলায় সে হতাশ হয়ে যায়। সে তখন নিজের রূপসজ্জার প্রতি উদাসীন হয়ে যায়, মলিন বসন পরিধান করে বিষণ্ণচিত্তে ভূমিতে বিভিন্ন আঁচড় কাটতে থাকে। আমরা এসব অহংকারের কথা সত্যভামা দেবীর ক্ষেত্রে বা বৃন্দাবনের গোপীদের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। কিন্তু জগন্নাথপুরীতে লক্ষ্মীদেবীর অহংকার সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি স্বামীর উপর ক্রোধান্বিতা হয়ে ঐশ্বর্য গর্বে মত্ত হয়ে তাঁকে আক্রমণ করেন।”
এভাবেই ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও স্বরূপ দামোদর বৃন্দাবনের গোপীদের কৃষ্ণভক্তি রসকথা স্মরণ করছিলেন। কীভাবে তাঁরা ক্রুদ্ধ হতেন, কখন তাঁরা ঈর্ষান্বিত হতেন, কী রকম রোষপূর্ণ ব্যবহার করতেন প্রভৃতি অপার্থিব কথা। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রীতির জন্যে রাজা স্বয়ং এই নাটকের আয়োজন করেছিলেন। লক্ষ্মীদেবী তখন সেবিকাদের নিয়ে বেরিয়ে এসে জগন্নাথদেবের প্রধান পাণ্ডাদের আটক করে তাদের ভর্ৎসনা করেন। এসব লীলা জাগতিক মনে হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্মীদেবী এবং বৃন্দাবনের গোপীদের এই অপ্রাকৃতভাব, প্রকৃত পক্ষে কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসারই উদগীরণ।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনেক সখী রয়েছে। কেউ কেউ অনেক ধীরা, তাঁরা ঈর্ষা বা অহংকার বোঝেন না, শুধু কৃষ্ণবিরহে বিষণ্ণবোধ করেন। কৃষ্ণ ফিরে এসে যদি তাঁদের কিছু মধুর বাক্য বলেন, তাতেই তারা শান্তি পান। অনেক নায়িকা আছেন ধীরাধীরা। তাঁরা ঈর্ষা ও ক্রোধের বৈদগ্ধ্য লীলাবৈচিত্র্য সম্পর্কে খুব বেশি পারঙ্গম নন। এ ধরনের নায়িকারা শুধু মুখাচ্ছাদন করে সে স্থান হতে প্রস্থান করেন। কিন্তু অধীরা নায়িকারা খুবই রোষান্বিত ও হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন, কিংবা অস্থির হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। এদের আবার তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- প্রগলভা, মুগ্ধা ও মধ্যা। তাঁরা প্রত্যেকেই কৃষ্ণপ্রেমে দিব্যোন্মাদগ্রস্তা।"
মাঝে মাঝে রাধারাণী খুবই ক্রোধান্বিতা হন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে তা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। সাত প্রকারের ভাব রয়েছে, তাদের প্রত্যেকটি আবার তিনটি করে বিভাগ রয়েছে। প্রতিটি বিভাগের আবার তিনটি উপবিভাগ রয়েছে। এসব হচ্ছে দিব্যভাবের পূর্ণ বিজ্ঞান। শ্রীল প্রভুপাদ বলতেন, চৈতন্যচরিতামৃত হচ্ছে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক কারণ এতে এসব কিছুর বর্ণনা রয়েছে।”
স্বরূপ দামোদর প্রতিটি দিব্যভাবের নির্দিষ্ট নাম ও এর বিভাগগুলো জানতেন। তাই তাঁরা পরস্পর কৃষ্ণের সাথে গোপীদের, মহিষীদের ও অন্যদের বিভিন্ন ভাব বিষয়ে আলোচনা করতেন। এ আলোচনায় কৃষ্ণপ্রেম উদ্দীপ্ত হতো।
হেরা পঞ্চমী লক্ষ্মীর অভিমানের চূড়ান্ত প্রকাশ। শুদ্ধভক্তিমূলক সেবায় সবকিছুই সম্ভব। এভাবেই সপার্ষদ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু লক্ষ্মীর ভাবপূর্ণ আচরণ উপভোগ করতেন।
জয় জগন্নাথ! হরে কৃষ্ণ!🙏🙌🙏
"এত বলি' লক্ষ্মীর সব দাসীগণে।
কটি-বস্ত্রে বান্ধি আনে প্রভুর নিজ গণে।।২০৯।।
লক্ষ্মীর চরণে আনি' করায় প্রণতি।
ধন-দণ্ড লয়,আর করায় মিনতি।।২১০।।
রথের উপরে করে দণ্ডের তাড়ন।
চোরপ্রায় করে জগন্নাথের সেবকগণ।।২০১১
সব ভৃত্যগণ কহে,- জোড় করি' হাত।
'কালি আনি দিব তোমার আগে জগন্নাথ।।'২১২।।
তবে শান্ত হঞা লক্ষ্মী যায় নিজ ঘর।
আমার লক্ষ্মীর সম্পদ- বাক্য অগোচর।।২১৩।।"
(শ্রীবাস ঠাকুরের বর্ণনায়,চৈতন্য চরিতামৃত, মধ্য লীলা,অধ্যায় ১৪)